করোনার অতিমারীতে অবসন্ন, বিপর্যস্ত মানুষের মনে অহরহ হানা দিচ্ছে মৃত্যুচিন্তা। অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তো এড়ানো যাবে না। তবে মৃত্যুর পরে নরকবাস এড়াতে চাইলে বেঁচে থাকতে থাকতে অন্তত একটা ভালো কাজ করে যাওয়া ভালো। সুযোগ থাকলে পুঁতে ফেলুন একটা নিম গাছ, একটি পিপুল, একটি বট, দশটি ফুল-ফোটা গাছ বা লতা, দুটো ডালিম, দুটো কমলা আর পাঁচটা আম গাছ। বরাহপুরাণের (১৭২-৩৯) উপদেশ মতো এই কাজ করলে সমাজের মঙ্গল ছাড়া কারও ক্ষতি তো হবে না!
বসুন্ধরা দিবসের সূচনা তো মাত্র ১৯৭৪ সালে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এ বছরের স্লোগান "ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন" -- বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার। মানুষ যে নির্মম ভাবে সীমাহীন লোভে পরিবেশের স্বাভাবিক ছন্দকে ধ্বংস করেছে সেকথা আজ সকলে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। বছরের বিশেষ একটি দিনে আনুষ্ঠানিক বৃক্ষ রোপনের রীতির প্রতি মর্যাদা প্রকাশ করেও স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক যে এর বহু আগে 'বনমহোৎসবে'র উল্লেখ রয়েছে বরাহপুরাণে। রোগ-ভয়ে সন্ত্রস্ত সমকালীন এই সমাজকে এও মনে করিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক হবে না, প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সমাজের কল্যাণের সঙ্গে বনস্পতির ওতপ্রোত সংযোগের মহিমা প্রচারিত হয়েছে। অরণ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝাতে চরকসংহিতার 'বিমানস্থানমে' (৩-১১) স্পষ্টভাষায় সতর্ক করা হয়েছে, গাছ কাটলে, নির্বিচারে বন সাফ করলে তা বিরাট বিপদ ডেকে আনবে। পরিবেশ দূষণ ও বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে। গাছ কাটা ছিল রীতিমতো অপরাধ। আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি, গ্রামাঞ্চলে মানুষের বিশ্বাস ছিল, শ্যাওড়া গাছে ভূত থাকে। কোনও গাছে ব্রহ্মদত্যি। সে সব গাছ কাটতে নেই। তেমনই আবার কোন কোন গাছের সঙ্গে ছিল দৈব সংযোগ। সুতরাং সেই গাছ কাটা পাপ। 'পদ্মপুরাণে' (৫৬-৪০-৪১) বলা আছে, গাছ কাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ আর গাছ কাটলে বা তৃণভূমি ধ্বংস করলে ভবিতব্য নরকবাস। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তো একেবারে নির্দিষ্ট জরিমানা ধার্য করা আছে। নগরের উপান্তের কোন উদ্যানে কেউ যদি কোন ফলের গাছ বা ছায়াদানকারী বৃক্ষের চারা নষ্ট করে তাকে জরিমানা হিসেবে দিতে হবে ছটি 'পনস' বা কাঁঠাল। সেই গাছের কচি ডালপালা ভাঙলে জরিমানা হবে এক ডজন কাঁঠাল। বড় শাখা-প্রশাখা ধ্বংস করলে জরিমানা এক লাফে বেড়ে হবে দু ডজন কাঁঠাল। আর সেই গাছের গুঁড়ি কাটলে বা পুরো গাছ ধ্বংস করলে সোজা আদালতের বিচার।
সনাতন হিন্দু ধর্মে বৃক্ষ ও প্রকৃতি বন্দনার প্রশস্তির প্রকৃত লক্ষ্য হল, মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা গাছ রক্ষা করা তাঁদের আবশ্যিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন। আর সে কারণেই প্রতিটি গাছের প্রতি তাঁরা আরোপ করতেন ধর্মীয় পবিত্রতা। তাই সমাজে খুব সহজেই গাছ হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় আরাধনার বস্তু। এর দৃষ্টান্ত রয়েছে লোকাচারেও। অসমের কাছাড় অঞ্চলে মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল এমনই এক সামাজিক রীতি -- 'রূপসী ব্রত'। বাঙালি হিন্দু রমণীরা সন্তান জন্মের পর নবজাতককে বাড়ির কাছের কোন গাছের পদমূলে রেখে মনে মনে প্রার্থনা করতেন, "হে বৃক্ষ, তুমি যদি আমার সন্তানকে রক্ষা কর, তাহলে আমিও তোমাকে রক্ষা করব।" 'বারোমাসি গানে' এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তেও কোন একটি বিশাল গাছকে 'ভৈরব বৃক্ষ' হিসেবে গ্রামের রক্ষাকর্তা বলে মান্য করার সামাজিক রীতি আছে। মনে করা হয়, রোগ-শোক-বিপদ-আপদ-প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সেই গ্রাম ও তার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে ওই মহীরুহ।
প্রকৃতি ও মানুষের ছন্দোবদ্ধ সহাবস্থানই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির মূল সুর। বেদ, উপনিষদ, স্মৃতি, ধর্মশাস্ত্রে ধরিত্রীকে নানাভাবে মাতৃরূপে বন্দনা করার কথা বলা হয়েছে। বৈদিক দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সেকালের ধর্মচর্চা বা লোকাচারের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় নীতিবোধ তখনকার সমাজে সহজেই গড়ে উঠেছিল। 'নমলিঙ্গানুশাসন' বা বহুল পরিচিত 'অমরকোষে' বিভিন্ন গাছের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য চমৎকার ভাবে বোঝানো হয়েছে। পাশ্চাত্যের ফরেস্ট ম্যানেজমেন্টের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে এর স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করার মতো। 'অমরকোষে' বৃক্ষ, মহীরুহ, শাখী, পাদপ, তরু, অগম প্রভৃতির পৃথক সংজ্ঞা নিরুপণ করা হয়েছে। আবার চরক বলেছেন, ফলদায়ী গাছ হল বনস্পতি, যে গাছে ফুল ও ফল দুই-ই হয় তা হল বনস্পত্য। যে গাছ একবার ফল দিয়েই মরে যায় তা হল ওষধি।
বেদ-পুরাণ-চরক যা-ই বলুন, আমরা শেষমেশ মনের আশ্রয় খুঁজি রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক ভাবনায় -- "ঐ গাছগুলো বিশ্ববাউলের একতারা।"
"হে নিস্তব্ধ, হে মহাগম্ভীর,
বীর্যেরে বাঁধিয়া ধৈর্যে শান্তিরূপ দেখালে শক্তির;
তাই আসি তোমার আশ্রয়ে শান্তিদীক্ষা লভিবারে
শুনিতে মৌনের মহাবাণী..."