এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • নামসংকীর্তন কহে নরোত্তম দাস

    Somnath Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৯ মে ২০১৭ | ৪৪৭৬ বার পঠিত
  • সাধনপদ্ধতি হিসাবে কীর্তনের প্রয়োগ সম্ভবতঃ ভক্তিধর্মের উত্থানের একদম গোড়ার দিক থেকেই। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনাতেও সমবেতভাবে আধ্যাত্মিক গান গাওয়ার প্রচলন ছিল (উদাঃ চর্যাগীতি)। বাংলায় বিভিন্ন আকর গ্রন্থে (চৈতন্যমঙ্গল, চৈতন্য চরিতামৃত) ‘সংকীর্তনদাতা’ বা ‘সংকীর্তনপ্রবর্তক’ হিসাবে শ্রীচৈতন্যের নাম পাওয়া যায়। অর্থাৎ, একভাবে মনে করা হয়, তিনি উপাসনার বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে কীর্তনের প্রচলন করেন। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে দেখি, শ্রীচৈতন্য বলছেন-
    কীর্ত্তন সকল কর্ম্ম কীর্ত্তন সকল ধর্ম্ম
    কীর্ত্তন সকল ব্রহ্মজ্ঞান ।
    কীর্ত্তন ভারত পুরাণ জপতপ দান ধ্যান
    কেহো নহে কীর্ত্তন সমান।।
    চৈতন্যচরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলছেন নামসংকীর্তন হলো ‘পরম উপায়’। অতএব, এইটা বোঝাই যায় যে ঈশ্বরসাধনা বা ভক্তির জন্য কীর্তনকেই মূল মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন শ্রীচৈতন্য। আমরা মূল প্রসঙ্গ, অর্থাৎ, নরোত্তম দাসের অবদান দেখবার আগে চৈতন্যের কীর্তনভাবনাকে দেখে নিই।

    চরিতগ্রন্থের বর্ণনায় নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের প্রকাশের প্রথম পর্যায়ে বিভিন্ন কীর্তন, বেড়াকীর্তন, নাচ ও ভাবাবেগ সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু, ব্যাপক মানুষ কে প্রথম যে কীর্তনটিতে অংশ নিতে দেখি, তা কাজিদলন অধ্যায়ে। কাজি যখন নবদ্বীপে কীর্তনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এক বিশাল জলতাকে সঙ্গে নিয়ে চৈতন্য কাজির বাড়ির দিকে কীর্তন করতে করতে যান। গণরোষের ভয়ে কাজি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। এই কীর্তনে নারীদেরও অংশগ্রহণ ছিল, সামগ্রিকভাবে একে এক মহামিছিল মনে হয়। বৃন্দাবন্দাসের চৈতন্যভাগবত থেকে এই কীর্তনের সম্বন্ধে বিশদে যা জানতে পারি, তা হল, এই কীর্তনে মূলতঃ তিন-চারটি পদ গাওয়া হয়। তার একটি ‘হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ। গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন।।’ অপর একটি পদ, যা চৈতন্যদেব স্বয়ং গাইছিলে্‌ – ‘তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে। শারঙ্গধর তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে।।’’ এই দ্বিতীয় পদটিকে বৃন্দাবনদাস বলছেন ‘চৈতন্যচন্দ্রের এই আদি সঙ্কীর্তন’। এখানে আমরা একটা জিনিস দেখতে পাই, শ্রীচৈতন্যের অনুশীলনে কীর্তন মূলতঃ কৃষ্ণের নামজপের এক সাংগীতিক পদ্ধতি। এই কীর্তনে বিভিন্ন জাতির মানুষ এমন কী নারী ও চণ্ডাল অংশগ্রহণ করছেন। এবং সামাজিক আন্দোলনের কোনও কোনও বীজ কীর্তনের মধ্যে থাকছে। প্রসঙ্গতঃ, বৈষ্ণব ভাবধারায় অহিংস গণপ্রতিরোধের উদাহরণ আমরা গান্ধিজির লড়াইগুলির মধ্যেও দেখি।

    চৈতন্যদেবের নামসংকীর্তনভিত্তিক সাধনার মধ্যে সহজিয়া বা বৌদ্ধতান্ত্রিক সাধনার অবশেষ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। বৃন্দসংগীত বা সমবেতভাবে গান, নাচ ও বাজনার মাধ্যমে দেহসাধনার বিবরণ চর্যার পদগুলিতে পাওয়া যায়, সুফি কিম্বা বাউল-ফকিরি ধারাতে এই সাধনাপদ্ধতি বর্তমান কালেও দেখা যায়। সহজিয়া সাধনায় জাতিবিচার কিম্বা কেবলমাত্র পুরুষের অধিকার আছে এরকম নয়। আর, কৈবর্ত বিদ্রোহ বা ডোম-ব্রাহ্মণ যুদ্ধে সহজিয়া সিদ্ধপুরুষদের নেতৃত্বদানের লোককথাও পাওয়া যায় (বেনের মেয়ে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী)।

    নামসংকীর্তন বিষয়ে বাউলরা বলেন, এ এক গোপন পদ্ধতি (দেহসাধনার), যা গুরুর কাছে শিখতে হয়। চৈতন্যচরিতামৃতে দেখা যায়, হরিদাস দিনে তিনলক্ষ বার নামজপ করেন। চৈতন্যদেব তাঁর শিষ্যদের বলছেন দিনে একলক্ষ বার নাম জপ করতে। অর্থাৎ ঈশ্বরের নামগ্রহণ কোনও এমন পদ্ধতি, যার মধ্যে শ্বাসবায়ুর গ্রহণ-নির্গমন এক নির্দিষ্ট সংখ্যায়, নির্দিষ্ট ছন্দে হচ্ছে। বা ভক্তিরসের এই সাধনার অঙ্গাঙ্গি অংশ হয়ে আছে প্রাণায়ম কিম্বা দেহভিত্তিক সহজ-সাধনা। দেহতত্ত্বের পথে সাধক যাঁরা, তাঁরা বাইরের লোককে নিজেদের সাধনাপদ্ধতি সম্পর্কে কিছু জানান না। তবু, জনশ্রুতি মেনে আমরা ভাসাভাসা যা জানতে পারি, তা হল এই সাধনায় নারী-পুরুষ মিলিত হয় কিন্তু সঙ্গমের ফলে কারুর দেহরসের ক্ষরণ ঘটেনা। যৌনসংগমের প্রাক্‌-চূড়ান্ত মুহূর্তে বীর্যস্খলন রোধ করতে সাধক প্রাণায়ম করেন। বলা হয় ইন্দ্রিয়সুখকে বর্জন করে সাধক সাধিকা দুর্লভ আত্মিক-সুখের সন্ধান পান। চৈতন্যচরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ (প্রচলিত আছে যে তিনিও দেহসাধনা করতেন), এর আভাস দিতে লেখেন- ‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্চা তারে বলি কাম। কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।’ দেহতত্ত্ব বা সহজসাধনা কাম থেকে প্রেমে বা ইন্দ্রিয়প্রীতি থেকে ঈশ্বর-প্রীতিতে উত্তরণের সাধনা। চৈতন্যযুগের নামসংকীর্তন সহজসাধনাকে গুহ্য ও দুরূহ যৌনযৌগিক ক্রিয়ার থেকে বাইরে এনে সাধারণের আয়ত্তে আনে। ফলে, ‘কলির ধর্ম নাম’ এই শব্দবন্ধের মধ্যে এই ইংগিত পাই, যে, বৌদ্ধতন্ত্রের অবক্ষয়ের ফলে দেহসাধনার মূল ধারাটি বিদূষিত হয়েছে, আর শ্রীচৈতন্য যে নামধর্ম প্রবর্তন করছেন, তাতে দেহসাধনার একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হচ্ছে নামসংকীর্তনের মাধ্যমে। কীর্তনের অংশ হিসেবে নামগানের সঙ্গে নাচ, খোল-করতালের তালবাদ্য থাকে সেগুলির মধ্যেও যোগাভ্যাস থাকতে পারে।

    শ্রীচৈতন্যের জীবদ্দশাতেই তাঁকে স্বয়ং পরমেশ্বর কল্পনা করে বাংলায় গৌরপারম্যবাদ চালু হয়। অর্থাৎ, কৃষ্ণের বদলে শ্রীচৈতন্যের উপাসনার প্রবর্তন হয়। (উল্লেখ্য জনপ্রিয় বাউল পদ- একবার ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাবো না।) এর সমান্তরালে যে ধারাগুলি ছিল, তার একটি চৈতন্য একই দেহে রাধা ও কৃষ্ণের যুগল অবতার, আর উপাসনা হবে এই যুগলরূপের, এবং আরেকটি হল কৃষ্ণের অবতারত্বহেতু চৈতন্যই পরম পুরুষ বা নাগর, বাকিরা নারীভাবে তাঁর সাধনা করবে। এর দ্বিতীয় ধারাটিকে বলা হয় গৌরনাগরবাদ, যা মূলতঃ সহজিয়াদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এই পুরুষের নারী হয়ে সাধনা করা বা একই দেহে পুরুষ-নারী যুগলরূপ কল্পনা করা, দুটিই দেহতাত্ত্বিক ধারণা এবং সাধনার পদ্ধতি হিসেবে দুইক্ষেত্রেই বিভিন্ন যৌনক্রিয়ার অনুশীলনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। গৌরপারম্যবাদ, যার মূল প্রবর্তক ছিলেন স্বয়ং নিত্যানন্দ, তা এই কঠিন যৌনাভ্যাসের পথ থেকে সাধারণ মানব-মানবীকে বের করে এনে সহজতর নাম সংকীর্তনের পথে তাদের সাধনা করার সুযোগ দেয়। এবং শ্রীচৈতন্যের নাম জপ ও কীর্তন বাংলায় জনপ্রিয় হতে থাকে।

    চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর থেকে বৈষ্ণব ধর্ম-আন্দোলনের কেন্দ্র নীলাচল থেকে সরে গিয়ে পূর্বে বাংলা ও উত্তরে বৃন্দাবনে গড়ে উঠতে থাকে। চৈতন্যদেব জীবদ্দশায় বৃন্দাবন ভ্রমণ করেছিলেন এবং উত্তর ভারতে ধর্মপ্রচারের জন্য বৃন্দাবনের অপরিসীম গুরুত্ব উপলব্ধি করে সেখানে প্রথমে রূপ-সনাতন এবং পরে বাকি গোস্বামীদের থিতু হবার আদেশ দেন। বৃন্দাবনে তৎকালে অন্যান্য বৈষ্ণব সম্প্রদায়েরও আশ্রম ছিল। সেখানে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সঙ্গে নিরন্তর তর্ক করবার দরকার হত। ফলে বৃন্দাবন হয়ে ওঠে শাস্ত্রচর্চা এবং সংস্কৃতে লেখালেখির কেন্দ্রস্থল। সাধনার পদ্ধতি হিসেবে এখানকার গোস্বামীরা বৈধী ভক্তি, পরকীয়াতত্ত্ব প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব দিতে থাকেন। পুরাণ বিশ্লেষণ করে এনাদের সিদ্ধান্ত হয় যে শ্রীকৃষ্ণ-ই পূর্ণব্রহ্ম এবং তাঁর শ্রেষ্ঠতম অবতার শ্রীচৈতন্য। তাই, বাংলায় যখন চৈতন্য নামকীর্তন চলত, সেইসময়ে এঁরা কৃষ্ণের আরাধনাকেই মূল গুরুত্ব দেন। এই মতবাদকে কৃষ্ণপারম্যবাদ বলা হয়। এর ফলে বাংলার সঙ্গে বৃন্দাবনের এক বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়। বাংলার লৌকিক বৈষ্ণবধর্মের ধারার বদলে বৃন্দাবনে পুরাণভিত্তিক সংস্কৃত মন্ত্র-আশ্রয়ী ব্রাহ্মণ্য ভাবধারার বৈষ্ণবধর্ম বিকাশ লাভ করতে থাকে।
    শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের (১৫৩৪) পর থেকে বাংলার বৈষ্ণবধর্মে বিভিন্ন উপধারার সৃষ্টি হতে থাকে এবং বাংলার সঙ্গে বৃন্দাবনের চিন্তাধারার দূরত্বও সৃষ্টি হয়। এই পর্যায়ে, ষোড়শ শতাব্দীতে, বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলিকে একমঞ্চে এনে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার শ্রেষ্ঠ সংগঠক হয়ে ওঠেন নরোত্তম দাস। নরোত্তম দাসের জন্ম ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে জমিদার ‘দত্ত’ পরিবারে। তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজে দত্ত-কে শূদ্রই ধরা হত, তৎসত্ত্বেও ব্রাহ্মণ্যভাবাশ্রিত বৃন্দাবনের গোস্বামীদের কাছে তিনি সম্মানিত ছিলেন এবং গোস্বামী মতের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ব্রাহ্মণ শিষ্যও গ্রহণ করেছিলেন। সেই হিসেবে শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দের পরই বাংলার সেইসময়কার সমাজসংস্কারকদের মধ্যে নরোত্তম দাস-কে ধরা যেতে পারে।

    নরোত্তম দাসের কর্মকান্ডের উপর সমসাময়িক গ্রন্থগুলি হল- ‘প্রেমবিলাস’, ‘ভক্তিরত্নাকর’ ও ‘নরোত্তমবিলাস’। নরোত্তমদাস নিজে সুকবি ছিলেন এবং অনেকগুলি তত্ত্বগ্রন্থও রচনা করেন। তারমধ্যে প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, সাধনভক্তিচন্দ্রিকা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রেমভক্তিচন্দ্রিকার বৈশিষ্ট্য হল পুরো গ্রন্থটিই প্রায় ত্রিপদীতে লেখা এবং আধুনিক বাংলাভাষার বীজ এর মধ্যে দেখা যেতে থাকে। এই গ্রন্থের একটি সাধন-সংক্রান্ত পদ হলঃ
    এ সভার অনুগা হইয়া প্রেম সেবা নিবো চাইয়া
    ইঙ্গিতে বুঝিবো সব কাজ।
    রূপে গুণে ডগমগি সদা হবো অনুরাগী
    বসতি করিবো সখীর মাঝ।।
    বৃন্দাবনে দুই জন চতুর্দিকে সখীগণ
    সময় বুঝিবো রস সুখে।
    সখীর ইঙ্গিতে হবে চামর দুলাবো কবে
    তাম্বূল যোগাবো চান্দ মুখে।।
    যুগল চরণ সেবি নিরন্তর এই ভাবি
    অনুরাগী থাকিবো সদায়।
    সাধন ভাবিবো যাহা সিদ্ধ-দেহে পাবো তাহা
    রাগ পথের এই সে উপায়।।
    সাধনে যে ধন চাই সিদ্ধ দেহে তাহা পাই
    পক্কাপক্ক মাত্র সে বিচার।
    অপক্কে সাধন রীতি পাকিলে সে প্রেম-ভক্তি
    ভকতি লক্ষণ তত্ত্ব সার।।
    লক্ষ্যণীয়, এর আগের সময় অবধি বাংলাভাষার পদগুলি (প্রাকৃত বা ব্রজবুলি নয়) মূলতঃ পাঁচালি আকারের ও পয়ারধর্মী। পুরাণাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন ও সংস্কৃত ভাষা অনুশীলনের চিহ্ন নরোত্তম দাসের রচনায় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে জটিল বাক্যের বিন্যাস এবং অব্যয় ও সর্বনামের প্রভূত ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এখানে রচনার ধরণ ও নিবন্ধধর্মী, যেখানে সরাসরি, রূপক বা উপমার আশ্রয় ছাড়াই, একটি তত্ত্বকে ও কিছু অনুশীলন পদ্ধতিকে বর্ণনা করা হচ্ছে। সে হিসেবে নরোত্তম দাসের রচনাকে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতের সার্থক উত্তরাধিকার বলা যায়। সাধন-ভক্তির তও্ববেত্তা ব্যতিরেকে নরোত্তম ছিলেন একজন অসাধারণ শক্তিমান কবি। রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলার উপর তাঁর অনেক অসাধারণ পদ আছে। লক্ষ্যণীয়, নরোত্তম দাসের তত্ত্বগ্রন্থগুলি আধুনিক বাংলাভাষার অভিমুখে হেঁটে লেখা, কিন্তু তাঁর রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদগুলিতে ব্রজভাষা বা মৈথিলির প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়।
    উদাঃ
    আজু রসে বাদর নিশি।
    প্রেমে ভাসল সব বৃন্দাবনবাসী।।
    শ্যামঘন বরিখিয়ে কত রস-ধার
    কোরে রঙ্গিণি বাধা বিজুরি-সঞ্চার।।
    দীগ বিদিগ নাহি প্রেমের পাথার
    ডুবল নরোত্তম না জানে সাঁতার।।

    বা
    কেলি সমাধি উঠল দুহুঁ তীরহি
    বসন ভূষণ পরি অঙ্গ।
    রতন-মন্দির মাহা বৈঠল নাগর
    করু বনভোজনরঙ্গ
    আননে কে করু ওর।
    বিভধ মিঠাই খীর বহু বনফল
    ভুঞ্জই নন্দকিশোর।।

    নরোত্তম দাসের শ্রেষ্ঠতম পদটি সম্ভবতঃ নিচেরটি-

    দুহুঁ মুখ-দরশনে দুহু ভেল ভোর।
    দুহুঁক নয়নে বহে আনন্দ-লোর।।
    দুহুঁ তনু পুলকুত গদগদ ভাষ।
    ঈষদবলোকনে লহু লহু হাস।।
    -অপরূপ রাধা-মাধব-রঙ্গ।
    মান-বিরামে ভেল এক সঙ্গ।।
    ললিতা বিশাখা আদি যত সখীগণ।
    আনন্দে মগন ভেল দেখি দুহু জন।।
    নিকুঞ্জের মাঝে দুহুঁ কেলি-বিলাস।
    দূরহিঁ দূরে রহুঁ নরোত্তমা দাস।।

    খেয়াল করা যায়, এই পদগুলিকে নরোত্তম রাধা-কৃষ্ণের লীলার সাক্ষীর অবস্থান থেকে বর্ণনা করছেন। চণ্ডীদাস-আদি পদকর্তাদের মতন সরাসরি কৃষ্ণ-বিরহ বা রাধাভাবের কথা তিনি লেখেন নি। বরং গোস্বামী-মতের সিদ্ধান্ত মেনেনিচ্ছেন যেখানে মানুষের সাধনার মূল বৃন্দাবন-লীলায় সখীদের মতন রাধাকৃষ্ণের প্রণয় উপভোগ করা। এবং সেই অবস্থান থেকেই তিনি মধুর রসের পন্থী হয়েছেন। এবং নরোত্তমদাসের বৈশিষ্ট্য এখানেই, যে কবি, গীতিকার বা শিল্পী হিসেবেও তিনি তাঁর তত্ত্বের প্রতি সম্পূর্ণভাবে অনুগত। এবং রসস্রষ্টা হিসেবে তিনি যা অবদান রেখেছেন, আসলে সেগুলি সবই তাঁর চিন্তাধারা ও বিশ্বাসকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য। এবং এই আঙ্গিক থেকেই আমরা বাংলা কীর্তনের রূপকার হিসেবে নরোত্তম দাসকে দেখতে পাবো। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বৈষ্ণব সাহিত্যিকদের মধ্যে কড়চা বা ডায়েরি লেখার প্রচলন ছিল। যেগুলি ছন্দোবদ্ধ নয় বলে তত জনপ্রিয় হতনা, বা মুখে মুখে ফেরা মানুষের গান হয়ে উঠত না। শ্রীচৈতন্যের জীবদ্দশা থেকে শুরু করে অনেক কড়চার উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায়, যার অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নরোত্তম দাসের একটি কড়চায় (দেহকড়চা) বাংলাগদ্যের আদিরূপ দেখতে পাওয়া যায় বলে শ্রুতি আছে।

    ধর্ম সংগঠক হিসাবে নরোত্তম দাসের আবির্ভাবের সময়ে বৃন্দাবনের কৃষ্ণপারম্যবাদের সঙ্গে বাংলার গৌরপারম্যবাদের বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। গৌরপারম্যবাদীরা গৌর-নিতাই বা গৌর-গদাধরের উপাসনা করেন এবং নামকীর্তনই প্রেমলাভের পরম উপায় মনে করেন। ওদিকে বৃন্দাবনের গোস্বামী-মতে রাধা-কৃষ্ণের পূজা-অর্চনা চলে এবং সাধক কায়মনোবাক্যে ব্রজে রাধাকৃষ্ণের সেবিকা মঞ্জরীর অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গিয়ে রাধাকৃষ্ণের মিলিতরূপের প্রেমসেবার অধিকার প্রার্থনা করেন। এর পাশাপাশি দেহতাত্ত্বিক সহজসাধনার বিভিন্ন ধারাও বাংলায় প্রচলিত ছিল। বৃন্দাবনে নরোত্তম দাসের প্রথম গুরু ছিলেন লোকনাথ গোস্বামী। তিনি গৌরপারম্যবাদী ছিলেন। তিনি নরোত্তমকে বলেছিলেন-
    ‘প্রথমেই গৌরাঙ্গের সেবা আচরিবা
    তার পর রাধাকৃষ্ণ সেবা যে করিবা।’
    লোকনাথ গোস্বামীর কাছে শিক্ষা সম্পূর্ণ করবার পর নরোত্তম দাস জীব গোস্বামীর কাছে গোস্বামীশাস্ত্র ও রাধা-কৃষ্ণের অর্চনার অধ্যয়ন নেন। বৃন্দাবন থেকে বাংলায় ফিরে এসে পদ্মাতীর প্রেমতলির খেতুরিতে তিনি স্থিত হন। ১৫৭৬-এর কিছু পরে প্রথম খেতুরি মহোৎসব আয়োজন করেন নরোত্তম দাস। এই মহোৎসবে বাংলার বিভিন্ন উপধারার বৈষ্ণবদের সকলে আসেন এবং তাঁদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠে। খেতুরি উৎসবের প্রাক্কালে নরোত্তম দাস সিদ্ধান্ত নেন যে চৈতন্যই শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠতম অবতার। যদিও মূলগত কারণে কৃষ্ণ অনন্য। তাই, খেতুরির উৎসবে কৃষ্ণ-রাধার উপাসনার পাশাপাশি তিনি বাংলার লৌকিক রীতি মেনে চৈতন্য-বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং গোস্বামীমতের অনুকরণে গৌরাঙ্গবিষ্ণুপ্রিয়ার যুগল পূজাপদ্ধতি প্রবর্তন করেন। চৈতন্যপারম্যবাদ, কৃষ্ণপারম্যবাদ এবং সহজিয়া যুগলসাধনার ধারা এক হয়ে খেতুরিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের একটা নতুন চেহারায় প্রকাশ পায়। উল্লেখ্য, খেতুরির এই বাৎসরিক মহোৎসব এখনও পালিত হয়ে আসছে।

    এই উৎসবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনাটি হয়, তা হল কীর্তন এক নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। শ্রীচৈতন্যের উত্তরাধিকার অনুসারে নরোত্তম দাস মনে করতেন নামগানই ‘চিন্তামণি সর্ব্বফলদাতা’। খেতুরির সম্মেলনে তাঁর প্রবর্তিত নতুন কীর্তন-এর বর্ণনা নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকরে বিশদে আছে। গুরু লোকনাথ গোস্বামীর আদেশ অনুসরণ করে (প্রথমেই গৌরাঙ্গের সেবা আচরিবা/তার পর রাধাকৃষ্ণ সেবা যে করিবা।) তিনি কীর্তন শুরু করেন চৈতন্য বিষয়ক নামসংকীর্তনের মাধ্যমে-
    ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দাদ্বৈতচন্দ্রে।
    গণসহ চিন্তয়ে মানসে মহানন্দে।।
    বারব বার প্রণমিয়া সবার চরণে।
    আলাপ অদ্ভুতরাগ প্রকট কারণে।।’
    কীর্তনের শুরুতে এই চৈতন্যস্মরণকে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ বলা হয়। ব্যাপারটি এত জনপ্রিয় যে শব্দটি বাগ্‌ধারারা হিসেবে ভিন্নার্থে ব্যবহৃত হয়ে আসে।
    প্রেমবিলাস কাব্যে এই কীর্তনের বর্ণনায় আছে-
    ‘প্রথমে করয়ে গান চৈতন্যমঙ্গল।
    তারপর গান হয় শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল।।
    পরে হয় গোবিন্দের গৌরকৃষ্ণলীলাগান।
    নরোত্তমের গানে সবার জুড়ায় পরাণ।।
    বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের কৃষ্ণলীলা গান।
    যে শুনয়ে হরয়ে তার মন প্রাণ।।’
    অর্থাৎ, গৌরপারম্যবাদ ও গুরুবাক্য মেনে শুরুতে চৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈতের নাম কীর্তন, তারপর কৃষ্ণনাম করে তিনি চলে আসেন রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তনে। কারণ গোস্বামীমতে (কৃষ্ণপারম্যবাদ) রাধাকৃষ্ণের প্রেম-ই আসল উপাস্য। তাঁদের প্রণয়লীলা শ্রবণ ও স্মরণ করেই সাধক নিজের প্রেমভক্তি চরিতার্থ করতে পারে। গৌরনাগরবাদীদের সন্তুষ্ট করতে এর সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ লীলাও যুক্ত হয়। এবং এরপরে বৈষ্ণব পদকর্তাদের পদগুলি গাওয়া হতে থাকে। লক্ষ্যণীয়, বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের পদ এর আগে বৈঠকি সঙ্গীত হিসেবে লোকে ছোটো আসরে রাগসংগীতের সঙ্গে গাইত। নরোত্তম এই পদগুলিকে পাঁচালির ঢঙে গাওয়ার প্রবর্তন করেন। সেখানে একজন মূল গায়েন থাকেন এবং তাঁর সঙ্গে সহকারী গায়ক (পালি বা দোহার) এবং এক বা একাধিক বাদক থাকেন। খেতুরিতে নরোত্তম দাস দোহার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেয়েছিলেন। সঙ্গে খোল ও করতাল বেজেছিল, বাদকদের সম্মানে কীর্তনের শুরুতে ‘খোলমঙ্গল’ অনুষ্ঠান হয়। পদগানকে লীলাকীর্তনে আনায় সাংগীতিক দিক থেকে নরোত্তম দাসকে অনেক সংযোজন করতে হয়েছিল। নরোত্তম দাস ধ্রুপদী সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত কীর্তনের অবিকৃত চেহারা এখন পাওয়া যায় না। কিন্তু, অনেকের ধারণা তিনি কীর্তনে ধ্রুপদের ঠাটে শুদ্ধ রাগ ও বিলম্বিত লয়ের ব্যবহার করেছিলেন। খেতুরি গরাণহাটি পরগণার অন্তর্গত বলে এই কীর্তনকে গরাণহাটি কীর্তন বলা হয়। এর কিছুকাল পরে শ্রীখণ্ডের উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রভাবে গরাণহাটি গানের উপর আরও বেশি মার্গসঙ্গীতের প্রভাব আসে ও মনোহরসাহী ঘরাণার কীর্তনের জন্ম হয়। এছাড়া আর দুটি বিশিষ্ট ধারা হল রেনেটি ও ঝাড়খন্ডী।

