এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  সমাজ

  • রবীন্দ্রনাথ : জয়িতা ভট্টাচার্য

    Jayeeta Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সমাজ | ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ৯২৩ বার পঠিত
  • রবীন্দ্রনাথ : জয়িতা ভট্টাচার্য
    ...................................................
    রবীন্দ্রনাথকে আমরা অনেকদিন  ধরে ভুলে গেছি। আসলেই ভুলে গেছি। আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে বাঙালির একটি পুঁজিকে জানি। যা আমাদের আটকে ফেলেছে একটা পিঞ্জরে। অনুষ্ঠানে, সিনেমার উদ্বৃত্ত অংশে, শোকসভা বা কবিতা উৎসব নিদেন এলিটিসম এর প্রমাণ দিতেও সেই রবীন্দ্রনাথ। আমরা রবীন্দ্রনাথ ভাঙিয়ে খাই। আর কিছু করার চেষ্টা করিনি আমরা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। এই অবধি পড়ে অবশ্যই কোনো কোনো রবীন্দ্রপ্রেমী রেগে যাবেন। ইনসিকিয়োর্ড ফিল করবেন! কিন্তু একবার যদি নিজেকে প্রশ্ন করে দেখি, আমরা কতটা ভেবেছি রবীন্দ্র দর্শন নিয়ে, কতটা? যতটা আমরা দেরিদা, হাইডেগার লাঁকা নিয়ে সমস্যা লিপ্ত থাকি তার এক চতুর্থাংশ আমরা রবীন্দ্র দর্শন আত্মস্থ করতে পারি নি। যে অন্তর্নিহিত শক্তি বিশ্বের পরমা প্রকৃতি সৃষ্টি করে চলেছে সেই অন্তর্নিহিত শক্তি  রবীন্দ্রনাথের চেতনার উৎস। কিন্তু তিনি তো অনন্য। তাই সেই চেতনার সঙ্গে  যুক্ত হয়েছে ইয়ুরোপের গতিবাদও। 
     
    পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এই অবিশ্রান্ত সৃষ্টির ধারাকে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু অনুসরণ করেছেন আমরা এই একবিংশ শতকে এসেও যে কোনো পরিবর্তনই গ্রহণ করতে পারিনা সহজে। পারেন না তাঁরাও যারা সমাজে রবীন্দ্র অনুরাগী বলে প্রতিষ্ঠা পান। বেদ উপনিষদের মায়াবাদী দার্শনিক তত্ত্ব থেকে তিনি নেমে এসেছেন বাস্তব জগতের সুখ দুঃখের, ঘাত প্রতিঘাতময় যাপন কথায়। সসীমের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন অসীমকে। তাঁর মানবদতাবাদ, জীবনদর্শন, মরমীবাদ, অদ্বৈতবাদ ও সর্বৈশ্বরবাদ দর্শন চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রবন্ধগুলিতে, পত্রালাপে, জীবনস্মৃতিতে, ছিন্নপত্র, শান্তিনিকেতনে নিয়ে লেখায় ও "হিবার্ট বক্তৃতায়"। সমকালের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রাসঙ্গিক তা বুঝতে গেলে এই দার্শনিক রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হবে।
     
    শোক, দুঃখ, বৈষয়িক ও সাংগঠনিক অজস্র কাজ অগ্রাহ্য করে নিমগ্ন থেকেছেন সৃজনে। কতখানি? যতখানি রয়ে যাবে শত বছর পার করেও। আর তিনি রয়ে যেতে পারলেন আরও একটি কারণে তা হলো তাঁর গতিময়তা। শব্দ একটি প্রবাহ। তিনি নিজের ইচ্ছে মতো তাকে ভেঙেছেন বারবার, গড়েছেন, অনসশরণ করেছেন, অনুকরণও করেছেন। একদম ছোট্ট একটা হিসেব - তিনি ১৯১৫ টি গান লিখেছেন, ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৪৮টি নাটক, ৯৫টি ছোটো গল্প, ১৯খণ্ডে চিঠিপত্র ও ২০০০ ছবি এঁকেছেন। অর্থাৎ  তিনি সৃজনের মধ্যেই বাস করেছেন। এটি তাঁর প্রধান সত্ত্বা। ধ্বনি মানুষকে সবচেয়ে আগে স্পর্শ করে একথা উপলব্ধি করে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ গান রচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রভাবিত করেছে তাঁর বাড়ি তে বড় দাদা, দিদিদের, সঙ্গীত চর্চা, যদুভট্টর  মতো মানুষের যাতায়াত।
     
    প্রথম গানটি মনে করিয়ে দিই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ১২৮১ সালে, "গগনের থাকলে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে", পরপর তিন বছর শুরুতে একটি করে গান লিখে নিজেকে যাচাই করে নিয়েছেন, ১২৮৬ সালে লেখা "এক সূত্রে বাঁধিয়েছি সহস্রটি মন" যদিও গানগুলির সুরকার সম্পর্কে বিতর্ক আছে। এই এক হাজার নশো পনেরো টি গানের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমরা বড়ো জোর একশত গানই গাই বার বার। এ আমাদের স্থবিরতা। তিনি তো জলপ্রপাতের মতো সৃষ্টির উল্লাসে মেতেছেন হাজার শোক দুঃখ ব্যাধিতেও। তিনি প্রেমে ছিলেন তাই জরা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। নতুন যুগের সৃষ্টি শীল মানুষের রবীন্দ্রনাথের যা শেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো তাঁর অনমনীয় মনোভাব। কে কী বলবে, পাঠক পড়বে কিনা, লেখাটি ভালো না খারাপ, ব্যকরণসম্মত না অশুদ্ধ এসব নিয়ে তিনি কখনো বিচলিত নয়। এখনকার দিনেও তরুণ কবিদের শুনতে হয় ভাল হয় নি বা অকবিতা, খারাপ গান, এসব সমালোচনা শুনে লেখকরা পথভ্রষ্ট ও নিরাশ হয়ে পড়েন। ভয়ে পেয়ে তারা আর নতুন কিছু করার ঝুঁকি নেয় না। গড্ডালিকা প্রবাহে গতানুগতিক লেখা লিখতে থাকেন ঝটিতি সুনামের আশায়। সমকালীন কবিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এখানেই প্রসঙ্গিক। তাঁর প্রথম দিককার গান বা কবিতা গুলি প্রায় কাঁচা, তেমন অবিস্মরণীয় কিছুই নয়। কিন্তু তিনি থেমে যান নি। একেবারে নিজের স্টাইলেই লিখে গেছেন নিরন্তর। অনেক সময় লিখেছেন free verse বা মুক্ত ছন্দে, ছন্দ শৈথিল্য লক্ষ্যণীয় "চিত্রাঙ্গদা", "শ্যামা" প্রভৃতি তে। যেখানে প্রভাবিত হয়েছেন বিদেশি গানে, বাউল বা মার্গ সঙ্গীতে নিজের গানে তা অনুকরণ করেছেন অবিচলিত ভাবে।
     
    এখানে আবার আমরা কিছু গান উল্লেখ করতে পারি, "আহা আজি এ বসন্তে" ও, "ওহে দয়াময় " =go where glory waits thee , মায়ার খেলা ও দেখিবি রে ভাই, আয় রে ছুটে=the vicar of Bray, কালমৃগয়া মানা না মানিলি=the British Grenadiers , কালী কালী বলো রে আজ=Nancy Lee , বাল্মীকি প্রতিভা  পুরানো সেই দিনের কথা =Auld lang syne তেমনই, "বেঁধেছিলেন প্রেমের পাশে"=চাঁচরের চাকুর আধো (কাফি কানাড়া রাগ) অথবা যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে=হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে - লোকগান যা তিনি শিলাইদহের বোটে বসবাসকালীন গ্রহণ করেছেন। বা আমার সোনার বাংলা=লোকগান, কোথায় পাব তারে, গগন হরকরা। রবীন্দ্রনাথের এই গ্রহণক্ষমতা, এই মুক্ত মন তাঁর সাহস আমাদের পাথেয়। আইরিশ, স্কচ, ইংলিশ ফোক/লোকগীতির প্রতি তিনি আকৃষ্ট ছিলেন। সেকথা তিনি মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন। কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি যেমন ইচ্ছে  লিখেছেন যা অচিরেই তাঁকে করে তুলেছে আইকন। যেমন লিখেছেন ব্রহ্মসঙ্গীত সেই একই মানুষ লিখছেন, চিরকুমার সভায়,
    "অভয় দাও তো বলি আমার Wish কী_
    একটি ছটাক সোফার জলে
    পাকী তিন পোয়া whisky।"
     
