যে খাতে জীবন বইছে, টুকরো টুকরো আনন্দগুলোর আর কোনও জায়গা নেই। একদিন এই টুকরো আনন্দের টানে সারাদিন ঘরছাড়া থাকতাম। কত গ্রীষ্মের প্রখর দুপুর, কত বৃষ্টিভেজা মেঘলা দুপুর। মনে হতো, এটাই জীবন। তার বৃত্তের বাইরে সবই তুচ্ছ। এই সব পাকামিতেই থার্ড ইয়ারে ইংরেজি অনার্স কেটে গেল। তাতেও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রফুল্লদের বাঁশ ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে মাচা তৈরি। মাথার উপর খড়ের চাল। বৈশাখ, জৈষ্ঠের দুপুরটা বেশ কাটত। মেয়েদের স্কুলের পিছনে শান্তিকাকুদের বাগান। সেখান গিয়ে আম চুরি। গালাগালি না খেলে আমচুরির মজাই নেই। বিকেল গড়ালে ভাগাড়ের মাঠে ক্রিকেট। তবে দুপুর আর সন্ধে তাসের আড্ডায় মন বুঁদ হয়ে থাকত আমাদের। আর থাকত গড়ের মাঠ হয়ে পড়া পকেট থেকে দুই-তিন টাকা চাঁদা তুলে ঝালমুড়ির উৎসব। পর্বতপ্রমাণ মুড়ির পাহাড় থেকে কখন যে চপ বা চানাচুরের টুকরোগুলো নিমিষে শেষ হয় যেত! ইসকাপন, রুইতন পাত্তি ফেলার ফাঁকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সাদামাটা অনাথ মুড়িগুলো। তখন আর কেউ তাদের মুখে তোলে না যে।
যারা অলরেডি স্কুলছুট হয়ে গিয়ে পাড়ার কারখানায় কাজে লেগেছে, তাদেরই বেশির ভাগ কন্ট্রিবিউশন থাকত এই ঝালমুড়ি উৎসবে। তাই, দেবা, কুরলেরা আমাদের কাছে একটু ধনী। লেদ মেশিনে কাজ করে সপ্তাহান্তে পকেট ভারি থাকত তাদের। আমি তখনও কাজে ঢুকিনি। মাচায় তার প্ল্যান কষা হচ্ছে। এভাবেই চলত টুকরো টুকরো আনন্দের ভাগবটরা। বর্ষাকালের মজা আরও অন্যরকম ছিল। ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের সেই বিভীষিকা রাতে মৎস চুরির অভিযানের মতো প্রতিদিনই বেরতাম মাছ ধরতে। বিদ্যুৎ নেই। ফাঁকা জলা জমিতে আমাদের দুই-চার খান বাড়ি। ঘর থেকে বেরলেই এক হাঁটু জল। রাস্তা থাকত জলে ডুবে। কুরলের বাবার চার ব্যাটারি টর্চ, আর পলাশের বানানো স্পেশাল বর্শা দিয়ে চলত মৎস অভিযান। কই, সিঙি, কাঁকড়া তো পেতামই। কখনও বরাতে জুটত কচ্ছপও। সাপের ভ্রুক্ষেপ ছিল না। পচে যাওয়া জমা জলে শরীর খারাপ হওয়ার দুশ্চিন্তাও ছিল না। নিকষ অন্ধকারের সঙ্গে ছিল অমোঘ বন্ধুত্ব।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশি কিছুদিন ঘরছাড়া। দ্বিতীয় ওয়েভে পড়ে গেল লকডাউন। ভয়াবহ পরিস্থিতির জেরে লকডাউনের মেয়াদ বেড়েই চলেছে। তার সঙ্গে বাড়ছে আমার উৎকণ্ঠাও। কত দিন বাবা-মার সঙ্গে দেখা হয়নি। কত দিন নিজের বিছানায় আরাম করে শুয়নি। বাধ্য হয়েই অফিস-কলিকের মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি চলে এলাম একদিন। হঠাৎ দেখায় বাবা-মার চোখ ছলছল হয়ে উঠল। বকুনিও খেলাম একমুখ দাড়ির জন্য। সবই তো ঠিক, কিন্তু সেই সব বন্ধুরা? আগে বলে রাখি, আমাদের এই পাড়া আর সে দিনের মতো নেই। অনেক উন্নত হয়েছে। গিজগিজ করছে বাড়ি। দু'দশকের মধ্যেই সময়ও কত বদলে গিয়েছে।
বাঁশের মাচা আর নেই। আশপাশের নির্মীয়মাণ বাড়ি সে সব বন্ধুদের এখন আড্ডার জায়গা। যারা প্রতিষ্ঠিত তাদের আর দেখা মেলে না। কেউ কেউ বাইরে আছে। দেবা, কুরলেরা আজও আড্ডা মারে। অনেক দিন পর তাদের সঙ্গে দেখা হতে একটি নির্মীয়মাণ বাড়িতে আড্ডা দেওয়া গেল। তাস এখনও চলে। সে দিন শখ করে ঝালমুড়ি নিয়ে আসা হয়েছিল। সে দিনের 'ধনী' দেবা, কুরলেদের আর সেই পকেটের জোর নেই। লকডাউনের জেরে অনেক দিন ধরেই বাড়িতে দেবা। দুই মেয়ে। বড়টা মাঝে মাঝেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। স্নায়ুর সমস্যা ডাক্তার বলেছে। দামি দামি ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই। প্রথম লকডাউনে সোনার দোকানের কাজটা বন্ধ হয়ে যায় কুরলের। কিছু জমানো টাকায় তিন-চার মাস সংসারটা চলে। তারপর বাধ্য হয়েই স্ত্রী ও ৩ মাসের সন্তানকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেয় সে। পাড়ার একটা কারখানায় কাজ জোটাতে পারলেও এবারের লকডাউনে রোজ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। যা হোক করে চলছে ৪টে প্রাণ। কুরলের বাবা অনেকদিন হল গত হয়েছেন।
সংসারে এ সব বিষন্নতা যেন হরতন, রুইতনের রাজা-রানি-গোলাম পাত্তিতে মাখামাখি হয়ে আছে। মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসে তাদের দলা পাকানো কষ্ট। তাস আর ঝালমুড়ির সঙ্গে এখন তাদের নতুন বন্ধু হয়েছে বাংলা। সন্ধের আড্ডায় কম পয়সায় এটাই তাদের পুষ্টিকর পানীয়। গলা-বুক জ্বালিয়ে দিয়ে উদরে প্রবেশ করলেই সব শান্তি। অন্তত আজকের রাতটুকু। কাল তো আবার লকডাউন। দেবার অনিশ্চিত কাজ। কুরলের হাফ রোজ। ওর বৌ কতদিন ওকে বলেছে একটা দুধের ডিপে এনে দিতে। গা করেনি। আজ এ কথা শুনলে, বাংলা আবার তাকে ভুলিয়ে দেবে। এইটুকুই শান্তি। তাদের এসব কথা শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। রং ভুল করি। ভুল হওয়ারই কথা। ওদের বেরঙিন জীবনে এ রংয়ের কী মূল্য। প্লাস্টিকের গ্লাসে মিনারেল ওয়াটারের মতো স্বচ্ছ বাংলা পানীয় গলায় ঢেলে কুরলে খেঁকিয়ে ওঠে, কী রে সব ভুলে গেছিস নাকি, রং তো ক্লাবস, গোলামটা ফেল...