এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • আগজা

    নিনা গাঙ্গুলি লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২২ মার্চ ২০১১ | ৭৮৫ বার পঠিত
  • "হোলি', বিহারে সবচেয়ে বড় তেওহার। বাপরে সাজ সজ রব পড়ে যেত "ফাগুয়া আ গইল বা" । মা, দিদিরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ত সব্বার নতুন জামা কাপড় আর কাজের লোকেদের তাদের মনপসন্দ সব নতুন জামা কাপড় দেবার জন্য বাজার করতে। আমাদের ছোটদের, মেয়েদের হত সাদা অর্গ্যান্ডির ফ্রক--মা নিজেই সেলাই করত, পরে দিদি। আর মা একটা খুব নরম মলমলের লম্বা জোব্বা টাইপের জামা বানাত--ঐ ম্যাক্সির মতন আর কি! সেও একজনের জন্য--বলছি পরে কার। এ ছাড়া বাবার হাইকোর্টের মুন্সী নাত্থুজীর ( মুসলমান, কিন্তু নতুন জামা পরতেন) লোয়ার কোর্টের চাপরাসী জানকী প্রসাদ এরকমও কিছু লিস্টে ছিল---আর ছিল নাগিনা ডোম !!

    এই নাগিনা ছিল এক অদ্ভুত চরিত্র। রোগা ডিগডিগে বেখাপ্পা লম্বা, চোখদুটো সবসময় টকটক করছে লাল, পরনে নোংরা ধুতি আর ফতুয়া, নেশায় টলছে , সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতনা--আর ছিল পিলে চমকে দেয়া বাজখাঁই গলার আওয়াজ! সব ছোটরা, আমরা খুব ভয় পেতাম ওকে। নেশাখোর নাগিনা মাঝে মাঝেই উদয় হত , বাইরে দাঁড়িয়ে বিকট চেঁচাত "বাবুজি নাগিনা ডোম আইলবা' । বাবা বেরোলেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম আর "বাবুজি কাম দিউ, ভুখা বানি" টলতে টলতে দুটো নালাও পরিষ্কার করে উঠতে পারতনা, কিন্তু ভিখ নেবেনা, সেই জেদ ছিল। মাকে মাইজী ডাকত আর খুব ভয় পেত কারণ মা বলত--যা নহা কে আব" অত বড় মানুষটা ভ্যঁ¡ ভ্যঁ¡ করে কাঁদত, কিছুতেই চান করবেনা---কত রকমের বাহানা বুখার হয়েছে, গায়ে খুব ব্যাথা ইত্যাদি। রুটি গুড় আর চা এ ছাড়া কিচ্ছু খেতনা, দিলেও না । কখনও কখনও নেশার ঘোরে নালা পরিষ্কার করতে গিয়ে নালার মধ্যেই পড়ে থাকত। যাইহোক, এই নাগিনা এলেই একটা হৈ হৈ রই রই পড়ে যেত বাড়ীতে---বাড়ীর চাকর বাকরদের একটা মস্ত খোরাক ছিল এই মানুষটা----ওরা পেছনে লাগত "কেকর জোরু, তোরা মেহেরারু' বল্লে ও ভীষণ ক্ষেপে যাতা গালাগালি করত, ঢিল ছুঁড়ে মারত।

    এই দেখ, হোলি থেকে কি আনহোলি কথায় চলে গিয়েছিলাম, সরি!