    এই dynamic রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক ও অনুপ্রেরণা। আবার রবীন্দ্রনাথ যেমন "হিন্দি ভাঙা" গানকে বহু জায়গায় ব্যবহার করেছেন। ইয়োরোপিয়ান রোমান্টিক সংস্কৃতি সম্পর্কে মুক্ত কন্ঠে নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলতে দ্বিধা করেননি। এই খোলামন ও অন্যকে, অন্য সংস্কৃতিকে মুক্তকন্ঠে স্বীকার করার মনটাও আমরা অহংবোধে হারিয়ে ফেলি। এটাও আমাদের শিখতে হবে। গ্রহণক্ষমতা। রোমান্টিক এর পরিভাষা কী। জীবনস্মৃতিতে তিনি এই বিষয় আলোচনাপ্রসঙ্গে বলছেন, রোমান্টিকের দিকটা বিচিত্রতার দিক, প্রাচুর্যের দিক, জীবনসমুদ্রের তরঙ্গ লীলার দিক, যার বিস্তার, নীল আকাশের নিরনিমেষতার মতো, সুদূর দিগন্ত রেখায় অসীমের নিস্তব্ধ আভাস। এই রোমান্টিকতা তিনি আমাদের সংস্কৃতি তে পাননি, সঙ্গীতে যা চেষ্টা করা হলেও সফল হয়নি। তিনি এটা লক্ষ্য করেছেন যে আমাদের গানে আছে এক বিশ্বব্যাপী বিরহবেদনা, বাক্য হারার বিহ্বলতা যেন। শূন্য দশকের কবিদের কাছে রোমান্টিক কথাটির সংজ্ঞা তাই গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতাবাদ, পুনরাধুনিক বা উত্তরাধুনিকতার সমস্ত বেড়া ভেঙে দিয়েছেন তাঁর উপন্যাস ও নাটকে। সবকিছু অগ্রাহ্য করে সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য। এবং শুধু নিটোল সাহিত্য। এই যে বলছেন, "মানুষের কোনো কথাটার অর্থ  সোজা নয়, ডিক্সনারিতে একটা মানে বাঁধা থাকে আর মানুষ সেই মানে সাতখানা করে"....... এর চেয়ে practical সত্য কথা আর কী হতে পারে।
     
    "শেষের কবিতা", আমার তো বটেই সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক উপন্যাস। এখানে যেমন অদ্বৈতবাদ তেমনই স্যাটায়ার ও উইট। "ইংরেজি ছাঁদে রায় পদবী 'রয়' ও 'রে' রূপান্তর যখন ধারণ করলে তখন তার শ্রী গেল ঘুচে কিন্তু সংখ্যা হলো বৃদ্ধি" - এই দশক কেন আগামী কয়েক দশক এগিয়ে লেখা সাহিত্য চিত্রপট। অথবা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর নিরীক্ষণ  প্রোটাগনিস্ট এর ভাষ্যে, "অমিত বলে ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা মুখশ্রী ।...যারা সাহিত্যের ওমরাও দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে স্টাইল তাদেরই। আর.... দশের মন রাখা যাদের ব্যবসা ফ্যাশন তাদেরই .... বঙ্কিমি ফ্যাশনে ...... নসিরামের লেখা নসিরামকে দিয়েছে মাটি করে ....."
     
    শুন্য দশকের বহুল আলোচিত একটি বিষয়। "কবিমাত্রের উচিত পাঁচ বছর মেয়াদে কবিত্ব করা.... যে সব কবি ষাট সত্তর অবধি বাঁচতে দ্বিধা করে না তারা নিজেকে শাস্তি দেয় সস্তা করে। ...... তাদের লেখার চরিত্র বিগড়্ যায়, পূর্বের লেখা থেকে চুরি করে হয়ে পড়ে .... "রিভার্স অব স্টোলেন প্রপার্টি” কথাটি চিরকালের মতো একটি সারসত্য যা সাহিত্যসমালোচকরা বারংবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন সমকালেও। এবং রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এমন স্পষ্ট উচ্চারণে  আর কে বলতে পারেন এই কথা। উপরোক্ত কোট গুলি বলা বাহূল্য "শেষের কবিতা" (প্রকাশকাল ১৩৩৫ প্রবাসী পত্রিকা) আজ ২০২০ তে দাঁড়িয়ে যা ভয়ানকভাবে  প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ মিলিয়ে দিতে পেরেছেন উপনিষদ ও ইয়েট্স। রবীন্দ্রনাথের মতো মডার্ন আমরা হতে পারি নি। "শেষের কবিতার" প্রতিটি ছত্রে স্যাটায়ার আর নিবিড় রোমান্টিশিসম্ এর মেল বন্ধন। প্রতিটা গানে ছুঁয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর ও জীবনের ঋতুচক্র।
     
