এক
ঘুমটাকে যদি রিমোট দিয়ে অফ অন করা যেত, বেশ হত। এই যে এখন চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ভোরবেলার ফাঁকা রাস্তায় সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে পাঞ্জাব বডির লরি। উল্টোদিক থেকে গাড়ি আসছে না খুব একটা। চার লেনের মাখন হাইওয়ে দিয়ে যেন নিজে থেকেই ছুটে চলেছে বিষ্ণুর পোষা লরিখানা।
আর চোখে একবার পদার দিকে তাকায় বিষ্ণু। ব্যাটা ছিবড়ে ওঠা গদিতে কুঁকড়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারা রাত জেগেছিল। চারটের দিকে একবার মুতে এসে বলল, "বিষ্ণুদা, চোখের মধ্যে মনে হয় কেউ আঠা চিপকে দিয়েছে। আর পারছি না গো। একটু শুই, কেমন? তোমার চোখ লেগে এলে ডেকো আমায়। জোরসে গান চালিয়ে দেবো। ঘুম ব্যাটা পালাবার রাস্তা পাবে না।"
পদাকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো না বিষ্ণু। কতই আর বয়স ছেলেটার। ভালো ঘরে জন্মালে এখনো দিব্বি পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যেত। বন্ধুদের সাথে খেলতে যেত মাঠে। তার বদলে লরির এই ঘুপচি কেবিনে আধ সেদ্ধ হয়ে দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়াতে হচ্ছে। খাওয়া, ঘুম কোনো কিছুরই নিয়ম মেনে হয় না। আসলে পেট বড় বালাই। মনে মনে ভাবে বিষ্ণু।
কতবার ভাবে, এই লঙ্কা, টমেটোর লরি আর চালাবে না বিষ্ণু। রাস্তায় কোনো কারণে দেরি হলে বাড়তে থাকে টেনশন। তার ওপর নতুন জ্বালা, লরিতে জি পি এস বসানো আছে। মালিক মোবাইল খুলেই দেখতে পায়, গাড়ি কোথায়। দুধে এক ফোঁটা জল মেশানোর জো নেই। কোথায় জ্যামে ফেঁসে আছে রাস্তা, সব দেখতে পায় মালিক।
এবারে হলদিবাড়ির থেকে লঙ্কা লোড করার সময়ই মনে হয়েছিল, বলে কয়ে অন্য কাউকে পাঠাবে। কিন্তু গাড়ির মালিক রাজি হল না। বাড়তি বকশিসের টোপ গিলে রাজি হতেই হল বিষ্ণুকে। আসলে ওকে বড্ড ভরসা করে মালিক। সময়মত মাল পৌঁছে দিতে জান লড়িয়ে দেয় বিষ্ণু। দরকার হলে টানা দু-তিন রাত না ঘুমিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাবে। কিন্তু লরির মাল পচতে শুরু করবে, আন লোডিংয়ের পর মালিক ফোন করে খিস্তি করবে, এসব একেবারেই না পসন্দ বিষ্ণুর।
একটু একটু করে জাগতে শুরু করেছে মহা সড়কের পাশের গ্রামগুলো। গরু বাছুর নিয়ে মাঠে আসতে শুরু করেছে লোকে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলো আরমোড়া ভেঙে জেগে উঠছে ধীরে ধীরে।
হঠাৎ ব্রেকে পা চলে গেল আপনা আপনি। টাল সামলাতে না পেরে লরিখানা গোত্তা খেয়ে সজোরে ধাক্কা মারলো ডিভাইডারে। লরিটা কাত হয়ে ঝুলে রইলো।
পদা হাল্কা চোট পেয়েছে হাতে। ব্যাটা ঘুমের চোখে বুঝতে পারেনি গাড়ি পাল্টি খেয়েছে।
এখন হাল্কা চোট নিয়ে বসে থাকার সময় নয়। দরজার লকটা খুলতে চাইছে না। পা দিয়ে একটা লাথ কষাতে খুলে গেল দরজা। ঝটাপট ব্যাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যবহার্য জিনিসপত্র, গাড়ির কাগজ পুরে এক লাফে নিচে নেমে এলো বিষ্ণু। হাত ধরে পদাকে নামালো কোনোরকমে।
হঠাৎ পিচ ঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বুকের ঢিপঢিপানি বেড়ে গেল কয়েক গুন। রাস্তা ভেসে যাচ্ছে রক্তের স্রোতে। এক পাশে দুমড়ে আছে একখানা সাইকেল। আর সাইকেল আরোহীর থেঁতলে যাওয়া শরীরে এখনো প্রাণ আছে কি না, দেখার সাহস পেল না বিষ্ণু। ও জানে, এখনো শ্বাস থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু হাসপাতাল অবধি পৌঁছানো যাবে না।
