দেবকী বসুর 'কবি' - একটি অটেকনিকাল পাঠ (নবম কিস্তি) : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ২৫ এপ্রিল ২০১১ | ১৫৮৫ বার পঠিত
ঠাকুরঝির উপর ওঝার অত্যাচারের তীব্র সঙ্কটের মুহূর্তে, রাজনের প্রশ্নে, সে উত্তর দেবে, হ্যঁ¡, সে ঠাকুরঝিকে ভালবাসে, কিন্তু সেই বাক্যেও থাকবে একটা "কিন্তু'। এই "কিন্তু' বেয়ে সে চলে যাবে, "জাত', "ঘর' ইত্যাদি প্রশ্নে। তার নিজের বাসনার একটা পরোক্ষ উল্লেখ থাকবে, যখন নিতাই রাজনের কাছে বলবে, বৃন্দাবনের ঘর সে ভেঙে দিতে চায় না, তাহলে বৃন্দাবনের বুকে সেই একই ব্যথা বাজবে, যা তার নিজের হচ্ছে। এই বেদনা হচ্ছে কেন? বাসনা অপরিপূরণে। তাই এই ভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে নিতাইয়ের বাসনা। কিন্তু তাও দেখুন, "জাত', "বিয়ে' বা "ঘর' ইত্যাদি সামাজিক ভাবে প্রদত্ত ধারণার নিরিখে। মুক্ত স্বতন্ত্র একটি ব্যক্তির নির্জলা বাসনার আকারে, যে ভাবে এসেছিল ঠাকুরঝির উচ্চারণ, আদৌ সেটা আসে না পুরুষ-অবস্থান থেকে। এই জায়গাটা বারবার ভাবায় আমায়, সামাজিক অভিজ্ঞতার নিরিখেও। আমার মনে হয়, সিমোঁ দ বোভোয়ার নিতান্ত ভুল দিয়েছিলেন বইয়ের নামটা। নারী সেকেন্ড সেক্স নয়, ফার্স্ট সেক্স। প্রথম লিঙ্গ নারী। যেখান থেকে নারী বা পুরুষ দুই লিঙ্গই জন্মায়। আমার ভীষণ ঈর্ষা হয় নারী অবস্থানকে, যে জন্ম দেওয়ার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। একটিও মৌলিক পুরুষ অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা নেই যা নারীর হতে পারে না কিছুতেই। কিন্তু দুটি মৌলিকতম অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি নারীর আছে যা কিছুতেই পুরুষের হতে পারে না। এক, গর্ভধারণ ও জন্ম দেওয়া। আর দুই, স্তন্যপান করানো।
দেবকী বসুর 'কবি' - একটি অটেকনিকাল পাঠ (দশম ও শেষ প্রবাহ) : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ৩০ মে ২০১১ | ১৬৭৬ বার পঠিত
অন্য কথায় চলে যাচ্ছি, "কবি'-তে ফেরা যাক। কুসংস্কারমুক্ত সীতা থেকে ন্যাশনাল সে?শালিস্ট মহান্ত - পিতৃতন্ত্র এভাবেই দিন কাটাচ্ছিল। এর মাঝখানে বাড়তে শুরু করল মুচি রাজন ডোম নিতাই আর ভোজপুরী মজুর বালিয়ার বাস্তবতা। "কবি' চলচ্চিত্রের জোরটা এইখানে যে সে এই অন্য বাস্তবতাটাকে নিয়ে এল সেই একই পিতৃতন্ত্রের কাছে। দর্শক তো সে-ই যে তারাশঙ্করের পাঠক ছিল, কিন্তু দর্শনীয় গেল নড়ে। যতটা নড়ার সম্ভাবনা ছিল উপন্যাস "কবি'-তে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি করে। তারাশঙ্করের অন্তর্বিরোধ, তাঁর লেখাতেই মহান্তের যে নীল চশমার কথা পেলাম, সেই নীল চশমা দিয়ে তিনি যে নিজেই দেখছেন, তাঁর শিল্পীসত্তার সমস্ত পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কারের পরও, তার অবস্থানই তার চোখে ওই চশমাটা গুঁজে দেয়, এই জায়গাটাই আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে "কবি' চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে। লেখাটা এবার ক্রমে গুটিয়ে আসছে। চলচ্চিত্রে আমরা পৌঁছেছি পঁয়ত্রিশ মিনিটের কিছু বেশি, তার মানে মোট দৈর্ঘের এক তৃতীয়াংশেরও কম। এখনও পরপর দৃশ্য ধরে, উপাদানগুলোকে পরপর স্পষ্টতায় নিয়ে আসাই যায়। কিন্তু কোনও নতুনতর দৃষ্টিকোণ নয়, তা হবে এতক্ষণ ধরে তুলে আনা দৃষ্টিকোণগুলো দিয়েই বারবার আলাদা আলাদা উপাদানকে দেখানো। এবং সেটা এখন আপনারা নিজেরাই করে চলতে পারবেন। আমি এই লেখাটা শুরু করেছিলাম, দেবাশিসের মত আমার ছাত্রস্থানীয় কারুর কারুর জন্যে, কেন "কবি' চলচ্চিত্রটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝাতে, ওই নানা সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণগুলো সামনে ধরে দিতে। সেগুলো এতক্ষণে মাথায় বসেই গেছে। এর পরেই আসছে নিতাইয়ের নিমন্ত্রণ, মহাদেব কবিয়ালের কাছ থেকে, দিন প্রতি ছয় টাকা বায়নায়। টাকাটাকে বাজারদরের সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন, মনে করুন, মেলায় এসে যে মালাটা দর করেছিল ঠাকুরঝি, তার খুব বেশি দাম মনে হয়েছিল, সেটার দাম ছিল ছয় পয়সা। এই প্রথম অর্থনৈতিক রকমে সেই স্বীকারটা এসে পৌঁছতে শুরু করল, যেটা এতক্ষণ আমরা সাংস্কৃতিক রকমে দেখছিলাম।
দেবকী বসুর 'কবি' - একটি অটেকনিকাল পাঠ (অষ্টম কিস্তি) : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ১৪ মার্চ ২০১১ | ১২৭৮ বার পঠিত
চলচ্চিত্রেও এই বাক্যের আগেই একাধিকবার দেখেছি আমরা বৃন্দাবনকে ঠাকুরঝির প্রতি একটা সস্নেহ প্রশ্রয় নিয়ে একটা আগলে রাখার ক্রিয়ায়। তাই কোনও অসুখী দাম্পত্য থেকে যে পরিপূরণের বা ক্ষতিপূরণের মত করে নিতাইয়ের প্রতি ঠাকুরঝির আগ্রহ এসেছিল তা নয়, এসেছিল ওই যাদু-উপাদান থেকে, ""কই এমনি মুখে মুখে বেঁধে গান করুক দেকি?'' এর পরের কিছু বাক্যেও একাধিকবার এসেছে "কবি' নিতাইয়ের প্রতি ঠাকুরঝির এই বিস্ময়। পরেও এসেছে। নিতাই একটা কিছু পারে যা সাধারণ নয়, অন্যরকম। নিতাইয়ের সেই অন্যরকমত্বটাকে গোড়া থেকেই সম্মান দিয়ে আসছে কেবল দুইজন, রাজন আর ঠাকুরঝি। ঠাকুরঝি তাকে সবসময়েই ডাকে "কবিয়াল' বলে। "কবি' উপন্যাসে যেমন, চলচ্চিত্রেও তেমনি, কবিকে গোড়া থেকেই কবি বলে চিনে আসছে ঠাকুরঝির এই প্রেম। বারবার ঠাকুরঝিকে নিয়ে বাঁধা পংক্তি চলে আসছে কবিগানে, "ছটায় ছটায় ঝিকিমিকি তোমার নিশানা' বা "কাল যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে' এই দুই গানেরই আবিষ্কারের আধার ঠাকুরঝি। আমরা পরে দেখব, এই গানগুলি এতটাই ব্যক্তিগত ঠাকুরঝির কাছে যে নিতাই সেটা কবিগানের আসরে গাওয়ায় ঠাকুরঝি তাকে মন্দ লোক বলে ডাকবে। আমি এটা বলতে চাইছি না যে দাম্পত্য অসুখ থেকে সঞ্জাত প্রেম প্রেম হত না, এটাই বলতে চাইছি যে এই প্রেমটা বরং একটা বাড়তি কিছুর দ্যোতক, চিহ্নিত করছে কবিয়ালের কবিগান গাওয়ার ওই বাড়তি ক্ষমতাকে।
দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ (সপ্তম কিস্তি) : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ১২২৫ বার পঠিত
প্রথমে চলচ্চিত্রে প্রসঙ্গটা কিভাবে এল সেটা দেখে নেওয়া যাক। প্রথমে রাজনের মন্তব্যে ইঙ্গিত আছে সেই অতিনির্ণয়ের, আগেই যেটা আমরা দেখেছি, আধুনিকতার পেশা থেকে জীবিকা অর্জন আর ঐতিহ্যের সক্রিয়তা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেটা নয়, কৌতূহলটা অন্য জায়গায়। এই একমাত্র জায়গা "কবি' চলচ্চিত্রের যেখানে খুব স্পষ্ট একটা নির্মাণের গরমিল পেয়েছি আমি, এবং যা একটুও ছিল না "কবি' উপন্যাসে। এতটাই বেমানান লেগেছে এটা অবশিষ্ট চলচ্চিত্রটা তৈরির সুচারু সুপরিকল্পিত রকমের সঙ্গে যে, "কবি' চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনও কেউ যদি আজও বেঁচে থাকেন, এবং তার স্মৃতিতে থেকে থাকে এই খুঁটিনাটি তো সেটা আমি জানতে আগ্রহী। গরমিলটা কোথায় সেটা আগে দেখে নেওয়া যাক উপন্যাস থেকে।
দেবকী বসুর 'কবি' , ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ (ষষ্ঠ কিস্তি) : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ১৩৭৬ বার পঠিত
সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর এই তিন যুগে তপস্যা ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণকেই আশ্রয় করিয়াছিল। কিন্তু এই তিন যুগে শূদ্রের তাহাতে অধিকার হয় নাই। এই নীচ বর্ণ ভবিষ্যতে ঘোরতর তপস্যা করিবে। কলিযুগই তাহার প্রকৃত সময়। শূদ্রজাতির দ্বাপরে তপস্যা করা অতিশয় অধর্ম। সেই শূদ্র আজ নির্বুদ্ধিতাবশত: তোমার অধিকারে তপস্যা করিতেছে। সেই জন্য এই বিপ্রবালক অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে।
রাজা রাম তখন এর নিরসনে গেলেন পঞ্চসপ্ততিতম সর্গে। কোথায় ঘটছে এই শূদ্রের তপস্যা তার তদন্তে গিয়ে রাম শেষ অব্দি খুঁজে পেলেন।
দেখিলেন শৈবল পর্বতের উত্তর পার্শ্বে একটি সুপ্রশস্ত সরোবরের তীরে কোন এক তাপস বৃক্ষে লম্বমান হইয়া আছেন এবং তিনি অধোমুখে অতিকঠোর তপস্যা করিতেছেন। তদ্দৃষ্টে রাম তাঁহার সন্নিহিত হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, তাপস! তুমি ধন্য, বল, কোন্ যোনিতে জন্মিয়াছ।
ষট্সপ্ততিতম সর্গে আমরা পাই কাহিনীর শেষটুকু।
দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ (পঞ্চম কিস্তি) : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ১৭ জানুয়ারি ২০১১ | ১১৯৪ বার পঠিত
মহাদেব কবিয়ালের গানে এর পরবর্তী অংশে যে প্রসঙ্গগুলি এসেছে তার দু-একটা এখানে উল্লেখ করে রাখি। এর পরেই মহাদেব কবিয়াল উল্লেখ করবে নিতাইয়ের জাত-ব্যবসার কথা। সেটা বলতে এখানে চুরি-ডাকাতির কথা তুলেছে মহাদেব। যেমন নিতাইয়ের বাবার কথা বলেছে সে, সিঁদ কেটে বাড়ি বাড়ি চুরি করত, বা তার ঠ্যাঙাড়ে ঠাকুর্দার কথা, এবং তার মায়ের বাবার কথাও যে কিনা দ্বীপান্তরে মরেছে। এছাড়া নানা জায়গায়, ডোমদের আর একটা পেশা ছিল শ্মশানে। ডোমদের এই ধরনের পেশাগুলির একটা ইতিহাস ছিল। বাংলার সামাজিক ইতিহাস নিয়ে কোনও খুব স্পষ্ট মতামত দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু নানা সময় যা কিছু শুনেছি বা পড়েছি, তার থেকে এইটুকু মাথায় আসছে যে, বোধহয় ব্রিটিশ আমলে ডোমদের এইসব অপরাধ ও মৃত্যুকেন্দ্রিক পেশার সূচনা প্রাকব্রিটিশ বাংলায়। সেখানে ডোমরা ছিল একটি যোদ্ধা জাতি। বিভিন্ন রাজার হয়ে যুদ্ধ করত এই ডোমরাই। এই ইতিহাসই বোধহয় ধরা আছে ওই ছেলেভোলানো ছড়ায়: "আগে ডোম, বাগে ডোম, ঘোড়াডোম সাজে'। আগে এবং পিছনে ডোম সৈন্যদের নিয়ে, অশ্বারোহী ডোম যোদ্ধাদের নিয়ে, "ঢাক মেঘর ঘাঘর' ইত্যাদিতে যুদ্ধের বাজনা বাজাতে বাজাতে যুদ্ধে যেতেন তখনকার বাংলার রাজারা। তারপর রুল ব্রিটানিয়ার দোর্দণ্ডপ্রতাপে, রাজশেখরের ভাষায়, "আন্ডার দি সুদিং ইনফ্লুয়েন্স অফ দি বিগ রড', রাজারা ভ্যানিশ, রাজায় রাজায় যুদ্ধও ভ্যানিশ। ফলত বহু জায়গাতেই ডোমরা তাদের যুদ্ধবিদ্যা সম্পৃক্ততা থেকে সহজেই রত হল চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি পেশায়। ডোমদের যেটা পোষাকি নাম, "রাজবংশী' বা "বীরবংশী', যার একটি মহাদেব কবিয়ালের গানে এর পরেই এসেছে, অন্যটিও এসেছে চলচ্চিত্রের অন্যত্র, তারও শিকড়টা তাই রাজা বা বীর, যা এদের সেই লুপ্ত হয়ে যাওয়া পেশাকেই চিহ্নিত করে।
দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ (চতুর্থ কিস্তি) : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ১০ জানুয়ারি ২০১১ | ১৪২১ বার পঠিত
সেই যে রেলের প্রসঙ্গ থেকে শরত্চন্দ্র আসতে শুরু করল, বারবার মাথায় এসেই যাচ্ছে এগুলো। এই বাবুর শরত্চন্দ্র সংস্করণটা মনে পড়ছে? এলএ পাশ করার পর ডেপুটি হওয়ার অপেক্ষারত নতুনদা? নতুনদা নামে যদি মনে নাও পড়ে, পাম্পশু থেকে নিশ্চয়ই পড়বে। এই বাবুটিরই নিকট কেউ হওয়ার সম্ভাবনা আছে নতুনদার। নভেম্বর বিপ্লবের বছরে শ্রীকান্ত ছাপা, তার বেশ কিছু বছর আগে ঘটেছিল নতুনদা উপাখ্যান, শ্রীকান্তর কিশোর বয়সে। ১৯০০ সালে শরত্চন্দ্রের বয়স ১৪, তার মানে ১৯০২ নাগাদ ধরে নিতে পারি নতুনদা মাঘের শীতে বরফশীতল নদীর জলে ডুব দিয়ে বসে কুকুরের হাত থেকে বেঁচেছিলেন, তখন যদি তার বয়স বাইশ-চব্বিশ ধরে নিই, তাহলে ১৯৩৮-এ তার বয়স প্রায় ষাট। তাহলে তারাশঙ্করের এই বাবুটির পিতা তিনি হতেই পারেন। এবং এই বংশধারা তো আবহমান ছিলই। শ্রীকান্তর বন্ধু ইন্দ্রর দাদা নতুনদা উপাখ্যান অন্তে একটি অনাবিল অপ্রতিরোধ্য ভাঁড়ে পর্যবসিত হয়েছিলেন, কিন্তু সে তো শরত্চন্দ্রের পোয়েটিক জাস্টিস, কাব্যিক ন্যায়বিচার, আদতে ঘটনাটা ছিল এই যে, যদি এমনকি ভাঁড় হয়েও থাকে, সেই ভাঁড়ই, সেইরকম ভাঁড়েরাই, ফিরে গিয়ে ডেপুটির চাকরি পাবে, ইন্দ্র জানিয়েছিল শ্রীকান্তকে।
দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ : প্রথম কিস্তি : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ২৩ নভেম্বর ২০১০ | ১৪৬৩ বার পঠিত
সত্যিই "কবি' ফিল্মটা আমার বিরাট একটা কিছু লেগেছে। তুলসী চক্রবর্তীর অলৌকিক ঐ অভিনয় নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই, সবসময়ই তিনি ঐরকম অভিনয়ই করে এসেছেন। কিন্তু, তার চোখের মুদ্রায়, কদর্য নাচের ভঙ্গীতে, যে ভাবে উঁচু জাতের দম্ভ এবং হিংস্রতাটা এসেছে, সেটা বোধহয় তুলসী চক্রবর্তীর পক্ষেই সম্ভব। নীলিমা দাশের কথা আগেই বললাম। অনুভা গুপ্তা, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, হরিধন, এদের সকলেরই অভিনয়, সঙ্গে রবীন মজুমদারের গান, এবং অনিল বাগচীর সঙ্গীত পরিচালনা, এর একটাও যদি সঠিক মানে না-পৌঁছত, "কবি' বোধহয় তার নিজের জায়গায় পৌঁছতে পারত না। নৃত্য পরিচালকের নাম দেখলাম প্রহ্লাদ দাস। তাঁর সম্পর্কে আর কিছুই আমি জানি না, কিন্তু প্রত্যেক বারই তুলসী চক্রবর্তীর ঐ বিকট নাচ দেখতে দেখতে আমার নৃত্যপরিচালকের কথা মাথায় আসে। একজন পঞ্চাশোর্ধ ভারি চেহারার মানুষের শরীরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ঐ নাচের ভঙ্গীর উদ্ভাবন তো সহজ কাজ ছিল না। এই রকম অজস্র টুকরো টুকরো কথা মাথায় আসে আমার। আক্ষরিক অর্থেই এগিয়ে পিছিয়ে এগিয়ে পিছিয়ে "কবি' ফিল্ম আমি অজস্রবার দেখেছি। আপনারা দেখুন, আমার প্রতিক্রিয়া যদি আপনাদের প্রতিক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হতে পারে, সেটাই এই কাজের সাফল্য।
পুজোর ব্লগ : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ২৯ মার্চ ২০১০ | ১১০২ বার পঠিত
যেটা পুজো সংক্রান্ত স্মৃতি আমার খুব স্পষ্ট ভাবে আছে, সেটা পাঁচ ছয় নাগাদ, নিউব্যারাকপুরের স্মৃতিটা ঠিক পুজোর নয়, পুজো উপলক্ষে ব্যায়ামসমিতির করা শরীরের পেশী প্রদর্শন, আর মামাবাড়িতে, মধ্যমগ্রামের বিধানপল্লীতে, দুলুদার দোকানের সামনে ফাঁকা মাঠে পুজোর মণ্ডপে, খুবই মাঠো সব, বাঁশের বেড়ার গায়ে চটের আবরণ, তার মধ্যে তখনকার ডেকরেটরের কাঠ-পিজবোর্ডের চেয়ারে বসে আমি আর গজো, তখনকার এক সঙ্গী, একটা খেলনা পিস্তল দিয়ে মারামারি করছি।
দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ : তৃতীয় কিস্তি : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ২০ ডিসেম্বর ২০১০ | ১২৬৭ বার পঠিত
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটিশের কালো বুটের কাজলকালো ছায়ায় নির্মীয়মান ঔপনিবেশিক পুঁজির মরডান (অনেক লোকেই দেখেছি, কিছুতেই র-টা ড-এর পরে বলে না, শত ধরিয়ে দিলেও, একটু ডর লাগে বলে? সেরকম বানানই লিখলাম।) হতে থাকে ভারতরাষ্ট্রে যে ঐতিহ্যটা আমরা পাচ্ছি তা আর আধুনিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন বিশ্লিষ্ট কর্তিত কিছু নয়, তারা এ অন্যের মধ্যে প্রথম থেকেই বসে আছে, সম্রাট কণিষ্ক যার নাম দিয়েছিলেন অতিনির্ণয় বা ওভারডিটারমিনেশন। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এই গোড়া থেকেই শোয়াশুয়িটা উপন্যাস "কবি' ধরতে পারেনি, কিন্তু ফিল্ম "কবি' পেরেছিল। উপন্যাস যেখানে শুধু বংশ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেই থেমে গেছিল, ফিল্মকে সেখানে ঠিক তার পাশাপাশি উল্লেখ করে দিতে হয় তার আধুনিকতার তকমা মানে চাকরির পদকেও। শুধু তার ডোম বংশ নয় কুলিগিরির চাকরিকে একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়ে সেই একই নাটককে নতুন চেহারায় হাজির করে দেয় "কবি' ফিল্ম। একটু পরে ঠিক এটাই দেখব আমরা কবিগানের আসরে। চণ্ডীর থানের মহান্ত আর স্টেশনমাস্টার তারা পাশাপাশি চেয়ারে আসীন থাকবেন। কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা আর ঐতিহ্য দিয়ে হচ্ছে না, তাকে আধুনিকতার আশ্রয় নিতেই হচ্ছে। তার পাশাপাশি আরও একজন থাকবেন। বর্গসঙ্করের কুলতালিকায় আমাদের বাঙালিদের আর একটা নিজস্ব সংযোজন। সে কথায় পরে আসছি।
দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ : দ্বিতীয় কিস্তি : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সিনেমা | ১২ ডিসেম্বর ২০১০ | ১৩৯৫ বার পঠিত
আমি খুব নিশ্চিত নই, সাউন্ডট্র্যাকের সমস্যার কথা তো আগেই বলেছি, বাংলায় যে আন্দাজটা আমি অনেকটা করতে পারছি, অন্য ভাষায় সেটা হচ্ছে না। তবে আমি আমার হিন্দিভাষী সহকর্মীদেরও শুনিয়ে দেখেছি। তাদেরও বাক্যটা ওরকমই লাগছে। তবে বাক্যটা এখানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়ও। কী বলতে চাইছে সেটা বোঝা যাচ্ছে খুব সহজেই। গুরুত্বপূর্ণ এখানে গোড়া থেকেই এই অবাংলাভাষী রেলকর্মীর অস্তিত্বটা উচ্চারিত হয়ে যাওয়া। উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্যে খুব সচেতন বদলগুলোর এটা একটা। উপন্যাসে এই চরিত্রটাই নেই। এমনকি উপন্যাসের শেষে নিতাই যখন ফের ফিরে এল চণ্ডীতলা ইস্টিশনে, সেখানের লোকজন তাকে ঘিরে এল। এক সময় মিছে শিরোপার গল্পে যে সম্মান নিজেই নিজেকে দিতে চেয়েছিল, সেই সম্মান এল আপনা থেকেই। উপন্যাসে এটা উল্লেখিত আছে নিতাইয়ের নিজের কেনা মিছে শিরোপা, ফিল্মে সেটা আর বলা হয়নি, শুধু শিরোপাটাই দেখানো হয়েছে। এটাও একটা বদল, কিন্তু তেমন জরুরি কিছু নয়।
ব্যান্ডপার্টি, নাইটরাইডার এবং গৌরী ধর্মপাল : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ | ১২৫৫ বার পঠিত
গতকাল দুপুরে আমার বৌয়ের সঙ্গে পাড়ায় একটি ব্যান্ডপার্টির খুব অশান্তি হয়, রাতে মানু সেটা আমায় বলল। বিয়ের ব্যান্ডপার্টি। আমাদের পাড়ায় খুব আসে। আমাদের এলাকায় ভূমিসংস্কারের প্রবল সাফল্যে পুকুর প্রায় লুপ্ত প্রজাতি, সবই এখন প্রোমো-তাড়িত বহুতল। আমাদের বাড়ির গায়েই একটা পুকুর এখনো অবশিষ্ট, বিয়ের মরশুমে প্রায়ই নানা বিয়েবাড়ি থেকে এখানে জল নিতে আসে। একসময় যেগুলো ছিল আচার, কিছু বৌ উপচার হাতে আসতেন, শঙ্খ নিয়ে, উলু দিয়ে, এখন তার সঙ্গে আসে ব্যান্ডপার্টি, এবং টুইস্ট নাচ। এই নাচের সঙ্গে এলভিসের কোনও সম্পর্ক নেই, হিন্দি সিনেমার নাচ দেখে, এবং নাইটক্লাবের নাচ টিভিতে দেখে নাচ-না-জানা লোক যখন পৃথুল দেহ কামোদ্দীপক রকমে আন্দোলিত করতে চায়, কিন্তু হয়ে দাঁড়ায় বিকটতা, তাকে বলে টুইস্ট, এতদিন মূলত বিসর্জনে নাচা হত, ধীরে বিয়েতে ও অন্নপ্রাশনে, এরপরে বোধহয় শবযাত্রাতেও হবে।
ত্রিদিবের গল্প : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ | ১২৮০ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
সবচেয়ে বেশি বছর ধরে, সবচেয়ে বেশি করে ত্রিদিব এটা বুঝেছে, তার নিজের জীবনে সবচেয়ে কদর্য ব্যাপারটা আসলে সে নিজেই। কিন্তু, যখন শেষ অব্দি এটা বুঝল, তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে, আর, নিজেকে নিজেই বদলানো মানে নিজেকে দিয়ে বদলানো, যে নিজের মধ্যেই রয়েছে গন্ডগোলটা। ওসব আসলে হয় না। কিন্তু এসব জেনে টেনে গেলে সুবিধে একটা হয়ই। নলেজ ইজ পাওয়ার। সুঠাম সঙ্গত দক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হয়।
হ্যারিসন ফোর্ডের গল্প : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ | ১১৭২ বার পঠিত
র্যান্ডম হার্টস ১৯৯৮-এর হলিউড ছবি। মূল অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড আর ক্রিস্টিন স্কট থমাস। ডাচ ভ্যান ডেন ব্রক (অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড) পুলিশ সার্জেন্ট, তার স্ত্রী পিটন (অভিনেতা সুজানা থম্পসন), সুখী তাদের বিবাহিত জীবন। এক আদুরে সকালে পিটন মায়ামি রওনা হল, কাজে। তখন কিছু বোঝাই যায়নি। পরে সংবাদ এল প্লেন-ক্র্যাশের। মায়ামিগামী প্লেন টেক-অফ করেই ভেঙে পড়েছে সমুদ্রে। যাত্রীদের একজনও বাঁচেনি।
ইতিহাসের গল্প : ত্রিদিব সেনগুপ্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৩ জুন ২০০৮ | ১১৭৮ বার পঠিত
এই ইতিহাসটার নাম কী হতে পারে শব্দ এবং আলোর যৌথ ইতিহাস? এটা ভাবলেই, এই যৌথ শব্দটা, এবং এই যে আমি একজন আলো, এবং আমিই সেটা লিখছি, এই গোটাটাই একটা তীব্র আভ্যন্তরীণ বিদ্রূপের মত আঘাত করছে আমায়। যৌথ। হ্যাঁ, যৌথ। বিগত বেশ কয়েকটা প্রজন্ম, একটা দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ যুগ, যে কোনো জীবিত আলো বা শব্দের সম্ভাব্য স্মৃতির চেয়ে অনেক অনেক দীর্ঘ একটা যুগ ধরে কাহিনীটা শুধু বিদ্বেষের আর পারস্পরিক হিংস্রতার। সেখানে ইতিহাস কেন, আলো বা শব্দের যে কারোর ভূগোলেও অন্য জনের অনুপ্রবেশের বিপরীতে এসেছে শুধু আক্রমণ আর নিধন।