ঠাকুমা (নানা) র বাপের বাড়ির দেশ ছিল সুকিন্দে। কে জানে কোথায় সে। একবারই মাত্র যাওয়া হয়েছিল সেখানে। কার যেন বিয়ে ছিল। বিরাট একটা বাসে চড়ে খুব ভোর ভোর রওনা দিয়েছিল ওরা। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের হাত ধরেছিল প্রায়। বর-বউয়ের কথা এখন আর মনে নেই তুলির। শুধু মনে আছে, খাওয়া শেষ হতেই ঢালাও বিছানায় শুতেই ঘুম বুড়ি হাত ধরেছিল সবার। শুধু তুলির ঘুম আসছিল না। মনে পড়ছিল নানা র মুখে শোনা দুই পাখির কথা। এই সুকিন্দে বাড়ির প্রাণখোলা বারান্দার পাশে যে কাঠবাদাম গাছ ছিল, সেখানে এসে বসতো দুই পাখি। তুঁইথুলি আর মুঁইথুলি। বিরাট দুই পাখি। বিশাল তাদের ল্যাজ..সেখানে চিকচিকে চুমকি জড়ানো আলো। বাঁকানো দুজনের ঠোঁট। একজনের লাল। অন্যজনের হলুদ। টানা টানা দু চোখের মাঝে নীল মণি ঝকঝক করতো। মাথায় তাদের ঝুঁটি। সেখানে ফাগুন বনের আগুন লাগানো রঙ ঝরে পড়তো।
ঘুম জড়িয়ে আসে তুলির দু চোখে। পুপুদিদির কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়তেই...
'তুঁইথুলি না মুঁইথুলি'.. 'তুঁইথুলি না মুঁইথুলি'... তুঁইথুলি মুঁইথুলি কে ডাকে, মুঁইথুলি তুঁইথুলি কে। কি তীব্র সেই ডাক !.. তাদের তীক্ষ্ণ চিৎকারে নিঃঝুম রাতের অন্ধকার খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে। পুকুরের জল ছলকে ওঠে। শোল বোয়াল জলের আরো গভীরে ডুব দেয়। পাখিরা পালক ফুলিয়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়। পেঁচারা শিকার ছেড়ে কোটরে ঢুকে পড়ে। কুয়াশা মাঠে নামবার আগেই থমকে দাঁড়ায়। আর ওই যে কাঠবাদাম গাছ..থর থর করে কাঁপতে থাকে। তারপর এক প্রবল ঝটকানি মেরে দুই পাখি, গাছ থেকে উড়ে গিয়ে বসে প্রাণখোলা ওই বারান্দায়।
যেখানে চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে দুলছে রজনীগন্ধার ঝালর ঝোলানো দুটো দোলনা। সেখানে।
দোল খেতে খেতে ওরা তীব্র চিৎকারে ডাকতে থাকে..তুঁইথুলি.... মুঁইথুলি।.....
গভীর রাতের সবুজ অন্ধকারে আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল, কুল, পেয়ারা, সবেদা গাছের হাত ধরাধরি করে বাড়ি ঘিরে নাচতে থাকে। আকাশের তারারা মাটির বুকে নেমে এসে গানে গানে ভুবন ভরিয়ে তোলে।
আর প্রাণখোলা বারান্দায়, ফুলের দোলনায় বসে তুঁইথুলি আর মুঁইথুলি পাখি, তাদের রূপের সিন্দুক খুলে পড়ে নেয় মায়া সাজ। একে অপরের রূপের শোভায় মুগ্ধ দুই পাখি ডেকে ওঠে..তুঁইথুলি.... মুঁইথুলি....
আম, জাম ,কাঁঠাল, কুল, পেয়ারা, সবেদা, জামরুল গাছেরা চাঁদের আলোয় ধোওয়া রুপোলি রেকাবিতে সাজিয়ে দেয় তাদের ফলের নৈবেদ্য।
তুঁইথুলি আর মুঁইথুলি তাদের আহার সাঙ্গ করে। চাঁদের পালকি চড়ে তারা ফিরে যায় সুরের আনন্দধামে। দিনমণি দুয়ার খোলার আগেই।
নানা মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কেমন দেখলে গো দিদিরানী, তুঁইথুলি আর মুঁইথুলি কে। কেমন লাগলো প্রাণখোলা বারান্দা কে।
'এই তুলি উঠে পড়, উঠে পড় বলছি'..পুপুদিদির চেঁচামেচি তে ঘুম ভেঙে যায় তুলির। একছুটে চলে যায় প্রাণখোলা বারান্দায় । কাঠবাদাম গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে তার কানে কানে বলে, 'তুমি আবার এসো নানা ..এমন অনেক রঙীন স্বপ্ন নিয়ে...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।