এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মিকি মাউসের হাসি 

    Aditi Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ নভেম্বর ২০২৩ | ৩৪৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • যেতে তো ইচ্ছে করে, কিন্তু যাওয়া কি কম ঝক্কি? রেঁধে বেড়ে, খেয়ে গুছিয়ে,  ঢাউস জামা কাপড়ের ব্যাগ, হাত ব্যাগে জলের বোতল,ছাতা, সব নিয়ে বেরোতে বেরোতে বেলা বেশ বেড়ে গেল। দুটি ভাতে ভাত বাচ্চা দুটোকে গিলিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্তি। হাওড়া যেতেই সে ঘন্টা দেড়েক, কোন ট্রেন তারপর পাবে, সিটিও ঠিক সময়ে আসবে কিনা, রবিবারে জায়গায় জায়গায় লাইনের কাজ…সব ফিরিস্তি মিটলে তবে নাবতে পারবে তুমি দিনের আলো থাকতে থাকতে। মরা আলো, সেও ভালো, তাও তো খানিক দু চোখ ভরে দেখতে পাবে আদরের স্টেশনটির চারপাশের চেনা পথঘাট,গাছপালা,দোকান বাজার, মন্দির মসজিদ! আলো জ্বলে গেলে কি আর সেই মুখগুলি দেখা যায়? তখন কেবল আঁধার বনাম আলো! চেনা চা দোকানের আঁচের ধোঁয়াটিও শেষ বিকেলের আলোয় বড় আপনার!
     
    দুটোর জন্যই নতুন গেঞ্জি কেনা হয়েছিলো। সুজিত স্টোর্সের সাদা প্লাস্টিকের প্যাকেটটা যত্ন করে কোথায় গুঁজে রেখেছে খুঁজতে খুঁজতেই রাগারাগি, দোষারোপ আর দেরী! বড়োটির মিকি মাউস, ছোটোটির পাওয়া গেলোনা, সে মুখ গোঁজ করে থাকলে খানিক, তারপর বাছলে লাল হলুদ ডোরা কাটা। রঙচঙে মিকি মাউসের পেছনের জমিনটি সাদা, কিন্তু ফাঁকা মাঠে মিকি মাউসকে যাতে একলাটি, বোকাটি না লাগে সে জন্যই বুঝি সাদা জমির উপর ফ্যাকাশে লালের সরু ডোরা টানা হয়েছে, যারা মিকিকে একলা হতে দেয়নি। ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে সঙ্গ দিচ্ছে, কিন্তু সামনে মোটে আসছেনা!যেন ওদের মানা করে দেওয়া হয়েছে!পেছনে সেই মরা চেহারার ডোরাগুলি মিকির রং ঢং কে আরও উজালা , আরও ডগমগানি সাপ্লাই দিচ্ছে, ঠিক যেমন নাচনে নায়কের পিছনে পাঁচ টাকার দল! 
     
    মিকি জামা আর লাল হলুদ ভারী খুশী আজ। ট্রেনেও পাওয়া গেছে দু মুখো দুটি জানলার ধার! বিবর্ণ ঘিঞ্জি ঘর বাড়ি, কারশেড, হাট বাজার ছাড়িয়ে রেলগাড়ি যখন খেত খামার, গাছ পালার দেখা পেয়ে একটু দম পায়, মাথার চুল উড়িয়ে ছুটতে পারে, তখনই আসতে আসতে ওদের চোখ ঢুলতে থাকে। তাদের দেখতে দেখতে মায়ের কানেও আবছা হয়ে আসে ঝালমুড়ি, দিলখুস ভেজিটেবিল চপের ডাক। ভাতের ঘুম জড়িয়ে ধরে তাকেও। চটকা ভাঙায়--- “গুরুনা ভজিনু সন্ধ্যা সকালে….”! ইলেকট্রিক ট্রেনের পোড়া গন্ধ ঢেকে যায় সেই কবেকার লাল ধুলো মাখা ছাতিম গন্ধে! লম্বা খোঁচা খোঁচা দাড়ির প্রায় অন্ধ বুড়ো। গলায় তুলসী মালা। মানুষটি খঞ্জনি বাজিয়ে ধরা গলায় গায়, হাত ধরে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে ঠিক বড়োটির বয়সের, বড়োটির মতোই রোগা পাতলা ছেলেটা। সামনে এসে হটাৎ থমকে দাঁড়ায়! চোখ তার বড়টির উপর, না, তার বুকের উপর। রঙ্গীন মিকি মাউস আঁকা নতুন… নতুন জামাটি!আহা! কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপর হটাৎ যেন স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে সে দাদুটির হাত ধরে এগিয়ে যায়, হাত পাততে পাততে দু দিকেই।মায়ের বুক টন টন। বাকি সময় বয়ে যায় শুধু বালকের চোখ দুটি ভেবে। তারপর মরা আলোয় কাঁধে ব্যাগপত্তর আর দু হাতে দুই শিশুর হাত ধরে সে নামে তার জায়গায়, বুকে রেখে আরেকটিকে। তারপর তো…
     
    কে এলোরে দোর /খোলোরে…
    খাবার দাবার/ বালিশ শোবার…
    এ বাড়ি ও বাড়ি /কাঁটাচচ্চড়ি…
    এ পাড়া বে পাড়া /“উফফ প্লিজ দাঁড়া”…!
    কমলা কেবিন/ রোল চাউ মিন…
    শম্পা- কাকলি /হাসি গলাগলি…
    ভাই আর দাদা /হবেই আলাদা?
    এই বার যাই/ স্কুলের কামাই..
    সোমবারে যাতে/পারিগো পাঠাতে।
     
    ফেরার দিনও দুটি খেয়ে তবেই বেরোনো। একবার ভাবে কাচা জামাটা খবরের কাগজে মুড়ে হাতের কাছে রেখে দি? যদি দেখা হয়? বড়োটিকে পরে বুঝিয়ে বলবে। ওই রকম আরেকখানা নিশ্চই বললে আনিয়ে দেবে, দেবেনা? হিসেবি মনটি বলে ওঠে, না থাক গা!কি দরকার? যদি না নেয়? ভরা কামরা লোকের মধ্যেতে সে আরেক দিককত! এর মধ্যে সে জামা গায়ে উঠে যায় মালিকের। ভেজা মনটাকে ঝেড়ে ঝুড়ে, টান টান করে শুকিয়ে নিয়ে মা এড়ি গেড়িদের নিয়ে আবার গিয়ে ওঠে ট্রেনে। জায়গা ধরার সমস্যা নেই, শুরুর স্টেশন তাও আবার উল্টোদিকে। ট্রেন ছাড়ে, মাঠ পেরোয় নদী পেরোয়, পেরোয় নদীর ধারে ইস্কুল। এক টান পিছনে আর এক টান সামনে নিয়ে মা ছোটে আর ছোটে। ট্রেন থামে বেজায়গায় কোথাও। সিঙ্গেল লাইনতো! চেনা সুরটি যেন ভেসে আসে? এক মন বলে, এসো এসো দেখি তোমায়, আরেক মনে আফসোসের হাল্কা ওস । এগিয়ে আসে সে, সেও তো চিনেছে, আর তাই বুঝি এক ঝটকায় ঘুরিয়ে নেয় শুকনো কচি মুখখানি, তারপর একটু ঝটপট করেই তাদের পেরিয়ে অন্য দিকে চলে যায়।! পয়সা বের করেও কেউ কেউ তাই দিতে পারেনা। ঠাহর করতে না পেরে বুড়ো ডাকে…. “ অ…গোপাল”! চোখ দুটি আজ যেন একটু জল জল , একটু জেদি জেদি? পলকের দেখা তবু…! মা ভাবে আর ভাবে!এ ছেলে তো জাত ভিকিরি নয়!ভালোই হয়েছে! তাকিয়েছিল জামার দিকে আগেরদিন ? বেশ করেছে! রং কে না ভালোবাসেগো? আহা কচি শিশু, পৃথিবীর রঙ চং ও দেখবেনা তো কি দেখবে ওপাশের ওই চিমড়ে মিনসে? উঠে থেকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েই আছে ইদিকে!
    কিন্তু দেখো কেমন ওই ছেলের বুদ্ধিটি!কেমন টপ করে ধরে ফেললে বলো, মিকি মাউস ওর দিকে চেয়ে হাসেইনি ? আসলে মিকি মাউসতো সকলকে খেলাই নেয়না , তার হাসবে কি? ছেলেদের বাপ লক ডাউনের পর তার কাজটি ফিরে না পেলে তার ছেলেদেরও ওই প্রাণীই হাসির ঠারে আসলে মুখ ভেঙচাতো , হাসতে বয়েই যেত তার!
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুমিতা | 103.25.***.*** | ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ২১:১৬526220
  • এতো মা আর তার তিন ছায়ের গপ্পো। খুব দরদী লেখা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন