প্রিয় বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে দেখি। প্রয়াত অজিত রায়ের একটি লেখা এখানে দিয়ে যাই। বইপোকা গ্রূপে লিখেছিলেন। লিস্ট হিসেবে ভালো ত বটেই, গদ্যকার হিসাবেও জুড়িহীন অজিত। (বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।)
===
আচ্ছা, আপনিও কি বলতে পারেন, পারেন কি এমন একটিও বইয়ের নাম লিখতে, বাংলা সাহিত্যের মেদভার লাঘব করার মতো একটিরও? বাংলা ভাষার এখনকার বড়-বড় নামচিন লেখকদের হাল সম্পর্কে আপনি নির্ঘাত ওয়াকিবহাল, চারপাশ জুড়ে গ্রামপঞ্চায়েত আর বিডিও অফিসের গণভোগ্য গল্প ডানা বিস্তার করে আছে, সেও আপনার নখদর্পণে। কেবল আমি জানতে চাইছি এমন একটি, দুটি, বা কিছু বইয়ের নাম, যেটি, বা যেগুলো অতীব রহস্যময়ী, হানা দেয়, কাছে টানে, ধর্ষণও করতে পারে, সব একেবারে ভুলিয়ে বাওরাবাতুল করে দিতে পারে, 'রঙ' এমন গাঢ় সারাটা জীবন ধূসর প্রজাপতি চোখের সমুখে ঝুলিয়ে ধরে রেখে দিতে পারে তায়েব মেহতার বন্দী লূলাপের আইকন যেমন! চাদ্ধারের পিঞ্জরে অবয়বহীন অজস্র লোকজন, মাঝখানে বীরবক্র পোজে দাঁড়িয়ে সে ---- রহস্যময়ী, হিরণ্যপ্রভা, নিরাবরণা ---- পরতে পরতে নির্মোচন তার অসৃগ্ধরার, রহস্যময়ীর, বন্দী মহিষিণীর কটিতট ও নৈঃশব্দের যোনিদেশ। তেমন সৃষ্টি কোনও? আসুন, দেখি, আমার বাতায় গুঁজে রাখা দু-একটা খুঁজে বের করতে পারি কিনা (হ্যাঁ, অবশ্যই 'গদ্য' হতে হবে) !
১. 'কপালকুণ্ডলা'
বাংলা উপন্যাসের পথ-চলার শুরুতেই মাত। প্রথম আঙ্গিক-সজাগতা, কী-লিখবো আর কীভাবে লিখবো-র বেহত্রিণ নমুনা। অননুকরণীয় শব্দকলাপ আর টেক্সট।
২. 'পিঞ্জরে বসিয়া শুক'
অন্য ভাষায়, সম্পূর্ণ অন্য ঢঙে, অন্য গাঁথুনিতে, অলৌকিক আলোর রঙে। আর কোনো বাংলা উপন্যাস এর পাদস্পর্শ করতে পারেনি। প্রুস্তের আয়তন স্রেফ না, এক প্রুস্তীয় আয়োজনও, এযাবৎ অনুচ্ছিষ্ট।
৩. 'এখন জীবন অনেক বেশি সতেজ স্বাস্থ্যে ভরা'
একমাত্র এই লেখকের পক্ষেই সম্ভব ছিল এমত লেখা, তিনিই একমাত্র, ছোট্ট একটি ঝিনুক দিয়ে খোকনবাবুর পুকুর সেঁচে ফেলায় যিনি ছিলেন অমিত এলেমদার।
৪. 'খোয়াবনামা'
নিছক বাস্তবতার রোমান্টিকতা নয়, বাস্তবতার বাস্তবতা। প্রত্যেক মানুষই, মানুষ-বিশ্বাসে বাস্তবতা, বাস্তবতার সূক্ষ্ম লহরী।
৫. 'কারুবাসনা'
জীবনানন্দের এই একটি উপন্যাস, যা খুঁড়লে আরও আরও জীবনানন্দ উদ্ঘাটিত হয়।
৬. 'আলালের ঘরের দুলাল'
বঙ্কিমযুগেরও আগে, সেই কুঁড়ি-ফোটা ময়ূরী সমবয়ঃ যখন, একদম খালিস আঁকাড়া রিয়েলিটি আর ঠকচাচা, আর, ওই অসংলগ্নতা ও অসম্পূর্ণতা, সেই তো প্রকৃত সিদ্ধি!
