এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • ওয়ং কার ওয়াই -- স্থান ও কালের তারল্য

    শমিত
    আলোচনা | সিনেমা | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ | ৫৩৬ বার পঠিত
  • ওয়ং - স্থান ও কালের তারল্য - ১

    আমার ওয়ং দেখা শুরু In the Mood for Love ছবিটি দিয়ে। প্রথম বার দেখার পরেই এক ঝটকায় ছিটকে যায় আমার অভ্যস্ত ইউরোপীয় সিনেমা পঠনপদ্ধতি, চশমা, স্থান ও সীমানাগত বোধ। ব্যক্তিগত স্থান ও সময়বোধের স্বচ্ছন্দ, চৌকশ মেপে নেওয়া পরিচিত গন্ডীর মধ্যে বাসরত পরিচিত চেতনাগুলি কেঁপে ওঠে। পরিচিতি এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করে - এ ভ্রান্তির সত্যতা থেকে জন্ম নেয় পরিচিতির অপরিচিত অস্বাচ্ছন্দ্য। ওয়ং-এর ছবি স্থান নির্ভর, শহর নির্ভর - হংকং নির্ভর বলতে হয় আরো শুদ্ধ করে বলতে গেলে। আর ওয়ং-এর ক্যামেরার গতিবিধিও নির্মোঘ আদেশের মতো নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে শহরের দরতয়ড়ঢ়ক্ষষসবষথভদ সরু করিডরে আর বাক্সের মতো ফ্ল্যাট ঘরে - এদিক থেকে ওদিক ঘুরতে গিয়ে ওয়ং প্রায় যেন দেওয়ালে, দরজায়, সোফায়, কোলে রাখা টিভিতে ধাক্কা খেতে গিয়েও খান না - কারণ চরিত্রগুলির স্থানাভাবজনিত পরিচিত অস্বাচ্ছন্দ্য তখন উঠে আসে ক্যামেরার গায়ে। এরই মধ্যে এক আশ্চর্য্য স্মৃতিনির্ভর সম্পাদনার সামনে আমাদের ছেড়ে দেন ওয়ং। ওয়ং-এর প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব কাহিনীগুলি গড়ে ওঠে অসংখ্য নিকট ও দূর অতীতের স্মৃতিবিন্দু দিয়ে ভরে তোলা ছোটো ছোটো ছবির সমষ্টি হিসেবে - যে ছবিগুলি ব্যক্তিগত ও তাই অসম্পূর্ণ। আর চরিত্রগুলির এই সব ব্যক্তিগত স্মৃতির স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতার উত্থান-পতন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে ছবির লয়। ক্রমেই অপরিচিত হয়ে উঠতে থাকে পরিচিত বাক্সগুলি, কোনগুলি, দরজা ও ঘুলঘুলিগুলি আর ওয়ং ৮ ফুট বাই ৬ ফুট কোনো ঘরের মধ্যে বসে সময়ের স্মৃতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্রমাগত বদলে দিতে থাকেন ক্ষেত্রমিতি।

    ওয়ং - স্থান ও কালের তারল্য ১.৫

    শারীরিক স্থানের শহরানুগ এই চুড়ান্ত অভাবের ফলে ওয়ং যেন বাধ্য হয়ে মানসিক স্থানের অপরিমেয়তাকে বেছে নেন বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে। আর এই মানসিক স্থানবোধ ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে চরিত্রগুলির দুর ও নিকট স্মৃতির যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্নতা - আপাতসংযোগহীনতার উপর ভিৎ করে। ওয়ং-এর ছবিতে চরিত্র কম, প্রতিটি চরিত্রই মূল চরিত্র, আর প্রতিটি চরিত্রই যেন একটি স্পষ্ট অথচ এলোমেলো দাগ - যার শুরু ও শেষ ক্যানভাসের বাইরে।

