‘পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর’—একটি বহুকৌণিক ঐতিহাসিক আখ্যান : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ১৭ জুলাই ২০১৯ | ১৭৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
রসগ্রাহী পাঠকমাত্রেই জানেন, ঐতিহাসিক উপন্যাসকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে গেলে, তথ্যের খুঁটিনাটি ও সত্যতা-সম্পর্কে লেখককে কতখানি নিষ্ঠাবান হতে হয়। আমি আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে যতটুকু বুঝি, রাজর্ষি এই কাজে সম্পূর্ণ সফল। সপ্তদশ শতকের বাংলা, বিশেষ করে, সমতটের বাকলা-বাখরগঞ্জ থেকে, সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম হয়ে, আরাকান বা রাখান-দেশ অবধি বিস্তৃত ভূখণ্ডের ভুগোল ও ইতিহাস, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক আচার-ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, বাচনভঙ্গী, এমনকী নৌবিদ্যার খুঁটিনাটি বর্ণনাতেও, লেখকের মনোযোগ ও যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। অথচ, তথ্যের এমত প্রাচুর্য কখনও বাহুল্য হয়ে ওঠেনি। বরং, পটভূমির বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে, গল্পের চরিত্রগুলিকেও আরো বেশি রক্তমাংসের বলে মনে হয়েছে।
কৌশিক গাঙ্গুলির ‘সিনেমাওয়ালা’: একটি ব্যতিক্রমী ছবি : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ২৮ আগস্ট ২০১৬ | ২৯৬৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩৫
বিগত এক দশকের বাংলা ছবি (মানে, কাগজের ভাষায়, তথাকথিত "মননশীল" বাংলা ছবি) দেখলে একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, বাংলা সিনেমার সাথে আন্তর্জাতিক সিনেমার সম্পর্ক, যা সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক একদা স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, এখন প্রায় পূর্ণতঃ ছিন্ন হয়েছে। বাংলা সিনেমা, অধুনা, তার নির্মাণে ও মেজাজে, পরিপূর্ণ মধ্যবিত্ততার একটি পঙ্কিল আবর্তে পাক খেতে খেতে, একমনে, নিজেই নিজেকে ক্রমাগত ধ্বংস করে চলেছে। বিশ্বসিনেমার ভাষা যতই বদলে যাক না কেন, যতই জটিল হয়ে উঠুক না কেন তার অন্তর্গত আখ্যানের বুনন, বা সেই আখ্যানের সঙ্গে বহির্বাস্তবের লেনদেন ও টানাপোড়েন, বাংলা ছবি, তবুও, দৃশ্যের মাধ্যমে একটি নিটোল, নাটকীয় অথচ অন্তঃসারশূন্য গপ্প বলাকেই তার পবিত্র কর্তব্য ঠাউরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে ব্যস্ত থাকবে। এমনকী, ছবির ভাষা নিয়ে মাথা ঘামানো ছেড়ে, শুধু যদি এটুকুই প্রত্যাশা করি যে সেই গল্প, আদতে, মধ্যবিত্তের কোন গূঢ় আস্তিত্বিক সংকট বা জটিল স্ববিরোধকে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করবে, তাহলেও আশাভঙ্গের শিকার হতে হয়। কেননা, মধ্যবিত্তের হাঁচি-কাশি-টিকটিকি-প্রেম-অপ্রেম-আমাশার গল্পকে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, সভ্যতার সংকট হিসেবে উপস্থাপিত করাই, এখন তার নতুন দস্তুর। এবং এই অন্তঃসারশূন্যতাকে আড়াল করার জন্যে রয়েছে আরোপিত কেতা, যা, বস্তুতপক্ষে, ষাট-সত্তরের দশকের আভাঁ-গার্দ ছবির থেকে ধার করা, পরবর্তীতে মিউজিক ভিডিওর জমানায় ব্যবহৃত হতে-হতে বাসি মাংসে পরিণত হওয়া, ক্যামেরা বা সম্পাদনার কৌশলমাত্র। বিশ্বসিনেমার কথা বাদ দিলেও, কেবল যদি হিন্দি বা মারাঠী সমান্তরাল ছবির কথাই ধরি, তাহলেও বোঝা যায়, বাংলা সিনেমা ঠিক কোন গর্তে গিয়ে মুখ লুকিয়েছে।
ধর্ষণ ও নারীর দায় : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৫ জুন ২০১৮ | ১২৩৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
প্রতিদিন অজস্র বিজ্ঞাপনে এ-কথাই নানাভাবে বোঝান হচ্ছে যে, পুরুষের করায়ত্ত হয়ে তার যৌনকামনা মেটানোর জন্যে নারী সর্বদাই প্রস্তুত, দরকার কেবল সঠিক ডিওডোরান্ট, সঠিক মাউথ-ফ্রেশনার, অমুক দাড়ি কামানোর সাবান কিংবা তমুক জাঙিয়ার। অর্থাৎ নারী এবং যৌনতা, দুই-ই পণ্য, এবং বিক্রয়ের জন্য হাজির। অন্য নানা পণ্যের সঙ্গে এগুলোকেও কেনা যায়। ক্রেতব্য সাবানের যেমন কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা থাকে না, তেমনি ক্রেতব্য নারীর নিজস্ব ইচ্ছার প্রশ্নটাও অবান্তর। থাকলেও, তা চুক্তিভঙ্গের সামিল, এবং ক্রেতাসুরক্ষা দপ্তরে নালিশ ঠোকা যায়।
রাতের অন্যান্য পাখি : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : নববর্ষ ২০১৪ | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ | ৯৬৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
প্রায় গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি, এমন সময়ে পেছন থেকে লোকটির গলা কানে আসে। ফিরে দেখি, এদিকেই হেঁটে আসছে। ও ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। ওপর থেকে তার চেহারার প্রকৃত বিশালত্ব আন্দাজ করা যায় না। তাকে ছোটো, এমনকী, যথেষ্ট অসহায় বলে মনে হয়। তার হাঁটার ভঙ্গীতে ক্লান্তির ছাপ ফুটে ওঠে। আমি ঢালু জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকি।
“আমাকে দেখলে চিনতে পারবে? পরে?” ফেরার পথে লোকটি জিজ্ঞাসা করে।
আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ও চুপ করে থাকি।
“মনে থাকবে নিশ্চয়ই।” লোকটা মুখ থেকে অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে হাসে। অল্প কাশি হয়। সে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রাখে। ও ধীরে ধীরে সামলে নেয়।
একটি কুকুর হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছিল। হর্ণ দিতে ছিটকে সরে যায়। আমি আড়চোখে বাঁ-দিকে তাকাই। দেখি, চোখ বন্ধ। ও ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি লেগে আছে।
“ইটস নট ইজি, ইয়াং ম্যান। নট সো ইজি।”
তৃতীয় শিবির : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ | ১২৮২ বার পঠিত
স্বপন সিগারেট ফেলে দেয়। ও তারপর রনকে চুপুচুপি বলে, "তোকে বলা হয় নি আসলে। আমার সেইসব বইগুলো, উদয়নের 'আমি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে', কিংবা তুষারের 'শেষ নৌকা', সেগুলোও খুঁজে পাচ্ছে না কয়েকদিন হল। আর, আর আমাদের পত্রিকার পরের সংখ্যার প্রুফ, সেটাও . . .' দূরে গাড়ির আসা-যাওয়ার শব্দ এইখানে বেশ পরিষ্কার শোনা যায়। বৃষ্টি ধরে এসেছিল। আলো যৎসামান্য, ও হলুদ।
এখন স্বপন উঠে দাঁড়ায়। দুহাতে কোটটা ফাঁক করে ধরে। বলে, "আমি কিন্তু ছাড়ব না, রন। আই উইল ডেফিনিটলি প্রোটেস্ট। প্রোটেস্ট রন, প্রোটেস্ট। ইয়েস ইয়েস, প্রোটেস্ট। আমি, আমি এ নিয়ে আন্দোলন করব। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখব। সংসদে বিল আনব।"
ধংসস্তূপ: বিন্যস্ত ও সততই অমরত্ব পিয়াসী : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৮ আগস্ট ২০১০ | ১৫১৮ বার পঠিত
এইখানে স্পষ্টতই একটি বর্ষাদিনের ছবি ফুটে উঠতে দেখি। জলে প্রতিফলিত শহরের ছবি, হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে মেয়েদের সতর্ক চলে যাওয়া, বাসে ও রিক্সায়। সেইসঙ্গে, যদুবংশের আচমকা উল্লেখে একটি আসন্ন ধ্বংসের আঁচ লেগে থাকে। অথচ গোটা কবিতায় জল কিংবা বৃষ্টি এই শব্দগুলি অনুচ্চারিত থেকে যায় (যদিও বর্ষা শব্দটি, একবার হলেও, উঁকি মেরে গ্যাছে)। ও তার বদলে চরু শব্দের অনুপ্রবেশ লক্ষিত হয়। এই চরু, যা হতে পারে জল, হতে পারে বৃষ্টি অথবা অন্য কিছু। সব মিলিয়ে প্রতীকের ব্যাবস্থাটাই এখানে উল্টেপাল্টে যায়। সিগনিফায়ারগুলি নিজেদের জায়গা বদল করতে থাকে অবিরল। এক নতুন শব্দব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান লেখক।
ও লেখক নিজেও এ ব্যাপারে অবহিত থাকেন আগাগোড়া। সে জন্যেই কথা কবিতায় লেখা হয় এইসমস্ত লাইনগুলি
নৈহাটি-গরিফা শিল্পাঞ্চল ঃ প্রদীপের নিচে অন্ধকারের একটি পুরোন কিসসা : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৯ মে ২০০৯ | ৭০৪ বার পঠিত
এই কয়েক মাস আগে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে টাটার শহিদোচিত প্রস্থানের পর যখন সারা-রাজ্য "হায় টাটা! হায় ত্রাতা!' এইরকম বিলাপের মধ্যে দিয়ে কেঁদেও কূল পাচ্ছে না, তখন একে একে বন্ধ হয়ে গেছিল বা যেতে বসেছিল নৈহাটি-গরিফার কারখানাগুলি, আমরা জানতেও পারিনি। অবিশ্যি এই বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলি টাটা-র ন্যানো প্রজেক্টের মত অতখানি হাই-প্রোফাইল ছিল না -- নিতান্তই মামুলি কিছু জুটমিল, রঙের, কাগজের কারখানা, বা এইরকম আরো কিছু ছোট-বড় মিল-ফ্যাক্টরি।
যৌনতা ও রাজনীতিঃ এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে? : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ৩০ আগস্ট ২০০৯ | ৮১৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
যৌনতার সঙ্গে রাষ্ট্রের (বা, বলা ভালো, ক্ষমতার) সম্পর্কটা সবসময়েই জটিল এবং, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এরা একে অপরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে ও নিজেও ব্যবহৃত হয়, বুঝে বা না-বুঝে। আবার সেই যৌনতা যদি প্রথাবিরুদ্ধ হয়, যদি তা হয় সমকামিতার মতো একদা-অপরাধ, তাহলে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু শুধুই কি সংঘাত? আর সেই সংঘাতও কি কেবল দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতার সঙ্গেই? তথাকথিত বামপন্থী উদারতাও কি বেমালুম হজম করে নিতে পারে যৌনতার ব্যতিক্রম বা ব্যতিক্রমী যৌনতা? না কি তাকেও ঢোঁক গিলতে হয়, যুঝতে হয় নিজের অন্তর্গত স্ববিরোধগুলির সঙ্গে?
বসন্তের জানলা দিয়ে : শৌভ চট্টোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : উৎসব ২০১২ | ০২ নভেম্বর ২০১২ | ৮৮৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
শহর থেকে অল্প দূরেই যে একটি চমৎকার হ্রদ রয়েছে, এ আমি অনেকদিন অবধি জানতাম না। হারুণের মুখে প্রথম যখন এর কথা শুনি, তখন থেকেই জায়গাটির প্রতি আমার এক অদম্য আকর্ষণ জন্মায়। ও সেখানে না-যাওয়া অবধি য্যানো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
তখন বসন্তকাল। যদিও শহরে তা নামমাত্র। কাজের চাপ তেমন না থাকায় আমরা প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই (রোববার বাদে) সদর স্ট্রিটের এই ছোটো পানশালায় জমায়েত হই। আমরা বলতে আমি, হারুণ, অরূপ আর মাস্টার। পানশালাটির নাম ‘সলিটেয়ার’। ও সেখানকার ওয়েটাররাও আমাদের চিনে ফেলেছিলো। ঘন্টাদুয়েক গল্পগুজব করে আমরা যে যার বাড়ি ফিরতাম।
তো এখানেই একদিন হারুণ হ্রদটির কথা আমাকে বলে। সে এও জানায় যে, শহর থেকে ওই হ্রদের দূরত্ব মাত্রই মাইল কুড়ি। কিন্তু নিকটে হলেও, ঘন সবুজ গাছপালায় ঘেরা, অনুচ্চ টিলাবেষ্টিত অধিত্যকাটির সৌন্দর্য না কি প্রায় অপার্থিব। সে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
তার এই কথায় বাকি সবাই সায় দ্যায়। আমি বলি যে, তাদের সৌভাগ্যে আমি ঈর্ষান্বিত। আগে জানলে আমিও নিশ্চয় এতদিনে হ্রদটি দেখে আসতুম