এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কলেজ বাড়ির রহস্য

    Sara Man লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ আগস্ট ২০২১ | ১১৩৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কলমে ডঃ শারদা মণ্ডল, অধ্যাপিকা, বিভাগীয় প্রধান, ভূগোল বিভাগ, প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ


    প্রথম পর্বঃ হাতেনাতে প্রমাণ?

    কলেজে নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলছে। আমি এই সেন্টারের অ্যাসিস্ট‍্যান্ট কোঅর্ডিনেটর। তাই তদারকিতে থাকতে হবে। মূল কোঅর্ডিনেটর সুমনদা আজ আসবেনা। তাই আমার দায়িত্ব বেশি। আন্দুল বাজার স্টপেজে বাস থেকে নেমে গোলাপ বাগান দিয়ে হেঁটে আসছি। চোখে পড়ল কালার জেরক্সের দোকানটা খোলা আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল অনার্স ক্লাসের জন্য কয়েকটা ম‍্যাপ জেরক্স করানোর ছিল। ঘড়িতে দেখলাম দেড়টা বাজে। এন এস ও ইউ এর পরীক্ষা শুরু হতে এখনও আধঘণ্টা বাকি। কাজটা সেরে নিই তাহলে। বাসুবাবু মানে বাসুদেব চ‍্যাটার্জি আছেন। পাঁচমিনিট পৌঁছতে যদি দেরীও হয় সামলে নেবেন। পদে তিনি এই দূরশিক্ষা কেন্দ্রের অফিস অ্যাসিস্ট‍্যান্ট বটে, আসলে তিনি আমাদের সকলের অভিভাবক। এই কেন্দ্র তাঁর হাতে তৈরি, আর সব কিছুই তাঁর নখদর্পণে। কাজ সেরে কলেজে যখন ঢুকছি, পরীক্ষা শুরু হতে আর পাঁচ সাত মিনিট বাকি। আজ প্রথমার্ধে পরীক্ষা ছিলনা। দুটো থেকেই শুরু। দিনটা রবিবার। ভর দুপুর বেলা, পরীক্ষার্থীরা দোতলায় হলে ঢুকে পড়েছে। হৈ চৈ নেই। একতলাটা একেবারে শুনশান। পুরোনো বাড়ির মাঠের দিকের বারান্দা দিয়ে টানা হেঁটে এলাম। অফিস আর অ্যাকাউন্টসের মাঝখানে একটা সরু গলি। ওখান দিয়ে রাস্তার দিকের বারান্দায় যেতে হবে। ঐ বারান্দায় পড়লে, সামনে দোতলার সিঁড়ি। বাঁদিকে শিক্ষাকর্মীদের কমন রুম। ডানদিকে আমাদের স্টাফরুম। ছুটির দিন আমি কোন কাজে এলে কেউ না কেউ খুলে দেয়। নইলে বন্ধ থাকে। আনমনে বাঁদিকে তাকালাম। শিক্ষাকর্মীদের কমনরুমে পর্দার ওপাশে কেউ রয়েছে, প‍্যান্ট, জুতো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওটা বেচুদা নাকি গোপাল দা? চেঁচিয়ে না ডেকে, তিন চার পা এগিয়ে গেলাম, সরাসরি কথা বলার জন্য। পর্দা সরিয়ে চমকে উঠলাম। এখানে কেউ নেই। এক মূহূর্ত আগে এখানে কেউ ছিল, আমি নিজে দেখেছি। এপাশ ছাড়া বেরোনোর ও রাস্তা নেই। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্টাফ রুম খোলানো যাবেনা তাহলে। উপায়ান্তর না দেখে সিঁড়ি দিয়ে আমাদের কেন্দ্রের অফিসে গিয়ে বসলাম। ঘটনাটা হজম করতে পারছিলাম না। আমি বাস্তববাদী মানুষ, কল্পনায় ভাসা একেবারেই নাপসন্দ। সই সাবুদ সারতে সারতে একটু থিতু হই। কাজের ফাঁকে মাথায় ভাবনার স্রোত চলে।


    ফ্ল‍্যাশ ব‍্যাক

    কলেজের এই অঞ্চলটা নিয়ে অনেক কাহিনী আগে শুনেছি। এক এক করে সেগুলো মনে মনে সাজাতে থাকি। যখন এই কলেজে যোগ দিই, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অঙ্কের অধ‍্যাপক হরিবাবু বলেছিলেন শোন প্র‍্যাকটিকাল শেষ করাতে তোদের দেরি হয়ে যায়। সন্ধ‍্যের মুখে কখনো বারান্দার এই কোণে আসবিনা। আমরা মানে আমি আর বল্লরীদি, ভূগোল বিভাগের প্রথম যোগদানকারী দুই ফুলটাইমার হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন? তিনি উত্তর দিলেন, অনেকে অনেক কিছু দেখেছে। তোরা এখন বুঝবিনা। এখানে কেউ যাতায়াত করে। আমাদের চোখে অবিশ্বাস দেখে, কপট রাগে তিনি বললেন, পুঁচকে মেয়ে সব জেনে গেছে, যা বলব শুনবি, যাঃ। আমরা হাসতে হাসতে বলেছিলাম, কলেজে ভুত আছে বুঝি? হরিবাবু বলে চলেন, আন্দুল প্রাচীন জনপদ - দক্ষিণের নবদ্বীপ। সামনে রাজবাড়ী। নবাবী আমল, ইংরেজ আমল সব কিছুর সাক্ষী। কত যুদ্ধ, শত্রুতা, গুম খুন, তার ইয়ত্তা আছে? কলেজ বেড় দিয়ে এই যে সরস্বতী খাল দেখছিস, একি চিরকাল এমন ছিল? বিশাল চওড়া নদী। আমরা যখন কলেজে আসি, তখনও এ নদী দিয়ে মালবাহী নৌকো যেত। কত মানুষের অকালে জলসমাধি হয়েছে এখানে কোনো ধারণা আছে তোদের? ফচকে মেয়ে সব। কলেজের এই মাঠ এককালে তো নদী ছিল। নদীর ওপরে দাঁড়িয়ে আছিস তোরা, ভূগোল পড়াস, এগুলো বুঝিসনা। কি দাম আছে তোদের ভারি ভারি মার্কশিটের? অবাক হয়ে হরিদার কথা শুনি। এই অকুণ্ঠ শাসন প্রাণভরে উপভোগ করি, এমন তো বাড়িতে হয়। বকুনি শুনে অজান্তেই কলেজটা দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে ওঠে। আমার স্বভাবটা হল একটা কথা শুনলে ছেড়ে দিইনা। গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি। শেষ দেখে ছাড়ি। একদিন কলেজ ছুটির সময়ে হিসাবরক্ষক তাপসদার ঘরে ঢুকে পড়ি।
    - তাপসদা, সন্ধ‍্যের মুখে বারান্দার এই কোণে কি কিছু দেখা যায়, বুদ্ধিতে যার ব‍্যাখ‍্যা মেলেনা।


    - শুধু সন্ধ‍্যে কেন দিদি দুপুরেও হয়।


    - মানে?