    ওয়ং - স্থান ও কালের তারল্য ২

    ওয়ং-এর ছবিতে কাহিনী যেন আপাতভাবে গৌণ। আসলে ঠিক গৌণ নয় - শারীরিক স্থান ও সময়কে নির্ভর করে গড়ে ওঠে যে ধরণের ঘটনাবলী - ওয়ং-এর ছবিতে তার সুযোগ বড় কম। ওয়ং-এর কাহিনীর বিস্তার মূলত: স্মৃতিতে। ফলত: ওয়ং-এর ছবিতে ঘটনারাজি এগোতে থাকে খুব ধীর লয়ে - স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতার মাঝে স্মৃতির মন্দমন্থর দোলাচলবৃত্তির তালে তালে। ওয়ং-এর ছবি গড়ে ওঠে স্মৃতি ও সময়ের অনিশ্চয়তায়, অস্থিরীকৃত চৌহদ্দির তারল্যে। সময়ের স্থাপত্ত্য করতে গিয়ে তারকোভস্কি বলেছিলেন সময়ের চাপের কথা। ওয়ং-এর ছবিতে সময়ের চাপ আছে। কিন্তু স্থাপত্ত্য নেই। তারকোভস্কির সময় কঠিন, নির্দিষ্ট, ছেনি হাতুড়িতে সেখানে কুঁদে তোলা যায় এক একটি মনোরম আকার। ওয়ং-এর সময় তরল। চাপ আছে, নির্দিষ্ট আকার নেই। ওয়ং-এর ছবি গড়ে ওঠে অগুন্তি অনির্দিষ্ট আকারের আভাষ জুড়ে জুড়ে।

    আর এর ঠিক বিপরীতে, ক্যামেরার সামনে ওয়ং-এর চরিত্রগুলি বেড়ে ওঠে গন্‌ গন্‌ করে, আর ক্রমেই বদলে যেতে থাকে তাদের শারীরিক পারিপার্শ্বিকতার দুরূহ কোন ও বাক্সগুলি। Christopher Doyle এর ক্যামেরা যেন হয়ে ওঠে ওয়াং-এর হাতের অগুন্তি রাবারের চাবুক যেগুলি শপাং শপাং করে অনবরত আছড়ে পড়তে থাকে ছোটো খোপঘরের দরজায়, নীচু সিঁড়িতে, সরু করিডর জোড়া দেওয়াল, ধোঁয়া ও নুড্‌লখানায়।

    ওয়ং-এর ছবির এই হংকংশীলতার একটি চরম উদাহরণ - happy together । প্রায় গোটা ছবিটিই ঘটে আর্জেন্টিনায় ( buenos aires )। অথচ সারা ছবিতে আর্জেন্টিনা চুড়ান্ত ভাবে অনুপস্থিত, যদিও সেটিই চরিত্রগুলির সবঁড়ভদতর অবস্থান। ওয়ং ছবি গড়েন স্মৃতিগত স্থানে, memory space -এ। তাই ওয়ং-এর চোখ সোচ্চার ভাবে আর্জেন্টিনায় খুঁজে বের করে শুধু সেই জায়গাগুলি যেগুলি হংকং-এর মতো; হংকং থেকে চলে আসা দুই প্রেমিকযুবকের হংকং-এর স্মৃতির মতো।

    থাকার জায়গা অর্থাৎ 'মাথা গোঁজার ঠাঁই' - ওয়ং-এর ছবিতে এই অদ্ভুত 'স্থানের'( space ) খেলার মাঝে পড়ে আশ্চর্য্য সব চেহারা নিতে থাকে। ধরা যাক chungking express এর কথা। ছবিটির মুলচরিত্রগুলির একজন এক চোরা কারবারি মহিলা - যার ড়ষ দতররনধ থাকার জায়গা নেই গোটা ছবিতে - তার ঘটনাগুলি ঘটে ট্রেনের বগিতে অথবা বার বা রেস্তোরাঁ বা অবৈধ আখড়াগুলিতে যেখানে কেউ 'থাকে' না। আরেক জন এক পুলিশ যার থাকার জায়গা, সে যখন থাকে না তখন, তার থাকার মতো করে রোজ গুছিয়ে রেখে যায় চুপি চুপি একটি মেয়ে, যে নিজে ঐ থাকার জায়গাটিতে থাকে না কখনো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ | ৫৩৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন