প্রথমে তক্কোটা হচ্ছিল ট্যাব দেওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে। পাক্কা এক পাতা আলোচনা চলার পরে জানা গেল সরকার কাউকেই ট্যাব-ফ্যাব দেয় না, দেয় ট্যাব কেনার জন্য ১০ হাজার টাকা। এবারে সবাই যে যাঁর মতো আগের আলোচনাকে গিলে ফেললেন! তখন ব্যাপারটা দাঁড়াল সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে। এখানেও বিষম গণ্ডগোল!
কেউ ভাবলেন সিপিএমের এলেবেলে সমর্থকদের কথা যারা তিনো কেন এত ভোট পেল/পাবে বলে কেঁদে বেড়ায়। কেউ পুরুষদের হিংসেয় বুক ফাটা দেখতে পেলেন। তো কেউ তরুণ প্রজন্মের ১০০% বিজেপির ভোটার - সে সম্পর্কে নিঃসন্দিহান হলেন। কেউ আরও এক কাঠি এগিয়ে ভেবে বসলেন বারো ক্লাসের পড়ুয়ারা বাবা-মায়ের এতই বাধ্য যে তারা যতক্ষণ 'ইলেভেনে ওঠা স্টুডেনটিকে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলে হাতে দিয়ে বলেন যা ফুত্তি কর, আর পাড়ার দোকান থেকে একটা ভুয়ো রসিদ নিয়ে স্কুলে জমা করে দিস' ততক্ষণ সেসব অকাজ-কুকাজ তারা ভুলেও করে না। এক এক করে আসি। শেষ থেকে শুরু করি বরং।
আসলে পুরোটা না জানলে ইলেভেনে পড়া পড়ুয়ার বাপ-মা ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তোলার অধিকারী হন বটে এবং নির্দেশও দিতে পারেন! কিন্তু অ্যাকাউন্ট তো খোলা হয় ছাত্রছাত্রীদের নামে এবং সেটাও ইলেভেনে নয়, বরং অনেক আগেই। সেই টাকা তোলার অধিকার কেবল তাদের বাবা-মায়েরই থাকে বুঝি?
যতদূর জানি, এ রাজ্যে উমাতে পড়ে প্রায় ৪০% সংখ্যালঘু পড়ুয়া। তাদের জন্য সরকারি তরফে মাইনরিটি স্কলারশিপ (সেখানে লুকিয়ে থাকা ঘাপলার কথাটা না হয় চেপেই গেলাম) দেওয়া হয়। তো ৯৯% নতুন ভোটার বিজেপির ভোটার হলে এই ৪০% সংখ্যালঘু ভোটও বিজেপিরই পাওয়ার কথা। তা তারা পায় কি? উফ, অঙ্ক কী কঠিন!
না, নারীরা ওয়েলফেয়ার স্কিমে টাকা পেলে পুরুষদের বুক ফাটার কিছু নেই। বুক ফাটেওনি। কেবল সেই টাকাটা পাওয়ার ক্ষেত্রে জড়িয়ে থাকা দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে মাত্র।
খুব স্পষ্টভাষায় জানিয়ে রাখা যাক, আমি সিপিএম, তিনো বা বিজেপি - কোনও দলেরই সমর্থক নই। এমনকি এলেবেলে সমর্থকও নই। কাজেই এই ভাতার জন্য কাদের ভোট বাড়ল কিংবা কমল সেই নিয়ে বিন্দুমাত্র কান্নাকাটি নেই। সব দলই ভোটমুখী কিছু কর্মসূচি নেয়, কারও সেটা সফল হয় কারও ব্যর্থ।
এই যে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্কিম নিয়ে এত কথাবার্তা হল, কিন্তু কই কেউ তো মিড ডে মিলের ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বললেন না। সেটা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্কিম নয়? কন্যাশ্রী কিংবা ঐক্যশ্রী নিয়ে কোনও আপত্তি নেই, সাইকেল দেওয়া নিয়েও নেই কিন্তু ফি বছর ১০০০ কোটি টাকা ট্যাব বিলানোর নামে অনর্থক অপচয়ের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি আছে। ওই টাকার অর্ধেক খরচ করলেই নবম থেকে দ্বাদশের ছাত্ররা অনায়াসে মিড ডে মিল পেতে পারে এবং মিড ডে মিলের সহায়িকাদের মাসিক বেতনও কিঞ্চিৎ ভদ্রস্থ হতে পারে। সরকারের প্রায়োরিটি তাহলে কী হওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত, স্কুলে চলা প্রত্যেকটি ওয়েলফেয়ার স্কিমই (কন্যাশ্রী ও রূপশ্রী বাদে) যে পরোক্ষে শিক্ষক ও পার্শ্বশিক্ষকদের ধারাবাহিক বঞ্চনার টাকায় চলে, এ কথা শুনলে অনেকে ফের রে রে করে তেড়ে আসতে পারেন। আচ্ছা শিক্ষকদের নাহয় বাদই দিলাম (তারা তো বুর্জোয়াজির অন্যতম স্তম্ভ, সরকারের নজর তো প্রান্তিকদের দিকে), পার্শ্বশিক্ষকদের বেতনের ব্যাপারটা আর কবে ভাবা হবে?
আরও একটা কথা, ইদানীং বেসরকারি স্কুলের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর নামও বাংলার শিক্ষা পোর্টালে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের জন্য মিড ডে মিল বাবদ টাকা বরাদ্দ হলেও স্কুলগুলোতে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা নেই। এই বিপুল পরিমাণ টাকা কোথায় যায়? ৪৩ হাজার ক্লাবপিছু পুজোবাবদ ৮৫ হাজার টাকা অনুদানে? দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের জন্য ২০৫ কোটি টাকার সরকারি দানছত্রে? নাকি কালিঘাট মন্দিরের সংস্কার বাবদ ১৬৫ কোটি টাকা অপচয়ে? আচ্ছা, এগুলোও কি ওয়েলফেয়ার স্কিমের অন্তর্গত?