শাহ আব্দুল করিমের লেখায় ব্যাপক জায়গা জুড়ে আছে সাম্যবাদ৷ শাহ আব্দুল করিমের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন এবং রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা এর বড় কারণ। গণমানুষের অধিকারের ব্যাপারে তিনি বরাবরই সচেতন ছিলেন। শাহ আব্দুল করিম সম্পর্কে আলোচনার একটা বিশেষ সুবিধা হলো ‘করিমের পদই পদের ব্যাখ্যা’। অর্থাৎ শাহ আব্দুল করিমের পদ মনোযোগ দিয়ে দেখলে বাড়তি কোনো ব্যাখ্যা পড়তে হয় না। অত্যন্ত সরলভাষায় পদ রচনা করতেন তিনি। তাই তাঁর পুঁজিতন্ত্র বিরোধী পদ মানুষকে জাগ্রত করেছে ও উৎসাহিত করেছে লড়াইয়ে। শ্রেণীসংগ্রাম থেকে বিপ্লব কী নেই তাঁর পদে। এত সূক্ষ্মদৃষ্টি হয়তো অনেক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক কিংবা নেতাদেরও ছিল না। ... ...
বাঙালির দ্বিতীয় প্রজন্ম ক্রমশ বাংলাটা ভুলে যাচ্ছে। শুধু বিদেশে বা ভিন রাজ্যেই না, খোদ কলকাতা শহরেও। কিন্তু এসব নিয়ে বলতে গেলে বাঙালি নিজেই হাঁ হাঁ করে উঠবে। তারা সর্বভারতীয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক হচ্ছে। আরও কী-কী হচ্ছে, ঈশ্বরই জানেন। সেখানে এসব ছোটো মনের পরিচয় দেওয়াটা ঠিক না। যদিও, যুক্তি দিয়ে জিনিসটা বোঝা দুষ্কর। বাঙালি যদি দিল্লি কিংবা নিউ-ইয়র্কে গিয়ে হিন্দি কিংবা ইংরিজি ভাষী হয়ে ওঠে, সেটাই যদি দস্তুর হয়, তবে বাংলায় এসে অন্যভাষীদের বঙ্গভাষী হয়ে ওঠারই কথা। আবার অন্যভাষীরা বাংলায় এসে যদি নিজের ভাষা বজায় রাখে, বা রাখতে পারে, অন্যত্র বাঙালিদেরও তেমনই হবার কথা। এর কোনোটাই হয়না। ভারতীয় বাঙালির কাছে এর কোনো ব্যাখ্যাও নেই। সম্ভবত অস্বস্তিকর বলেই। আর সেই জন্য প্রশ্নটা তোলাই ট্যাবু। তুললে কঠিন-কঠিন ইংরিজি গালি বর্ষিত হতে পারে। ... ...
যেহেতু অস্তিত্ব নিছক একক নয়, সামূহিক – ‘কে আমি’ থেকে পৌঁছে যাই ‘কে আমরা’: এই জিজ্ঞাসায়। পারিবারিক পরিচয়েও নিহিত রয়েছে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরম্পরা, রয়েছে বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের আলো-ছায়া, রয়েছে চিৎপ্রকর্ষ অর্জনের দীর্ঘ ইতিহাস। এতে কত অজস্র উচ্চাবচতা, কত নতুন সূচনাবিন্দু। এসব ভাবতে গিয়ে দেখি, জাতিসত্তার বিচিত্র হয়ে ওঠায় ‘আমি’ ও ‘আমরা’-র অভিজ্ঞান অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। ভাষাই জাতির পরিচায়ক, ধর্ম কখনই নয়। ... ...
রোমহর্ষক আর নয়নাভিরাম-এর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। বাংলার ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের ঘটনাগুলি রোমহর্ষক, কিন্তু নয়নাভিরাম হয়ে থেকেছে সম্প্রীতির ছবিগুলি। পুকুরপাড়ে বসে নারকেল গাছের পাতার জলে বিলি দেখা নয়নাভিরাম, কিন্তু তা নিয়ে জনশ্রুতি রটে না, পুকুরে বিষ ঢেলে যখন মরা মাছ ভেসে ওঠে তা প্রজন্মান্তরের গল্প হয়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির টুকরো টুকরো ছবি এই সমাজে বহমান থেকেছে, সমাজচিত্রে সহজাত সৌন্দর্য এনেছে। আর কয়েক দশকে একবার দাঙ্গা-ফ্যাসাদের গল্প ইতিহাস বইয়ে এসেছে। কিন্তু, মানুষ পুকুরে বিষ দিতে ফিরে যায় না বরং ডাঙায় বসে পানকৌড়ি দেখে। তাই, দাঙ্গা হাঙ্গামার ইতিকথা সরিয়ে তার চিরন্তন জীবনে সে সম্প্রীতির কথাই বলেছে। দাঙ্গা-দেশভাগের পরেও তাই এই দেশের মানুষের যৌথচিন্তায় বিভেদ মাথা তুলতে পারে নি। ... ...
সইদুল তার ঘোড়াদের নিয়ে চলে যেতে যেতে একবার তাকাল ধ্রুবর দিকে। তারপর বলল, ‘আল্লার বল আর ভগমানেরই বল, দুনিয়া তো একটাই। কত জমি কেড়ে নেবে আমাদের কাছ থে? জমি থাকবে, মাঠও থাকবে। দৌড়ও থাকবে। দৌড় চললি তোর সাথে আমার মেলামেশাও চলবে। আমরা নড়বড়ে না হলিই হল।’ ঘোড়াগুলো যে পথে দৌড়ে আসবে তার দু’ধারে এখন ঘেঁষাঘেষি লোক। দূরে কলাগাছের সারির গায়ে গায়ে মানুষও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরপাড়ের উঁচু জমিতে জায়গা করে নিয়েছে অনেকে। যারা পেরেছে তারা চড়ে বসেছে আশপাশের গাছের মাথায়। দু-একটা পাকা বাড়ির ছাদেও উঠেছে। কাগজের ভেঁপু পোঁ পোঁ করে বাজছে নাগাড়ে। উত্তর দিকে, মাঠের শেষমাথায় দুটো বাঁশ দূরে দূরে খাড়া করে রাখা। তাদের মাঝখানের দড়িতে খিরীশ গাছের ছোট ছোট ভাঙা ডাল ঝোলানো পরপর। ওখানে পৌঁছতে পারলেই দৌড় শেষ। ধ্রুব সেই জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ভিড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বউ, ছেলে-মেয়ে মাঠের উল্টোদিকে। দক্ষিণ দিক থেকে হইহই উঠল। দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই আওয়াজের ঢেউ ভেসে আসছে এদিকেও। ওই দেখা যাচ্ছে ঘোড়াদের। কেশর উড়ছে হাওয়ায়। খুরের দাপটে উড়ছে সাদা ধুলো আর কালো ছাই। ছিটকে যাচ্ছে ঘাস-পাতা-খড়ের কুচি। ধ্রুবর সামনে দিয়ে চলে গেল কয়েকটা ঘোড়া। তাদের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে যেন। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। ধ্রুব দেখতে পেল সইদুলের মাদি ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে আসছে। তার থেকে অনেক দূরে বাচ্চাটা। এই যাঃ, পাগলি তো দাঁড়িয়ে পড়ল। আরে, সে তো উল্টোবাগে চলেছে। হলটা কী? ... ...
মাননীয় মহোদয়, আমাদিগের দেশ নাই। দেশ নাই তাই কিছুই নাই। হাসপাতাল, ইস্কুল, ব্লক আপিস, পঞ্চায়েত, থানা, চৌকি, রেশন কার্ড, ইলেকট্রিক, জল কিছুই নাই। মোবাইলের সিমও নাই। ফলে গ্রাম হইতে বাহিরে ইন্ডিয়া গেলে ভয় হয় কখন অনুপ্রবেশের দায়ে ধরা পড়ি। অথচ আমরা তো ইন্ডিয়াই হইতাম, ভাগ্যের ফেরে হই নাই। অকাল বৃষ্টি আমাদিগে এই করিয়াছে। ইন্ডিয়ার ইস্কুল কলেজে পড়ার কোনো উপায় নাই মিথ্যা পরিচয় গ্রহণ করা ব্যতীত। ছিটমহলের কন্যার জন্য ইন্ডিয়া বা বাংলাদেশ, কোথাও পাত্র পাইবার উপায় নাই। ছিটমহলের পাত্রকে কেহ কন্যাদান করিতে চাহে না। যাহার কোনো দেশ নাই, তাহার চালও নাই, চুলাও নাই, তাহাদের মাথার আকাশ ফুটা হইয়াই আছে, ফলে গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্র, বর্ষায় প্রবল ধারাপাত হইয়াই থাকে। জানি দেশ পাইলে ইহা আর থাকিবে না। অনাথের নাথ হইবে। আমাদিগের পাশের গ্রাম মদনাগুড়ির সব রহিয়াছে। সেই যুদ্ধের সময় মদনাগুড়ির আকাশ ভেঙে অকাল বৃষ্টি হয় নাই। তাই ফসলও মরে নাই। এখন মদনাগুড়ি যাইতে বাতৃগাছ পার হইতে হইবে। বাতৃগাছ বাংলাদেশ, মদনাগুড়ি ইন্ডিয়া। তাহার পাশে সিঙিমারি নদী ইন্ডিয়া। নদী লইয়া বাজি ধরেন নাই প্রভুগণ। কেন না নদীর ভিতরে প্রজা নাই। খাজনা দিবে কোনজন? মানুষ সমেত গ্রাম হস্তান্তরে সুখ অনেক। ... ...
আমরা যে রকম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঠা বের করি, গাছটি নড়েও না, চড়েও না, এই অচেনা বৃদ্ধও সে রকম প্রাণ থেকেও জড়ের মতো পড়ে থাকে। গাছের মতো একটি বারও নিজে থেকে প্রাণের প্রমাণ দিতে যায় না। এক দল হতাশ হয়, অন্য দল নতুন উদ্যম নিয়ে শুরু করে। একটা পরিপূর্ণ শব্দ ওর মুখ থেকে যে বের করতে পারবে, সে যেন গ্রামে বীরের মর্যাদা পাবে! আমরা যখন একঘেয়ে দৃশ্যে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম, তখনই আমাদের মধ্য থেকে বোমাটা ফাটাল কেউ। স্পাই! দেখোগে ভারতের স্পাই। বোবা-পাগলের ছদ্মবেশে তথ্য নি’ পালাচ্ছি। কেউ একজন বলল ভিড়ের ভেতর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতা চাঙা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মুহূর্তে সকলে যেন নিশ্চিত হয়ে গেল, লোকটি স্পাই ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। গ্রামের পশ্চিমে খাড়া মাইল ছয়েক হাঁটলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। আমাদের গোপন কোনো তথ্য নিয়ে সীমান্ত দিয়ে পালাচ্ছে বলে আমরা ধরে নিলাম। স্পাইদের নিয়ে গ্রামে অনেক গল্পের প্রচলন ছিল। একটা গল্পের কথা তখনই মনে পড়ল। এরা এমন কৌশলী ও নিবেদিত দেশপ্রেমিক হয় যে, কোনো দেশে স্পাইগিরি করতে গিয়ে বিয়ে-সংসার পর্যন্ত করে। তারপর মিশন শেষ হলে বিনা বাক্যে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যায়। এমনভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে তাদের এই ছদ্মবেশ ধরাও যায় না। আমাদের ভেতর থেকে কেউ কেউ এরই মধ্যে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। প্রথমেই একজন কঞ্চির মাথায় চুলগুলো পেঁচিয়ে টান মারল জোরে। নকল চুল হলে উঠে আসত। কিন্তু মাত্র কয়েকটা চুল ছিঁড়ে এল। বৃদ্ধের গায়ের রং আসল কি না, মুখে মেকআপ দেওয়া কি না, পরীক্ষা করার জন্য হাবু ভাই পেছনের গর্ত থেকে এক বালতি ঘোলা পানি তুলে ওর মাথায় ঢেলে দিল। গায়ের রং যেমন ছিল, তেমনই থাকল। মাঝখান থেকে সকলের সন্দেহটা থেকে গেল। ... ...
অগত্যা জামা টেনে পকেটে মানিব্যাগ ঠেসে বেরিয়ে পড়লুম। ফিরে মিষ্টির প্যাকেট রান্নাঘরে জমা করে বসলুম বারান্দায়। গল্প খুব জমে উঠেছে... ... আমরাও ঠিক করে ফেললাম, একজন হিন্দু মরলে দশজন মুসলমান মারব। আমাদের ভেতর তখন আগুন জ্বলছে। জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশন, লীগ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দির মুসলমান যুবসমাজকে সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান, এক-একটা হিন্দুর দোকান লুট হচ্ছে– জওহরলাল পান্নালাল, কমলালয় স্টোর্স, কে.সি বিশ্বাসের মতো বড় দোকান। মুসলমান দোকান ওরা চিহ্ন দিয়ে রেখেছিল, লুটের হাত থেকে বাঁচাতে। এমন কি হাঙ্গামা হতে পারে ধরে নিয়ে মুসলমানদের জন্য এ্যাম্বুলেন্স মজুত রেখেছিল। লীগ প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে করে লীগের লোকদের জন্য ছোরাছুরি, পেট্রল, কেরোসিনও নিয়ে যাওয়া হয়। আমি সামুর ছেলের দিকে তাকাই। চোখ দুটো বড়। যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁকা, শুকনো খট খট করছে। বুঝতে পারি মুখ দিয়েই এখন বাতাস চলছে ওর। নিচু স্বরে বলি, বাবা। কিন্তু ওরা বোঝেনি আমরাও ভেতরে ভেতরে তৈরি ছিলাম। ন্যাকড়ার বল বানিয়ে কেরোসিনে চোবানো হল। বোমা বাঁধা হল। এমনকি টেরিটরিয়াল আর্মিতে কাজ করে এরকম কিছু লোক বন্দুকের যোগান দিল। বোমা-লাঠি-বন্দুক নিয়ে গঠিত হল প্রতিরোধ বাহিনী। এরপর বাবা কী বলবে আমি জানি। বাবা আজ সংক্ষেপে বলছে, তবু আমি জানি বাবা কী বলবে। ছেলেটি কঠিন চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের ভেতর ছটফট করছে হাওয়া। বাবাকে থামাতেই হবে। গলা তুলে ডাকার চেষ্টা করি, বাবা, বাবা ও... । ... ...
থকথক করে কেঁদে ফেলে ছেলেটি , আমি মোছলমান বলি মা আমারে বাঁচায় নাই স্যার— যাতি আসতি কতবার ভালো ভালো কলা দিছি দুগগা মার পায়ের তলায়—বলাইকাকার সাথি কতবার ডাকিছি মা, ওমা জগজ্জননী আমারে একটু বুদ্ধি দাও মা -- প্রাণ খুলে শ্বাস নেন নূরতাজ মন্ডল। যাক বলাই সাহা্রা তাহলে মিথ্যে বলেনি কাল মাঝরাতে। ছেলেটা সত্যি নিরীহ। বলাই সাহার বউ কি যেন বলেছিল, গোপাল। তা গোপালই বটে ! একটু বেশি ভালো মানুষ। সমাজের লোকেরা যাদের বোকা বলে তেমন সোজা সরল মানুষ। কৃস্টালের পেপার ওয়েটটা টেবিলের কাঁচের উপর ঘুরাতে ঘুরাতে নূরতাজ মন্ডল উপলব্ধি করেন, এই ছেলেটার ভালোমানুষি মনে এবার পাপ ঢুকে পড়বে। জেল বাস হয়ত তিনি রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু ছেলেটা এবার সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবে। ওর মনে মানুষকে সহজে বিশ্বাস করার সরলতা মুছে গিয়ে অন্যদের মত জেঁকে বসবে আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবানকে ভাগ করে নেবার শিক্ষা। জন্ম নিবে ঘৃণা । মানুষকে ধর্ম দিয়ে ভাগ করতে শিখে যাবে ছেলেটা। এক হাতের চেটো দিয়ে অন্য হাত মুছে নিয়ে তিনি মনে মনে হাসেন, এই তো এই জগতের বাস্তব শিক্ষা। ছেলেটার বুদ্ধির কমতি ছিল। এবার তা পূর্ণ হলো ... ...
ছেলে বলেছিল আজ মায়ের হাতের রান্না খাবে।তাতেই নয়নতারার মাথাটা ধরেছিল। পার্টিশন! যত দোষ পার্টিশনের। না হলে এক গামলা ভাত রান্ধনের জন্য নয়নতারাকে ছেলে বৌ খোঁচা দিতে পারে? তাও যদি আরেকটা ছেলেপুলে হত। একটা মেয়ে নিয়ে দ্যাবাদেবী সারাক্ষণ আদিখ্যেতা করছে! মাণিকগণ্জের বাড়িতে নয়নতারা নিজের সাতটা ব্যাটা বেটির সঙ্গে কতগুলো ভাগ্নে ভাগ্নীও মানুষ করে ফেলেছেন। তবে ভাত রাঁধতে হত না। অতগুলো মানুষের ভাতের হাঁড়ি কি তেরো বছরের নতুন বউ সামলাতে পারে না মাড় গালতে পারে? বড় জা আর শাশুড়ি প্রায় সমবয়সী। তাঁরাই বলেছিলেন , এ বাড়িতে বউরা ভাতের মাড় গালে না। অত বড় হাঁড়ির ওজন বউ মানুষের নেওয়া নিষিদ্ধ। মাড় গালে মইনা নাগী। মণিভূষণ নিয়োগী।বাপ মা মরা ছেলে। ভাতের মাড় গালা থেকে শুরু করে তরতর করে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পাড়া, সব পারে।এমনকী ইজারা নেওয়া পদ্মার বুকে জাল ফেলে যে কটি ইলিশ ওঠে, সবকটি ঘরে এনে তুলতে পারে মইনা নাগি। ... ...
আমি ওর কিউরোসিটি আরও বাড়িয়ে দিয়ে সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ বইটি খুলে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ চ্যাপ্টারটি পড়তে শরু করে দিলাম। দাদাজীর মৃত্যুর পর তার দেরাজ থেকে তরবারি হাতে জিন্নাহের একটি ছবি পাওয়া গেছিল। ছবিটি একটি প্রচারপত্র। তাতে কী লেখা ছিল তা ঠিক পড়া যাচ্ছিল না। তবে শিলা সেনের ‘মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল’ বইটিকে সূত্র হিসাবে ধরে নিলে এই প্রচারপত্রের ভাষা ছিল এই রকমঃ আশা ছেড়ো না। তলোয়ার তুলে নাও। ওহে কাফের, তোমার ধ্বংসের দিন বেশি দূরে নয়। আমার ভাবতে বেশ অসুবিধা হয় আমার পূর্বপুরুষ কোনও একসময় এই স্লোগানটির সঙ্গে একাত্মবোধ করেছিল। কিংবা এমনও তো হতে পারে, সময়ের উত্তেজনা তাঁকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে তিনি তাঁর স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলেন! ‘সময়ের উত্তেজনা’ শব্দবন্ধটির প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া জরুরি। এই শব্দবন্ধটি অনেকটা মদের মতো। এই শব্দবন্ধটি এমন এক পরিসর সৃষ্টি করে যেখানে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রকে অনায়াসেই ঊহ্য রাখা সম্ভব। ‘সময়ের উত্তেজনা’ একটি নেশা, যেখানে এই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলির আচরণকে আমরা তাদের নিজেদের দ্বারা সজ্ঞানে নির্বাচিত আচরণ হিসাবে ভাবতে চাই না। যেন কোনও মাতাল সুনসান রাতে গাল দিতে দিতে ঘরে ফিরছে। ‘সময়ের উত্তেজনা’ লঘু হয়ে এলে, তাই, একটি নিরাপদ আস্তানার সন্ধান আমরা পেয়ে যাব, এটুকু আশা করে থাকি। কিন্তু দাদাজী কি শেষপর্যন্ত কোনও নিরাপদ আস্তানার সন্ধান পেয়েছিলেন? কেনই বা তিনি জিন্নাহের ছবিটি কুটি কুটি করে কেটে ছিঁড়ে ফেলে দেননি? ... ...
জামাই আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে বলে ‘যাক এলাকা থেকে প্রায় সবকটাকে ভাগানো গেছে। শয়তানের ছাওয়ালগুলো, পুড়িয়ে মারতে পারলে শান্তি হত!‘ প্রমদা ঠিক না খেয়াল করেই বলেন ‘হ্যাঁ যত গুন্ডা সব জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়।‘ জামাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ‘না না আপনি জানেন না বাবা এই শেখের ব্যাটারা শয়তানের ছাওয়াল সব, আমাদের কটা ছিঁচকে চোরের সাধ্য কি ওদের মত হিংস্র জানোয়ার হয়? দ্যাখেননি ওদের দেশে ওরা কী করছে? যাক দূর হয়ে যাক ওরা নিজেদের জায়গায়।‘ প্রমদা থতিয়ে যান – জামাইরা তো আজ পঁচিশ ত্রিশ বচ্ছর হাওড়াতেই থিতু, তাঁর জানা মতে ওদের তো কিছু ক্ষতি হয় নি! ... ...
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ লড়ছে এমন কিছু মুক্তিসেনা লুকিয়ে আছে ঐ ক্যাম্পগুলোতে। অস্ত্র চালান করা, আন্তর্জাতিক রেডিও স্টেশন অপারেট করা, সবেতে আছে ছেলেগুলো। শিতলখুচি বর্ডার দিয়ে ওরা পারাপার করে। আজ যাদের দেখছো, কাল গেলে দেখবে তাদের মুখগুলো পালটে গেছে। সে যাক, ওদের দেশের স্বাধীনতার লড়াই ওরা কেমনভাবে লড়বে ওরা বুঝবে। কিন্তু খুকি... - খুকি কী ? খুকি কেমন কইরা আসলো এইসবের মধ্যে ? মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে। - শোনো, তোমার খুকি না হাতে এতোদিন হাতকড়া পরতো, যদি ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে পুলিশ অন্যদিকে তাকিয়ে না থাকতো। রিলিফ দেবার নাম করে চরে যায়, ছেলেগুলোর সঙ্গে মেলামেশা করে। একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে নাকি সম্পর্কও হয়েছে। সারা টাউনে ঢি ঢি পড়ে গেছে তো। আর তার সঙ্গে তুমি মেয়েকে পাঠিয়ে দিলে! ... ...
আই সি সি ওয়ার্ল্ড কাপের পুল বির খেলা পড়ল ইন্ডিয়া ভার্সাস পাকিস্তান। ঠিক হ'ল, শহরে একটা পাবে জায়ান্ট স্ক্রীনে খেলা দেখবে যাবে রাজীব, ওর বন্ধু সন্তোষ আর পারভেজ। ডে নাইট ম্যাচ, ওদের ফিরতে দেরিই হবে। দুপুর হতেই দুই সখী ফিরোজ আর বকর কে নিয়ে নাসরীনের বাড়িতে টিভির সামনে বসেছে। ভারত ব্যাট করছিল প্রথমে। দুরন্ত খেলছিল ধবন, বিরাট আর রায়্না। বল উড়ে পড়ছিল বাউন্ডারির বাইরে। বাচ্চারা হাত তালি দিচ্ছিল-ওরা কোহলির ফ্যান। নাসরীন চুপচাপ-শান্ত, স্থিত উচ্ছ্বাসহীন। মায়া অস্বস্তিতে ভুগছিল-ভাবছিল, ইন্ডিয়া এত ভালো না খেললেই পারত আজ। ভাবছিল, বিরাট আউট হয়ে যাক, ইন্ডিয়া হারুক। বস্তুতঃ উল্টোটাই ঘটছিল। পাকিস্তান ৩০০ রান চেজ করছিল। শুরুটা ভালই ছিল। কিন্তু ১০২ থেকে ১০৩ রানের মধ্যে তিনটে উইকেট পড়ে আর তারপর শহীদ আফ্রিদির ক্যাচ বিরাট ধরে নিতেই মায়ার মুখ শুকিয়ে আসে। গলা খাঁকরে বলে, এবারে খেয়ে নিলে হত না? নাসরীন বলল, 'দোন্ট ওয়রি, দে আর এনজয়িং দ্য গেম।' বস্তুতঃ বকর আর ফিরোজের মধ্যে কোনৈ হেলদোল দেখছিল না মায়া। চার ছয় বা কেউ আউট হলেই ওরা সোফায় উঠে নাচছিল। খেলা শেষ হতে মায়া বাড়ি ফিরে এলো। ইন্ডিয়ার জয়ে ও কষ্ট পাচ্ছিল আর এই অনুভূতিটা আরও বড় কষ্টের জন্ম দিছিল ওর মনে। নাসরীনকে বলেছিল-' মাথা ধরে গেছে, আজ আর খাবো না' ... ...
তখন আমাদের ছোট শহর যেন নতুন সভ্যতার আলো দেখা আফ্রিকার কোনো গহীন জনপদ। পাহাড় থেকে নেমে আসা দাঁতাল হাতি শহরের রাস্তায় নেমে হুটোপাটি করে, নাম তার গনেশ। আদিবাসী দেবতার পূজার রাত্রে শহরের রাস্তায় কেউ বেরোলে প্রাণদন্ড হয়। রাজার রাজত্ব গেলেও তাঁকে সবাই মহারাজ বলে, তাঁর স্ত্রীকে মহারাণী। সে যাই হোক, আসল গল্পটা এটা নয়। এরও অনেকটা আগের ঘটনা। আমার বাবা তখন বালক। বাবার ছোটবেলা কেটেছে চা বাগান এলাকায়। দিনদুপুরে বাঘ বেরোয়। সপ্তাহে একবার স্থানীয় ডাক হরকরা ছাতুয়া বুড়ো আসে চিঠি নিয়ে। মোড়ের মাথায় তার তালপাতার তৈরি ছাতাখানা দেখতে পেলে 'চিঠি চিঠি' করে দৌড়ে যাওয়া তখন বাবাদের একমাত্র বিনোদন। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশপাশ হবে। আমার ঠাকুর্দা কলকাতায় চাকরি করতে গেলেন। সঙ্গে নিলেন আমার বাবাকে। কলকাতায় পিতাপুত্রের সংসার কিছুটা দাঁড়িয়ে যাবার পর ঠিক করলেন ঠাকুমা আর কাকা পিসিদের নিয়ে যাবেন। ... ...
নার্গিস ভাবছিল দিল্লির কথা; দাঙ্গার অদ্ভুত অদ্ভুত খবর আসছিল দিল্লিতে। ওসমান সাহেব তখনও দোনামোনায় ভুগছেন, কেননা দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, এটা যেন অবিশ্বাস্য ঠেকছিল তাঁর কাছে। করলবাগের বাড়িটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা। দলে দলে লোক চলেছে ট্রেনে করে পাকিস্তান, ওদিকে লাহোর থেকে শিখ পরিবাররা আসছে দিল্লি। যে যেখানে পারছে, ফাঁকা বাড়ীতে, বাগানে, রাস্তার পাশে উদ্বাস্তু মানুষেরা আশ্রয় খুঁজছে। কে যেন বলেছিল, নার্গিসের মনে পড়ে না, সীমান্ত পেরিয়ে অমৃতসরে শুধু খুন হওয়া লাশ নিয়ে ঢুকেছে একটা ট্রেন। একদিন বেলার দিকে ওসমান সাহেব বাইরের ঘরে বসে কিছু ব্যবসার কাগজপত্র দেখছিলেন। নার্গিস বাড়ীর ভেতরে ছিল। হঠাৎ রাস্তায় আর্তনাদ ও গোলমালের শব্দ শুনে সে ঘরের জানলার কাছে গিয়ে রাস্তাটা দেখার চেষ্টা করতে করতেই ওসমান সাহেবের চিৎকার তার কানে এল — জানলার কাছে যাস না। ততক্ষণে বাইরের দরজাটার গায়ে লোকগুলো লাথি মারতে শুরু করেছে। নার্গিস শুধু একঝলক দেখতে পেল একটা কনুই অব্দি কাটা হাত রাস্তায় পড়ে আছে, যেটা থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তখনও। তার বাবা ঘরে ঢুকেই তাকে জানলার কাছ থেকে টেনে এনে একটা থাপ্পড় মারলেন তার গালে। সেদিন তারা কোনোক্রমে বেঁচে যাবার পর দিল্লি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক সহজ হয়ে যায় ওসমান সাহেবের কাছে। ... ...
কালবাদে পরশু দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। সে কারণেই বােধ হয় অসম্ভব ভিড় বাজারটায়। ফাড়ির ঠিক উলটোদিকে ফুল বেলপাতা বিক্রি করে লক্ষ্মীমণি, তার পাশেই বসে আনােয়ারা। সপ্তাহে চারদিন করে আসে সে। লক্ষ্মীমণি অবশ্য জানত আনােয়ারার আজকে আসবার দিন না হলেও আজ সে আসবেই। গত বছরে এর অন্যথা হয়নি। এ বাজারেও এখন সকলে জেনে গেছে| এই বুড়িমার কাছে খাঁটি চোদ্দশাক পাওয়া যায়। আনােয়ারা আসলে লক্ষ্মীমণি খুশি হয়ে ওঠে। জিজ্ঞাসা করে -টেরেন কি লেট ছিল ? আনােয়ার শাকের বােঝা রেখে পিঠ সােজা করে দাঁড়ায় না গাে লক্ষ্মী। ফাস্ট টেরেনটা পেলাম না। লক্ষ্মীমণি খুব চটপটে মানুষ। পাশের অস্থায়ী চায়ের দোকান থেকে কাঁচের গ্লাসে দু’গ্লাস চা আর বিস্কুট নিয়ে আসে। একটা গ্লাস আর বিস্কুট আনােয়ারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-- -ও নাও খেয়ে নাও আগে। কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে আনােয়ারা। তারপর আপন মনে বলে— কাইল রাত থেকে চান্দুর মা আমার মােমিনা বিটির মাথার পােকাটা নড়ে উঠেছে। আমায় গাল দিতেছে। ছেলেটারে পিটলাে। জ্যান্ত হারিকেনটা মাটিতে আছড় দিল। আফশােসের সঙ্গে মুখে চুক চু্ক শব্দ তােলে লক্ষ্মীমণি। -ই। ওরে বাবার ঘরে পাঠায়ে দাও। মাথা নেড়ে হাসে আনােয়ারা। গাে বু তা হয় না। কাঁচা বয়সে সােয়ামী হারালে কোন মেয়ের মাথার ঠিক থাকে বলাে। ঠিকঠাক ছেলে পেলি আমি মােমিনার বে’ দেব আবার। চায়ে চুমুক দেওয়া ভুলে লক্ষ্মীমণি তার বন্ধুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে-মনে মনে ভাবে। ... ...
গতকাল সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। এক দুশ্চিন্তায়। শেষ মুহূর্তে এখানে চলে আসার দুর্ভাবনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। কেন না আমরা মুসলমান। হিন্দু এলাকায় থাকব। নিরাপত্তাহীন এক ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল। কেন না এখন গুজরাতে ভয়াবহ দাঙ্গা চলছে। বীভৎস সব খবর বেরোচ্ছে সংবাদপত্রে। আমার স্ত্রী নাসিমা খবরের কাগজ পড়ে না, তার এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। আমি একা একা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, স্ত্রী পরিবারকে মহিষবাথানে যে নিয়ে যাচ্ছি, ঠিক করছি কি? এখানের পরিস্থিতি যে খারাপ হবে না, তার নিশ্চয়তা কি আছে। গ্রামে মুসলমান এলাকায় থাকি, খানিকটা মনে জোর পাই। মহিষবাথানে তো সবাই হিন্দু, আমরা একমাত্র মুসলমান। জায়গা কেনার সময় এ কথা মাথায় আসেনি। মানুষজন যেভাবে জায়গাজমি কেনে, বাড়ি ঘরদোর করার স্বপ্ন দেখে, আর পাঁচজনের সঙ্গে আমার কোনও তফাত ছিল না। বরং মনে হয়েছিল হিন্দু এলাকায় মুসলমানরাও থাকবে। সহাবস্থানের প্রেম খুঁজেছিলাম। আর সেই প্রেমকে শেষ পর্যন্ত লালন করতে পেরেছিলাম বলে গতরাত দুর্ভাবনায় কাটিয়েও আজ মহিষবাথানে চলে আসতে পেরেছি। গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশিত "নির্বাচিত গল্পপাঠ' গ্রন্থ থেকে। ... ...