    হোলির দিন সক্কালবেলা পুরোনো জামা পরতাম। ফুলহাতা জামা, যাতে গায়ে হাতে রঙ কম লাগে, আর সাদা জামা , রঙ লেগে বেশ খোলতাই হয় যাতে। গায়ে মাথায় আচ্ছা করে মাখতাম সর্ষের তেল মাখতাম - পরে চানের সময় ঐ বাঁদুরে সবুজ রঙ রুপোলী পেন্ট সটাসট উঠে যাবার টোটকা আরকি । তারপর কচিকাঁচা ছেলেমেয়ের দল বেরিয়ে পরতাম পাড়ায় ---বাড়ী বাড়ী ঘুরে খেলা--বাড়ীর সামনে গিয়ে হাঁক "বুরা না মানো, হোলি হ্যায়" সেই বাড়ীর লোকজন বেরিয়ে আসত রঙ খেলতে, আর যে বাড়ীর লোকজন বেরোতনা তাদের জানলা দিয়ে রঙভর্তী বেলুন ছুঁড়তাম ( ইস,কি দুষ্টুই ছিলাম তাই ভাবি) আমি একজন পালের গোদা কারণ হাতের টিপ ভাল ছিল। অব্যর্থ। জানলা গলে বেলুন চলে যেত। এই করে সারা পাড়া হৈ হৈ করে সব্বাইকে রঙ দিয়ে , নিজেরা ভূত হয়ে বাড়ী ফিরতে ফিরতে সেই বেলা একটা । শুরু হত "স্নান প্রজেক্ট' অনেক ঘষেও সব রঙ একদিনে উঠতনা। চান করে হাল্কা ঝোলভাত খেয়ে ছোট্ট একটা ঘুম---কারণ বিকেল থেকে শুরু হবে হোলির নেওতার খানা, পুয়া পুরী পাকওয়ান ( হে হে পিনা ছিলনা, ধ্যুস!)

    মেনু হত ডালপুরি, না না ছোলার ডলের নয়--অড়হড়-দাল তাও আবার সর্ষের তেলে সেঁকা ভাজা ( বিহারী ডেলিকেসি, যে খেয়েছে সে জানে তার স্বাদ নয় "সোয়াদ') ঝাল ঝাল আলুরদম, মীঠা পোলাউ, গরগরে মাংস, ক্ষীর ( ঘন খোয়া-ক্ষীর) আর মালপো। সারা বাড়ীতে কি খুশবু সেসব রান্নার! আর একটা জিনিষ মা বানাত চাল-ডাল আর আলু দিয়ে সাদা খিচ্‌ড়ী, ঘী পড়ত কিন্তু নুন না। এই সাদা খিচুড়ী একজনের জন্য তৈরি হত।

    বিকেলে সব নতুন জামা পরে রেডি। বাড়ীতে আসতেন বাবার বন্ধুরা। বিকেলে ঠাকুরের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করে তারপর গুরুজনদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করে শুরু হত বিকেলের আবীর খেলা--সুখা হোলি। সবাই সবাইকে নানা রঙের আবীরে রঙীন করত--শুরু হত খাওয়া-দাওয়া । সিয়াবাবু কি একটা শরবৎ বানিয়ে আনতেন, শুধু বড়দের জন্য, আমরা বাদ ( হে হে এখন বুঝি ভাঙ্গের) কত হাসি গল্প ঠাট্টা, মা দিদিরা গান গাইত, আমরা ছোটরা কবিতা বলতাম । গুরুবচনচাচাজী শায়রি বলতেন।

    ও হ্যঁ¡ আমাদের বাড়ীর পাশে গুরুদয়াল অ¡র উত্তীমলালের খাটাল ছিল। এই দুই যাদবভাই হোলি সিজন মাতিয়ে রাখত। রাত নটা-দশটা থেকে শুরু হত তাদের যাদব-গোষ্ঠীর হোরি-ধুন চৈতি গান ( হা হা গান না gun) হেঁড়ে গলায় সুরের ভুষ্টিনাশ, তার সঙ্গে ঢোলক ডুম্‌ডুমাডুমডুম ধ্‌ম , ঠনঠনাঠন খঞ্জুনি --মাঝে মাঝে পাড়ার নেড়ি কুকুর গুলো ভয়ে উঁউউউউ করে কেঁদে উঠত ( না গানে যোগ দিত, কে জানে) আরও রাত করে শুরু হত নৌটঙ্কি নাচ --কি হুল্লোড়! ছোকরা মেয়ে সেজে নাচত যদিও--তা তাও আমাদের ছোটদের দেখা বারণ ছিল--কারণ ভাষা ও অঙ্গভঙ্গি বেশ R রেটেড হয়ে উঠত। ঐ খুব চুরি করে জানলা দিয়ে একটু আধটু যা দেখেছি--খুব রাগ ধরত বড়দের ওপর--সবতাতে যে কেন এত না না ছিল, উফ!

    তো, এই হোলির নেওতায় নিয়মিত ছিল নাগিনাও। আসত বিকেল পাঁচটা নাগাদ। মা ওকে তেল, সাবান নতুন গামছা আর জামা কাপড় দিত। ঘষে ঘষে চান করত সে, ঝাঁকড়া চুল পরিপাটি করে ঝুঁটি বাঁধত। পরিষ্কার চেহারা, নতুন ধুতি-ফতুয়া পরে বেশ ভাল দেখাত। চেনাই যেতনা। আর সেদিন সে থাকত একশ শতাংশ সোবার, কোনও নেশার জিনিষের ধার দিয়ে যেতনা। আমাদের ছোটদের একটা করে নিজে হাতে বানান তালপাতার সেপাই গিফ্‌ট দিত আর হেসে বলত "ডরো নহি খোখি, ই হই আচ্ছা আমদি নাগিনা'। আমদি হল গিয়ে পাটনাই ভাষায় আদমি।

    তো, এসবের বহুদিন আগের এক হোলির কথা। আগজার দিন , হোলির আগের দিন যেদিন রাত্রে হোলিকাকে পোড়ানো হয়। নাগিনা তখন জোয়ান মরদ। কয়েকটি উঁচা ঘরানার বড়লোকের ছেলেরা , যারা এখনও বিহারের রাজনীতি দাপটে বেড়ায়,সেদিন কোনও গ্রাম থেকে একটি গরীবের যুবতী মেয়ে কিম্বা বউকে তুলে এনে, তার ওপর অকথ্য অত্যাচার করে। নাগিনা ডোমকেও টাকা, গাঁজা ভাঙ্গ মদ নিজেদের থেকে পরসাদি দেয় এবং ভোগ্যা মেয়েটেরও পরসাদি পায় নাগিনা। নেশার ঘোরে কারুরই জ্ঞান ছিলনা। এবং যাবার আগে মেয়েটিকে পুড়িয়ে দেবার ব্যাবস্থা করে যায় ঐ নাগিনা ডোমের সাহায্‌যে --নাগিনার যখন হুঁশ হয় , তখন বহু দেরী হয়ে গেছে। আর মেয়েটিও এতই দুর্ভাগা যে সে পোড়ে সাংঘাতিক ভাবে কিন্তু মরে না। সেই আধপোড়া মেয়েটিকে নাগিনা নিজের খোলিতে রাখে, সাধ্যমত সেবা করে বাঁচায়--কিন্তু সে চোখে ভাল করে দেখতেও পেতনা, কোনও কিছু চিবিয়ে খেতেও পারতনা আর শুধু গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর তার কোনও ভাষাও ছিলনা। সেই পঙ্গু দলা পাকানো মেয়েটির কেউ কোনওদিন খোঁজ করেনি---নাগিনার কাছেই সে থেকে গেছে।

    এরই জন্যে প্রতি হোলিতে ঐ সাদা খিচুড়ী, মলমলের আলখাল্লা -জামা , ক্ষীর মালপো বুকে করে নিয়ে -----সারা শহর যেদিন ঝুম বরাবর ঝুম শরাবি আনন্দে মেতে থাকে ---রোজকার নেশাখোর নাগিনা---১০০% সোবার , লম্বা লম্বা পা ফেলে আমাদের বাড়ীর গেট পেরিয়ে চলে যেত-- --আর একটি অনুতপ্ত হোলি উদযাপনে!!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ২২ মার্চ ২০১১ | ৭৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন