মরণ-ঝাঁপ ও জনগণেশ : পরিমল ভট্টাচার্য
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ | ১২৯৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ২৩
বিগত আড়াই দশক ধরে এই রাজ্যে সরকারের ভ্রান্ত নীতি আর ব্যবসায়িক পুঁজির যুগলবন্দীতে সরকারি স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রমশ পঙ্গু করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রমরমা হয়েছে। বলা বাহুল্য, তাতে পৌরহিত্য করেছে সংবাদমাধ্যমের একাংশ, সমাজের বিপুল অংশের মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারে সহমত নির্মাণ করেছে। (তাতে পুরোহিতের ছাঁদার যোগান নিশ্চিত হয়েছে, সেটা বিজ্ঞাপনের পাতায় চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়।) মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্ন আয়ের মানুষেরাও আজ এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন এই বেসরকারি ব্যবস্থার কাছে যেতে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে দানা বেঁধে উঠছে অনিশ্চয়তা, স্নায়ুচাপ, ক্ষোভ।
দমদমে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনা এই জটিল পরিস্থিতির ইঙ্গিতবাহী। যে চা-দোকানি মেয়েকে সরকারি অবৈতনিক স্কুলে না পাঠিয়ে আয়ের সিংহভাগ খরচ করে পাড়ার নামজাদা মিশনারি প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠাচ্ছেন, আর যে মাংসবিক্রেতা টাকার অভাবে ভাইঝিকে পাঠাতে পারলেন না, যে মধ্যবিত্ত গৃহবধূ স্কুলের দিদিমণির কাছে মেয়েকে টিউশন পড়তে পাঠিয়েছেন “স্পেশাল কোচিং” – এর আশায়, আর যে বস্ত্র ব্যবসায়ী ফি বছর স্কুলে মোটা টাকা ডোনেশান দেন মেয়েকে “স্পেশাল অ্যাটেনশন” -এর লোভে, যে অভিভাবক সেটা দিতে পারেন না, আর যে ছোকরা বিপিও কর্মচারী চোখ শানিয়েছে স্কুল ছুটির পর স্কার্টের নীচে কিশোরী হাঁটু দেখে ... এরা সকলেই ভেতরে এক-একটি কালো চোরা স্রোত পুষে অপেক্ষা করে থাকে, আর একদিন একটি মর্মান্তিক ঘটনা, সেই ঘটনাকে ঘিরে রটনা, এই সব স্রোতগুলোকে মিলিয়ে দেয়। আর সবাই ইটপাটকেল নিয়ে জড়ো হয় দিনভর লাইভ সম্প্রচারিত উন্মত্ত জনগণেশের পুজোয়।
রূপকথার নটেগাছ মুড়োয় না : পরিমল ভট্টাচার্য
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৬ আগস্ট ২০১৩ | ৪২৭৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬৩
-দুনিয়ার সেরা ইঞ্জিনিয়ারেরা বসে এমন একটা জায়গা বানিয়ে দিতে পারবে? এখানে যে জড়িবুটি হয়, তাই খেয়ে আমাদের বাপদাদা পরদাদারা বেঁচেছে, আমরা বাঁচছি, আমাদের ছেলেপুলে নাতিপুতি বাঁচবে। কিন্তুই খাদান হলে? যা বক্সাইট আছে সেটা তুলে ফেলতে নাকি পঁচিশ বছর লাগবে। তারপরে কী হবে? পঁচিশ বছরের জন্য কশো বছর বন্ধক রাখব আমি?
কুমুটি মাঝির গলায় ছিল অনাগত প্রজন্মের ভার। অস্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তাঁর মুখে। পায়ের কাছে গর্তগুলো চেয়েছিল অক্ষিবিহীন কোটরের মতো। বনে কোথাও একটা কাঠঠোকরা ঠক ঠক করে শব্দ করছিল।
আপাতত ভবিষ্যৎ বন্ধক রাখতে হবে না কুমুটি মাঝিদের। তবে, "তারপর তারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল" - রূপকথার এই শেষ লাইন লেখার সময় আসেনি এখনও। নিয়মগিরি পাহাড়ের নীচে লাঞ্জিগড়ে রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার রিফাইনারি, তার জঠরে খিদে, পাহাড়ের গা বেয়ে কনভেয়ার বেল্ট করিডোর পড়ে আছে অজগরের মতো।
রূপকথার শেকড়বাকড় : পরিমল ভট্টাচার্য
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ২০ আগস্ট ২০১৩ | ১৭২৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১৫
বর্ণ গন্ধ ধ্বনির এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেক্ষাপটটা জরুরি। না হলে সব উন্নয়ন বিতর্কই শেষ পর্যন্ত মাথা কোটে অসার নাগরিক তাত্ত্বিকতার আবর্তে, “কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতেই হয়” জাতীয় বুলিতে। যারা পাচ্ছে, তাদের যে কিছুই হারাতে হচ্ছে না, আর যারা হারাচ্ছে তারা যে পাচ্ছে না কিছুই – আবহমান এই নির্মম সত্যিটা খোদাই হয়ে থাকে একটি যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে, একটি নীরব চোখের ভাষায়, একটি ঠোঁটের কুঞ্চনে। তেমন এক মুখের সামনে এসে মুখোমুখি বসতে হয়। ঠিক তেমনই একটি পাহাড়ের মাথায় এক স্বচ্ছ শীত অপরাহ্ণে, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বনটিয়ার ঝাঁক আর কাঠঠোকরার ঠক ঠক শব্দে, আর্দ্র বনজ গন্ধে তিরতিরে ঝর্নার ধ্বনিতে, প্রতিভাত হয় ধর্মস্থানের সংজ্ঞা। পুরাণকথার নায়কের আঁতুড়ঘরের হালহদিশ নিয়ে যখন দেশ পোড়ে, সাম্প্রদায়িকতার দাঁতনখ শানিয়ে ওঠে, তখন এক কন্ধ রমণীর বাচন – “ তুমো মন্দির ইটা বালি রে তিয়ারি, আমো মন্দির গাছা লতা পাথরো ঝরনা জন্তু রে!” - ঝোড়ো হাওয়ার মতো আমাদের সনাতন দেবালয়ের পোড়ো দরজাটা সমূলে নাড়িয়ে দেয়।
প্রলাপ, অথবা ... : পরিমল ভট্টাচার্য
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৪ এপ্রিল ২০১৬ | ৯১৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
আর আমাদের এখানে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কারা যেন একটা মড়া ফেলে রেখে যায় রাস্তায়। পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আমার রাস্তার দিকের জানলা বন্ধ করে দিই। দমবন্ধ করে অপেক্ষা করি, কখন এলাকার লুম্পেন মস্তানটা আসবে চোলাইয়ের ঠেক ফেরত, লাশটার পায়ে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে ফেলে আসবে খাল পাড়ের ঝোপে। লাশের সদগতি হবে। তার জন্য অবশ্য গুনাগার দিতে হবে পাঁচ বছর ধরে। তা হোক, বাতাসে পচা দুর্গন্ধটা অন্তত কাটবে কিছুকাল।
খোয়াবনামার ভাষ্যকার : পরিমল ভট্টাচার্য
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৮ জুলাই ২০১৬ | ১৫৪০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২২
অবশ্য তাতে তাঁর কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। কারণ তিনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, আজ থেকে কয়েক দশক পরে যখন পূর্ব কলকাতার এই জলাভুমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যখন এই শহরটাও আর বাসযোগ্য থাকবেনা, তখন ঠাঁইনাড়া মানুষ তাঁর লেখা পড়ে জানবে এই আশ্চর্য বাস্তুতন্ত্রের কাহিনি। এও এক সত্যি রূপকথা।
সত্যিই কি তাই হবে? সত্যিই কি আন্তর্জাতিক রামসর স্বীকৃতি পাওয়া এই জলাভূমি সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে?
আমি জানি না। আমি কেবল স্বপ্ন দেখতে পারি।
আমি স্বপ্ন দেখি, তাঁকে মাথায় রেখে গড়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট, যেখানে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিয়ে হাতেকলমে গবেষণা করছে ছাত্রছাত্রীরা। দেশ বিদেশের বিভিন্ন শহর থেকে প্রতিনিধি দল আসছে এই মডেল রূপায়ণের জন্য। রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা আসছে শিক্ষামূলক ভ্রমণে ।
আমি স্বপ্ন দেখি, এই জলাভূমি মুক্ত রাখার জন্য এক বিশাল মিছিল, যাতে পা মিলিয়েছে সেই তরুণ প্রজন্ম যারা সেদিন ক্যাম্পাস মুক্ত রাখার জন্য পথে নেমেছিল।
এবারের বইমেলার থিম কান্ট্রি হয়েছে রাস্তার অন্য পারে পূর্বকলকাতার জলাভূমি, আমি স্বপ্ন দেখি, বিশাল মাল্টিমিডিয়া প্যাভিলিয়ান। হাতুড়ি ঠুকে মেলার উদ্বোধন করছেন জলাভূমির একনিষ্ঠ ভাষ্যকার।
কলকাতার নতুন লোগোয় হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া আর শহিদ মিনারের বদলে এখন থেকে জলজমিনের ছবি।
প্লাবনভূমি : পরিমল ভট্টাচার্য
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ৩১ আগস্ট ২০১৭ | ১৪৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের পর সেই ইতিহাসটা আবার রিপিট হল। দুর্ভাগা এই রাজ্য! এমনিতেই জমি বাড়ন্ত, ব্যবসাবাণিজ্য সব চলে যেতে শুরু করেছে তখন, কলকারখানাগুলো ধুঁকছে। তার ওপর এসে আছড়ে পড়ল এই বিপুল মানুষের ঢেউ। ফের একটা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শামিল হওয়া। তারপরে তো ক্ষমতায় এল পার্টি। অপারেশান বর্গা হল। দশটা বছরে ভূমিহীনদের মধ্যে যত পাট্টা বিলি হয়েছে, স্বাধীনতার পর এতগুলো বছরে সারা দেশে আর কোথাও হয়েছে কি? খোঁজ নিয়ে দেখো। যদিও সেটা শেষ কথা নয়। সেটা হতে পারত একটা শুরু। হল না।
কিন্তু মেজকা, ভূমিসংস্কার করতে গিয়ে গ্রামের আসেপাশে সব পতিত নাবাল জলা জংলা জমিগুলোকে খাস করে নেওয়া হল। ওর মধ্যে কিন্তু নদীর প্লাবনভুমিও ছিল, বছরের পর বছর পড়ে থাকত ওড়কলমি শেয়াকুল বনডুমুরের ঝোপঝাড়ে ভরা। সবার জন্য অবারিত - গ্রামের আতুরি বুড়িরা পাতালকোঁড় হিঞ্চে-ব্রাহ্মী-গিমে শাক শাপলা তুলে নিয়ে বাজারে আসত। পুজোপার্বণে গরীবগুর্বো মেয়েবউরা তুলে আনত আকন্দকুঁড়ি ধুতরোর ফুল, দুর্ভিক্ষের সময় গেঁড়িগুগলি। পাঁচ-দশ বছরে একবার বড়োসড় বন্যা হলে জলে ভরে গিয়ে বসতিগুলোকে বাঁচাত, কিন্তু ...