    লীলাকীর্তনে কৃষ্ণ ও চৈতন্যজীবনের বিশেষ কিছু ঘটনার বর্ণনা এবং তাদের আধ্যাত্মিক অর্থ ব্যাখ্যার তাৎপর্য আসে। সে হিসেবে, কীর্তনের লিরিক খুবই বৈচিত্র্যময়, তাতে পাঁচটি বিশেষ উপকরণ থাকে। সেগুলি হলঃ ১) কথা- এক পদের অন্যপদে যোগ সূত্রে হিসেবে ব্যবহার করা নায়ক/নায়িকা, দূতী বা সখীর উক্তি; ২) আখর- পদ বা পদাংশের ভাবব্যাখ্যার জন্য গায়ক মূল গান থামিয়ে, সুর ও বাজনার সঙ্গে তাল রেখে নিজের ভাষায় উক্তি করে যান। তবে সব ধরণের কীর্তনে আখর থাকে না; ৩) তুক- অনুপ্রাসবহুল ছন্দোবদ্ধ মিলন-গাথা। অনেক সময় পদের মাঝখানে তুক গাওয়া হয়; ৪) ছুট- ভারি তত্ত্ব বা লীলা ব্যাখ্যার মাঝখানে কীর্তনীয়ারা একটু হালকা ধরণের পদ সহজ ভাবে গেয়ে থাকেন; ৫) ঝুমর- কীর্তনের নিয়ম রাধাকৃষ্ণের মিলন গেয়ে শেষ করা। কিন্তু অনেক গায়ক থাকলে সবাই তো শেষ করতে পারেন না। তাই গায়কেরা নিজের অংশের শেষে এক দুই ছত্র ঝুমর গেয়ে মিলন বর্ণনা করেন।

    কীর্তন বাংলার সংস্কৃতির এক অসামান্য উপার্জন। শুধু সাংগীতিক বা কাব্যগুণ নয়, শুধু আধ্যাত্মিক বিকাশও নয়, বাংলার গণমানুষের যৌথজীবনযাত্রার একটা অনন্য উপাদান হয়ে থেকেছে কীর্তন। এবং নরোত্তমদাসের সমন্বয়ী প্রচেষ্টাও ছিল গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের বিভিন্ন যূথকে এক মঞ্চে আনার। আমরা সেই প্রচেষ্টার সাফল্যের নিদর্শন হিসেবে কীর্তনকে দেখতে পাই, যা আরেকদিক থেকে সাংগীতিক উৎকর্ষও পেয়েছিল।

    ঋণস্বীকারঃ
    বাঙ্গলা কীর্তনের ইতিহাস, হিতেশরঞ্জন সান্যাল
    লোকায়ত শ্রীচৈতন্য, তুহিন মুখোপাধ্যায়

    http://bookpocket.net এ পূর্বপ্রকাশিত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৯ মে ২০১৭ | ৪৪৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শিবাংশু | ***:*** | ২০ মে ২০১৭ ০৫:৪৮59691
  • মূল্যবান লেখা। ভালো লাগলো।

    কয়েকটি সংযোজন করি।

    নিমাঞি বা পরবর্তীকালের বিশ্বম্ভর ছিলেন বিদ্বান, তার্কিক, নৈয়ায়িক, শাস্ত্রবিশারদ অধ্যাপক। তখন তাঁর সখ্য মুরারি গুপ্তের সঙ্গে। সেখানে ভক্তিপ্রবণতার কোনও স্থান নেই। তাঁর সঙ্গে বৈষ্ণবদের তখনও কোনও হৃদ্যতা নেই। বৈষ্ণবরা তখন কার্যত নবদ্বীপে প্রায় অন্তেবাসী। তাঁদের মূলস্তম্ভ বলতে অদ্বৈত আচার্য। তাঁর বাড়িতে ব্যাকরণ-ন্যায়চর্চার সঙ্গে প্রত্যহ কীর্তনও হতো। অদ্বৈতের ব্যক্তিত্ব বিদ্যার্থীদের কৃষ্ণভক্ত করে তুলেছিলো। তখনও বিশ্বম্ভর সেখানে নেই। মুকুন্দদাস ছিলেন উত্তম গায়ক। অদ্বৈতসভায় প্রত্যহ কীর্তন গাইতেন। বিশ্বম্ভর তাঁকে দেখলেই ব্যাকরণ ও ন্যায়ের নানা কূট প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করতেন। শ্রীবাসকেও করতেন। সমাজের নানা স্তরের বৈষ্ণববিরোধীদের থেকে একা অদ্বৈত তাঁদের রক্ষা করতেন। ন্যায়ধর্মের কেন্দ্র নবদ্বীপে ভক্তিধর্মের সূচনা হচ্ছিলো শুধুমাত্র সমবেত সংকীর্তনের মাধ্যমে। সঙ্গীত দিয়ে দিয়ে গোষ্ঠীকে বেঁধে রাখার প্রক্রিয়াটি কিন্তু অতি প্রাচীন। বৈদিকযুগে সমবেত সামগান গেয়ে গোষ্ঠীর মধ্যে কামারাদোরির উন্মেষ ঘটানো হতো। সঙ্গীতের এই প্রয়োগ যতোটা ভক্তিমুখী, তার থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক।

    নবদ্বীপে বৈষ্ণবধর্মের প্রথম বৃহৎ উপক্রমটি শুরু হয় দাক্ষিণাত্য থেকে পুরী সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের আগমনের পর। অদ্বৈতের গুরু মাধবেন্দ্রপুরীর বিশ্বস্ত শিষ্য ঈশ্বরপুরীর নবদ্বীপে আসাটা একটি জলবিভাজক ছিলো। তিনি অবশ্য কুমারহট্টের লোক। ঈশ্বরপুরী মুকুন্দের কীর্তন শুনতে ভালোবাসতেন। বিদ্যাবিলাসী বিশ্বম্ভরকে ভক্তিবাদের দিকে আকৃষ্ট করার কাজটি করেছিলেন এই ঈশ্বরপুরী। বিশ্বম্ভরের মধ্যে তখন থেকেই একটা বড়ো টানাপড়েন শুরু হয়। তিনি সমুচ্চকোটীর ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে পড়েন। পাণ্ডিত্য প্রতিষ্ঠার টানে বঙ্গদেশ যাত্রা করেন। সেই কাজে সফল হয়েও কিন্তু তাঁর মধ্যে ভক্তিভাবের আধিক্য দিন দিন বেড়ে যায়। সেই সময় তপন মিশ্র তাঁর কাছে শাস্ত্রের কিছু কূট প্রশ্নের নিরসন করতে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু বিশ্বম্ভর তাঁকে সব কিছু ত্যাগ করে 'হরে কৃষ্ণ' মন্ত্র সংকীর্তন করতে বলেন। ভাগবতের 'কলৌনামৈব কেবলম' তত্ত্বের প্রতি তিনি তখন নিবেদিত।

    তবে সংকীর্তনকে কার্যকর রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে সফলভাবে প্রথম ব্যবহার করেন যবন হরিদাস। বিশ্বম্ভরকে কেন্দ্র করে নবদ্বীপে কৃষ্ণভক্তি আন্দোলনের সূচনা কীভাবে হয়েছিলো তার বিশদ বর্ণনা বৃন্দাবনদাসের লেখায় পাওয়া যায়। নবদ্বীপের অতি উচ্চস্তরের প্রাতিষ্ঠানিক শাস্ত্রচর্চাকে সরিয়ে ভক্তিচর্চার সমূহ প্রয়োগের প্রধান অঙ্গ ছিলো নিরন্তর সংকীর্তন। সত্যিকথা বলতে কী, বৈষ্ণবধর্মের প্রধানতম, সম্ভবত একমাত্র ধর্মীয় উপচার ছিলো সংকীর্তন। তবে একজন নিপুণ সংগঠক হিসেবে বিশ্বম্ভরের মাস্টার স্ট্রোক ছিলো নামসংকীর্তনকে নগরসংকীর্তনে রূপান্তরিত করা। " হরি হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ/ গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন", অদ্বৈতসভার এই নামসংকীর্তনকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন উচ্চ ও নিম্নবর্গ নির্বিশেষে সমস্ত জনতার মধ্যে। এই নগরসংকীর্তনের আবেদন ছিলো প্রায় পরবর্তীকালের 'ইন্টারন্যাশনালে'র মতো। নানা সূত্র থেকে শ্রীচৈতন্য সম্বন্ধে যা কিছু জেনেছি তার ভিত্তিতে তাঁকে একজন প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই মনে করি। তাঁর জীবন-মৃত্যু সব কিছুরই নিয়ন্তা রাজনৈতিক বস্তুস্থিতি। বাংলার ইতিহাসে তাঁর ব্যক্তিত্ব একটি জলবিভাজক বাস্তবতা।

    বৈষ্ণব, বাউল, ফকিরি, দেহতত্ত্ব, সহজিয়া, দরবেশি ইত্যাদি নানাস্রোতের লোকজ সাধনপদ্ধতির পারস্পরিক বিন্যাস ও তার সঙ্গে তাদের সাঙ্গীতিক এক্সপ্রেশন একটি বড়ো বিষয়। এখন থাক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন