সত্যজিৎ ঘরে-বাইরেতে সন্দীপের গলায় কিশোরকুমারকে গিয়ে গান গাইয়েছিলেন। কেন গাইয়েছিলেন? আপনারা সক্কলেই ঘরে-বাইরে পড়েছেন। ফলে আলাদা করে বলার কিছু নেই, রবীন্দ্রনাথের দুখানা উপন্যাস খুবই প্রচারধর্মী, গোরা এবং ঘরে-বাইরে। গোরাতে প্রায় চোঙা ফুঁকে ভালো-ভালো কথা বলা হয়েছে। ঘরে-বাইরেতে অতটা নয়। কিন্তু তাতেও, সেটা প্রায় কুরুক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিখিলেশ হয়ে সন্দীপকে শৈল্পিক কথার মারপ্যাঁচে নানা ব্রহ্মাস্ত্র ঝেড়েছেন। বিমলা বেচারি সেই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় উলুখাগড়া। তাকে বাদ দিলে ওটা আর উপন্যাস না হয়ে 'স্বদেশী বিষয়ক আবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ' হয়ে যেত, তাই রাখা। ... ...
চালচিত্র এখন সিনেমাটাও এই রীতি অনুসরণ করেই বানানো। যদিও অত পুরোনো না, এবং অত গভীর অনুসন্ধানেরও প্রয়োজন পড়তনা, কিন্তু সেটুকুও করার দরকার মনে হয়নি। এই সিনেমায় আশির দশকের কলকাতায় দিব্যি ল্যাজ তুলে ঘুরে বেড়ায় নীল-হলুদ বেসরকারি বাস, আশিতে সেসব বাস কেউ চোখে দেখেনি। শব্দ শোনা গেলে তারা হয়তো নিউটাউন-নিউটাউন বলেও হাঁক পাড়ত। দেখা যায়, সবুজ অটো। নায়কের বৌয়ের নাম মাঝেমধ্যেই মিতা থেকে বদলে গীতা হয়ে যায়। এবং মিতা ওরফে গীতা মিনার্ভা থেকে উত্তরপাড়া যেতে নিয়মিত শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরেন। শিয়ালদা থেকে উত্তরপাড়া ট্রেনে চড়ে যাওয়া একেবারে অসম্ভব কিছু না, কিন্তু সে তো নৈহাটি-ব্যান্ডেল হয়েও যাওয়া যায়, সাধারণভাবে সুস্থ লোকে ওই দিক দিয়ে নিয়মিত যায় না আর কি। ... ...
পাপের স্পর্শ ( A touch of Sin ) ছবিতে হিংসা, রক্তপাত, আত্মহনন ভালো পরিমাণে আছে। কিন্তু এসব আছে এমন একটা সমাজে বাঁচার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যেখানে প্রতারণা আছে, নিষ্ঠুরতা আছে, আছে অর্থগর্বী প্রমত্ততা। দেখে কখনো মনে হবে না যে ৭৪ বছর আগে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে যাওয়া , সমাজতান্ত্রিক পথে হাঁটা কোনো দেশের ছবি দেখছি। ... ...
এই ফুটবলের বাজারে আমি লোভে পড়ে একটা সিনেমা দেখে ফেললাম। কলকাতার সিনেমাজগতের পুরাযুগ নিয়ে সিনেমা, জিনিসটায় আমার আগ্রহ আছে, সেই লোভে। সিনেমার নাম কলা। ইংরিজিতে QALA। তাই থেকেই বোঝা উচিত ছিল কেসটা। কিন্তু আমি আবার ঠেকে শিখি। খুলে দেখি একেবারে কাঁচQALA । যেমন মিস্টিসিজম, তেমনই ডার্ক, কিন্তু সিনেমাটা কীসের প্রেক্ষাপটে, সুইজারল্যান্ড না কলকাতা, বোঝার উপায় নেই (ভাষা হিন্দি, তাতে অসুবিধে নেই, কারণ,হিন্দি সিনেমার প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রায়ই সুইজারল্যান্ডে দেখা যায়।) কলকাতার সিনেমা নিয়ে ছবি, কিন্তু সারাক্ষণ দেখে গেলাম সিমলারও উত্তরে কোন এক জায়গায় ধাঁইধপাধপ বরফ পড়ছে। কেদার-বদ্রীতেও সারাবছর বরফ পড়েনা, আলাস্কাতেও না, কিন্তু এখানে পড়ে, হয়তো উত্তরমেরুর কাছাকাছি, কে জানে। সেখানে এক সঙ্গীতশিল্পী মহিলা তাঁর মেয়ের উপর হেবি অত্যাচার করেন, আর বেপাড়ার একটা পাঞ্জাবি ছেলেকে ধরে এনে গান শেখান। সেই জাল ভেদ করে মেয়ে একদিন কলকাতায় গানের জগতে সুপারস্টার হয়, এই হল গপ্পের একটা অংশ। শুরুর পাঁচ মিনিটেই এটা বুঝতে পারবেন, কাজেই স্পয়লার নয়। ... ...
দম বন্ধ করে, দাঁত চেপে দেখে শেষ করলাম নতুন করে বানানো ক্লাসিক 'অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'। এরিক মারিয়া রেমার্কের অসাধারণ এই উপন্যাস অবলম্বনে এর আগে আরও দুইবার সিনেমা বানানো হয়েছে। ১৯৩০ সালের সিনেমাটা দুর্দান্ত ছিল। এবারের সিনেমা নেটফ্লিক্স তৈরি করেছে এবং অসাধারণ ভাবেই তৈরি করেছে। এই সিনেমা নেটফ্লিক্স কেন হলে মুক্তি দিল না তা আমার ঠিক বুঝে আসল না। এই বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা এইটা। অস্কারের জন্য যোগ্য দাবিদার হতে পারত কোন সন্দেহ ছাড়াই। একাডেমী অ্যাওয়ার্ডের নিয়ম অনুযায়ী মনোনয়ন পেতে হলে সিনেমাকে অবশ্যই হলে মুক্তি দিতে হবে এবং কয়েক সপ্তাহ অন্তত চলতে হবে। সেই সূত্রে অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট অস্কারের জন্য মনোনীত হবে না হয়ত। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্যাটাগরির নিয়ম জানা নাই, আইএমডিবির তথ্য অনুযায়ী এইটা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্যাটাগরিতে এবারের জার্মান মনোনয়ন অস্কারের জন্য। অস্কারের ছোট্ট তালিকায় জায়গা পেলে আমি অবাক হব না, বরং খুশিই হব। ... ...
পর্দা জুড়ে ফুটে ওঠে পরিত্যক্ত মন্দিরে এক বিশাল রামের মূর্তি। আধুনিক দর্শক আশা করি এই অনুষঙ্গ ভালোই বুঝতে পারবেন। রাম গেরুয়া ধুতি পরে রামের মূর্তি থেকে তীর ধনুক খুলে নেয়। জড়িবুটির ম্যাজিকে তার সমস্ত ক্ষত এতক্ষণে উধাও। সারাংশে রাম আর ভীম, সঙ্গে রয়েল বেঙ্গল বাঘ, কম্পজ্বর ভাল্লুক, চিড়বিড়ে চিতাবাঘ, চোখানাক নেকড়ে, দৌড়বাজ হরিণ, উপজাতির শিকারী ভায়েরা - সিনেমার গল্প জুড়ে সবার মিলিত প্রচেষ্টা বড়লাটের বাড়ি উড়িয়ে দিয়ে সব খারাপ ইংরেজ খতম করে। প্রথম দৃশ্যের নির্মম ফার্স্ট লেডির ময়ূর আঁকা নিথর হাতটি শূন্যে দোলে। কিন্তু এতো শুধু খোলসের বিবরণ। ভাবুক দর্শকের সামনে খুলে যায় বোধের দরজা। আর্য আর ফর্সা ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভীম। পাঁচ নিষাদ পুত্রকে তাদের মায়ের সঙ্গে জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার গ্লানি ধুয়ে আজ সে নিজেই নিষাদের কন্ঠস্বর, তাদের চেতনার প্রতিভূ। আর আবহ জুড়ে গান বাজে রাঘবম রাজসম। তীরধনু আর অক্ষয় তূনীর হাতে ভীমকে সুরক্ষা দেন রাম। পুলিশ অফিসার রামের অহল্যা মনোভূমি আজ ভারতের ঐতিহ্যধারী রামের স্পর্শে প্রাণ পায়। আজ সে সত্যিকারের শ্রীরামচন্দ্র হয়ে ওঠে। ... ...
…এই ছবি মুক্তির সাথে সাথে যেন বাঙালি পুরুষ জাতির শৌর্যবীর্য দিকে দিকে প্রকাশিত হচ্ছে। স্বস্তিকার অভিনয় শিল্প ও কাহিনীর চরিত্রের সাথে মানানসই লকডাউনে ঈষৎ আটপৌরে পোষাক ইত্যাদিতে স্যোশাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভার্চুয়াল যৌন হেনস্তার বান ডেকেছে। কেন স্বস্তিকা পোস্টারে অন্তর্বাস ও আঁচল সরে যাওয়া স্তনাভাস দেখালেন, কেন ফেসবুক “হইচই” পেজের বিজ্ঞাপনে তিনি স্মার্ট হেয়ার স্টাইলে নারী মুক্তির কথা বললেন, এ নিয়ে একের পর এক কি বিভৎস ধর্ষমর্ষকামী অগনিত কুৎসিত মন্তব্য আসছে!...আসলে এইসব বেটাগিরির চপেটাঘাতই এই ছবি ... ...