    অনেক জায়গায় নারী সম্বন্ধে তাঁর নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। কিন্তু আধুনিক নারীবাদের দৃষ্টান্ত আমরা দেখি তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে। যেমন,
     
    চোখের বালিতে      বিনোদিনী
    ঘরেবাইরে                 বিমলা
    চতুরঙ্গের               দামিনী
    শেষের কবিতার     লাবণ্য
    নষ্টনীড় এ               চারুলতা
    স্ত্রীর পত্রে             মৃণালিনী
    মননশীল আধুনিক নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন।
     
    আবার বলি রবীন্দ্রনাথের মত আধুনিক আমরা হতে পারিনি। শাশ্বত সত্যকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন "শেষের কবিতায়"। পলিগ্যামি বা বহুগামীতাকে প্রশ্রয় দিতে দ্বিধা করেন নি। যখন অমিত বলে কেতকী দৈনিকের ঘড়ার জল আর লাবণ্য টলটলে দিঘি। দুটোই জরুরি ও থাকতে হবে। শয্যায় কেতকী ও চেতনায় লাবণ্য। এর থেকে সাহসী ও সমকালীন উপলব্ধি নরনারীর সম্পর্কে আর কী হতে পারে। আদ্যন্ত  রাজনৈতিক নাটক "রক্তকরবী "যে কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থার কালে উপযোগী ও প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে অনেক লেখক পূর্বেই আলোচনা করেছেন আজও তা আমাদের রোমাঞ্চিত করে, উত্তেজিত করে। গীতিনাট্য ও নৃত্য নাট্য তাঁর নতুনধরনের কম্পোজিশন। গীতিনাট্যে গানের প্রাধান্য বেশি। গান নিয়ে অনেক নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।পুরাতনীগানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। নৃত্যনাট্য নাটক বা কাহিনীর প্রাধান্য বেশি। কালমৃগয়া, বাল্মীকি প্রতিভা বা মায়ার খেলা নৃত্যনাট্য, শ্যামা, চণ্ডালিকা গীতিনাট্য। মাত্রা ও ছন্দ নিয়ে কী ভীষণ নিরীক্ষা করেছেন। কোথাও একদম ব্যাকরণ মেনে মাত্রাবিভাগ, অন্ত্যমিল আবার তিনিই প্রবর্তন করছেন "মুক্তছন্দ" যা উত্তরাধুনিক কবিতায় এখন বহুল ব্যবহৃত। এভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে যান রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এলিটিস্ট থেকে গৃহবধূর পাকশালে, "ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে " বা শোকের আবেশে "ভরা থাকস্মৃতি সুধায় বিদায়ের পাত্রখানি"। তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে আমরা রবীন্দ্র মহাসাগরে ডুব দিই। শঙ্খ বাবু তাঁর "নির্মাণ ও সৃষ্টি" বইটিতে রবীন্দ্র কবিতায় কবির আত্মবিমোচনের ধারাটি আলোচনা করেছেন, "পুরবী থেকেই দেখা যায় এই ঢালুতট সেখানে তাই কেবলই আসে 'হারিয়ে ফেলা বাঁশি', নাম ভুলে যাওয়া প্রেয়সীর নিঃশ্বাসের হাওয়া, শুকিয়ে পড়া ফুল, "পরিশেষে", পুনশ্চ বা খোয়াই ........ আত্মজৈবনিক এসব ছবিকে শুধু রোম্যান্টিকতা বলা যায় না বোধহয়। এখানে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ছুঁতে থাকেন প্রতি মুহূর্তে।
     
    "শ্যামলী, পত্রপুট বা ছড়ার ছবির কবিতাগুলিকে কবির ছেলেবেলা রূপে ব্যবহার করা হলো" (শঙ্খ ঘোষ)। ঠিক এই কারণেই মানসী, চিত্রা বা কল্পনার মতো কাব্যগ্রন্থে ও গোরা,চতুরঙ্গ বা ঘরে বাইরে-তে ব্যক্তি ও দেশ। থাকে পাশাপাশি। এমার্সনের ধারনার আত্মজীবনীর সঙ্গে ঠিক মেলে না কবির এই জীবনবোধ। ক্রমশ সেই কবিতাই আকার নেয় গদ্যে .... জীবনবোধের উন্মেষ ... স্ট্রীম অফ কনসাসনেস। রবীন্দ্রনাথ নিজে অমিয় চক্রবর্তী কে বলছেন - "ঘরে বাইরে উপন্যাসের মধ্যে কোনো জ্ঞানকৃত রূপকের চেষ্টা নেই"। বার বার ফিরে আসছি রবীন্দ্র উপন্যাসে। কারণ কবির অনুভব যা প্রকাশিত হয়েছে কবিতায় তা পরিনতি লাভ করছে উপন্যাসে। মানুষের জৈবিক গঠনে সবচেয়ে আগে স্পর্শ করে ধ্বনি। তাই অজস্র কবিতা তাঁর গান হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ কুটির থেকে রাজপ্রাসাদ, এলিট থেকে ছাপোষা একেবারে সবাইকে ভাসিয়ে দিতে পেড়েছেন তাঁর গানে, যা জীবনের প্রতিটী অনুভূতির তন্ত্রী ছুঁয়ে যায়। তবুও মননশীল ব্যক্তি মাত্রের কাছে প্রাসঙ্গিক তাঁর চিঠিপত্র, গদ্য ও প্রবন্ধগুলি সমসাময়িক প্রেক্ষিতে হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ।
     
    এই প্রসঙ্গে আবু সয়িদ আয়ুবের "পান্থ জনের সখা" বা বিস্তিরণ গবেষনামূলক সুনীল গাঙ্গুলির উপন্যাস "প্রথম আলো" পড়লে পাঠক অনুভব করতে পারেন কী অসীম শোক, বেদনা, আর্থিক অনটন বা কুত্সা সহ্য করেও সৃষ্টির ধারাকে অনিবার রেখেছেন।  রাজনৈতিক সংকট তাঁকে বিচলিত করে। তাঁর খ্যাতি! তবু ভ্রষ্ট করে না। তিনি ইন্টেলেক্চুয়াল। তীব্র প্রতিবাদ এসেছে তাঁর লেখায়, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে "আফ্রিকা" প্রভৃতি কবিতা প্রমাণ করে তিনি ভাববাদী বা প্রেমের কবি শুধু নন, কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তার বিরোধ - পথের চেয়ে তাঁর মনন অনেক উচ্চস্তরে। আজ তাঁকে নিয়ে যে উন্মাদনা তা অনেকটাই হুজুগ। রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করতে একটি জীবন যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয় কোনো লেখাই। তাই আমরা শুধু মুগ্ধ হতে পারি, রবীন্দ্র মহাসাগরে ডুব দিতে পারি আর তার ট্র্যান্সেন্ডাটেলিসম্ বা অতীন্দ্রীয়বাদকে বোঝার চেষ্টা মাত্র করতে পারি।
     
    রবীন্দ্রনাথের শিল্প ভাবনা কী তাঁর সাহিত্যে পথের প্রতিফলনই নয়? 'অবচেতন' শব্দটির প্রতি আমাদের ঝোঁকের ফলে আমরা অনেক সময় সালভাদর দালি বা ম্যাক্স এর্ন্সটের সঙ্গে তুলনা করে ফেলি। আমরা ভুলে যাই রবীন্দ্রনাথের কথা। তাঁর চিত্রশিল্প পাতাল থেকে উঠে আসা অবচেতনের অনুভব। প্রতিটি চিত্রে অবচেতন মনের প্রতিরূপ। লালসা, যৌনতা বা শচী চেতনা। সেই "প্রান্তিক" এর অবচেতন চিত্র এই সাহিত্যেরই প্রতি রূপ। শিবনারায়ণ রায় বা ধুর্জুটিপ্রসাদ আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেন। দিন শেষে যে কবি বলেন,
       
    "শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে,
    ঐ একটা অনেক কালের বুড়ো, জয়িতা ভট্টাচার্য
    আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে
    আজ আমি ওকে জানাচ্ছি----
    পৃথক হবো আমরা।"

    (শেষ সপ্তক)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ৯২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন