আমরা অতীতে যেখানেই ছিলাম, যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ভেঙে ফেলা খেলাধুলোয় ব্যস্ত ও ত্রস্ত মানুষ -- আমরা কেবল ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে নাড়াচাড়া করে দেখছি। দেখছি, অক্ষরগুলো এখনও বেঁচে আছে কিনা। দেখছি, গনগনে চিতার শিখার থেকে কেউ রুমাল নাড়ে কিনা। চিতাভস্মে সমান হবার যে আবেগপ্রবণ আকাঙ্খা তার লেশমাত্র নাই। এখন কেবল ধানখেতে কালো একটি ছেলে শুয়ে আছে, রক্তাক্ত। কালো কালির ওপর লাল কালির এই কাটাকুটি লিখেছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী। ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়। ... ...
কবিতা কি সত্যি কখনো অস্ত্র হয় বা হয়েছে? মানে ঠিক যেভাবে দেখাতে চায় মেরুকরণের রাজনীতি, কবিকে নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে? নাকি তার জায়গাটা একটু আলাদা যা চিনতে না পেরে আমরা কবিতার প্রাসঙ্গিকতাকে ওই একই খোপে ঢোকাতে চাই ও বারংবার ব্যর্থ হয়ে নিরাশায় ভুগি। আদতে, সমালোচকদের মধ্যে একটা মাপকাঠি কাজ করেছে চিরকাল, যে, যথেষ্ট দেকার্তিয়ান না হলে, সেইটে আধুনিক রাজনীতির অংশ হয় না। ... ...
আমার বন্ধু সন্দীপ একটা কবিতার কাগজ বার করে। বেশ কিছুদিন ধরেই বলছে, পরের সংখ্যার জন্য অন্তত গোটা দশেক পদ্য ওর চাই। বড়ো অস্থির সময় যাচ্ছে আজ। কতোবার বসার চেষ্টা করলুম, কতো খসড়া। কতো বার প্রথম দু ' তিনটে লাইন লেখার পরে নিরাশ ছিঁড়ে ফেলা। অথচ কতো কথা বলার বাকি থেকে যাচ্ছে, কতো চমক দেওয়া শব্দবন্ধ মাছির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার চারিধারে। কিন্তু শাদা কাগজে কালো অক্ষরে তারা ধরা দিতে চাইছে না। মাঝে মাঝে হয় এমন। সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়। নিজেকে বাহুল্য বোধ হতে থাকে। গানের কাছে যাই, মানুষের কাছে যাই, বইয়ের কাছে যাই, কিন্তু শব্দ বাঁধার রেশ গুলো খুঁজে পাইনা। প্রিয় কবিদের প্রচুর পদ্য বারবার পড়ি, কতো জাদুর মতো প্রতীক, তৈরি শব্দের মায়া মাথায় ঝিলিক দিয়ে পালিয়ে যায়। পদ্যের শরীরে যদি প্রাণটাই প্রতিষ্ঠা না করা গেলো তবে তার অলঙ্কার কী প্রয়োজন। মৃতদেহের মাথায় হিরের মুকুট ? ... ...
আজ তিনদিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন শেষ হলো। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই চারদিক খোলামেলা প্রাঙ্গনে, পাশেই জুবিলি পার্ক, হুহু করে শীতহাওয়া ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শীতহাওয়া, কিন্তু তাজা, তৃপ্ত স্পর্শ তার, চোখ মুখ স্নিগ্ধ করে দেয় তার স্নেহ। ভিড় পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছি। ... ...
জীবন মানে তো একটা পথ চলা। যেকোন পথে যেতে প্রথমদিন শুধু পথটাকেই দেখি, তাকে মাপি। পরের দিন চোখ তুলে দেখি আশপাশ, কতো গাছ, কতো হাট, কতো খালবিল। তার পরের দিন গাছের পাতা কেমন সবুজ, কী রঙের ফুল, কোন পাখির বাসা, বিলে পদ্ম ফুটেছে না শালুক, মানুষগুলি বাইরে থেকে কেমন? তার পর কোনোদিন পেরিয়ে যাই মানুষগুলির অন্দরমহল, হেঁসেলঘর। প্রথমদিন পথের দুপাশে যেমন সব কিছু অচেনা, অজানা, অবুঝ লেগেছিলো, সেই অস্বস্তিটা যে কোথায় চলে যায়, কে জানে। কবিতাও তো জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল চলে, তার প্রথম অবুঝপনা কখন যে অতীত হয়ে যায়, তার কোনও হিসেব থাকেনা। তখন নিশ্চিন্তে বলে উঠি, 'কবিতা বুঝিনি আমি', যেহেতু তখন আমি জেনে গেছি, বুঝি নাই বুঝি, কবিতাকে তো আমি পেয়ে গেছি। ঠিক তোমার মতন........ ... ...
এটা নিয়ে একটা তুমুল তর্ক চলতো জীবনানন্দের আসল উত্তরাধিকারী কে? দাবিদার আমার প্রিয়তম দুই কবি, বিনয় ও শক্তি। তখন কবিতাকে বা বলা ভালো বিভিন্ন কবিতার ধারার উৎস হিসেবে একজন বড়ো কবিকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রবণতা বড্ডো প্রকট ছিলো। 'রবীন্দ্র অনুসারী' বা অন্যরকম মূঢ় তকমাও ছিলো খুব সুলভ। একটু সরব হয়ে মানুষের দুঃখসুখ নিয়ে চর্চা করতেন যেসব কবি তাঁরা ছিলেন 'সংগ্রামী', কেউ ছিলেন মাতাল, আর কেউ বা পদ্যবণিক। বুদ্ধদেব বসুর 'মতো' যাঁরা , তাঁরা 'বৌদ্ধ' আর বিষ্ণু দের কাছাকাছি ছিলেন 'বৈষ্ণব'রা। ... ...