৭. 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা'
ভাষা বা ডিসকোর্স সময়ের বাহক হয়েছে, উঠে এসেছে মানবিক ভূগোল, এমন আর কটা? এ ভাষা বাংলা সাহিত্য ধরে রাখতে পারলে আরও স্প্রেড করত তার বাচ্চাদানি।
৮. 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'
বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রান্তশায়ী সমাজের এমন উজ্জ্বল প্রতিবেদন, আর্থ-সামাজিক চালচিত্রের সমীকরণ, একালের এনকোর রামকথা।
৯. 'ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংসভক্ষণ ও তাহার পর'
চালু দাঁড়ার প্রথাবহির্ভুত উপন্যাসের গৎ থেকেও এটমিক দূরত্বে, ঠাহর হয় বুঝি বিদেশি। 'গড় শ্রীখণ্ড' 'মধু সাধুখাঁ, এমনকি 'রাজনগর' আর 'মহিষকুড়ার উপকথা'কে মনে রেখেও, আমি এই বইটির কথাই বলবার মতো মনে করলাম।
১০. 'তিতাস একটি নদীর নাম'
মাটির মানুষ, মাটিঘেঁষা, মাটির সুগন্ধী গায়ে মেখে, প্রকৃত নয় হয়ত, কিন্তু যথার্থ একখানি।
১১. 'চাঁদের অমাবস্যা'
ফরাসি গন্ধেভরা, ওয়ালীউল্লাহর একেবারে সুররিয়ালিস্ট স্প্রে, বাংলা সাহিত্যে।
১২. 'অসাধু সিদ্ধার্থ'
লেখকের অন্তর্ভেদী অন্তর্দৃষ্টির এক বেপোট পৃথিবী, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের অন্তঃপুর আর বৃদ্ধা বেশ্যার শয্যা-সাথী, পাপ-পুণ্যের গণিতের বাইরে এক লাজবাব উপন্যাস।
১৩. 'স্বপনের ম্যাজিক রিয়ালিটি'
এক অবসকিওর লেখক, দীর্ঘ ও বিভ্রান্তিকর উন্মাদনার ঘোর কাটিয়ে ফিরে এলেন নতুন উদ্যমে, জীবনানন্দের লাইন তুলে এনে লিখলেন তৃতীয়-চতুর্থ-আরো সব আন্তর্জাতিক গ’ড়ে-ভেঙে-গড়ে দীপ্তিমান কৃষিজাত জাতক মানব, মহান সিংহও আসে যায় অনুভাবনায় স্নিগ্ধ হয়ে। অন্য এক তুঙ্গ, অন্য ভুবন, অন্য রবিন্দ্রীয়।
১৪. 'মফঃস্বলী বৃত্তান্ত'
লেখক, তাঁর স্থানকাল-ধৃত মানুষ, সাধারণ এক আমি আদমি বাংলা গদ্যসাহিত্যে গালিচা জুড়ে পেচ্ছাব করে যাচ্ছে, শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য, সমগ্র ডিসকোর্স জুড়ে প্রস্রাব করে যাচ্ছে, ওঃ, ভাবা যায় না!
১৫. 'রহু চণ্ডালের হাড়'
অভিজিৎ সেনের বিষয়বস্তুর অভিনত্ব ও গূঢ় গবেষণা। বাজিকর মাত্রেই জানে রহু চণ্ডালের হাড় কথাটাই ঐন্দ্রজালিক, বুজরুকি। তবুও যাযাবর বাজিকররা আজও খুঁজে ফেরে তাদের বীজপুরুষ রহু চণ্ডালের হাড়।
১৬. 'চতুস্কোণ'
পদ্মানদী বা পুতুলনাচ-কেও ছড়িয়ে যাওয়া উপন্যাস, পাশে বসার যোগ্য শুধু 'অহিংসা'র।
এতদ্ব্যতিরিক্ত, রবীন্দ্রনাথের গান আর কিছু প্রবন্ধ অবশ্যই এই সূচিতে ঢুকতে পারতো। বঙ্কিমের অন্তত রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল। পারতো 'পদ্মা নদীর মাঝি', এমনকি 'পুতুলনাচের ইতিকথা'ও, ধূর্জটিপ্রসাদের 'অন্তঃশীলা', বিভূতিবাবুর 'আরণ্যক', অমিয়ভূষণের 'রামী রজকিনী', তেমনি, অতি সম্প্রতিকালে শাহজাদ ফিরদাউসের 'ব্যাস', লোকনাথ ভট্টাচার্যর 'বাবুঘাটের সোনালী মাছ', নবারুণ ভট্টাচার্যর 'হারবার্ট', মলয় রায়চৌধুরীর 'নামগন্ধ', দেবজ্যোতি রায়ের 'নরকের থেকে এক টুকরো অনির্বচনীয় মেঘ', অরূপরতন বসুর বইটার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, হয়ত সুবিমল মিশ্রর একটি, শুভংকর গুহর 'বিয়োর', রণবীর পুরকায়স্থর 'সুরমা গাঙর পানি', অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্কিমচন্দ্র' এবং আরও কেউ কেউ নিশ্চিত বাদ পড়ে গেলেন, এই বইগুলোও কালের দহেলিজে ইতিমধ্যেই টোকা দিয়েছে, নিঃসন্দেহে। আর, কী বলি, জিব কেটেই বলি, একেবারে শেষের দিকে হয়ত আমারও অন্তত একটি বই জুড়ে দেওয়া যেত, কিন্তু নিজের অপ্রতিহত ব্যর্থতা আমারই শরণে থাক।
আমি যে কাল্ট-এর লেখক, বহুভোগ্যা বা গণভোগ্যা বই আমায় বিশেষ টানে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বহুপঠিত বই মাত্রেই ঝুল। বরং এ বিষয়ে আমার একটা সুনির্জন ভাবনা আছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবিটিও বারম্বার দেখলে তাতে আমাদের দৃষ্টি-গ্রহণ লেগে যায়। একটি ভালো লাগা বইয়ের ক্ষেত্রেও অমনটি হতে পারে। হয়ই। একসময় বিবমিষা জাগে, এমনও দেখা গেছে, সেই বইটিই তখন রদ্দির ভাওয়ে বেচে দিয়ে খালাস পেতে চাই আমরা। বহুপাঠে বইয়ের অভিপ্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তার স্রষ্টাও বিপন্ন হয়ে উঠতে পারেন। প্রথা-বহির্ভুত ভালো বই সাধারণ্যে প্রশংসা কুড়োতে থাকলে তার নন্দনতা মার খায়-ই। যে লেখক তাঁর সৃষ্টি বা রচনা মারফৎ পাঠকের সংবেদনকে একদিন নানান মাত্রায় উদ্ভাসিত রেখেছিলেন, তিনি আজ নিজেই উদ্ভিন্ন আর নিস্তেজ। এরপর সেই সৃষ্টিশীল ব্যতিক্রমী লেখকের জীবনেও নেমে আসে পুনরাবৃত্তির কালো গাদ, সেই গাদ গড়িয়ে গড়িয়ে লেখককে ক্রমশ কবরের দিকে নিয়ে যায়। সুনীল আলোয় চতুর্দিক ঢাকা পড়ে, পাঠকের আবার গড্ডালিকা যাত্রা শুরু হয়।