তৃতীয় কিস্তি
এটা ভ্রমণকাহিনী নয়। গোড়াতেই যেটা বলেছিলাম সেটাই, ভ্রমণ করতে গিয়ে বাঙালিদের থেকে সাহায্য পাবার ঘটনা।
হারউইচে ফেরি থেকে নেমে লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশনের ফর্ম ভর্তি করতে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম, ঠিকানা লিখতে হবে। লম্বা লাইন পাশাপাশি দুটো। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খশখশ করে ফর্ম ফিলাপ করছে। পেন নেই আমার। পাশের লাইনের একজন ছেলের কাছে পেন চাইলাম, ফর্ম ভর্তি করতে গিয়ে তাকে বললাম— আমার তো ঠিকানা এখানে কিছু নেই, কী লিখব এখানে?
সে স্থিরভাবে বলল, তাহলে তুমি যেতে চাচ্ছো কোথায়?
— লন্ডন।
— লন্ডনে যেখানে গিয়ে উঠবে সেখানকার ঠিকানা লিখে দাও।
— সেসব তো এখনও ঠিক নেই...
ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বলল, তাহলে আমি জানি না।
লাইন সামনের দিকে এগোচ্ছে। ঝপ করে তার ফর্মে সে যা ঠিকানা লিখেছে সেটা দেখে নিয়ে যতটা মনে রাখতে পেরেছি নিজের ফর্মেও সেটা তাড়াতাড়ি লিখে নিয়ে তাকে কলমটা ফেরত দিলাম।
ইমিগ্রেশন কিছুই সেভাবে খুঁটিয়ে দেখেনি। ফেরিঘাট থেকে ফের ট্রেন, সেখান থেকে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রিট পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা সাড়ে আটটা। আমার পিঠব্যাগটা অসম্ভব ভারি, তাতে রয়েছে খাবার, জলের গোটা পাঁচ ছয় বোতল এবং দুসেট সালোয়ার কামিজ। এই অবধিই আমার টিকিট কাটা ছিল। এখন বাসস্থান খুঁজতে হবে। গ্রীষ্মকাল, তাই শীতবস্ত্রের দরকার নেই, কিন্তু সূর্য অস্তমিত।
সিনিয়রদের কাছে শুনতাম তাদের লন্ডনে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কিছুই নেই, তবু তারা বেড়াতে যেত, যদিও তারা সবাই পুরুষ। মেয়ে সিনিয়র কেউ ছিল না তাই মেয়েদের অভিজ্ঞতা আমার জানা নেই।
মস্কোয় যে হোটেলে থেকেছিলাম ভিসা নেবার সময়টায়, সেখানে রোজই নানানজনের সঙ্গে আলাপ হতো। একজন বাংলাদেশি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সিনিয়র। আগেও দুবার লন্ডন গেছে। এবার যাবে কম্পিউটার কিনতে। পারসোনাল কম্পিউটার বলে একটা জিনিস বেরিয়েছে যেটা নাকি এমনি ছোটখাট কম্পিউটারের চেয়ে দামে বেশি এবং দেখতে শুনতেও খুব ভাল। মাইক্রোসফট বলে একটা কোম্পানীর অপারেটিং সিস্টেমে ওটা চলে। লন্ডন কি সিংগাপুর থেকে কিনে এনে সোভিয়েত বাজারে বেচতে পারলে বিরাট লাভ। সবাই কিনতে পারে না, প্রচুর দাম, বেশ ওজনও আছে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কম্পিউটার কিনতে কত পাউন্ড লাগে? তাতে সে যে সংখ্যাটা বলেছিল তেমন টাকা আমাকে বেচে ফেললেও পাওয়া যাবে না। তার নিজেরও অত পুঁজি নেই॥ যাদের অনেক পুঁজি আছে তারা এরকম ছেলেদের কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এবং যাতায়াত-খাবারদাবারের খরচ টরচ দিয়ে কম্পিউটার আনানোর কাজ করে। মাথাপিছু একটা কম্পিউটার আনলে কাস্টমসে ট্যাক্স দিতে হয় না। যারা অন্যের পুঁজি নিয়ে কম্পিউটার আনতে যায় তাদের নাম "পাইলট"। এই সিনিয়র ভাইটিও একজন পাইলট।
আমার মাথায় প্রশ্ন খেলে গেছল, তাই সরাসরি সেই ছেলেটিকে বলেছিলাম— আমিও পাইলট হতে চাই।
— আপনি?
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে একটু তাকিয়েই সে আর হাসি চাপতে পারে নি।
— হাসছেন কেন?
— আপনি কী করে পাইলট হবেন?
— আপনার চেনা কেউ থাকলে তাকে একটু বলুন না, এই ট্রিরে তার জন্য কম্পিউটার এনে দেব।
সে আবারও হাসতে থাকে।
— কী যে কন আপনি!
— কেন? এতে হাসির কী আছে? টাকা নিয়ে তো আমি পালাবো না, আমাকে তো ফিরে আসতে হবেই এখানে লেখাপড়া শেষ করতে!
— মাইয়া মানুষ পাইলট। নাঃ। কেউ রাজি হবে না।
(ক্রমশঃ)