“জানি না”, অস্থির সীতাপ্রসাদ মাথার চুল খামচে ধরল। “কিন্তু গত বছরের সব কটা ঘটনা পর পর খেয়াল করে দেখো। মে মাসে প্রভুজির হুকুম আসল। আমরা ত্রিশূল নিয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে কবরখানায় হামলা চালালাম। এখানে, ঠিক এই জায়গাতে,” সীতাপ্রসাদ এলোমেলো হাত চালাল চারপাশে, “এখানে আমাদের গোটা দল এসে কবরগুলো একটার পর একটা খুঁড়লাম। এমনকি পচে গলে যাওয়া বডিগুলোকেও ছাড়িনি । যেসব জেনানারা কংকাল হয়ে গিয়েছিল তাদের বাদ দিলাম শুধু। তারপর কাজ হয়ে গেলে লাশগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলাম যাতে সকলে দেখতে পায়। পরদিন থেকে টেনশন শুরু হল। বলা হল ওরা অ্যাটাক করবে, তাই পার্টি অফিস থেকে রাত্রিবেলা তলোয়ার আর ত্রিশূল বিলি হল। আমরা হামলা চালালাম। খুনখামারি যা হবার তা তো হল, ওদের সবাই চলে গেল রিফিউজি ক্যাম্পে। সব কিছুই জুন মাসের মধ্যে মিটে গেছে। ভোটার লিস্ট চেক করে দেখো, যে কয়খানা ঘর এখনো টিকে আছে তাদের একটাতেও কোনো জোয়ান মদ্দ নেই। আগাছা সাফ করে দেবার মত উপড়ে ফেলেছি। তাহলে এতদিন বাদে এই মার্চ মাসে এমন কাজ করল কে? কে এমনভাবে খুন করল তিনজনকে? আশেপাশের গাঁও গুলোর কেউ নয় কারণ এই কাজ করবার জন্য গায়ের যা শক্তি লাগে তা ওই কয়েকঘর বুড়োহাবড়াদের মধ্যে নেই। আর এমনভাবে বডিগুলো সাজিয়ে রাখল ঠিক যেভাবে আমরা ঐ লাশগুলোকে সাজিয়ে রেখেছিলাম। ... ...
প্রতিবেশী সবজে বা ক্যাটক্যাটে নীল চেক-লুঙ্গি যে শুধু পোষাক নয়, পুরোনো ঢাকার রিকসার মত একটা পশচাদমুখী, মধ্যযুগীয়, অন্ধকারাচ্ছন্ন মানসিক অবস্থা। সর্বস্তরের নতুন বাঙ্গালি নারী তাই পুরুষকে সাথে নিয়েই আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। দৈনন্দিনে, সামাজিক অনুষ্ঠানে,সদর্থে খেলানো বা হাতে নেওয়া কুচি ধুতি বা নানা কাট পাজামারা তাই এগোচ্ছে। কিছু কিছু প্রযুক্তি যেমন প্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না, লুঙ্গিও পারলো না। দুটি সুবিধে কিন্তু ছিল। উত্থান সংক্রান্ত। প্রথমটি হল সম্প্রীতির আবহে খোলা আকাশের নীচে শিশিরে ভেজা গ্রাম বাংলায় প্রাত:কৃত্য। দ্বিতীয়টি হল ঘটনাচক্রে অনিচ্ছামৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে কোনো কোনো পুরুষের প্রাথমিক সামাজিক পরিচয় জেনে নেওয়ার সর্বজনীন সুবিধে। এই পদ্ধতি ১৯৪৬ নাগাদ মধ্য কলকাতায় আবিষ্কৃত হবার পর থেকেই জনপ্রিয়তার কারণে প্রায় জাতীয় ঐতিহ্য হয়ে উঠেছিল। অপিমোড-পুরনারীর বাচ্চা তথ্য সংগ্রাহক দের এতোটা জানার কথা নয়। যাই হোক লুঙ্গির বিরুদ্ধে এই প্রবল জনমত প্রতিষ্ঠার পরের নয়, তার অল্প পূর্বের ঘটনা নিয়েই আমাদের সুশান্ত-অনিতার গল্প। তখনো সমাজে তর্ক চলছিল। বিবর্তনের গতি তখনো হয়তো কিছুটা সহমর্মী-শ্লথ ছিল। ... ...