উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্র থেকে ভোরের দিকে বেরিয়ে আপনার জগিং-উদ্দেশী বন্ধুকে ফোন করে হয়তো বললেন, প্রায় ঘুমন্ত আপনাকেও কেমন কৌশিকীর শেষ ভজনটা জাগিয়ে তুলেছিল। উত্তরে সে ধরুন বললো, "কেমন গাইলো রে? একটু গেয়ে শোনা তো? নিদেন একটু কথা বলে তো বোঝা?"... ব্যোমকে যাবেন না?
বা হয়তো আপনি একা প্যারিস ঘুরে ফেরার পর ঈর্ষান্বিত বান্ধবী বললো, আইফেল টাওয়ারের একটা ময়দা দিয়ে মডেল বানিয়ে দেখাতে। কী ভয়ানক ফালতু না প্রচেষ্টাটা?
এইজন্যেই, কেন যে সিনেমা দেখে ফিরে তার সম্পর্কে লিখতে বসে লোকে তার গল্প, পশ্চাৎপট—এইসব নিয়ে শব্দ খরচ করতে বসে—আমার মাথায় ঢোকে না।
তাইলে লিখতে কেন বসলাম, তাই তো? বলছি। খুব ভালো কোনো আর্টফর্মের সঙ্গে অনেকদিন দেখা না হলে, আর সেই সময়জুড়ে রাজনীতি, সমাজ, কাজের জগত—সর্বত্র বেড়ে চলা শব্দে ডুবতে থাকলে, একসময় মনে হয়—শিল্পের দেবতা মৃত, আর্টের আর কোনো প্রয়োজন নেই আপনার জীবনে। কপাল ভালো আর আপনার নিজের ক্ষিদে থাকলে এইরকম এক সময় হুট করে একটা কালজয়ী কিছু আপনি পড়ে, দেখে বা শুনে ফেলেন। মেঝেয় ছড়িয়ে পড়া চোয়াল কুড়োতে যখন আপনি ব্যস্ত, মাথায় আসে, "একটা/কিছু লোক এটা ভেবেচিন্তে, ছক কষে, প্ল্যান করে বানিয়েছে? কী করে!?"
এই বিস্ময় থেকেই লিখতে বসা। "Anatomy of a Fall" দেখে ইস্তক জীবনে শান্তি নেই, (যদিও সবে ঘণ্টাদুয়েক পেরিয়েছে), তাই টাটকা থাকতে থাকতে রিয়্যাকশনটা লিখে ফেলি।
অনেকগুলি ভাইবোনের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখবেন, কেউ না কেউ বেশি ভালোবাসা পায়। কেউ না কেউ বেশ বঞ্চিত হয় স্নেহ থেকে। ওই, বলে না, মাঝের ছানাদের বিশেষ দেখে না কেউ... সেইসব। তা, পরিবারেই যদি এমন হয়, কী করে আশা করেন—গল্পের চরিত্রদের সবার প্রতি সমান স্নেহ, সমান সহমর্মিতা থাকবে চিত্রনাট্যকার, পরিচালকের? কেউ না কেউ থাকবেই, যার পক্ষ আপনি কিছুতেই নিতে পারবেন না। সে চরিত্র সাধারণত গড়াই হয় অন্য পক্ষের মতকে শ্রেয় প্রতিপন্ন করতেই।
অ্যানাটমি... এক অদ্ভুত সিনেমা সেই দিক থেকে। এমনকি কুকুরটার পক্ষ নিয়েও কিছুক্ষণ সাময় কাটিয়েছি জানেন হলের ভেতর! চরিত্রদের মনের ভেতর ঢুকতে হলে ক্লোজ-আপ শট আর পিওভি ব্যবহার করার কায়দা সবাই জানে। এই সিনেমায়— একজনের কানের পাশ থেকে অন্য দূরে বসা চরিত্রের মুখে ফোকাস, যখন নেপথ্যে অন্য আর এক চরিত্র কথা বলে চলেছে—পাহাড়ি পথে মূল চরিত্রকে অনুসরণ করে এগোতে এগোতে হঠাৎ তারই সঙ্গে ক্যামেরা আবিষ্কার করে (জ়ুম ইন করে) দূরে ঘটে চলা অস্বস্তিকর কোনো ঘটনা—হঠাৎ অনুভব করা, যে, নেপথ্যসঙ্গীত বন্ধ হয়ে গেছে কখন যেন, আর সেই মুহূর্ত থেকে আপনার ভেতরে অস্বস্তি বেড়ে চলেছে... না, পরিচালক নতুন কিছু করেছেন বলে মনে হয়নি, কিন্তু যা করেছেন—যন্ত্রণাদায়ক প্ল্যানিং আর পরিশ্রম আছে তার পিছনে।
একটা লোক সিনেমার শুরুতেই মরে গেছে। চড়-থাপ্পড়, গ্লাস ভাঙাভাঙি, পেশাদার উকিল গোটা সময় জুড়ে ন্যুয়ান্সের পিন্ডি চটকে বুলি-সুলভ সওয়াল করছে... সবকিছুর পরও, কখনোই আপনার মাথায় রক্ত চড়বে না, এমনকি কুশীলবদের গলাও চড়বে না প্রায় কখনোই। কী যে এক মায়া লাগাইসে গোটা ফিলিম জুড়ে! আমার মতো পাষাণহৃদয়েরও ইচ্ছে করেছে উঠে গিয়ে সকলের মাথায় মিনিটখানেক করে অন্তত হাত বুলিয়ে আসি।
এক মুহূর্তও কঠোর বাস্তবের থেকে মুখ না ফিরিয়েও এই সিনেমা যা মমতার উদ্রেক করতে পারে, তা ম্যাজিকের কম কিছু না।
আর কিছু বলে লাভ নেই। যা যা মনে আসছে তা লেখা বৃথা, সিনেমাটা দেখাই তার চেয়ে ভালো কাজ।
যান, আইফেল টাওয়ার চড়ে আসুন, আমার ময়দার মডেল চটকে এই ফেল্লুম আস্তাকুঁড়ে।