    - একদিন দুপুরে সুনীলদা কলঘরে যেতে গিয়ে দেখল, অন্য কেউ ঢুকে গেল। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও সে বেরোচ্ছে না। শেষে সুনীলদা দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখে দরজা খোলা। কেউ নেই। একজন ঢুকেছিল কিন্তু কেউ বেরোয়নি।


    - বলেন কী? এযে অবিশ্বাস্য।


    - হ‍্যাঁ দিদি, প্রথম প্রথম অসুবিধে হয় বটে, পরে সব সয়ে যায়।


    হায় ভগবান, এ কি কান্ড রে বাবা, ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে হাঁটা দিই।

    কলেজের নানা ব‍্যস্ততায় দিন কাটে। সহকর্মীরা নতুন থেকে পুরোনো হয়ে ওঠে। ছাত্রছাত্রীরা জীবনের সব ফাঁক ভরাট করে বসে পড়ে। অতিপ্রাকৃত সঙ্গীদের কথা আর মনে পড়েনা। একবছর নবীন বরণের পরদিন কলেজে ঢুকতেই ইউনিয়নের জি এস দৌড়ে আসে। সঙ্গে আরও কিছু ছেলেমেয়ে। প্রথমে ছেলেদের কথা শুনি।


    - কী হয়েছে?


    -কাল অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে ম‍্যাডাম।


    - সব ঘর সাজানোর জন্য আমরা কয়েকজন তো রাতে কলেজে ছিলাম।


    - হ‍্যাঁ জানি তো।

    - ওদিক থেকে একুশ, কুড়ি, উনিশ নম্বর ঘরে বোর্ডে স্বাগতম লিখে আমরা এন ইলেভেনে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ঢুকতে পারিনি। ঐ ঘরের সামনের বারান্দায় একটা অদ্ভুত গরম হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। অন্য কোথাও কিছু নেই। ভয়েতে আমরা ওঘরে আর ঢুকিনি। এমনিতে তো সন্ধ‍্যে হলে এই কোণে কলঘরে আমরা দল বেঁধে যাই। একা যাওয়া যায়না। নিজে নিজে কলে জল পড়ে। 

    এবারে মেয়েদের পালা।

    - ম‍্যাডাম ওপাশের বারান্দায়
    আমাদের কমনরুমে একটা আয়না আছে।


    - হ‍্যাঁ দেখেছি তো।


    - ওটা আমরা সরিয়ে দেব।


    - কেন?


    - প্রোগ্রামের সময়ে যারাই বিকেলে ঐ আয়না দেখে সাজে, তারা সব অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সকালে কিছু হয়না।


    - ধ‍্যাৎ। এসব আবার হয় নাকি?


    - হচ্ছে তো ম‍্যাডাম।


    - আচ্ছা ঠিক আছে, তোমরা এবার ক্লাসে যাও।

    আমি নির্বিকার মুখে ওদের কথা শুনি, আর মনে মনে আঁক কষি। তাপসদার বলা কর্মীদের কলঘর হল উত্তর পূর্ব কোণে, আর ছাত্ররা যেটার কথা বলছে, ওটা দক্ষিণ পশ্চিম কোণে। মাঠের মাঝ বরাবর ধরলে একেবারে ব‍্যাস বরাবর বিপরীত দিকে। কলেজ বেড় দিয়ে যে সরস্বতী নদীর ধারা রয়েছে, দুটো কলঘর তার দুই প্রান্ত সীমায়। যে বারান্দাগুলির কথা হল, সেগুলি সব নদীর পাড় বরাবর। সব অভিজ্ঞতাই হরিদার নদীর গল্পের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।


    ছিন্ন চিন্তা সূত্র

    বেল বাজছে। পরীক্ষা শেষ। বাসব আসছে খাতা গুছিয়ে। ওকে বলি আজ কী হল। বাসব মিতভাষী। মুচকি হেসে বলল, ও কিছু নয়, ডাক্তার বাবু জানান দিলেন, উনি সব নজরে রাখছেন। ডাক্তার বাবু মানে তিনকড়ি ঘোষ, যাঁর জমি, বাড়ি ভূসম্পত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এই কলেজ। তাঁরই গুরুর নামে এই কলেজের নাম দিয়েছেন, প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ। নিজের কথা যাতে প্রচার না হয়, একটা ছবিও তিনি রাখেননি। আমরা কেউ ডাক্তার বাবুর ছবি দেখিনি। ধুর্ বাসব তো মজা করে বলছে। যা এতকাল ধরে শুনছি, সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা,আজ কি তবে আমার নিজের হল?


