এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বঙ্গসম্মেলন ৪ 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ জুলাই ২০২৪ | ৬২২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৩ জন)
  • | | |


    আমি গাঁয়ের ছেলে, সবসময়ই একটু পিছিয়ে থাকি। আমরা কিবোর্ডকে বলতাম ক্যাসিও, ধাঁইধপাধপ করে জ্যান্ত তবলা সহযোগে গান করতাম, ক্যারাওকে মেশিন যখন প্রথম চোখে দেখি, একটাই প্রশ্ন এসেছিল মাথায়। এক দাদা ডেমো দিচ্ছিলেন, তাঁর গলা সুর ছাড়া আর সব জায়গায় পড়ে। সেই শুনে আমার যন্তরটাকে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল বাবা, মিউজিকের সবটাই যখন বাজাতে পারছিস, তখন গলাটাই বা বাদ দিলি কেন? 

    আরও কয়েক-দশক  পরে জানা গেল, নেহাৎই গাঁয়ের ছেলে বলে কল্কে পাইনি, তা বলে বুদ্ধি মোটেই কম নেই। এই প্রশ্ন বাঘাবাঘা সঙ্গীতশিল্পীদেরও মাথায় এসেছে। এবং তাঁরা গলাশুদ্ধ ক্যারাওকে মেশিন নিয়েই গান-টান করেন। এতে এমনি কোনো সমস্যা নেই। খালি রেওয়াজের ধরণটা একটু বদলাতে হয়। সারেগামা আর বলতে হয়না, ওটা তো যন্ত্রে পিচ-কারেক্ট হবে, সঙ্গে একটু ঠিকঠাক ইকো -রিভার্ব।ব্যস, গান হয়ে যাবে বিউটি-পার্লার-ফেরত খেঁদি-বুঁচির ন্যায় অপরূপ, চোখ ফেরানো যাবেনা। ফলে রেওয়াজটা করতে হবে ঠিক জায়গায় ঠোঁট নাড়ার। মানে উত্তমকুমারের মতো অভিনয় না করে স্রেফ টেরি-বাগানো প্র‌্যাকটিস করতে হবে, মেরিলিন মনরো হতে গেলে অভ্যাস করতে হবে হাওয়ায় স্কার্ট ওড়ানো, ব্যস। 

    এটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার, আমি গাঁয়ের ছেলে, সবসময়ই একটু পিছিয়ে থাকি, কিন্তু এবার বঙ্গসম্মেলনে বুঝলাম, যে, শিল্পীরা অনেকেই শহুর, আন্তর্জাতিক  এবং চালাকচতুর। অনেক গানই চলছে স্রেফ ট্র‌্যাকের সঙ্গে। এবং সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, যে, অনেক গানেই তেড়ে প্র‌্যাকটিস করে, স্রেফ ঠোঁট নাড়া হয়েছে। এ অবশ্য প্রমাণ করা ভারি মুশকিল। শুনে-দেখে বুঝতে হবে এবং সেটাও সাবজেক্টিভ। প্রমাণ করা নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, কারণ নানারকম প্রযুক্তি বাজারে আসছে, লোকে ব্যবহার করবে নাই বা কেন। দর্শক-শ্রোতা ফুর্তি পেলেই হল। সে ঠিক কথা, কিন্তু তার পরেও দুখানা জিনিস থেকে যায়। এক, স্বীকৃতি। আপনি যদি ট্র‌্যাকের সঙ্গে গান, তো গানের অর্ধেক কৃতিত্ব মিক্স-মাস্টারের। আর যদি স্রেফ ঠোঁট নাড়েন, তো পুরোটাই তার। আপনি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে সেটা পাঠ করে যদি পুরোটাই নিজের কৃতিত্ব বলে চালিয়ে দেন, তো সেটা যেরকম জালিয়াতি, এক্ষেত্রেও কৃতিত্ব না দেওয়াটা তাইই। আর দুই, পাশ্চাত্য সঙ্গীতে এ বস্তু চলে, কারণ ওখানে পুরোটাই ধরাবাঁধা। ভারতীয় গানে, শ্রোতারা শিল্পীকে সামনে পেলে সবসময়ই চান নতুন কিছু চেষ্টা, একট কিছু যোগ করা, যা আগে ছিলনা। এই চেষ্টাটা ছাড়া ভারতীয় গান হয়না। সব শিল্পীরাই করেন এবং করতেন, সব সবয় উৎরেছে তা না। স্বয়ং রবিশংকরও আত্মজীবনীতে লিখেছেন, নতুন জিনিস করতে গিয়ে তিনি এবং আলি-আকবর বার তিনেক চেষ্টা করে তারপর পেরেছিলেন, এবং সেটা লাইভ কনসার্টে। গান থেকে এই নতুন কিছু চেষ্টা করার ব্যাপারটা তুলে দিলে ভারতীয় সঙ্গীত ব্যাপারটাকেই খুন করা হয়। শ্রোতারা ভারতীয় গানে ওটা চান। এখনও।

    এবার, কেউ বলতেই পারেন, যে, কে বলল শ্রোতারা ওটাই চান। সেও প্রমাণ করা যাবেনা। কিন্তু এই যে সঙ্গের ছবিটি দিলাম, দেখুন ট্র‌্যাকের সঙ্গে হচ্ছে, কোনো বাদক নেই ( আলাদা করে বলে দিই, এইটা লিপসিংক বলে মনে হয়নি, যেগুলো হয়েছে, তার ছবি দিলামনা, ইচ্ছে করেই)। এটা হয়েছে দিনের বেলায়। যাকে বলে প্রাইম-টাইমে। শ্রোতাদের আসন মোটামুটি ভর্তি ছিল। একটাও জায়গা নেই, এরকম কোনো অনুষ্ঠানে হয়নি, এতেও না। আর একটাই মাত্র বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হয়েছে শিকাগোয়, সেটা শুরু হয়েছে রাত এগারোটায়। শেষ হয়েছে প্রায় দুটোয়। সেখানে শেষ অবধি একই রকম লোক ভর্তি ছিল শুধু না, রাত বারোটায় মাত্র কুড়ি মিনিট গাইবার সুযোগ পেয়ে রশিদপুত্র আর্মান যখন উঠে যাচ্ছেন, প্রেক্ষাগৃহে তখন ছেলেটিকে ধরে রাখার জন্য চেঁচামেচি (অসাধারণ মেজাজ ছেলেটির)। রাত দেড়টায় বাঁশুরিয় চৌরাসিয়া যখন প্রশ্ন করছেন, কী বাজাই, ভৈরবী না পাহাড়ি, দর্শকরা সুস্পষ্ট মতামত দিচ্ছেন কোনটা চান। ক্যারাওকে-মাচা-কোম্পানির বেশিরভাগই, আমি লিখে দিতে পারি, এই দুটো জিনিস খায় না মাথায় দেয় জানেনা। ফলে শ্রোতা দিব্য আছে, এই পোড়ো শিকাগোতেও, এবং রাত দেড়টাতেও। তারা যান্ত্রিক ঠোঁট নাড়া শুনতে নয়, লাইভ জিনিস চায়। কিন্তু প্রাইম-টাইম  তাএর জোটেনা। অদিতি মহসিন সময়াভাবে নেমে যান। চৌরাসিয়া, আর্মানরা কুড়ি মিনিট-আধঘন্টা সময় পান। যদিও অদিতি এবং এই দুজনের আরও অনেকটা করে শুনতে চেয়েছিলেন শ্রোতারা (সেতারি অবশ্য  ফাঁকি মেরেছেন, সে অন্য কথা)। অথচ এসভিএফ মাচা হয় ঘন্টার পর ঘন্টা।

    না, বিশুদ্ধবাদী কিছু কথা বলা হচ্ছেনা। নানারকম জিনিস নানারকম দর্শক চান, সবই হতে পারে। কিন্তু যেটা বলা হচ্ছে, সেটা হল স্রেফ যান্রিক ঠোঁট-নাড়ারা পায় প্রাইম-টাইম, আর যথেষ্ট দর্শকানুকূল্য থাকা সত্ত্বেও লাইভ রেওয়াজি জিনিস পায় সামান্যই সময়, এ তো এমনি হয়না। এর পিছনে একট হায়ারার্কি কাজ করে। গ্ল্যামারের হায়ারার্কি। যে কারণে ফালতু তারকা-সমাবেশের প্রয়োজন পড়ে। সেই মাচাকে সংস্কৃতি হিসেবে তুলে ধরা হয়। সেটা গায়ের জোরে। 

    এইটাই বঙ্গসম্মেলন নিয়ে শেষ কিস্তি। একটু বেশিই গুরুগম্ভীর হয়ে গেল, রিচ একটু কমে যাবে, কী আর করা যাবে। কিন্তু আসলে এই ঠোঙাসর্বস্বতা নিয়ে গুরুর হয়ে অন্য লেখায় লিখেছি। ঠোঙা নয়, ভিতরের মাল দেখুন, এই বার্তা দেবার জন্যই বস্তুত গুরু খোলা (মানে অন্যতম কারণ আর কি)। তার একটা চমৎকার কেস-স্টাডি পেয়ে লিখে ফেলতেই হল। এই সিরিজ এখানেই সমাপ্ত। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Biplob | 138.59.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৯:৪০534300
  • ঠিক জমল না সৈকত বাবু। হেউমারটা দেন।
  • অরিন | 119.224.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৪ ১০:২৭534304
  • "শ্রোতা দিব্য আছে, এই পোড়ো শিকাগোতেও, এবং রাত দেড়টাতেও। তারা যান্ত্রিক ঠোঁট নাড়া শুনতে নয়, লাইভ জিনিস চায়। কিন্তু প্রাইম-টাইম  তাএর জোটেনা। অদিতি মহসিন সময়াভাবে নেমে যান।"
     
    পড়ে খুব খারাপ লাগল।
    সংগঠকরা ব্যাপারগুলো বোঝেন না, না এই ইচ্ছাকৃতভাবে এই ধরণের আয়োজন করেন?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন