স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে..
দিনভর কিছু অসৎ, দাঙ্গাবাজ ও ভণ্ড লোকের কথা শোনাই আমাদের নিয়তি। আমাদের রবীন্দ্রনাথ নেই, আমাদের বসন্তকাল নেই, আমাদের ঝরাপাতার মর্মরর্ধ্বনি নেই। আমাদের আছে শুধু বাতেলাবাজি ও অবিরাম মিথ্যের চর্চা।
এক নেতা আর এক নেতাকে তেড়ে খিস্তি দিলেন। পরের দিন ওই দুই নেতাই গলাগলি করে হাঁটলেন। আমরা খিস্তির খবর শুনলাম। গলাগলির খবরও শুনলাম। কিন্তু কেন শুনলাম? ওঁরা কি এতই গুরুত্বপূর্ণ? আমার রোজকার নুন-লঙ্কা-পান্তাভাতে ওঁদের ভূমিকা কী? কিছুই না। তবু শুনি। এক চোর আর এক চোরের প্ৰশস্তি গায়, আমরা শুনি। এক দাঙ্গাবাজ নতুন কোনও দাঙ্গার স্বপ্ন দেখায়, আমরা দেখি। এক ভণ্ড দিনবদলের কথা ভুলে গিয়ে গড্ডলস্রোতে দিনাতিপাত করে, আমরা সয়ে যাই। এঁরা আমার জীবনে কতটুকু জুড়ে থাকে? একটুও না। অথচ দিনভর এঁরাই আমার স্মৃতি, এঁরাই সত্তা, এঁরাই ভবিষ্যৎ।
খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেলের খবর দেখুন। সারাক্ষণ তিন-চারজন লোকের মুখ ঘুরেফিরে আসে। কেউ কাউকে 'তোপ' দাগছেন, কেউ 'তির' ছুড়ছেন (আজ যেমন মুখ্যমন্ত্রী তির ছুড়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে), কেউ 'বিস্ফোরক' কথা বলে খবরে ভেসে থাকতে চাইছেন। যেন আমাদের জীবন এই 'তির', 'তোপ,' আর 'বিস্ফোরণে' ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি সকালে চা খাই তির মেরে, দুপুরে ডাল-ভাত খাই তোপ দেগে, বিকেলে মাঠে হাওয়া খাই বিস্ফোরণের ধোঁয়ায়। আমাদের শুধু তোপধ্বনি আছে, মর্মরধ্বনি নেই।
এত অসৎসঙ্গে আমি দিনভর থাকি কী করে? থাকি কারণ, আমার কোনও প্রতিবাদ নেই। চারটে লাফাঙ্গা ছেলে আমার কানের কাছে ডিজে বাজাচ্ছে। আমার প্রতিবাদ নেই। কুঁড়েঘরের বাসিন্দা রাতারাতি রাজপ্রাসাদের মালিক হয়ে গেল। আমার প্রতিবাদ নেই। আমার চোখের সামনে রোজ ধর্মের কুৎসিত নাচনকোঁদন। আমার প্রতিবাদ নেই। আমি জেনেবুঝে ধর্ষককে ভোট দিচ্ছি, আমি জেনেবুঝে চোরের জয়গান গাইছি, আমি জেনেবুঝে যাঁরা অস্ত্র হাতে দেবতার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে তাঁদের ঘরে ডেকে আনছি। আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন কবেই মিইয়ে গেছে। আমি শুধু মেনে নিচ্ছি। সব মেনে নিচ্ছি।
শামসুর রাহমানের একটি কবিতা ছিল----দুঃস্বপ্নের একদিন। কবিতার লাইনগুলো যেন ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে।
চাল পাচ্ছি, ডাল পাচ্ছি, তেল নুন লাকড়ি পাচ্ছি,
ভাগ করা পিঠে পাচ্ছি, মদির রাত্তিরে কাউকে নিয়ে
শোবার ঘর পাচ্ছি, মুখ দেখবার
ঝকঝকে আয়না পাচ্ছি...
কিউতে দাঁড়িয়ে খাদ্য কিনছি,
বাদ্য শুনছি...
ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি।
রোজ মনে হয় আমি কি এর বাইরে কেউ? একদম না। কেসি পালের ছাতার নীচে আমার নিরাপদ জীবন। দিনভর নিরাপত্তা খুঁজছি। আর ঈর্ষায় জ্বলপুড়ে মরছি। আমার সন্তান পাশের বাড়ির দত্তবাবুর সন্তানের চেয়ে কত বেশি নম্বর পেল, আমার হকের পাওনা আজও কেন দিল না সরকার? সিমলা, কাশ্মীর, আন্দামানে বেড়াতে গেলে বাঙালি-খানা মিলবে তো? অষ্টপ্ৰহর অশ্লীল আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে আছি। কে করবে প্রতিবাদ? প্রতিবাদের পরিসরই নেই আমার আত্মায়। কোথায় কিছু অনাচার হলে বিরোধী দল 'প্রতিবাদে' মিছিল করল। কিছুদিন পর একই অনাচার বিরোধী দল করল। ফের মিছিল। ফের তির, ফের তোপ, ফের বিস্ফোরণ। আসলে এগুলো কোনও প্রতিবাদই নয়। স্রেফ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
নিট ফল, ওই তির, তোপেই বিশ্বরূপ দর্শন।
ভাস্কর চক্রবর্তী তো লিখেই ছিলেন, "আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে।'