এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কারাগার বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা

    Dibyendu Singha Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ২৭ জুন ২০১৮ | ২৭৩৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Dibyendu Singha Roy | ২৭ জুন ২০১৮ ১৪:৪০377320
  • ২০১৭ কলেজ স্কয়ার বই উৎসবে প্রথম যখন বইটা হাতে নিয়েছিলাম মনে হয়েছিল নকশাল আন্দোলন নিয়ে আবার একটা বই। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা পড়েছি। কোনোটা পক্ষে কোনোটা বিপক্ষে। হাজার চুরাশির মা পড়া হয়ে গিয়েছে। "অন্তরঙ্গ চারু মজুমদার" নামের একটা বইতে চারুবাবু সম্পর্কেও কিছু জেনেছি। আবার রুনু গুহ নিয়োগীর সাদা আমি কালো আমি পড়ে নকশাল আন্দোলনের ঠিক বিপরীত ও নকশাল দমনে সরকারি পদক্ষেপের প্রধান বিখ্যাত/কুখ্যাত এক চরিত্রের চিন্তাধারার পরিচয়ও পেয়েছি। এ বইতে নতুন কিছু থাকবে এমন আশা করিনি তাই কেনা হয়নি।
    এক বছর পরে বইটা কেনা হলো ও পড়ে ফেললাম। কেমন লাগলো বলার আগে আরো কিছু কথা বলেনি।
    ২০০৩ সালে ৪৮ বছর বয়সে যখন মেজ জেঠু মারা যান বাবা একদিন দুঃখ করে বলেছিল " ওকে জেলে স্লো পয়জনিং করেছিল। "
    বাবার মনে তীব্র ঘৃণা ছিল কংগ্রেসীদের উপর। জেঠু ১৩ মাস বহরমপুর জেলে ছিলেন নকশাল করার অপরাধে। সেই ১৩ মাসে একটু একটু করে কাউকে বিষ দেওয়া তারপর ২৮-৩০ বছর পরে তার মৃত্যু। যুক্তি নয় তীব্র ঘৃণা থেকে বলা। বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নকশাল আন্দোলন নিয়ে, বলেছিলো "ওদের লাইনটাই ভুল ছিল। খতমের লাইন। "
    আমিও যেন কোথায় পড়েছিলাম চারুবাবু বলেছিলেন "শ্রেণিশত্রুর রক্তে হাত রাঙায়নি যে সে বিপ্লবীই নয়"
    কোথাও যেন এক পক্ষের ওপর পক্ষের প্রতি তীব্র ঘৃণা। আদর্শের জন্য লড়াই কি কোথাও স্রেফ খুনখারাপি তে বদলে গিয়েছিলো? আন্দোলন দমনের নামে রাষ্ট্র কি প্রবল সরকারি সন্ত্রাস শুরু করেছিল ?
    এর মাঝে কি কেউ ছিল না যারা নিরপেক্ষ ? অথবা যারা গর্বিত হতেপারে নিজেদের আন্দোলন নিয়ে আবার নির্দ্বিধায় নিজেদের ভুল স্বীকার করতে পারে। বলতে পারে তাদের কথা যারা রাষ্ট্র ও নকশাল এদের কোনো দিকেই না গিয়ে প্রতিবাদ করেছেন।
    বিশ্বাস করুন এই বইটা না পড়লে জানতে পারতামনা ঘোষিত, প্রতিষ্ঠিত ডানপন্থী গৌরকিশোর ঘোষের কফি হাউসে কাছা পরে এসে এমার্জেন্সির জামানায় গণতন্ত্রের মৃত্যুতে অভিনব প্রতিবাদের কথা।
    এই বই অন্ধ সমর্থন বা বিরোধী পক্ষের প্রতি তীব্র ঘৃণার আবেগে লেখা হয়নি। লেখক নিজেকে প্রতিবাদী বীর বিপ্লবী বলে প্রমান করার চেষ্টা করেননি। বরং পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে তার বুক কেঁপে যাওয়ার কথা নির্দ্বিধায় বলেছেন। বলেছেন সত্তরের কলকাতার প্রায় বিস্মৃত বামপন্থীদের কথা। এই বই লেখকের শেখার গল্প, দেখার গল্প, দিন যাপন ও উপলব্ধির গল্প বলে।
    বলে ভারতের কমুনিস্ট আন্দোলের বহু ধারায় বিভক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হওয়ার শুরুর দিনগুলোর কথা।
    রাষ্ট্রের গুলিতে শহীদের কথাও বলে আবার পুলিশি অত্যাচারে শেষ অবধি ভেঙে পড়া মানুষের আত্মগ্লানির কথাও বলে।
    এখনো অবধি আমার পড়া গুরুচন্ডা৯র শ্রেষ্ঠ বই।
  • বিপ্লব রহমান | ২৮ জুন ২০১৮ ১৯:২০377321
  • আমার বাবা নকশাল নেতা ছিলেন। আমার বড় ভাই মানবও নকশাল ক্যাডার ছিলেন, বাবার সাথে পার্টি করতেন। দুজনই একমাসের ব্যবধানে
    গত বছর মারা গেলেন। বাবা বার্ধক্য জনিত কারণে, আর ভাই ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছিলেন দীর্ঘদিন।

    আমাব বাবার মতো এমন আদর্শিক, জ্ঞানী এবং আধুনিক মানুষ আর একজনকেও দেখি না।

    প্রয়াত নকশালাইট নেতা আমার বাবাকে নিয়ে লেখা একটি নোট এখানে-- মুক্তমনা ও গুরুচণ্ডালীতে একই সাথে লিখেছিলাম।

    ~~~~~~~~~~~
    আমার বাবা আজিজ মেহের

    আমার বাবা আজিজ মেহের (৮৬) সেদিন সকালে ঘুমের ভেতর হৃদরোগে মারা গেলেন।

    সকাল সাড়ে আটটার দিকে (১০ আগস্ট) যখন টেলিফোনে খবরটি পাই, তখন আমি পাতলা আটার রুটি দিয়ে আলু-বরবটি ভাজির নাস্তা খাচ্ছিলাম। মানে রুটি-ভাজি খাওয়া শেষ, রং চায়ে আয়েশ করে চুমুক দিয়ে বাবার কথাই ভাবছিলাম।

    আজ তাকে কাছেই সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। দুদিন আগে তিনি পর পর তিনবার বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন। ৮৬ বছর বয়সে এই প্রথম তার পা ফস্কে গেল। নইলে এতো বছর ধরে সব কাজ তিনি একাই করেছেন। অস্বাভাবিক পরিস্কার স্মৃতি তার। আর ভীষণ বই পড়ার বাতিক।

    এইসব ভাবতে না ভাবতেই অনিন্দ্য, আমার ভাতিজার টেলিফোন, দাদু, দাদু করে ওর হু হু কান্না শুনেই বুঝে গেলাম, বাবা আর নেই। বাবা অনিন্দ্যর বাসাতেই আছেন গত বছর বিশেক ধরে।

    আমি তরিঘড়ি করে দৌড়ালাম। কাছেই মগবাজারে অনিন্দ্যর বাসা। সেখানে আমার বড় বোনেরা, বাবার বোনেরা, আরো সব আত্নীয়-স্বজন জড়ো হতে থাকেন। বাবাকে সিরাজগঞ্জের গ্রাম মুগবেলাইয়ে, তার পারিবাকি কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়। পুরো বাড়িটি ধীরে ধীরে মরা বাড়িতে পরিনত হয়। অদ্ভুদ সব অচেনা লোকেরা পুরনো এপার্টমেন্টটিতে গিজ গিজ করে।

    আমি একটি আ্যাম্বুলেন্সে করে বাবার মরদেহ কমিউনিটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেই, ডেফ সার্টিফিকেটের জন্য। সেখানে আমার বন্ধু ঝন্টু চাকমার স্ত্রী সাথি চাকমা বৌদি সহায়তা করেন। জরুরি বিভাগে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়। আমি হাসপাতালের লবিতে পাখার নীচে বসে মোবাইল চিপে বাবাকে নিয়ে ছোট্ট একটি ফেসবুক নোট লিখি। জানাই তার চলে যাওয়ার সংবাদ। আমার অফিসেও ফোন করে জানাই বাবার মৃত্য সংবাদ। হেড অফ দা নিউজ তার সম্পর্কে আরো জানতে চান। আমি ফেসবুক নোটটির কথা বলি। আমি দু-তিনদিন ছুটি চাই, তখনই তা মঞ্জুর হয়।

    ফেসবুক দেখে, আমার কর্মস্থলের টিভি সংবাদ দেখে একের পর এক টেলিফোন আসতে থাকে। সবাই জানতে চান, কখন, কিভাবে? আহা, তার মতো আদর্শিক লোক হয় না। পুরোনো কমিউনিস্ট নেতা বিমল বিশ্বাস ফোন করেন। বাবার স্নেহভাজন জুনায়েদ সাকী সহমর্মিতা জানান জার্মানি থেকে। গণ সংহতি আন্দোলনের আরো অনেক বন্ধু, শুভাকাংখী ফোন করেন। সাংবাদিক বন্ধুদের অনেকেই। অচেনা নম্বর থেকেও একের পর এক ফোন আসতে থাকে। আমি কথা বলতে বলতে অসুস্থ বোধ করতে থাকি। এরপর আমি সেলফ সেন্সর করে বেছে বেছে ফোন ধরি। এছাড়া আমার কোনো উপায় থাকে না।

    বাবার মরদেহ বাসায় আনার পর দু-একজন আত্নীয়-স্বজন কান্নাকাটির চেষ্টা করেন। আমি তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি। অনিন্দ্যর ছোট বোন, ভাতিজি প্রার্থণা দাদুর বিছানার পাশে বসে নিরবে চোখ মোছে। আমি স্কুল পড়ুয়া কিশোরীটির চোখ মুছে দেই। সবার সামনে বলি, উনি তার কোর্স পূর্ণ করেছেন। একটুও না ভুগে, কাউকে না ভুগিয়ে মারা গেছেন, এতে কান্নার কিছু নেই। জন্মের মতো মৃত্যুও স্বাভাবিক, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    স্নানের পর হিমায়িত লাশবাহি গাড়িতে বাবার মরদেহ সিরাজগঞ্জ রওনা হয়ে যায়। আমি আর অনিন্দ্য কল্যানপুর থেকে বাস ধরে সিরাজগঞ্জের পথে রওনা দেই। সঙ্গে আমার মেজ বোন, আরেক মামাতো বোন।

    আমর চারটি প্রাণী যখন সিরাজগঞ্জের মুগবেলাই গ্রামে পৌছাই তখন ঘুট ঘুটে আধার। সবার হাতে হাতে টর্চ দেখে বোঝা গেল, পল্লী বিদ্যুতের খুব ঘন ঘন লোড শেডিং হয়। দাদু বাড়ির সামনের উঠোনে বাবার মরদেহ আনা হয়। সেখানে আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, আধার ভেঙে নামাজে জানাযায় দাড়ান। আরো আসেন বাবার কৃষক কর্মীরা, যাদের নিয়ে তিনি জীবনের ৪০টি বছর কাটিয়েছেন।

    এরপর বাড়ির পেছনে পারিবারিক কবরস্থানে বাবাকে গোর দেয়া হয়। আমি ভীড় থেকে একটু দূরে অন্ধকারে শাল গাছের নীচে দাড়িয়ে পাথর মুখে সব দেখি। আমি জানি, চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়।

    একজন চোয়াল ভাঙা, খোঁচা খোঁচা দাড়ির বয়স্ক লোক আমার দিকে টর্চের আলো ফেলে বলেন, তুই টিংকু (বাবার ডাক নাম) ভাইয়ের ছেলে না? আমি তোর মোমেন চাচা হই। পাশেই সৈয়দ গাতি গ্রামে থাকি। আমি আর তোর বাবা অনেক কৃষক সংগ্রাম করেছি। অনেক আন্দোলন-সম্মেলন করেছি। সে মেলা কথা। একদিন আসিস তো! সব বলবো নে। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেই।

    এরই মধ্যে কেউ একজন এক মুঠো মাটি এনে বাবার গোরে দিতে বলে। আমি মাটিটুকু ঢেলে দেই। এক লাহমায় আমার মনে পড়ে যায়, কবরে শোয়ানো বুড়ো লোকটির আত্মত্যাগ, আদর্শের দীর্ঘ যাত্রা।

    বাবা আজিজ মেহের ছিলেন সাবেক নকশাল নেতা, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল, মতিন-আলাউদ্দীন) এর সাধারণ সম্পাদক। সারাজীবন অনেক কৃষক আন্দোলন করেছেন, মওলানা ভাষানীর সাথে কাগমারী সম্মেলন করেছেন, সন্তোষের মহা সমাবেশ করেছেন, পাকিস্তান আমলে বহু জেল খেটেছেন, সবশেষ কারা বরণ করেছেন জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন আমলে।

    আমার বাবা রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি যৌবনে ভাল স্টিল ফটোগ্রাফি করেছেন। এরপর কি করে যেন জড়িয়ে পড়েছিলেন চলচ্চিত্রেও। বাবার পৈত্রিক নাম কিন্তু ছিল এসএম মসিউর রহমান। আর সিনে জগত ও গোপন পার্টির ছদ্মনাম ছিল আজিজ মেহের। শেষে তিনি এই নামেই পরিচিতি পানা। কালক্রমে তার আসল নামটিই হারিয়ে যায়। বাবা সর্বত্র পরিচিত ছিলেন আজিজ মেহের নামেই।

    তিনি পাকিস্তান আমলের বিখ্যাত ছবি “জাগো হুয়া সাবেরা”র সম্ভবত সহকারি পরিচালক ছিলেন। পরে উনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান এবং আলমগীর কবিরের সঙ্গে দু-একটি ছবিতে কাজ করেছেন। আলমগীর কবিরের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র “ধীরে বহে মেঘনা” ছবির প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন বাবা।

    স্বাধীনতার পর পরই আমার বাবা “বিচার” নামে একটি সামাজিক ছবি নির্মাণ করেছিলেন। সুচন্দা ছিলেন এই ছবির মায়ের চরিত্রে। ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে, মা কুপুত্রকে নিজেই দোনালা বন্দুকের গুলিতে হত্যা করেন—এটিই ছিল তার বিচার।

    আটের দশকে তিনি ড. আহমদ শরীফের ওপর একটি প্রামন্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন, “উজান স্রোতের যাত্রী”। গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের “উজান স্রোতের যাত্রী/ ওরে ও ছাত্রছাত্রী/ মশাল জ্বালো, মশাল জ্বালো, মশাল জ্বালো…” গানটি থেকে কথা নিয়ে এই ছবিটির নামকরণ আমিই করেছিলাম।

    এখনো মনে আছে জহির রায়হানের ক্যামেরা ম্যান লক্ষণ দাস ছিলেন এই ছবিটির চিত্রগ্রাহক। কলকাতার বিদ্যাসগর মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা, ড. আহমদ শরীফের পালক কন্যা, ড. প্রথমা রায় মন্ডল ছিলেন এর প্রযোজক। সম্ভবত এর একটি রাশ প্রিন্ট এখনো তার কাছে রয়েছে। ড. শরীফের পরিবারের কাছে এর মূল কপিটি থাকার কথা।

    বাংলাদেশ আমলে তিনি “বস্তু প্রকাশন” নামে একটি প্রকাশনা গড়ে তোলেন। ‘বস্তু প্রকাশন’এর বইগুলো সবই ছিলো চিন্তাশীল এবং যথারীতি ব্যবসা-বিফল। বাবা প্রকাশ করেছিলেন — ড. আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক আহসাব উদ্দীন আহমেদ, আহমদ ছফা, আনু মুহাম্মদ, আরজ আলী মাতুব্বর, এমন কি মাওসেতুং, লু-সুন’ও। মাতুব্বরের ’সত্যের সন্ধান’ ও ‘সৃষ্টি রহস্য’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হয়েছিলো আদি প্রচ্ছদে ‘বস্তু প্রকাশন’ থেকেই। সে কথা একটু পরেই আবার বলছি।

    আটের দশকে আমার বাবা সাপ্তাহিক খবরেরকাগজ সহ বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত কলামও লিখতেন।

    তখন আমি কলেজে পড়ি, তখন আমি আর্জেস গ্রেনেড, দারুণ যৌবনকাল! সে সময় লিটল ম্যাগাজিনের ভূত ঘাড়ে চেপে বসায় আমি অকালপক্ক বয়সেই জেনে গিয়েছিলাম, ছাপাখানার কল-কব্জা। সীসার হরফ, কাঠের ব্লক, তেল-কালি মাখা গ্যালি-বয়, মেশিন ম্যান, ল্যান্ড মাইনের মতো ছাপার কালির টিন, এমনকি আলো-আঁধারিতে ঘোলা বাল্বের নীচে ভাড়ি চশমা আঁটা প্রুফ-রিডার — সবই আমাকে খুব টানতো।

    আরো পরে এলো কম্পিউটার, ডিমাই ও ডাবল ডিমাই আকৃতির অফসেট প্রেস। সংবাদ পত্র, বই-পত্র, পোস্টার-লিফলেট, এমন কি লিটল ম্যাগাজিনও ছাপা হতে লাগলো কম্পিউটারে। প্রথমে অ্যাপেল ম্যাকিনটস-এর ছোট্ট সাদা-কালো মনিটর, পরে আইবিএম-এর ঢাউশ-আকৃতির সাদাকালো মনিটর ওয়ালা কম্পিউটারই ভরসা।…

    আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন তার প্রকাশনাটিকে দাড় করাতে। কয়েকটি কম্পিউটার না হোক, অন্তত একটি ডিমাই আকৃতির অফসেট প্রেস কেনার। তাতে হয়তো তার প্রকাশনার ব্যবসার সুবিধা হতো। নিজস্ব বই প্রকাশ ছাড়াও বাইরের অন্যান্য ছাপার কাজও তিনি হয়তো পেতেন। কিন্তু মা’র রেডিও অফিসের কেরানীর চাকরি, আমরা ভাই-বোনগুলো তখন মাত্র একে একে পাস করে বেরিয়েছি, কোনো পারিবারিক সঞ্চয় নেই –সংসার চালানোই দায়, এ অবস্থায় কিছুতেই বাবা কোনো প্রেস কিনতে পারলেন না। উনি বই প্রকাশ করতে শুরু করলেন রশিদ মিয়ার প্রেস, আল-আমিন প্রিন্টার্স, ৭২ নম্বর, নারিন্দা থেকে।

    পারিবারিক উত্তপ্ত আলোচনা থেকে ওই বয়সেই আমি জেনেছিলাম, বাবা বই প্রকাশ করতেন দাদুর আমলের আম-কাঁঠালের বিশাল বাগানের পুরনো সব গাছ উজাড় করার টাকায়। আর তার ব্যাক্তি পরিচিতির কারণে তিনি লেখক সন্মানী দিতে পারতেন সামান্যই। এই করে তিনি রশিদ মিয়ার বাকী টাকা শোধ করতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু যথারীতি ব্যবসাটি খুব শিগগিরই লাটে উঠে যায়।…

    এখনো মনে আছে, পুরনো পল্টনে বাসস অফিসের নীচে, বাবার অফিস ঘরের পেছনে স্তুপ করে রাখা হতো অবিক্রিত বই। খাগড়াছড়িতে আমার পাহাড়ি বন্ধুরা পাঠাগার খুলতে চাইলে বাবার কাছ থেকে আমরা বিনা পয়সায় এক ট্রাক নিউজ প্রিন্টে ছাপা (সুলভ সংস্করণ) বই পেয়েছিলাম। …

    কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে বাবার লেখা একটি বই ‘নিষিদ্ধ কথকথা’! সে বইটি বাজারে নেই অনেক বছর। তাকে উদ্ধত করে আমি মুক্তমনাসহ বিভিন্ন সাইটে একটি নোট লিখেছিলাম, ‘সিরাজ সিকদার: অন্য আলোয় দেখা’, গুগল করলেও সেই লেখাটি বোধহয় পাওয়া যাবে।

    আমার বাবা আপোষহীন আদর্শ আর হাজার তিনেক বই ছাড়া কোন সম্পদ রেখে যাননি। তাকে নিয়ে আমি গর্বিত।

    ওইদিনই রাতে লাস্ট বাস ধরে আমি আর অনিন্দ্য ঢাকায় ফিরি। তখন ঝিরি ঝরি বৃষ্টি। আমি মোবাইল খুল হোয়াটস এপে এক বন্ধুর খুব শান্তনা নেই। ফেসবুক খুলে বাবাকে নিয়ে লেখা মন্তব্যগুলো অনিন্দ্যকে পড়ে শোনাতে শোনাতে আমার গলা ধরে আসে। অনিন্দ্য চোখ মোছে। আমরা বন্ধুর মতো হাত ধরে পাশাপাশি বসে থাকি অন্ধকার বাসে। শ্যামলী পরিবহনের বাসটি যেন মহাসড়ক ছেড়ে উড়াল দিয়েছে, এমনই গতিপ্রাপ্ত বলে মনে হয়।

    বাবার কথা ভাবতে ভাবতে আমি আধো ঘুম-জাগরণ, তীব্র মাথা ব্যাথা ও বিবমিষায় ভুগি। ফিস ফিস করে যেন নিজেকেই বলি, তব যাত্রা হোক শুভ। ভাল থাকুন বাবা, লাল সেলাম!
  • বিপ্লব রহমান | ২৯ জুন ২০১৮ ২১:০০377322
  • "কারাগার বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা " বইটি পড়ার বাসনা রাখি। জানি না কি ভাবে পাব! :/
  • π | ১৯ জুন ২০২১ ০০:০৭734619
  • বাসব রায় লিখলেন, 


    কল্লোল দাশগুপ্ত অতি সহজেই ফেসবুকে লভ্য। কয়েকটা পোস্ট পড়লেই বোঝা যায় তিনি আপাদমস্তক বামপন্থী। সম্প্রতি তাঁর দুটি বই পড়লাম, একটা বড় নাম – কারাগার বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা এবং আরেকটি হল তক্কোগুলি, চরিতাবলী ও আখ্যানসমূহ। প্রকাশক গুরুচণ্ডা৯।


    লেখক ১৫ বছর বয়সে প্রথম জেলে যান। হ্যাঁ, তাঁকে তখনই নকশাল সন্দেহে ধরা হয়েছিল। কিছুদিন জেলে থাকার পর তিন বছর কলকাতায় থাকতে পারবে না এই শর্তে ছাড়া পান। দুটি বই প্রকৃতপক্ষে সিকোয়েল। প্রেক্ষাপট পশ্চিমবঙ্গ এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে কলকাতা। আর সময়কাল ১৯৭৪-১৯৮৬। দুটো বই টানা পড়লে মনে হবে একটিই গ্রন্থ পড়ছি। 


    বছর দশেক আগে শিলঙের হিরণ্ময় রায়ের একটি বই পড়েছিলাম, পুরনো শিলঙের সংস্কৃতি ও খেলাধুলো। সেখানে হিরণ্ময় অসাধারণ নির্লিপ্তিতে লিখেছেন ভীমসেন যোশি, অমিতাভ বচ্চন, রেখা, কেন ব্যারিংটন, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পিকে-চুনী-বলরামের কথা। একটা উদাহরণ দিই, ‘ভীমসেন আমাদের বাড়িতে থাকাকালীন খুব ভোরে উঠে রেওয়াজ করতেন। একদিন মাকে বললেন আপনি খুব চমৎকার লুচি বানান, এরকম জীবনে খাইনি।’ ব্যস ভীমসেন সম্পর্কে এটুকুই। আবার অমিতাভ বচ্চন সম্পর্কে তাঁর ওয়ান লাইনার, ‘খুব লম্বা। আমাদের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় মাথা হেলিয়ে দিয়েছিল।’


    কয়েক মাস আগে মারা গেছেন গুয়াহাটির নারায়ণচন্দ্র সরকার। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দ, গান্ধীজি এবং শেখ মুজিবর রহমানের। নাহ্ এনিয়ে তিনি কখনোই উচ্চবাচ্য করতেন না। 


    কল্লোলের দুটি বইয়ে এরকম উদাহরণ যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, শিবু সোরেন, অশোক মিত্র, ক্ষিতি গোস্বামী, যতীন চক্রবর্তীকে মিট করেছেন, কিন্তু কোনো অতিশয়োক্তি নেই। লেখকদের মধ্যে জ্যোতির্ময় দত্ত, শম্ভু রক্ষিত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর রায়, সংস্কৃতি জগতের হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মৃণাল সেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, বাদল সরকার, প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কিন্তু এঁরা নিছ্কই একেকটি চরিত্র, তেমন প্রশংসাও নেই, নিন্দাও নেই। 


    সত্তর দশক নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশক। কল্লোলের এই দুটি বইকে ওই দশকের বাস্তব দলিল বললে একেবারেই ভুল বলা হবে না। প্রায় পঞ্চাশটা লিটল ম্যাগাজিন যেমন স্বদেশ, প্রস্তুতিপর্ব, অনুষ্টুপ, পদধ্বনি, পূর্বতরঙ্গ.. এগুলোর গুরুত্ব উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। পাশাপাশি রয়েছে অনেক গণসংগীতের দলের কথা। যেমন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মাস সিংগার্স, উত্তরপাড়ার অরণি, এখানে গান গাইতেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। 


    দুটি বইয়ের আখ্যানের অনেকটা জুড়ে রয়েছে জেলখানা পর্ব। প্রেসিডেন্সি জেলে রাজনৈতিক বন্দিরা জরুরি অবস্থার সময়ে কেমনভাবে থাকতেন, আদ্যোপান্ত লেখা রয়েছে। নকশালরা কেন ব্যর্থ হল, চারু মজুমদার কেন ধরা পড়লেন, বামফ্রন্ট সরকার গড়ার পর নকশালরা কেন ধীরে ধীরে মুছে গেল... লেখক নিজের মতো ব্যাখ্যা করেছেন। 


    যাঁরা সত্তর দশকের কলকাতা দেখেননি, এই বই দুটো ভ্রমণ করুন, দর্শন হয়ে যাবে। আড্ডা, আড্ডা এবং আড্ডা। কেওড়াতলা, কালীঘাট, রাসবিহারী, টালিগঞ্জ, ময়দান, ব্রিগেড, কলেজ স্ট্রিট, রাজাবাজার, লালবাজার, বেহালার রাস্তাঘাট মায় দোকানও উঠে এসেছে বইতে। 


    আজ মে দিবসের অনুষ্ঠান তো কাল ফ্যাসিবাদ বিরোধী কনভেনশন, পরশু গণসংগীতের অনুষ্ঠান.. হয়েই চলেছে। বৈকালিক আড্ডা শুরু হয়েছে কেওড়াতলার মোড়ে, সন্ধ্যায় ভবানীপুর আর রাসবিহারী মোড়ের শেষ যে চায়ের দোকান বন্ধ হয় সেখানে থেমেছে, তখন রাত্রি বারোটা। 


    নকশাল আন্দোলন, পুলিশি নির্যাতন, বামপন্থার আগুন, সংঘবোধ, লেখক-শিল্পীদের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ছবির মতো উঠে এসেছে বইদুটিতে। ওহ্ একটুকরো ফুটবলের গল্পও আছে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন