কিছুদিন আগেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে অভ্যুত্থান হয়ে গেল। অনেকটাই বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের আদলে। যদিও ভয়াবহতা এবং ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে নেপালের থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে! 'ভ্যান্ডালিজমে' বাঙালি সব সময় সর্বশ্রেষ্ঠ কিনা! তবে উভয় দেশের অভ্যুত্থানের প্যাটার্ন কিন্তু এক ও অভিন্ন।
নেপালের অভ্যুত্থানের নেপথ্য কারণ
নেপালে মূলত 'নেপোকিড' টার্মে স্টারকিডদের(Starkids) প্রতি স্বজনপ্রীতির অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের দূর্নীতি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের অভিযোগে নেপালের জেন-জি প্রজন্ম রাস্তায় নামে। এই আন্দোলনকে সুসংহত করে ১জন নেপালী ডিজে এবং এক্টিভিস্ট। সুদান গুরুং 'হামি নেপাল' নামের ভলান্টারি সংগঠনে সংগঠক। ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের পর এই সুদান গুরুং নিজের বাচ্চা ছেলেকে হারিয়ে এই সংগঠনের পরিকল্পনা করে এবং কার্যক্রম শুরু করে।
রাস্তায় নামার পর কী ঘটে? জেন-জি প্রজন্মের তরুণশক্তি রাজনৈতিক নেতাদের ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট ভবন আর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর গিয়ে আঘাত হানে। তারা চিৎকার করে বলে, Don’t Mess with Us! চলে তান্ডব। এরপর সেনাবাহিনী সোচ্চার হয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে। এতে প্রায় ৭০ জনের প্রাণ যায়। প্রায় ৩০০ জন আহত হয়।
জেন-জি'রা কখন দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে? যখন কে পি শর্মা'র সরকার নেপালে ফেসবুক, ইউটিউবসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যান করে দেয়, ঠিক তখন জেন-জি'রা রাস্তায় নেমে আসে। মানে তাদের মতপ্রকাশের অধিকার যখন হুমকির শিকার হয়েছে, তখনই তারা দলে দলে রাস্তায় নেমেছে।
এরপর তারা তাদের অধিকার আদায়ে মারমুখী আচরণে লিপ্ত হয়েছে। সবশেষে কেপি শর্মার সরকার পদত্যাগ করে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
অবশেষে এই জেন-জি প্রজন্ম ভার্চুয়াল প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোটিং করে সুশীলা কার্কি'কে ৬ মাসের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে। মানে অন্তর্বর্তী সরকার আরকি। আর সুশীলা কার্কি ক্ষমতায় বসেই নতুন নির্বাচনের তারিখ হিসেবে ৫ মার্চ'কে ঘোষণা করে দিয়েছেন।
কিন্তু নেপালে এই অল্প কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থান সত্যিই কি বিষ্ময়কর না? গত কয়েক বছরে এই এশিয়াতে ৪টি দেশে অভ্যুত্থান ঘটেছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং নেপাল। প্যাটার্ন একইরকম। অভ্যুত্থানের প্যাটার্ন একই রকম হওয়াটা দোষের কিছু নয়। তবে এই পদ্ধতিগত দিকটা আমাদের মাঝে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়। এর পেছনে আদতে কে/ কারা? কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি কাজ করছে কি? নাকি প্রতিটা অভ্যুত্থানই স্বতঃস্ফূর্ত?
এখন এই অভ্যুত্থান বিষয়ে যদি আমরা যে ৩টি অনুসিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারি সেগুলো হবে:
ক. আমরা এটাকে হামি নেপাল ও ছাত্রদের অভ্যত্থান বলতে পারি।
খ. এটা হচ্ছে জেন-জি প্রজন্মের ভার্চুয়াল পৃথিবী এবং বাস্তব জগত'র সাংঘর্ষিক ঘটনা।
গ. যখনই প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, অর্থাৎ ভার্চুয়াল জগতে ব্লকেড সৃষ্টি হয়েছে, তখনই এই তরুণ প্রজন্ম মতপ্রকাশের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
সবার শেষের অনুসিদ্ধান্তটি খুবই জরুরি পয়েন্ট। এই আলোচনা'কে উপলব্ধি করতে চাইলে আমাদের এই শেষের পয়েন্টটা নিয়ে অবশ্যই চিন্তাশীল থাকতে হবে।
বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের নেপথ্য কারণ
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের সম্পর্কে যারা অবগত আছেন তারা সবাই এই পয়েন্টগুলো সম্পর্কেও কমবেশি জানেন,
ক. এটা প্রথম দিকে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ১টি আন্দোলন ছিল।
খ. তৎকালীন আওয়ামী সরকারের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে সেই আন্দোলন জনরোষে পরিণত হয়েছিল।
গ. এই আন্দোলনেও প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল। সরকার প্রায় টানা ১০ দিন পুরো দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এছাড়াও কিছু অন্তর্ঘাতমূলক রাজনৈতিক সমীকরণ গুপ্ত অবস্থায় ছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক মিল এই পয়েন্টটাতে। নেপালে যেমন ডিজে সুদান গুরুং ভালো প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। সেরকম বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে কতিপয় ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সার কিংবা বলতে পারি ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটরেরা প্রভাবক ছিল। যেমন: পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস প্রভৃতি। এরা মূলত সাদা চামড়ার দেশে থাকেন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক পাণ্ডিত্য জাহির করেন।
এই ঘটনাগুলো কি অভিনব?
নিঃসন্দেহে আমরা অভিনব বলতে পারি। কেননা বিশ্ব কখনো এর আগে এরকম টোটাল ক্যাওয়াস'র সাক্ষী হয় নাই। কেন বলছি এমন কথা? ভাবুন তো, ২০ বছর আগে মানুষ কখনো চিন্তা করেছে, ফেসবুক/ ইউটিউব নামের মাধ্যম থাকবে। যেখানে কাজ এবং অকাজ সবই থাকবে। আর সেইখানে মানুষ যেমন খুশি নিজের ১টি কৃত্রিম পরিচয় সৃষ্টি করে অন্য মানুষের সাথে যুক্ত হবে?
সাদা কথায়, ভাবেনি। কিন্তু এখন মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। যারা ব্যবহারে অভস্ত্য, তারা যদি হঠাৎ দূর্ঘটনাবশতও এই প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন মানুষের মাঝে একরকমের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। বলতে পারেন ভার্চুয়াল জগতের নেশায় এখন আচ্ছন্ন বহুসংখ্যক মানুষ। এই প্রযুক্তির সাথে সবচেয়ে যাদের বেশি আঁতাত, তারা হলো নতুন প্রজন্মের। তারা জেন-জি।
তারা ভার্চুয়াল গেম, ডেটিং, মিটিং ইত্যাদি নানান কর্মকান্ডে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। হয়তো একটু রেস্টলেসই বটে।
পাঠক হয়তো ইউভাল নোয়া হারারি'র সম্পর্কে অবগত আছেন। যিনি চমৎকার ভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রযুক্তি এবং মানবসভ্যতার সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন। তিনি তার আলোচনায় এই প্রযুক্তির ভয়াবহ দিক সম্পর্কে খুব চমৎকার যুক্তিসংগত কথা বলেন। তার মতে, পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের কারণ হতে পারে ভার্চুয়াল জগৎ।
হয়তো আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সেই আলামতই প্রকাশ পাচ্ছে। কেননা বাঙলা প্রবাদ আছে, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী! প্রযুক্তি সম্পর্কে যদি ধারণা কম থাকে তবে যেমন খুব সহজেই ১টি গোষ্ঠীকে বিপন্ন করা সম্ভব। তেমনি এর মাধ্যমে মোড়ল হয়ে উঠাও সহজ!
ডিপস্টেট ধারণা
অনেক রকম বাহাসই প্রচলিত আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে আমেরিকার ডিপস্টেট থিওরি। সাধারণত এই বায়াস মতে, আমেরিকা ইন্দো-প্যাসিফিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে নাকি মায়ানমারে নিজেদের ঘাঁটি করতে চায়। এই যুক্তির পেছনে অবশ্য বেশ কিছু প্রমাণ আছে। যেমন আমেরিকা বাংলাদেশের কাছে চট্টগ্রামে মানবিক করিডোর করার প্রস্তাবনা জাহির করেছে। এবং সেই মোতাবেক কাজও শুরু করেছে। কেননা ইদানিং আমেরিকার ১০০+ কমান্ডো, এজেন্ট, সেনাসদস্য ইত্যাদি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী'কে বিশেষ ট্রেনিং শেখাতে চট্টগ্রামে অবস্থান করছে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবগুলোই আমেরিকার প্রযুক্তি। তারা যে বিশেষ এলগরিদম ব্যবহার করে এদিকের ভার্চুয়াল জগতকে প্রভাবিত করছে না, এরকম কোনো জোরদার যুক্তিকে আমরা নাকচ করতে পারি না। কেননা ভাইরাল কীভাবে হয়? এ ব্যাপার কেবল সেই এলগরিদমই জানে! আর জানে এর সৃষ্টিকারীরা!
আরেকটি বাহাস প্রচলিত আছে, ভারতীয় সরকার নাকি তার প্রতিবেশি দেশগুলোতে নিজস্ব প্রভাব খাটাতে এ ধরনের পরিকল্পনা করতে পারে?
আমার কাছে এ কথা তেমন যুক্তিসঙ্গত লাগে না। কেননা আমাদের প্রতিবেশি অশান্তিতে থাকলে আমরাও এক প্রকার যারপরনাই অস্বস্তিতে পড়ি। আর দেশের ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম কিছু হবার কথা নয়!
তবে প্রযুক্তির অন্তরালে এই অভ্যুত্থানগুলো আমাদের'কে মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে এবং চারিত্রিক বিবর্তন সম্পর্কে বেশ কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষ কি এভাবেই ধ্বংসের পথে ধাবিত হচ্ছে? এই আন্দোলনগুলো কি প্রযুক্তিগত বিপ্লব?
বিজ্ঞজনেরা হয়তো এইসব সম্পর্কে আমাদের একসময় পরিষ্কার ধারণা দিতে পারবেন।
২১।০৯।২৫
[ সবাইকে শুভ মহালয়া।
পরবর্তী পর্বে আবার কথা হবে।
ধন্যবাদ।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।