স্বপ্নদীপের হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে...
আরেকজনের অভিজ্ঞতা।
১৯৯৭ এর জুলাই মাস, স্থান বেনিয়ান হল হস্টেল, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়। আমি তখন ইংরেজী সাহিত্যের স্নাতকোত্তরের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সাহিত্য যে খুব ভাল লাগত, তা একেবারেই নয়। বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করা সত্বেও এক মহা পণ্ডিত দাদার বুদ্ধিতে কাল্যানীতে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে শুরু করি। সেই পন্ডিত দাদা আমার থেকে বছর তিনেকের বড় ছিল আর আমার স্কুলেই পড়ত। আমার মামা বাড়ি ছিল কাল্যানীতে আর ওই দাদাও তখন কাল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত । আমাকে সেই অর্থে গাইড করার কেউ ছিলনা। আমাকে বোঝাল বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে কোন লাভ নেই। রসায়ন নিয়ে পড়তে গিয়ে তা সে ভালো মত টের পাচ্ছে ; তার থেকে ইংরেজী নিয়ে পড়লে, স্কুলে চাকরী নিশ্চিত। ওই দাদা এস. এফ. আই এর এক মস্ত বড় নেতা ছিল। আমিও ভাবলাম ভালই হল, হস্টেল পেতে আর অসুবিধা হাবে না, ওর হস্টেলে গিয়েই উঠব। ও থাকত পি. জি. থ্রি হস্টেলে। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে চিনতামও না।
তখন হস্টেলগুলিতে অমানবিক মানসিক অত্যাচার চলত র্যাগিং এর নামে। আর র্যাগিং এর জন্য কুখ্যাত ছিল বেনিয়ান হল, কারণ আর কিছুই নয়, বেনিয়ান হল ছিল কাল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে বড় হস্টেল। একশ কুড়িটা রুম, দুটো উইং- নর্থ উইং আর সাউথ উইং। হস্টেলে থাকার প্রধান শর্তই হল, প্রত্যেক বোর্ডারের ঘরে ঘরে গিয়ে পরিচয় করা।যতক্ষণ সেই পরিচয় পর্ব শেষ হয় ততোক্ষণ নিস্তার নেই। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেই দাদা আমাকে বেনিয়ান হল হস্টেলেই ব্যবস্থা করে দেয়। আমি খুব দ্বিধা দ্বন্দ নিয়ে ওই হস্টেলে গিয়ে উঠলাম। আমার রুমমেট ছিল রাজীব ব্যানার্জী, জুয়োলজির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যাহোক পরিচয় পর্ব কোন মতে কাটিয়েতো উঠেছিলাম কিন্তু ভাল মতো বুঝতে পারছিলাম ইংরেজি সাহিত্য আমার জন্য নয়। তাই পড়াশুনায় মন বসলো না, সারা দিন কেবল খেলে বেড়াতাম।
হস্টেলে এই ধরণের ছেলেদেরই কদর বেশি।সকলে আমাকে ভালবাসত। তাই তিন বছরের স্নাতক পড়া শেষ করলেই বেনিয়ান হলের প্রিফেক্ট আর তার পর হস্টেল হল’ডের জেনারেল সেক্রেটারীও নর্বাচিত হই। আমাদের হস্টেল একটু স্বতন্ত্র ছিল। তখন বামফ্রন্ট মধ্য গগনে থাকলেও , সেই সময় একমাত্র বেনিয়ান হল হস্টেলে এস. এফ. আই এর সেই রকম নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি যখন হস্টেলের দ্বায়িত্বে তখন এত বড় হস্টেল থেকেও এস. এফ. আই এর কোন নেতা ছিল না। পার্টির ওপর মহল পর্যন্ত এ নিয়ে চিন্তায় ছিল। যেখানে সব হস্টেল থেকে দলে দলে এস. এফ. আই , ছাত্রদের পার্টির বিভিন্ন মিটিং মিছিলে নিয়ে যেতে পারতো, আমাদের হস্টেলে তা হত না। আর আমিও ক্লাস বাদ দিয়ে জোর করে ছাত্রদের মিটিং মিছিলে নিয়ে যাওয়ার একদমই পক্ষপাতি ছিলাম না। আমাদের হস্টেলে পৃথক কোন রাজনৈতিক দলের প্রভাব ছিল না এবং তার কোন সুযোগও ছিলনা। ছাত্র ইউনিয়ান ইলেকশানে যদি অন্য কেউ নমিনেশান তুলতো তবে তার ওপর অবর্ননীয় অত্যাচার নেমে আসত। হস্টেলে যারা থাকতো তাদের তো কোন সাহসই ছিলনা। যারা ডে স্কলার ছিল তাদের মধ্যে কেউ যদি নামিনেশন তুলতো তাহলে তার কপালে জুটতো মার। জামা প্যান্ট ছিঁড়ে গলা ধাক্কা দিতে দিতে ট্রেনে তুলে দিত সি পি এমের গুন্ডারা। এস. এফ. আই এর নেতাদের আস্ফালন ছিল অকল্পনিয়।
অনেক দিন থেকেই আমাদের হস্টেলকে উচিত শিক্ষা দেবার ছক কষা চলছিল। কিন্তু এস. এফ. আই পেরে উঠছিল না হস্টেল বড় হওয়ার জন্য আর আমাদের ইউনিটির জন্য। আমাদের মধ্যে হস্টেল সেন্টিমেন্ট ছিল খুব গভীর। এই সময় ১৯৯৫ সালে হস্টেলে আসল একটি ছেলে। নাম বিশ্বজৎ , সোশিওলজি , প্রথম বর্ষ। মাথায় মস্ত বড় টাক আর ইয়া বড় গোঁফ। আমরা একটু অবাকই হয়েছিলাম এত বড় বয়সে প্রথম বর্ষে পড়তে আসায়। কেউ কেউ বলেছিল বাংলাদেশের ছেলে কিন্তু কথায় কোন বাংলাদেশী টান ছিলনা। ও সক্রিয়ভাবে এস. এফ. আই করতো। ওর হস্টেলে ডাক নাম ছিল টেঁকো বিশু। আমি যখন বেনিয়ান হলের প্রিফেক্ট তখন ওর সেকেন্ড ইয়ার। ও থাকতো হস্টেলের সাউথ উইং এর দোতালায়। দিন দিন ওর দৌরাত্ম্য বাড়তে লাগলো। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ওর র্যাগিং ছিল মারাত্মক। ওর জন্য এম এ প্রথম বর্ষের ছাত্ররা পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে হস্টেল ছেড়ে চলে যেত। ভাল ভাবে সুতর্ক করলেও কর্ণপাত করত না। ইতিমধ্যে আমরা লক্ষ্য করছিলাম যে কিছু দিন অন্তর অন্তর সাউথ উইং এর দোতালায় পিকনিক হচ্ছে। বক্স বাজছে আর খাসীর মাংসের গন্ধে সমগ্র হস্টেল ম-ম করছে । আমদের মাসে একবারই গ্র্যান্ড ফিস্ট হত। ফ্লোরে ফ্লোরে ফিস্ট হওয়ার কোন রেওয়াজ ছিলনা। আমরা সবাই আবাক হয়ে যেতাম। তারপর খবর পেলাম যে হস্টেলের মাঠে যে ছাগল চড়ে বেড়াত তার থেকে ধরে এনে বিশু বাথরুমে কেটে ফেলতো। মাংস খাওয়ার লোভ দেখিয়ে আর নূতনদের ভয় দেখিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে রাখত। ছাগল কেটে ফেলার পর, মাথা, চামড়া, নাড়িভুড়ি পুরানো ব্যাগে করে ট্রেনের কামরায় প্রথম বর্ষের কোন ছাত্রকে দিয়ে রেখে আসতো। এরকম ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছিল। আমি যখন জানতে পারলাম, হস্টেলের প্রিফেক্ট হিসেবে একটু কড়া করেই সতর্ক করলাম ওকে। বলেছিলাম, ‘ পার্টি কর আর যাই কর হস্টেল থেকে বের করে দেব’।
এরপর কিছুদিন সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে হস্টেলে একটি ঘটনা ঘটল। স্ট্যটিস্টিক্স এর একজন দাদার রুমে ওর সহপাঠী প্রায়ই আসতো। মহিলা গেষ্ট আসলে, রুমের দরজা খোলা রাখারই নিয়ম ছিল। ওই দাদা থাকত হস্টেলের সাউথ উইং এর দোতালায়্ ।এই বিষয়ে ওই ফ্লোরের অনেকের ঈর্ষা ছিল, কারণ আর কিছুই নয় অনেকের অনেক চেষ্টাতেও যখন প্রেম হয়নি তখন তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ে উঠেছিল তীব্র প্রেম বিরোধী। বিশু ছিল তাদের লিডার। ওর কথা ছিল , ‘ আমদের সব গেল শুকিয়ে, আর তুমি থাকবে রসে বসে ! দেখাচ্ছি মজা।‘ ক্রমে ও আর কয়জনকে নিয়ে দাবি জানাতে লাগলো যে- কাউকেই মহিলা গেষ্টকে নিজের রুমে নিয়ে যাওয়ার আনুমতি দেওয়া যাবে না। এবিষয়ে পুরো হস্টেল দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গেল। জেনারেল বডির মিটিং ডাকা হল। তুমুল হইচই। যাদের প্রেমিকা আছে তারা এই দাবীর বিরোধী, আর যাদের প্রেমের সম্ভবনা আছে তারাও বিরোধী। অনেকের মা, দিদিরা বাড়ী থেকে দেখা করতে আসতেন, তারাও এর বিরোধী ছিল। কিন্তু জি বি তে সিদ্ধান্ত হল মহিলা গেষ্ট আসলে রুমে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
হষ্টেলে প্রথম ঐক্যে ফাটল ধরল। আর সি পি এম পার্টি যেন এর অপেক্ষাতেই ছিল। সবার অলক্ষ্যে বিশু একটা লিষ্ট তৈরী করল। গোপনে তাদের সবাইকে ছাত্র ইউনিয়ান অফিসে যেতে বলা হল। আমি প্রিফেক্ট, অথচ আমি কিছু জানতে পারলাম না। পরে শুনেছি ওই মিটিং -এ অনেক তাঁবর তাঁবর নেতা এসে ভাষণ দিয়ে ছিল। বড় কিছু যে হতে চলেছে তার একটা আভাস দেওয়া হয়েছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে এও তাদেরকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে পার্টির সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করলে ফল ভুগতে হবে। সবাইকে বলে দেওয়া হল এ বিষয়ে টুশব্দটি না করতে।
ঠিক তার পর দিনের ঘটনা। আমাদের ডিনার দশটার মধ্যে হয়ে যেত।সামনেই পরীক্ষা ছিল তাই রাতের খাবার হয়ে গেলে বাইরে আড্ডা না দিয়ে আনেকেই ঘরেই চলে গিয়েছিল। আমিও আমার ঘরেই ছিলাম। ডাইনিং এ খেতে গিয়ে সবাইকে একটু অস্বাভাবিক রকম চুপচাপই দেখেছিলাম। বিশুদের দলের কয়েকজন কানে কানে ফিস ফিস করছিল, কিন্তু ঘ্রূনাক্ষরে বুঝতে পারিনি কিছুক্ষ্ণের মধ্যে কি ঘটতে চলেছে ! হটাৎ বাইরে খুব শোরগোল শুরু হল। কিছুক্ষ্ণের মধ্যেই তা আর্তনাদে পরিনত হল। একশর বেশি ছেলে বাঁশ, লোহার রড নিয়ে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে আক্রমণ করছে।আর উদ্বাস্তু কলনির ছেলারা এসেছিল পার্টির নির্দেশে।পুরো হস্টেল ওরা ঘিরে ফেলেছিল। মুখে অশ্লীল গালাগাল আর সঙ্গে দুমাদুম দরজায় লাথি। চারিদিকের থেকে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ আর বাঁচাও , বাঁচাও চিৎকার । আমি সাউথ উইং এর টপ ফ্লোর অর্থাৎ তিন তলায় থকতাম। আমি কি করবো না বুঝতে পেরে ছাদে চলে গেলাম। ছাদ থেকে দেখতে পেলাম কি বীভৎস দৃশ্য। এক এক করে সিনিয়ার ছেলেদের ধরে মারতে মারতে বাইরে বের করে আনছে। প্রথমে গ্রাউন্ড ফ্লোর তার পর ফার্স্ট ফ্লোর। মার খাচ্ছিল বিশেষ করে তারাই যারা গোপন মিটিং এ ডাক পায়নি। যখন ছাদ থেকে শুনলাম বিশু আর ওর দলবল চিৎকার করে আমাকে খোঁজ করছে, আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ছাদের মধ্যে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়াচ্ছি আর ওদের কন্ঠস্বর ক্রমে গাড় হচ্ছে। ছাদের উপর বড় জলের ট্যাঙ্ক ছিল। তার তলা ছিল অন্ধকার আর বড় বড় শ্যাওলা আর ছত্রাকে ভর্তি। ট্যাঙ্ক থেকে সবসময় জল চুইয়ে পরে পরে যায়গাটা ছিল একদম স্যাঁতসেঁতে । ছাদ থেকে ট্যাঙ্কের উচ্চতা এক হাতের মত। আমি প্রাণ ভয়ে ট্যাঙ্কের তলায় শুয়ে পরে ঘষটাতে ঘষটাতে গিয়ে ঢুকলাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এল বিশুর দলবল। ওরা খুঁজে চলেছে সমানে। এরই মধ্যে বিশু ট্যাঙ্কের তলায় লোহার একটা রড দিয়ে খোঁচাতে লাগল। নিকষ অন্ধকার, ট্যাঙ্কের তলায় কিছু দেখবার অবকাশ নেই। কিন্তু বিশু সমানে খুঁচিয়ে চললো। যেন ওর দৃঢ় বিশ্বাস ট্যাঙ্কের তলায় কেউ না কেউ আছে। আর আমি মুখ চেপে একদম ছাদের বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে ঠেসে যেতে লাগলাম। হাতের রড ছোট ছিল তাই আমার কাছে পোঁছাচ্ছিল না । বার বার অকথ্য গালাগাল দিয়ে বলছিলো , ‘বেরিয়ে আয় না হলে প্রাণে মেরে দেব’। ওর মাথায় যেন খুন চেপে গিয়েছিল। এবার গালাগাল দিতে দিতে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা লম্বা বাঁশ নিয়ে এসে আবার খোঁচাতে লাগল। এবার আর রক্ষা নেই। বাঁশের গুঁতো গায়ে লাগতেই ওর অনুমান সঠিক হয়ে গেল। এবার ও বেপরোয়া ভাবে পৈশাচিক উল্লাসের সঙ্গে খোঁচাতে লাগল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ আমি রাজেশ, আমার খুব লাগছে, আমি বেরিয়ে আসছি, আমি বেরিয়ে আসছি।‘ এবার বিশু বাঘের মতো গর্জন করতে লাগলো। কোন মতে আমি যেই মাথা বের করেছি বিশু টিউবলাইটের লোহার ফ্রেম দিয়ে আমার মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করতে লাগলো। আমার চোখে ছিল একটা মোটা সেলুলয়েডের ফ্রেম আর আমি দুহাত দিয়ে মাথাটাকে রক্ষা করে চলেছি। লম্বা বাঁশ দিয়ে তো মারা যায় না, তাই নিমেষে বিশু বাঁশ ফেলে লোহার ফ্রেম তুলেনিয়েছিল। আমার দু হাত ক্ষতবিক্ষত, মাথা ফেটে গিয়েছে। সব কমরেডরা তখন আমাকে শাসাচ্ছে। তারই মধ্যে শান্তনু বলে আমার ইংরেজী বিভাগেরই এক ভাই যে পাশের হষ্টেলে থকতো, একটা আস্ত থান ইট দিয়ে আমার বা-গালের ঠিক ওপরে সজোরে মারলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ফুলে বাদিকের চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমি রেহাই পেলাম মারের হাত থেকে। সব ছাদ থেকে এক এক করে নেমে গেল। সব শেষে নামল বিশু। আর নামার সময় কানের কাছে চাঁপা গর্জন করে বলে গেল, ‘ কিরে শালা আমাকে না বলেছিলি তুই হষ্টেল থেকে বের করে দিবি। দেখ কেমন লাগে’।
যে ছেলে একা একটা পাঠা কেটে ফেলতে পারে নিজে হাতে, তার থেকে এই রকম নিশংসতা একটূও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম শান্তনুর আচরণে। যে ছেলে ডিপার্টমেন্টে দেখা হলেই দাদা দাদা বলে, চশমা পরা শান্ত গোছের দেখতে, সে যে আমাকে ইট দিয়ে এই ভাবে মুখে মারবে, আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আমি আস্তে আস্তে ছাদ থেকে তিনতলায় নেমে এলাম। চোখের সামনেই দেখলাম হস্টেলের সবচাইতে লম্বা আর শান্ত ছেলে সৌমিন্দ্র দাকে ওই লোহার বাটাম দিয়ে বিশু এমন মাথায় মারলো যে একটা সারে ছয় ফুটের ছেলে ঠিক একটা কলা গাছের গোড়ায় দা দিয়ে কোপ দিলে যে ভাবে পরে যায়, ঠিক সে ভাবে পরে গেল। ও কিছুক্ষণের জন্য সেন্সলেস হয়ে গেল।
এবার নামলো সি পি এমের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিম। আমাদের সবাইকে কর্ডোন করে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল। জিয়া দা বলে এস এফ আই- এর এক সিনিয়ার দাদা স্কলার হষ্টেল থেকে এসেছিল বেশ কয়েকজন কে নিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে সামাল দিতে। খুব ভাল ভাবে সামালও দিলো। একজন ছেলেও পুলিশের কাছে গেল না। ডাক্তার কোন ঝামেলা করলো না। আমার হাতে কপালে স্টিচ পড়ল। আর অনেকেরই পড়ল। সেই রাতে একটা উপলব্ধি হল যে সংগঠিত আক্রমণকে প্রতিহত করা সহজ নয়। প্রাণের বান্ধবরাও পাশে দাঁড়ায় না। পর দিন এক এক করে যারা মার খেয়েছিল সবাই একসঙ্গে হস্টেল ছেড়ে দিল। প্রায় পয়ত্রিশ জন। পর দিন সকালে আমার শহরের সেই মহা পন্ডিত দাদা, যার ভরসায় আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, হাতে একটা হরলিক্স নিয়ে সান্তনা দিতে এসেছিল। আমি বলেছিলাম আমার মামার ছেলেরা আছে, আমি পুলিশে যাব। আমি বিশুর শাস্তি চাই। ও আমাকে বোঝাল এসব করে কোন লাভ নেই কারণ বিশু একা না , ওর সঙ্গে পুরো পার্টি আছে। আমি যেন এসব না করে ভাল করে এম- এর পরীক্ষা দিই। আর যাবার সময় বলেগিয়েছিল, ‘ জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে লডাই করে কি লাভ?’
পরীক্ষা অবশ্য আর দেওয়া হয়নি। দুই তিন দিন হস্টেলে ছিলাম, আতঙ্কে ঘুমাতে পারিনি। সহপাঠীরাও এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করল। বেনিয়ান হস্টেল পার্টির কন্ট্রোলে এলো সম্পূর্ণ ভবে আর বিশুর গুরুত্ব বেড়ে গেল এস এফ আই- এ। কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। আমি ছাড়া সবাই এম এ পরীক্ষা দিল। আর আমি বনগাঁ ফিরে গেলাম।
আমাদের যে কি দোষ ছিল তা আমরা কেউ এত দিনেও বুঝতে পারিনি। না আমরা সি পি এম এর বিরুদ্ধ পার্টি করেছিলাম না আমরা ওদের বিরোধিতা করেছিলাম। আমরা কেবল আমাদের মতো থাকতে চেয়েছিলাম, দলের দাসত্ব করতে চাইনি। তার জন্য এত বড় শাস্তি। তখন না ছিল ফোন ,না ছিল এত নিউজ চ্যানেল। এই হাড় হিম করা সন্ত্রাস বাইরের কেউ জানতেও পারেনি। ২৭ বছর কেটে গিয়েছে, বিশু সি পি এম থেকে তৃণমূলে গিয়েছিল। এবার হয়তো আবার বিজেপি তেও আসবে। আমি হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলাম, কিন্তু হাজার হাজার ছাত্র আছে যাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে, মানবতার প্রতি বিন্দু মাত্র শ্রদ্ধা থাকলে কোন রাজনৈতিক দল কি এই রকম অমানবিক সন্ত্রাসকে অনুমোদন করতে পারে? আপনারাই বিচার করবেন। আমি যা কিছু লিখেছি সব প্রমান আছে।একটি বর্ণও অতিরঞ্জিত নয়। অনেকের নামই নিতে পারি, নিলাম না। তারা অনেকেই এখন কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে। এত বছর পরে কাউকে বিড়ম্বনায় ফেলা আমার অভিপ্রায় নয়। যাদবপুরের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপের হত্যায় ২৭ বছরের পুরনো স্মৃতি আবার দগদগে হয়ে উঠল। র্যাগিং এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন হয়েছিল। আমাদেরও হস্টেল সুপার ছিল, যেমন ঠিক আজ যাদবপুরে আছে। আমাদের সুরক্ষা দিতে তিনি ব্যার্থ ছিলেন, যাদবপুরের সুপারও ব্যার্থ হলেন আর একটা প্রাণ চলে গেল। আমার একটাই প্রশ্ন যে "জুটা" সব ব্যাপারেই অতি সক্রিয়, তারা কি জানে না হস্টেলে কি হয় ? যাদবপুরে অনেক ছাত্রছাত্রী, বিশেষ করে আর্টসের, যে গাঁজাতে আসক্ত হয়ে জীবন নষ্ট করে ফেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে, তা কি শিক্ষকদের অজানা?
শিক্ষকরা সব সময় ছাত্রদের রোল মডেল। তাদের দেখেই ছাত্রছাত্রীরা যাদবপুরে বামপন্থী ভাবধারায় আসে। তাহলে এখন তাঁরা দায় নেবেন না কেন ? ছাত্র শিক্ষক নিবিড় সম্পর্ক মানে কখনোই পুত্রসম ছাত্রের থেকে সিগারেট চেয়ে খাওয়া নয়। আর অনেক বিষয় আছে তার উল্লেখ নাই বা করলাম। করলে অনেকেই বলতে পারে - কাক হয়ে কাকের মাংস খাচ্ছি।