পরীপর্ব : কুলদা রায়
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : উৎসব ২০১৩ | ০২ নভেম্বর ২০১৩ | ১৩১৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
সেদিন আমাদের সামনে, আমাদের তিন আপা—রিজিয়া, ফরিদা আর আমেনা খবরটি পেয়ে ঠিক উড়ে যাওয়ার মত করে ছুটে গিয়েছিল মডেল স্কুলের পুকুরের দিকে। তখন ভরা বর্ষা। জল থৈ থৈ করছে। আর মাঝখানে পদ্ম ফুটেছে। পদ্মের গায়ে ফড়িং উড়ছে। হাল্কা হাওয়ায় জল নড়ছে। এর মধ্যে কোথাও বাছেদ ভাই নেই। তিন বোনে সেই পুকুর পাড়ে বসে হাহাকার করে বাছেদ ভাইয়ে নাম ধরে ডেকে ডেকে ফিরল। সেই আর্তনাদে জলের মধ্যে একটা আলোড়ণ উঠল। একটি হাওয়াও ছুটে এলো দক্ষিণ থেকে। আর কারা কারা মিছিল নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল—তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। এবং আরো কয়েকটি লোক রাঁতে ইঁদুর ধরতে পারেনি বলে হায় হায় করছিল আর মাঝে কপাল চাপড়াচ্ছিল, এর মধ্যে কে জন বলছিল, আজি রজনীতে দীপালী অপেরায় অভিনীত হইবে একটি পয়সা দাও। মূল ভূমিকায় অভিনয় করিবেন—নট সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস। আর কিছু ডানাকাটা পরী।
এই পরী শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে জলের নীচ থেকে বাছেদ ভাই উঠে এলো। একটা বড় সড়ো মাছের মত। মাথাটি উপর দিকে। দুহাত দুদিকে তখনো ছড়ানো। ঠিক এই ভাবেই গাছ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। পড়তে পড়তে বলেছিল—আমি উড়ছি।
কাকমানুষের চকখড়ি : কুলদা রায়
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : নববর্ষ ২০১৪ | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ | ১৪৪৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১৩
সুখী দিদি ঘাসের উপর দিয়ে ঝরা পাতার উপর দিয়ে ছায়ার উপর দিয়ে খণ্ড খণ্ড নৈশব্দের মধ্যে দিয়ে ছবির বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে গেছে। সাধু পরমানন্দের বাড়ির পিছনের বাড়িটিতে। ওই বাড়িটিতে সুখী দিদির ছোট একটি ঘর। জং ধরা চালে নীলমণি লতা। দুখীরাম সেই কবে এনেছিল। তাদের পুকুরটিতে গোহাটের গরুগুলি মুখ দেখে আর জল খায়। হাম্বা করে ডাক দেয়। সুখী দিদি এই ছবির বাগান থেকে এই বাড়িটিতে যেতে যেতে তার পায়ের ছাপটি ফেলে যাচ্ছে ঘাসের উপরে। সেখান থেকে জোনাকি পোকার মত মৃদু মৃদু আলো বেরুচ্ছে।
আর এই দেখে লিকলিকে লোকটির দুচোখ বেরিয়ে এসেছে। গলা থেকে বেরুচ্ছে গর গর শব্দ।
সাধু পরমানন্দের বৌ কমলা দিদিমণি রান্না বান্না ফেলে দৌড়ে এসেছে । লোকটিকে পেছন থেকে টেনে ধরল। লোকটির গলার রগ ফুলে উঠেছে। কপালে ঘাম। ছুটে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু সত্যি সত্যি যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সুখী দিদির নাম ধরে ডেকে যাওয়াই তার জন্য ভয়াবহ এবং একমাত্র নিয়তি। কমলা দিদিমণি বলছে, মথি উদয়। মথি উদয়। ঘরে আয়। ঘরে আয় বাবা।
যেতে যেতে ফিরে ফিরে ছবির বাগানটিকে দেখতে লাগল মথি উদয় নামের এই মানুষটি । বাগানের মধ্যেকার নতমুখী মানুষটিকে। তার চলে যাওয়াটিকে। উড়তে থাকা কালো কাকটিকে। সাধু পরমানন্দ তখনো সুর করে বলছে- --
‘ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক; সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক; এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমণ্ডলের বিতানে থাকুক; তাহাতে সেইরূপ হইল।‘
বাংলাদেশে রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা এবং অন্যান্য মিথ্যা মিথ : কুলদা রায় ও এম এম আর জালাল
বুলবুলভাজা | অপর বাংলা | ০৮ আগস্ট ২০১১ | ১২০২ বার পঠিত
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন-এ অভিযোগটি অধুনা পাকিস্তানপন্থী কলমজীবীরা করছেন। কিছু কিছু পাকিস্তানপন্থী পত্রিকায় মাঝে মাঝে এ ধরনের রবীন্দ্রবিরোধিতা দেখা যায়। ফরহাদ মজহার রবীন্দ্রনাথে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক ছিদ্রান্বেষণ করেছেন তার "রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ' বইটিতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে মজহার কোন ছাড় দেন নি। সাদ কামালী নামে একজন গল্পকার-প্রবন্ধকার ফরহাদ মজহারের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমান বিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ নানাবিধ ত্রুটি খুঁজেছেন। ড: আহম্মদ শরীফও রবীন্দ্রনাথে প্রজা উৎপীড়ন খুঁজেছেন। অবাক কাণ্ড হল এই রচনাকারদের কোথাও "রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন' - এই তথ্যটি নাই। রবীন্দ্রনাথ যে সব শাক সবজি কলাটা মূলোটা খেতেন, দৈ-খৈ কোথা থেকে খেতেন, কাদের ক্ষেতেখামারে সেসব উৎপাদিত হত -- ফরহাদ মজহার এবং সাদ কামালী নানাপ্রকার খাটাখাটুনি করে তাও বের করে ফেলেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন -- এই ধরনের রগরগে অতি বিখ্যাত রবীন্দ্রছিদ্রটি তাদের রচনাতে উল্লেখ করেননি। কেন করেননি সেটা একটা কোটি টাকার প্রশ্ন বটে। এই তথ্যটি সঠিক হলে নিশ্চয়ই তারা তাদের রচনাতে উল্লেখ না করে পারতেন না।
এ ব্রিফ ডাইরি অফ হারিকেন : কুলদা রায়
বুলবুলভাজা | কূটকচালি | ৩০ আগস্ট ২০১১ | ৮১৭ বার পঠিত
আমার বড় মেয়েটি এই ঝড়জলের মধ্যে হাতে রসুনের কোয়া নিয়ে জানালার কাছে বসে আছে। নিউ ইয়র্কের ঝড়জল হারিকেন ওরফে আইরিন দেখতে চেষ্টা করছে। আইরিন নামের এক ভৌতিক ভ্যাম্পায়ারকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
আমাদের দেশের কালবৈশাখির মত শোঁ শোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে। গাছের ডাল নড়ছে। পাতা পড়ছে। এরকম ঝড়বাতাস আমাদের দেশে বছরে গণ্ডায় গণ্ডায় আসে যায়। সরকার ঘুমায়। আর জনগণ তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত ছুটে বেড়ায়--পোকামাকড়ের মত মরে।। আবার ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শুনলাম, ছোটে মেয়েটা গলা খুলে গাইছে, ওরে ঝড় নেমে আয়, আয়।
ছয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল উরফে চান্দু মিয়ার সহি সফরনামা : কুলদা রায়
বুলবুলভাজা | অপর বাংলা | ২৮ মার্চ ২০১১ | ১৭৭৫ বার পঠিত
ইমাম হুজুর শুধু ফরমাইলেন, আপ হামেশা মেরী বাত পর একিন করে। তাহার কাছে সবই জানা। তিনি আসমানে তাকাইলেন। আর অমনি ঝর ঝরাইয়া বারিষ নামল। এই বারিষে বহুদিন বাদ গোসল হৈল। কৈইন্নার চুল ছিড়্যা ছিড়্যা খাডো হৈয়া গেছিল। নয়া চুল গজাইল। হাডু পর্যন্ত কালা চুল নাইমা আইল। হুজুরে আলা কৈলেন, আর তার ছিন্ন কুচযুগল পুনর্গঠিত হৈল। উহা আগের চাইয়া বহুৎ খুবসুরৎ। ঝিল মিল কৈরা ওডে। কৈইন্না ফির বালেগ বনেগা। ইহা অবিশাস্য নয়কো। ইহার রহস্য অপার হে। এই রহস্যের কুন কুল-কিনারা নাই। কারণ তাকে যহন গোরা সৈন্য কি ইনডিয়ার মেলিটারি কি নাবালেগ ছেলে-ছোকরা বাঁশ বাগান হৈতে মোরাকোবা কি হালতে জেলখানার দিকি টাইন্যা লৈতে আসতি আছিল, তহন তিনি অই অবস্থায়ই আঙ্গুলি বিস্তার কৈরলেন, আর আছছোরোমের খালডার পাশে পুরানা পাকুড় গাছ ঝপাৎ কৈরা পানির মৈদ্যি পৈড়া গেল। এÉ¡তে এÉ¡তো শব্দ হৈল যে উপারে নতুন ইস্কুলের লগে খান সাবের বাসার ভিতরে এক ঝাঁক রাজহাস প্যাক ফ্যাক কৈরা উডল। খান সাব শ্যাখ সাবের চাচা লাগে। সাং গিমাডাঙ্গা। টুঙ্গিপাড়া। তিনি মৃত লোকদের লিস্টি রচনায় ব্যেস্ত আছিলেন। দৌড়াইয়া আইসা খান সাব কৈলেন, হুজুর...
মনুসাহিত্য : মোগো বাড়ি বরিশাইল : কুলদা রায়
বুলবুলভাজা | অপর বাংলা | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১০ | ৮২৩ বার পঠিত
আমাকে রক্ষা করতে আমার মা জননী একদিন দক্ষিণ দেশে চলে এল। রীতিমত উন্মাদ দশা। আমাকে যে বাঘে খায় নি, কুমোইরে খায় নি, বা ডাইনীতে কাঁচা গেলে নি দেখে তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। রক্ষাকালীর উদ্দেশ্যে পাঁচসিকে মানত করে বসল। বলল, বাবা, তোর এখানে থাইকা কাম নাই। বাড়ি ফিরে চল।
ছেলেকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়ে বসে আছে স্নেহময়ী মা। জানালাও আটকেছে শক্ত করে। চোখে ঘুম নাই। দরোজায় শব্দ হল। মার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। খুলতে গেলে হাত চেপে ধরেছে। বলছে, খুলিস না। খুলিস না। ডাকাইত। ডাকাইত আইছে।
ডাকাইত না। প্রতিবেশী বৌদি এসেছেন। হাতে পাকা আমের ঝুড়ি। খেয়ে মা বলল, অ মা, এ দেহি আম--মিঠা।
দুটি হলুদ ইলিশের গল্প : কুলদা রায়
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : ইদের কড়চা | ২১ মে ২০২১ | ৩১৩০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
এই ধুতি পাঞ্জাবি কখনো কাছ থেকে আমরা দেখিনি। দেখার সুযোগই দেননি। ঠাকুরদা সবার স্পর্শ বাঁচিয়ে তাদের রাখেন। বলেন, অতিথি এলে তিনি পরবেন। হলুদ ইলিশ রাঁধা শেষ হলে তাকে নিয়ে খেতে বসবেন। অতিথি তখন কাঁসার থালায় হাত দিয়ে গিয়ে আলাদা এক সম্ভ্রম নিয়ে দেখবেন এই প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তানকে। দেখবেন, চাঁদ নম্র হয়ে নেমে এসেছে ঠাকুরদার মাথার উপরে। মলয় পাহাড় থেকে ছুটে এসেছে স্নিগ্ধ হাওয়া। কোথাও বেজে উঠেছে পাখোয়াজ। অতিথি খাওয়া ভুলে যাবেন। একটু বেশি রকম ঝুঁকে বলবেন, আপনাকে কুর্নিশ করি। কুর্নিশ গ্রহণ করুণ হে মান্যবর।