চারদিক ভালো করে জরিপ করে বিষ্ণু। একটা সরু মোরামের রাস্তা এসে মিশেছে এই হাইওয়েতে। সাইকেলওয়ালাও বুঝতে পারেনি লরি এতো জোরে ছুটে আসছে। বুঝতে পারার আগেই সব শেষ। বিষ্ণু জোরে ব্রেক চেপেও কিছু করতে পারে নি।
আর এক মুহুর্ত দেরি না করে পদাকে টানতে টানতে উল্টোদিকের লেনে চলে আসে বিষ্ণু। এটাই রক্ষে, স্থানীয় লোকজনের এখনো ঘুম ভাঙেনি সবার। না হলে এতক্ষণে রাম ধোলাই খেয়ে হাড়গোড় ভেঙে কেৎরে পড়ে থাকতে হত রাস্তায়। পুলিশ এসে হাসপাতাল বা মর্গে চালান করে দিত প্রয়োজন মত।
উল্টোদিকের লেনের ধারে বসে হরহর করে বমি করে দিল পদা। বিষ্ণু ওর ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে এগিয়ে দিল পদার দিকে।
"একটু সহ্য কর পদা। একে তো চোট পেয়েছিল। তার ওপর এরকম বীভৎস এক্সিডেন্ট দেখলি চোখের সামনে", পদার চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে দিতে বলল বিষ্ণু, "এ লাইন বড় কঠিন, পদা। সব সময় মাথা বরফের মত ঠান্ডা রাখতে হয়। দ্যাখ, তুই যতই সাবধানে চালা, রাস্তায় চলতে গেলে ঠোকাঠুকি লাগবেই। আর এই দানব লরির ঠোকা মানেই স্পট ডেড। সে সময় তুই কিভাবে সামাল দিবি, এটা তোর ক্যালি। পদা রে, মনে হয় কপাল খুলে গেল। দেখ, একটা ভলভো বাস আসছে। মনে হয় শিলিগুড়ির যাবে। এই এলাকা ছেড়ে পালতে হবে দ্রুত। সামনে কোথাও একটা নেমে যাব। আগে তোকে একটা ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হবে। চোট জোরালো না হলেও ফেলে রাখা যাবে না। বাসে উঠেই দু জায়গায় ফোন করতে হবে। মালিকের সাথে দর কষাকষিটা আগে সেরে নিয়ে সত্যকে ধরতে হবে। সে ব্যাটা আবার ফোন নম্বর পাল্টে ফেলেছে কি না, কে জানে।"
বাসটা কাছে আসতেই হাত দেখায় বিষ্ণু। জোরে জোরে হাত নাড়তে থাকে। বাস গতি কমায়।
দুই
"স্যার, সত্যি বলতেছি, আমি দেখি নাই সাইকেল আসতেছিল। একটা চিপা গলি থেকে সাইকেলটা সোজা পড়লি তো পড়, একেবারে আমার লরির সামনে। আমি ব্রেক মারচি জোরসে। দেখচেন না লরিটার অবস্থা? আমি যে প্রাণে বাঁচচি, এইটা আমার কপাল। এখন পুরাটাই আপনার হাতে। আপনিই ভগবান। বাঁচাইলে আপনি বাঁচাবেন, মারলে আপনি মারবেন। "
মনে মনে কথাগুলো আওড়ালো সত্য। আর ঘন্টাখানেকের পথ। তারপর বাস থেকে নেমে সোজা থানা। বিষ্ণু অপেক্ষা করে আছে বাসস্ট্যান্ডে।
একটু আগেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছে সত্য। ঝাল ঝাল ডিম কষা আর রুটি। ওর বৌয়ের রান্নার হাত ভালো। বাস যে হোটেলের সামনে দাঁড়ায়, সেখানেই খেলে হত। কিন্তু বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার সময় হাতে টিফিন বক্স তুলে দিয়ে ওর বৌ বলেছিল, "এবারে আবার কতদিন থাকতে হয়, কে জানে! সেই তো ওই ট্যালট্যালা ডাইল, কাঁচা সবজি আর বরফ চাপা মাছ গিলতে হবে। এই শেষ, আমি কিন্তু বইলা দিলাম। নেহাত প্রতি সপ্তাহে লোনের কিস্তি দিতে হয়, তাই না করতেছি না। যেটা পাবা, সেই খোক টাকাটা দিয়া কিন্তু লোনটা শোধ করব, বুঝচো? কিন্তু বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা নিয়া পুরুষ মানুষ ছাড়া থাকার ম্যালা সমস্যা। সবার মানসিকতা তো সমান না। মোট কথা, এইটাই লাস্ট। আর না। বাচ্চারা বড় হইতেছে। আজ না জানুক, যদি কোনোদিন জানতে পারে?"
একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল সত্যর। বাসের ঝাকুনিতে সেটা চটকে গেল। এখন বাড়িতে ভাত ঘুমের অভ্যেস হয়েছে। আগে ট্রাক চালানোর সময় দীর্ঘ অনেক বছর ঠিক ঠাক ঘুম হয় নি। এখন সকাল বিকেল টোটো চালানো আর মাঝে মাঝে ড্রাইভার সেন্টার থেকে ফোন এলে ঘন্টা কয়েকের ছোট গাড়ির ড্রাইভারির মাঝে কুড়িয়ে পাওয়া অলস দুপুর বেলাটায় বিছানা সম্মহণের মত টানে সত্যেকে।
সেই বড় এক্সিডেন্টের পর কোনো কিছু নিয়েই আর উত্তেজনা বোধ করে না সত্য। এই যে বেঁচেবর্তে আছে, এটাই ঢের বলে মনে হয়। আর কিছুক্ষণ বাদেই সেই যে থানায় ঢুকবে, প্রথমে থানা লক আপ, তারপর সংশোধনাগারের চক্কর কেটে ক মাসে যে বেরোতে পারবে, সেটা জানা নেই। আই পি সি তিনশো চার এর এ ধারা। সত্যর মুখস্ত হয়ে গেছে। তবে ভরসা এটাই, সত্যের কোনো খাটাখাটনি নেই। উকিলের পয়সাও বিষ্ণুর মালিক দেবে। আর বিষ্ণুর হয়ে সত্য যে জেল খাটবে, এটার পরিশ্রমিকও কম নয়। মনে মনে হিসেব করে রেখেছে সত্য। ওর এক্সিডেন্টের পর ওপারেশন, চিকিৎসা, বেরোজগারী হয়ে দিনের পর দিন বাড়িতে পড়ে থাকার কারনে হয়ে যাওয়া দেনা - এবার সব চুকে বুকে যাবে, এটাই শান্তি। আর পরিবারের খরচটাও মাসে মাসে সত্যর বৌয়ের হাতে পৌঁছে দেবে বিষ্ণু। কথা যখন দিয়েছে, সে কথার খেলাপ কখনো হবে না, এটা সত্য জানে।
সত্যর বৌয়ের প্রথম প্রথম অবাক লাগতো। প্রথম যে বার আর একজন চেনা ট্রাক ড্রাইভারের হয়ে থানায় প্রক্সি দিয়েছিল সত্য, সেবার বলেই ফেলেছিল মায়া, "আচ্ছা, এই যে ওরা তোমাকে পয়সা দিতেছে, বদলে তুমি ওদের হয়ে জেল খাটবা, ওদের ফায়দাটা কোথায়?"
মুচকি হেসে সত্য বলেছিল, "আরে, আমাদের লাইনে এসব হামেশাই চলে। যারা ভালো ড্রাইভার, মালিক তাদের তুয়ায় তুয়ায় রাখে। লাখ লাখ টাকার জিনিস দেশের এ মাথা থাইকা ও মাথা যায়, বিশ্বস্ত ড্রাইভার ছাড়া যার তার হাতে গাড়ি ছাড়তে চায় না মালিকেরা। আর ড্রাইভাররাও জানে, এক্সিডেন্ট কেসে জেল খাটা মানে, অন্তত ছয় মাস তুমি বেকার। তাই ড্রাইভার আর মালিক দুইজন মিলা আমার মত কম পয়সার লোকেদের ভাড়া করে। ওরাও বাঁচে, আমারো ঘরে দুইটা পয়সা আসে। আর জেলটাও না একটা অভ্যাস, বুঝচো? প্রথমে খুব কষ্ট হবে , আবার কয়কদিন থাসকলেই অভ্যাস হয়ে যাবে।"
এবারে উঠতে হবে এবারে। নির্দিষ্ট স্টপেজ এসে গেছে। সত্য এগোয় দরজার দিকে। বিষ্ণুকে দেখা যাচ্ছে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের শেডে দাঁড়িয়ে আছে। খুব তাড়া ছেলেটার। থানার দিকটা সামলেই লরি ছাড়িয়ে ও রওনা দেবে গন্তব্যে। এতোগুলো টমেটোর ব্যাপার।
—------
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।