    পর্ব দুইঃ অতীন্দ্রিয়

    শেষ পর্যন্ত বেড়ালের ভাগ‍্যে শিকে ছিঁড়ল। স্থায়ী চাকরিতে যোগ দেওয়ার দশ বছর পরে অবশেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে আমি পি এইচ ডি করার জন্য নির্বাচিত হলাম। চাকরির প্রথম দিকে ডিপার্টমেন্টটা শূন্য থেকে শুরু করে তাকে দাঁড় করাতেই মেতে ছিলাম। যখন সম্বিত ফিরল তখন অনেক বছর দেরি হয়ে গেছে। সুযোগ পাচ্ছিলাম না। যা হোক কাজটা ভালো ভাবে করার জন্য ইউ জি সি তে ফ‍্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে দুবছর ছুটির আবেদন ক‍রলাম। প্রভু জগদ্বন্ধুর কৃপায় ছুটি মঞ্জুরও হল। ২০০৮ এর ডিসেম্বরে আমার পড়ার ছুটি শুরু হল। ঐসময়ে রোজ বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে হাজিরা খাতায় সই করতে হত। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি। তাই সপ্তাহের ঐ দিন গুলো তে কলেজে গিয়ে আমি এন এস ও ইউ এর কাজ করতাম।
    দিনটা ছিল ২০০৯ সালের পাঁচই সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। এবং অবশ্যই শনিবার। সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে। এজীবনে ভুলতে পারবোনা। আজকাল সকলের চলভাষে ক‍্যালন্ডার থাকে, তাই যে কেউ পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারে, আমি ভুল বলছি কিনা। মেঘলা দিন, মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। বাসুবাবু খবর পাঠিয়েছেন একষট্টিটা হোম অ্যাসাইনমেন্টের খাতা দেখে দিতে হবে আমাকে। সারা সপ্তাহ জুড়ে গবেষণার নানা কাজের ধকল। ক্লান্ত ছিলাম, কিন্তু বাসুবাবুর কথা তো ফেলা যায়না। সময়ের মধ্যে করে দিতেই হবে আমাকে। শনিবার একটা পনেরোয় কলেজের ক্লাসের ছুটি হলে আমাদের দূরশিক্ষা কেন্দ্রের ঝাঁপ খোলা হত। দুপুর একটা নাগাদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উপস্থিত হলাম। একষট্টিটা খাতা একরকম নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ভূগোল অনার্সের সঙ্কেত GEOA, এখানে সঙ্কেত হল EGR। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয়, চতুর্থ আর ষষ্ঠ সন্মাষ মিলিয়ে, হরেক মডিউলের খাতা মিলে মিশে রয়েছে। আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে, মূল‍্যায়ন করে বেঁধে দিতে হবে, আজকের মধ‍্যেই। পুরোনো বাড়িতে দোতলায় আমাদের কেন্দ্রের অফিসটা খুব ছোট ছিল। তাই খাতাগুলো একতলায় আমাদের স্টাফরুমের টেবিলে নিয়ে এসে ছড়িয়ে বসলাম। সবরকম মডিউলের জন্য একটা করে প্রশ্নপত্র বাসুবাবু গুছিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো সঠিক বান্ডিলে গুঁজে দিলাম। আজ দর্শন বিভাগে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জিগীষা। এই দিনটা ওরাই পালন করে। ছাত্রছাত্রীরা ডাকতে এসেছে। আমার খুবই ইচ্ছে করছিল যেতে, কিন্তু বাসুদাকে আমি কথা দিয়েছি। অগত্যা আমি একাই বড় ঘরে প্রশস্ত টেবিলে খাতা দেখতে শুরু করলাম। বাকি সকলে অনুষ্ঠান দেখতে তিনতলায় সাঁইত্রিশ নম্বর ঘরে চলে গেল। সময়ের অত হিসেব ছিলনা। সহকর্মীরা যখন হৈ হৈ করতে করতে আর অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে নেমে এল, তখন ঘড়িতে দেখলাম বিকেল সাড়ে তিনটে। ওরা সব যে যার ব‍্যাগ গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরল। আমার তখনও প্রায় চল্লিশটা খাতা বাকি। বেজার মুখে টিফিনটা খেয়ে নিয়ে আবার খাতা দেখায় মন দিলাম। মাঝখানে প্রণবদা এসে জিজ্ঞেস করেছিল, দিদিমণি আর কতক্ষণ? আমি বললাম, আজ একটু সময় লাগবে।
    - ঠিক আছে ওদিকটা বন্ধ করে দিচ্ছি।
    - দিন, এদিকে খোলা থাকলে চলবে।

    ওদিক মানে মাঠের দিকের বারান্দার দরজা, যেদিক দিয়ে ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য বহিরাগত অতিথি যাতায়াত করে। এদিক মানে লাল বারান্দার দিকে দরজা, যেদিক দিয়ে আমরা যাতায়াত করি। আমাদের স্টাফরুম দুটো লাগোয়া ঘর মিলিয়ে। দুটো ঘরের মধ্যে যাতায়াতের পথ আছে, কিন্তু কোনো দরজা বসানো নেই। লাগোয়া ঘর দিয়েই মাঠের দিকে এবং  কলেজের বাইরে যাওয়া হয়। আমাদের ক‍্যান্টিন আর কলঘর দুটোই ওখানে। ওঘরের দুটো দরজা এখন বন্ধ, তাই ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুরো একতলাটায় এখন আমি একাই আছি। শুধু মাঠে এন সি সি এর কুচকাওয়াজ চলছে। মাঠের চারিধারে মার্চ করতে করতে দলটা যখন এদিকে আসছে, তখন সেই আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি একমনে খাতা দেখে চলেছি। হঠাৎ মনে হল পাশের ঘরে কেউ ঘড়ঘড় করে ভারি কাঠের চেয়ার টানছে। খুব অবাক হলাম, ওঘরে তো কেউ নেই। ঢুকলে এঘর দিয়ে আমার সামনে দিয়ে ঢুকতে হবে। নিজেকে বোঝালাম আমার মনের ভুল। হয়তো দোতলায় আমাদের কেন্দ্রের অফিস ঘরে কেউ চেয়ার টেনেছে। অথবা হয়তো মাঠের দিকের বারান্দায় আমাদের এন সি সি অফিসার পলাশ চেয়ার টেনে দরজার ওপাশে বসল। নিজের মন কে যতই বোঝাই আমার ভিতরে আর একটা মন স্পষ্টভাবে বলতে লাগল দোতলায় বা বাইরে নয়, পাশের ঘরে খুব কাছে চেয়ার টানা হয়েছে।

    সাত পাঁচ ভাবনা সরিয়ে রেখে খাতা দেখছি। লেলো এসে স্টাফরুমে ঢুকলো। আমাদের কলেজের নাইট গার্ড হিমদা মানে হিমলাল শর্মা তিনটে নেড়িকুকুরের ছানা পুষেছিল। লালটার নাম লেলো আর কালোটা কেলো। সাদা পাটকিলে মেশানোটার যে কি নাম ছিল এখন ঠিক মনে পড়ছেনা, ধরে নিলাম ধলো। এখন তারা পূর্ণ বয়স্ক। যেমন ডাগর তেমনি নধর। কলেজে তারা রাজার মতো অবাধে ঘুরতো। লাল বারান্দায় কাউন্টার করার জন্য একটা জোড়া বেঞ্চি রাখা থাকতো। সেটার হাই বেঞ্চে তিনজন পাশাপাশি সারি দিয়ে বসে রাস্তা দেখতো। আমার সঙ্গে তাদের বিশেষ কোনো বন্ধুতা ছিলনা, শত্রুতাও না। বলা যেতে পারে একটা স্বাভাবিক মুখচেনা সৌজন‍্যের সম্পর্ক ছিল। লেলো, কেলো, ধলো তিনজনেই নিয়ম করে, বিকেলের দিকে স্টাফরুমে ঢুঁ মারতো। কখনো একসাথে আসতো বা কখনো একা। বিকেলে ঘরটা একটু ফাঁকা থাকে। টেবিলের নিচে কোনো খাবারের টুকরো পড়ে আছে কিনা সেটা নিশ্চিন্তে তদন্ত করা যায়, ভালো কিছু পাওয়া গেলে মৌজ করে খাওয়া যায়। অনেক সুবিধে আছে। আমি সচরাচর ক্লাসের পরে পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঐঘরে বসে টিফিন খেতাম। সারাদিন খাওয়ার সময় হতোনা। মনেও থাকতো না। তাই আমার সাথে ঐসময়ে ওদের নিয়মিত দেখা হত। শনিবারে হাফছুটি। তাড়াতাড়ি ঘর ফাঁকা হয়ে যায় বলে ওরা চারটে থেকে যাতায়াত করত। শনিবারে আমার দূরশিক্ষা কেন্দ্র চলত বলে সেদিনও দেখা হত।  একসাথে এলে ওরা একটি কর্তব্যকর্ম নিয়মিত করে যেত। পাশের লাগোয়া ঘরে ক‍্যান্টিনের খাবারের অবশিষ্টাংশ ফেলার জন্য একটা বেশ বড় সাইজের উঁচু ড্রাম রাখা থাকত। ওদের পক্ষে মুখ বাড়িয়ে সেখান থেকে খাওয়া সম্ভব হতনা। তাই একজন লাফ দিয়ে ড্রামের কানায় উঠে মুখটা ভিতরে রেখে বাকি শরীরটা বাইরে ঝুলিয়ে দিত। আর বাকি দুজন বিপরীত দিক  থেকে মাথা দিয়ে ঠেলা মারত। মিলিত প্রচেষ্টায় ড্রামটা ওরা উল্টে দিত। আর পুরো ঘরটা থৈ থৈ করত, সঙ্গে একটা মিশ্র সুবাসে চারিপাশটা ম ম ক‍রত।

    কলেজের এই পুরোনো বাড়ির দেওয়ালগুলো খুব মোটা, কাদার গাঁথনি। জানালা গুলো দরজার মতো লম্বা। বাড়িটার বয়সও অনেক। কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে এখানে একটা ব‍্যাঙ্ক ছিল। সেই ব‍্যাঙ্কের কাউন্টারটাতেই এখনো কলেজের ক‍্যাশ, ফর্ম সবকিছুর দেওয়া নেওয়া হয়। ঘরগুলো খুব ঠান্ডা, একেবারে প্রাকৃতিক ভাবে যাকে বলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। অনেক গরমের দুপুরে স্টাফরুমে বসতে গিয়ে দেখেছি, লেলো কেলো কেউ একটা টেবিলের তলায় ঘরের লাল সিমেন্টের মেঝেতে পায়ের কাছে দিব‍্যি ঘুম দিচ্ছে। তাই লেলোর এই সময়ে এঘরে আসাটা অত‍্যন্ত স্বাভাবিক। ও প্রথমে আমার টেবিলের তলায় একটুখানি ঘুরঘুর করল। আর ওকে দেখতে গিয়ে দরজা দিয়ে লাল বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় আমার নজর পড়ল। বাইরে একটা ঘ‍্যানঘ‍্যানে মনখারাপ করা বৃষ্টি হচ্ছে। লেলোর রুটিন পারফেক্ট। কারণ ঘড়িতে এখন বিকেল চারটে দশ। কিন্তু মেঘের জন্য বাইরেটা বেশি অন্ধকার দেখাচ্ছে। এমনদিন আমার একদম ভালো লাগেনা। লেলো বোধহয় আজ এঘরের মেঝেতে তেমন কিছু পেলোনা। ওদের প্রিয় পাশের ঘরটায় ঢুকে গেল। অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলে, তাই কোনো অসুবিধে নেই। শুধু দু তিন মুহূর্ত, একটা নতুন খাতা খুলেছি সবে। হঠাৎ একটা শ্বাসের শব্দ। চমকে দেখি লেলোর মুখটা একটু ওপরদিকে তোলা। পিঠ ধনুকের মতো বাঁকানো। জোড়া পায়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে লেলো ছুটে অন্ধকার ঘর পেরিয়ে আমার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওর ঐ অবস্থা দেখে আমি তো হতবাক। আমার এখনো কুড়ি বাইশটা খাতা বাকি আছে। ভাবলাম লেলোর কিছু মনে পড়ল বলে, হয়তো ছুটল। এরপর মিনিট দশেক ও কাটেনি। পাশের ঘরে আবার ভারি চেয়ার টানার শব্দ। এবারে আমি সতর্ক ছিলাম। তাই মন বোঝানোর মতো আমার কাছে আর কোনো যুক্তি ছিলনা। এবারে স্কুলে যেমন শিখেছিলাম, বিবেকানন্দের মুখ কল্পনা ক‍রে গভীর ভাবে শ্বাস নিয়ে কাজ শেষ করার সঙ্কল্প দৃঢ় করলাম। আধঘণ্টা পরে লেলোর মতোই কেলো এসে ঘরে ঢুকল। আমার টেবিলের তলায় ঘুরল, ওঘরে ঢুকল আর দু তিন মুহূর্ত পরে ঠিক একই ভঙ্গিতে ছুটে বেরিয়ে গেল। আমি ছবি হয়ে দেখলাম। এবারে আমার বুক কেঁপে গেল। দেওয়ালে আমার মাথার উপরে প্রভু জগদ্বন্ধুর এক বিশাল তৈলচিত্র, যেন জীবন্ত। কলেজের রজত জয়ন্তীতে তৈরি করা হয়েছিল। প্রভুর মুখের দিকে তাকাই।
    তুমি তো জানো প্রভু  কর্তব‍্যে কখনো হেলা করিনি। জানিনা এখানে কী ঘটছে, আজ আমার সহায় হও।

    প্রভুর মুখে স্মিত হাসি। কী হল জানিনা। মনে একটা অদ্ভুত জোর পেলাম। কিন্তু ভিতর থেকে আর একটা মন সতর্ক করছিল, এখানে একা থাকা আর উচিত হবেনা। ঠান্ডা মাথায় সব খাতা আলাদা করে বেঁধে নিলাম। লাগোয়া অন্ধকার ঘরে ঢুকে, হাতড়ে হাতড়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে আলো জ্বালালাম। ঘরটা খুঁটিয়ে দেখলাম, না কোনো চেয়ার অগোছালো নেই। প্রণবদা যেমন সাজিয়ে রেখেছিল, ঠিক তেমন। এতটুকু এদিক ওদিক কিছু নেই। সাত আটটা খাতা বাকি ছিল। সেগুলো নিয়েই, ওপরে বাসুদার কাছে উঠে গেলাম। কিন্তু অফিসে ঢোকার সময়েই হঠাৎ ঝপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। নিজেকেই সাধুবাদ দিলাম ঠিক সময়ে চলে এসেছি বলে। আর একটু দেরি করলে ঐঘরে থাকাকালীন আলো নিভে যেত। আর না জানি কী হত, হার্ট অ্যাটাক ও হতে পারত হয়তো আমার।
    ওখানে বসে বাকি কাজ শেষ করলাম। কিন্ত মেলাতে গিয়ে এক কান্ড। প্রায় দশটা খাতায় যোগে ভুল। বাসুবাবুর মুখ গম্ভীর। কী ব‍্যাপার দিদি, আপনার এভাবে ভুল তো হয়না। শেষের দিকে আমার মনসংযোগ নড়ে গিয়েছিল। আমি কি অবচেতনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, একা ছিলাম বলে? সবই কি আমার মনের ভুল? আজও এর উত্তর খুঁজে বেড়াই।

    এই ঘটনার পর আজ বারোবছর হল, অ্যাডমিশন বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যাই হোক, সন্ধ‍্যে পর্যন্ত কাজের জন্য অফিসে থাকলে, সই করার জন্য ঐ স্টাফরুমে আমি একা কখনও আর ঢুকিনি। কোনো স্টাফকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। স্টাফ কাউকে না পেলে ইউনিয়নের ছেলেদের কাউকে ডেকে নিয়ে যেতাম। ওরা আগে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দিত, তার পরে আমি ঢুকতাম। এখন তো আর ঐ পুরোনো বাড়িতে অফিস বা স্টাফরুম কিছুই নেই। নতুন বিল্ডিং প্ল‍্যান পাশ করানো আছে। পুরোনো বাড়ির গেটের ওপরে নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট অফিসটাও ভাঙা পড়েছে। যেকোনো দিন পুরো বাড়িটাও ভাঙা পড়ে নতুন বাড়ি উঠবে। এখন সবই চলে এসেছে, নতুন সুবর্ণ জয়ন্তী ভবনে। সেবাড়ি নিয়েও এক গল্প।


    তৃতীয় পর্বঃ সুবর্ণ জয়ন্তী

    আজকে যেখানে সুবর্ণ জয়ন্তী ভবন এবং অ্যানেক্স বিল্ডিং রয়েছে, সেই জায়গায় একটা বিরাট ভিত তৈরি করা ছিল। কলেজে যোগ দিয়ে শুনেছিলাম ওখানে অডিটোরিয়াম হবে। আরও শুনেছিলাম ওখানে ভিত খুঁড়তে গিয়ে সুখাসনে বসা অবস্থায় একটি মানব কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। সম্ভাব্য কারণ হিসেবে জানতে পারলাম আন্দুল হল শাক্ত ও বৈষ্ণবদের সহাবস্থানের জায়গা, হয়তো বা সংঘাতেরও। এই সরস্বতী নদী যা কলেজ বেড় দিয়ে আছে, তাহল শাক্ত ও বৈষ্ণব প্রভাবিত অঞ্চলের সীমারেখা। এদিকটা মানে কলেজের দিকটা হল বৈষ্ণবদের। এদিকের স্থান নামেই তার পরিচয়। আ-ন-দু-ল শব্দটাই নাকি আনন্দধূলি থেকে। মহাপ্রভুর নীলাচল যাত্রাপথে নামসংকীর্তনে মাতোয়ারা  ভগবান ও ভক্তদের পদধূলিতে ধন্য এই ধূলি। প্রভু জগদ্বন্ধুও একজন বৈষ্ণব ধারার সাধক। নদীর ওপারটা যে শাক্ত প্রভাবিত, তার প্রমাণ হিসেবে কলেজের পুরোনো লোকেরা বললেন, ওপাশে আছে বাংলায় বিখ্যাত কালীকীর্তন সমিতি। ঐ সমিতির ভক্তিগীতির ক‍্যাসেট আমি রামকৃষ্ণ মিশনে দেখেছি। যাইহোক, বৈষ্ণবদের সুখাসনে বসিয়ে সমাধি দেওয়া হয়। জানিনা কার কঙ্কাল, কতদিন আগেকার মানুষ তিনি, কলেজের মাটির তলায় যিনি চিরশান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বিভিন্ন কারণে ওখানে অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা যায়নি। পরে অধ‍্যক্ষ কালাচাঁদ সাহা ওখানে লেডিস হোস্টেল তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ইউ জি সি থেকে গ্রান্ট ও এসে গিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জটিল হয়ে ওঠে, যে সেটাও সম্ভব হয়নি। পুনর্বার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে ওই জমির পড়চায় প্রাক্তন অধ‍্যক্ষ বিশ্বনাথ ঘোষের নাম আছে, কলেজের নাম নেই। সব মিলিয়ে বারবার বাধার পাহাড় তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। কোনো ভাবেই কোনোকিছু নির্মাণ করা যাচ্ছিলনা। দিনের পর দিন বিডিও অফিসে, আর আই অফিসে, ল‍্যান্ড রেভিনিউ অফিসে ধর্না দিয়ে পড়ে থাকতাম বাসুবাবু আর আমি। শেষ পর্যন্ত কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তীতে সীমাদি প্রস্তাব দিলেন, এত বাধা পড়ছে ঐ জমিতে,  প্রভুর পুজোর দিন একটু পুজো করে নিলে ভালো হয়। হতাশ এবং বিধ্বস্ত আমরা মেনে নিলাম এই প্রস্তাব। সীমাদি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্যা, কলেজ থেকে হেডক্লার্ক হিসেবে কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে প্রভুর পুজো হয়। কারণ ঐদিন কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস। ২০১৪ সালের পনেরোই অগাস্ট প্রভুর পুজোর পরে পুরোহিত মশাই এসে এই জমিতে পুজো করেছিলেন। সকলের সম্মিলিত শুভকামনার জোরে অবশেষে মেঘ কেটে যায়। কলেজে নতুন অধ‍্যক্ষ সুব্রত বাবু যোগ দেন এবং একটি নয় দুটি নতুন ভবন ঐ জমিতে নির্মিত হয়। ২০১৭ সালে সুবর্ণ জয়ন্তী ভবনে কাজকর্ম শুরু হওয়ার পরে এখানে কারোর মুখেই কোনো অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা আমি শুনিনি। এই ভবন আমাদের গর্ব, আমাদের সম্মিলিত সংগ্রামের প্রতিরূপ।


    চতুর্থ পর্বঃ  সোনাঝরা দিন

    স্টাফরুমে অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার কথা বললাম বলে পাঠক দয়া করে ভেবে নেবেননা যে  ওখানে কোনো ভয়ের ব‍্যাপার ছিল।
    আমাদের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ‍্যাপক শ‍্যামল সেনগুপ্ত ছিলেন এক পন্ডিত, রসিক ও বর্ণময় মানুষ। তিনি কলেজে থাকলে হাসিগল্পে স্টাফরুম মাতিয়ে রাখতেন। গ্লকোমায় তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর অনুভব আর স্মৃতিশক্তি দেখে আমাদের তাক লেগে যেত। প্রথম যেদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হল, সেদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কলেজে ট্রেনে আসা হয় না বাসে? আমি বললাম বাসে। তিনি বললেন সাবধানে চলাফেরা কোরো, গীতায় বলেছে বাসাংসি জীর্ণানি। আমি রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রী, ক্লাস ফাইভ থেকে গীতা পড়েছি। বাসাংসি জীর্ণানির অনুষঙ্গ আমার ভালোই জানা ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে যে কেউ রাস্তার লজঝড়ে বাসের প্রসঙ্গ টেনে আনতে পারে, এটা মাথায় আসেনি। প্রথম আলাপেই পক্ককেশ শ‍্যামলদার ভক্ত হয়ে গেলাম। আমি তখন উত্তর পূর্ব কলকাতা থেকে দক্ষিণ পশ্চিম হাওড়া যাতায়াত করছি। প্রথম দিকে দীর্ঘ যাত্রা শেষে কলেজে এসেই আমার খুব খিদে পেয়ে যেত। ক্লাসে যাওয়ার আগেই টিফিন বক্স খুলে খেতে বসে যেতাম। স্টাফরুমে সকলে হাসতো। আমার একমাস পরে যোগ দেওয়া বল্লরীদি নতুন এসে সবার সামনে খেতে লজ্জা পেত, আর ওর পেটব্যথা করতো। ভূগোল বিভাগের এই দুটো মেয়েকে বড়রা যেমন স্নেহ করতেন, তেমনি আমাদের নিয়ে মজাও করতেন কম নয়। স্বভাব অনুসারে, শ‍্যামলদা আমার নাম রাখলেন বৃহৎদতী আর বল্লরীদির নাম হল মৃদুদতী। কমার্স বিভাগে ছিলেন রঘুদা। স্টাফরুমে তিনি ডেকে ডেকে ইংরেজিতে কীর্তন শোনাতেন।  ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে তাঁর পাতা ফাঁদ এড়ানো খুব মুস্কিল ছিল। একটু উদাহরণ দিই।
    - এ-ই যে! কলেজ চলছে বাড়ি যাচ্ছিস যে বড়।
    - না মানে খেতে যাচ্ছি স‍্যার।
    - কোন বিষয়ে পড়া হয়?
    - বাংলা স‍্যার।
    - ও - ও, বাংলা, পরীক্ষা তো এসে গেল, সাজেশন নিবিনি?
    - সাজেশন! দিন না, স‍্যার, দিন না।
    - কাল দেব। এখন বল দিকিনি ... ঐ নামটা ধরে কোন স‍্যারকে ডাকছিলি?
    অলমিতি বিস্তারেণ। ব‍্যাখ‍্যা নিষ্প্রয়োজন। আর ছিলেন সুশান্তদা, অর্থনীতিতে সুপন্ডিত। তিনি আবার আমাদের রাজ‍্যের একজন মাননীয় সাংসদ ছিলেন। কলেজে ভূগোল বিভাগ খোলার ব‍্যাপারে তিনিই ছিলেন প্রধান উদ‍্যোক্তা। আমরা এসে ঠিকঠাক পড়াচ্ছি কিনা সেবিষয়ে তিনি রীতিমতো খোঁজখবর করতেন। তখন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের বয়সের তফাৎ কম ছিল, তাই সুশান্ত বাবুর সবকথাই তারা আমাদের বলে দিত। এই নিয়েও স্টাফরুমে নানা মজা হত। ইতিহাস বিভাগে ছিলেন দুই হরিহর আত্মা শান্তি বাবু আর স্নেহাদ্রি বাবু। স্নেহাদ্রি বাবুর দশাসই চেহারা, এন সি সি করাতেন, ছাত্র বিক্ষোভ একা দাঁড়িয়ে সামাল দিতেন। তাই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু শান্তিবাবু তাঁর নাম রাখলেন পারভেজ মুশারফ। আবার অধ‍্যক্ষ কালাচাঁদবাবু আমাদের প্র‍্যাকটিকালের সুবিধে হবে বলে, ক্লাসরুমের পাশে একটা ছোট অফিস রুম করে দিয়েছিলেন। সারাদিন সেখানে কেটে গেলে, স্টাফরুমে খোঁজ পড়ত শারদা - বল্লরী কোথায় গেল? দর্শন বিভাগের নিমাইদা দুটো নাম বলতে অসুবিধে হয় বলে, ছোট করে জিজ্ঞেস করতেন শাল্লরী কই? রঘুদা একবার খবর আনলেন, সুশান্ত বাবুর মুখটা লম্বা তাই স্টুডেন্ট মহলে ওনার নতুন নাম হয়েছে ল‍্যাংচা। আর আমার মুখটা যেহেতু গোল চাকা, আমার নাম হয়েছে নান রুটি। ব‍্যাস স্টাফরুমে হুল্লোড় পড়ে গেল। শ‍্যামলদা আমার নাম দিয়ে দিলেন নান থেকে 'নানু'। শ‍্যামলদা বহু দিন হল অবসর নিয়েছেন, অদ‍্যাবধি তাঁর ফোন পাই - নানু ভালো আছ তো?ছোট বড় সকলে মিলে স্টাফরুমে অনাবিল আনন্দ আর আন্তরিকতার স্রোত বয়ে যেত। কলেজের গন্ডির বাইরেও সেই স্রোত আগলে রাখতো। বটানি বিভাগে ছিলেন প্রজ্ঞা দি। তখন নতুন বিয়ের পরে হাওড়ায় ঘর ভাড়া নিয়েছি সদ‍্য, আপনি কোপনির সংসার। প্রজ্ঞাদি বলে রেখেছিলেন, বাড়ির বাইরে পা রাখলে আমাকে একটা টেলিফোন করবে। সেই কথা মেনে চলতে হত, নইলে জুটতো অজস্র বকুনি। বাইরের যে কাউকে কলেজের গল্প শোনালে তারা অবাক হয়ে যেত, বলতো তোদের কলেজটা এত ভালো!


    পঞ্চম পর্বঃ লাইব্রেরির কথা

    কলেজে স্টাফরুমের সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরিও ছিল তুমুল আলাপ আলোচনার জায়গা। তখন কম্পিউটারের যুগ শুরু হয়নি। মোবাইল ফোনও ভবিষ্যতের গর্ভে। তাই নিয়মিত সকলকেই লাইব্রেরি যেতে হত। কেবল কফি কাপের বদলে সঙ্গী হত মুড়ি। প্রথমদিকে পুরোনো ভবনের দোতলায় লাইব্রেরি ছিল। এখানে আন্দুল রাজবাড়ির দুটি রাজসিক আলমারি আছে। আর তার মধ্যে আছে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিয়ার সম্পূর্ণ সংগ্রহ। প্রথম যখন এই লাইব্রেরি আমি দেখি, এর সংগ্রহ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বহু কলেজে পরীক্ষা নিতে গেছি। সেখানকার লাইব্রেরি দেখেছি, কিন্তু এত বড় সংগ্রহ খুব কম জায়গায় আছে। পি এইচ ডি করার সময়ে নানারকম বইয়ের সাহায্য এখান থেকে পেয়েছিলাম। সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরি হল এই কলেজের আর এক রহস্যময় জায়গা। কেন একথা বললাম, সেই প্রসঙ্গে আসি। এই লাইব্রেরিতেই এক ঘরোয়া আলোচনায় শুনেছিলাম, কলেজের প্রথম হিসাবরক্ষক অরুণবাবু, লাইব্রেরিয়ান বদ‍্যিনাথবাবু আর যে হেডক্লার্কের কাছে আমি জয়েন করেছিলাম, সেই অনিলবাবু তিনজনেই গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, এই লাইব্রেরিতে অতিপ্রাকৃত কিছু আছে। কোনো নিশ্চিত অনুভব তাঁদের এই বিশ্বাসের পিছনে ছিল। এমনও শুনেছিলাম লাইব্রেরি ফাঁকা থাকলে ভর্তি মনে হয়, যেন অনেকে আছে। কিন্তু খুঁজতে গেলে কেউ নেই। অরুণবাবু আর বদ‍্যিনাথবাবু আমার যোগ দেবার আগেই অবসর নিয়েছেন। তাই তাঁদের সঙ্গে মোলাকাতের সুযোগ ছিলনা। আর বড়বাবু অনিল লাহা ছিলেন রাশভারী, নিয়মানুবর্তী এবং কড়া ধাতের মানুষ। কেমন একটু উদাহরণ দিই। অরুণ বাবুর পরে যিনি হিসাবরক্ষক হলেন সেই তাপসদার কাছে গল্পটা শুনেছি। তাপসদা তখন তরুণ তুর্কি। সদ‍্য বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে। একদিনের জন্য ছুটি চাইতে গেছে বড়বাবুর কাছে। পাওনা ছুটি থাকলেও নেবার উপায় নেই। বড়বাবু যদি বোঝেন সত‍্যি দরকার আছে, তবেই দেবেন। বুঝিয়ে সুজিয়ে ছুটির অনুমতি মিললো বটে, কিন্তু ট্রেনের সঙ্গে সময় মিলিয়ে, নটায় তাপসদাকে কলেজে এসে সই করে যেতে হবে। তাপসদা নটায় কলেজে গিয়ে দেখে, ঘড়ি ধরে সকাল সাড়ে আটটা থেকে অনিলবাবু কলেজে বসে আছেন। পরবর্তীতে এই শাসনের ফল এমন হল যে ছুটির দিন এলেই তাপসদার টেনশন বেড়ে যেত, আবার ছুটি! বাড়িতে কী করব দিদি?  আজকাল অবশ্য এমন করে চাকরি করা শেখানো মানুষেরা অবলুপ্ত হয়েছেন। এমন শিক্ষার্থীও পাওয়া যায়না। কমার্সেও একজন সৌম‍্য শান্ত, হাসিমুখ অনিলবাবু ছিলেন। বছরের পর বছর হাসিমুখে কলেজ অ্যাডমিশনের ঝড় সামলে যেতেন। দুই অনিলের বয়স প্রায় এক। কিন্তু শিক্ষক অনিলবাবুকে আমরা অনিলদা বলে ডাকতাম, অফিসের অনিলবাবুকে বড়বাবু। তাঁকে দাদা সম্বোধনের সাহস ছিলনা। তাই কলেজের ভুতের গল্প বলুননা বড়বাবু, এমন বায়না করাও সম্ভব ছিলনা। তাবলে বায়না আমার কম ছিল এমনও নয়। ফিজিক্সের সুদেব বাবু ছিলেন কলেজের পাশেই, সরস্বতীর ওপারে আন্দুল রাজবাড়ির জামাই। ভারি ভদ্র এবং শিষ্ট মানুষ। তিনি কলেজের বার্সার ছিলেন। তাঁকে ধরতাম, রাজবাড়ির ইতিহাস বলুন, ওখানেও কি ভূত আছে নাকি? রাজবাড়ি নিয়ে চলুন, আমি দেখব ওখানে কী আছে, নাচঘরে কি নুপূরের আওয়াজ শোনা যায়? সত‍্যজিত রায়, ছবি বিশ্বাস কি জলসাঘরের সময়ে সত্যি এখানে এসেছিলেন?  রাজবাড়ির পিছনে অত থাম কিসের? সুড়ঙ্গ টা কোথায়? - ইত‍্যাদি নানা প্রশ্ন করে করে ওনাকে পাগল করে দিতুম। উনি বলতেন - উফফ্ এখন ছাড় দিকিনি, মেলা কাজ পড়ে আছে। প্রিন্সিপালকে সব কাজ শেষ করে রেডি করে দিতে হবে। যাহোক সুদেব বাবু আমাদের রাজবাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। মাঝখানে গথিক থামওয়ালা নাচঘরের দুপাশে কাছারি বাড়ি। দুই দিকে দুই তরফ থাকে। একদিকে সুদেববাবুর শ‍্যালকের পরিবার, অন‍্যদিকে ওনাদের কাকার পরিবার। এও শুনলাম রাজবাড়ি থেকে সুড়ঙ্গ গেছে উনসানির দিকে, বোধহয় উনসানিতে যেখানে জি টি এস টাওয়ার আছে, সেইদিকে। ১৮১৮ সালে ইংরেজ আমলে সার্ভেয়ার জেনারেলের তত্ত্বাবধানে সারা ভারতবর্ষের মানচিত্র নির্মাণের জন্য গ্রেট ট্র‍্যাঙ্গুলেশন সার্ভে শুরু হয়েছিল। বাংলার সমতল জায়গায় ছিল না কোনো পর্বত শৃঙ্গ, বা লক্ষ বছরেও স্থান পরিবর্তন করবেনা এমন কোনো কন্ট্রোল পয়েন্ট। উল্টে এখানকার বদ্বীপীয় নদী গুলো সব সময় স্থান পরিবর্তন করে। প্রাকৃতিক কোনো স্থায়ী কন্ট্রোল পয়েন্ট এখানে নেই, যা অনেক বছর পরেও সার্ভে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তাই ইঁটের টাওয়ার করে বাংলা জুড়ে কন্ট্রোল পয়েন্ট তৈরি হয়েছিল। এখনকার স্থানীয় লোকে এসব ইতিহাস ভুলে গেছে। লোকমুখে কোথাও কোথাও এই ভাঙা টাওয়ারগুলোকে  গীর্জা বলা হয়। খড়দার কাছে এমন সুখচর গীর্জা দেখেছি। বোধহয় ইংরেজরা করেছিল বলে এমন নাম। ২০১৮ তে ইংল্যান্ডের বেলফাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর সার্ভে অফ ইন্ডিয়া মিলে ন‍্যাশানাল লাইব্রেরির ভাষা ভবনে দু'শ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে আমি গিয়েছিলাম। উনসানির রাস্তায় এমন একটা টাওয়ার আছে। যদিও প্রথমে কোনো প্রামাণ্য নথি পাইনি, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানে যাকে বলে সারকামস্ট‍্যান্সিয়াল এভিডেন্স, সেটা বিচার করে আমার এই ধারণা হয়েছিল। পরে জেনেছি এটা ছিল সিমাফোর টাওয়ার। এর মাথায় আগুন জ্বালিয়ে সঙ্কেত দেওয়া হত সরস্বতী নদীতে জাহাজ এগোচ্ছে। পরে এটাকেই জি টি এস টাওয়ার করে দেওয়া হয়। রাজবাড়ির সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভিতরে নাকি লক্ষ সাপের আস্তানা। কলেজেও সাপের গল্প আছে। সুযোগ হলে পরে বলা যাবে। লাইব্রেরিতে ফিরে আসি। পুরোনো বাড়ির হালত খারাপ, তাই অত বইয়ের আলমারির চাপ রাখা ঠিক হবেনা, এই ভেবে অধ‍্যক্ষ কালাচাঁদবাবু লাইব্রেরির স্থান পরিবর্তন করলেন। তখনকার নতুন ভবনের তিনতলায়, মানে হিসেব মতো কলেজ ভবনের একেবারে উত্তর দিকে, সরস্বতীর পাড়ে। যখন আমরা প্রিজম‍্যাটিক কম্পাস সার্ভে করি, চুম্বকের কাঁটা লাইব্রেরির দিকে স্থির হয়। ঐ জায়গাটা হল চতুর্ভুজাকৃতি কলেজ ক‍্যাম্পাসের একটা কোণ। এই কোণে সরস্বতীর পাড় আর কলেজ ভবনের দূরত্ব সবচেয়ে কম। আমাদের আর একজন প্রাক্তন লাইব্রেরিয়ান মীরাদির মুখে এই স্থান পরিবর্তনের সময়ে ঘটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। ২০০১ সালে যখন নতুন জায়গায় সব বইয়ের আলমারি এবং বইগুলো সরানো হচ্ছে, তখন মীরাদি সেই বই গোছানোর দায়িত্বে ছিলেন। গরমের ছুটিতেও কাজ চলত। আন্দুল রাজবাড়ির যে দুটি আলমারি কলেজে আছে, সে দুটি তখন সদ‍্য নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে। আলমারি দুটো দেওয়াল জোড়া, ছাদ পর্যন্ত উঁচু, আর তাদের সারা গা জুড়ে চোখ ধাঁধানো কাঠের অলঙ্করণ। ওদুটোতে সব প্রাচীন, বিরল বইয়ের সংগ্রহ রাখা হয়। এখনো আছে। তার মধ্যে কিছু বই আছে পাতলা কাঠের বোর্ড দিয়ে বাঁধানো। একদিন মীরাদি একা লাইব্রেরি তে নিজে হাতে ঐ আলমারির বই সাজাচ্ছিলেন। ঐ সংগ্রহ অন্য কোনো কর্মীর হাতে দিতে তাঁর মন সায় দেয়নি। কিন্তু অনেক সময় নিয়ে বহু পরিশ্রমে বইগুলো সাজিয়ে ফেলার পরে, একেবারে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত সব বই ঝরঝর করে মেঝেতে পড়ে গেল। মীরাদির বয়ানে বাকিটা বলি - 'আমি চমকে উঠলাম। এত যত্ন করে সাজালাম। প্রশস্ত তাক, বই কোনো চাপাচাপি করিনি। কোনো ঠেকনার অভাব হয়নি। ভেতর থেকে একসঙ্গে সব তাকের সব বই কিকরে পড়ে যেতে পারে? বুকটা কেঁপে উঠল। অত উঁচু তাক থেকে পুরোনো ভঙ্গুর পাতা ওলা কাঠ বাঁধাই বই - ওযে অমূল্য সম্পদ। চুরমার হয়ে গেলে কলেজের কাছে কী জবাব দেব। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলামনা। আমি কি কিছু ভুল করে ফেললাম? দুরুদুরু বুকে বইগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করি। ও মা! বই যেমনকে তেমন আছে। যেন কিছুই হয়নি। প্রভুকে মনে মনে ধন‍্যবাদ দিলাম। বইগুলো ধ্বংস হলে আমার কি রক্ষা থাকত? সেদিন আর সময় ছিলনা। বইগুলো একপাশ করে রেখে, ঘরটা চাবি দিলাম। কিন্তু পরের দিন সেই একই ঘটনা ঘটল। না এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারেনা। কে বই ফেলে দিচ্ছে? ভয়ে সারা গা শিরশির করতে লাগল। কলেজে এসে ইস্তক অনেক কিছু শুনেছি। এখানে লাইব্রেরি আসা কি কেউ পছন্দ করছেনা, নাকি আমার সাথে মস্করা করছে। শেষে অন্য লোকজনদের ডেকে, অনেকে মিলে সেই বই সাজানো হল। তারপরে আর ঐ আলমারিতে তেমন কিছু ঘটেনি। আসলে সচরাচর ঐ আলমারি তো খোলা হয়না। অত টানাপোড়েনের জন্য কেউ কি বিরক্ত হয়েছিল। অবসর নিয়েছি, তবু আজও উত্তর পাইনি'। লাইব্রেরির ডানপাশে বি ব্লকের সিঁড়ি। দুয়ের মাঝে লাইব্রেরির লাগোয়া কোনাকুনি একটা ঘর আছে। এখন সেটা আমাদের স্মার্ট রুম। দ্বিতীয়বার ন‍্যাক অ্যাক্রেডিটেশনের সময়ে কাচের জানলা, প্রোজেক্টর, স্মার্টবোর্ড , লেখার উপযোগী হাতলওলা চেয়ার, এয়ার কন্ডিশনিং মেশিন দিয়ে সাজানো হয়েছে। ওটা এখন আমাদের ইউ জি সি নেটওয়ার্ক রিসোর্স সেন্টার। কিন্তু আগে ওটা ছিল লাইব্রেরি রিডিং রুম। ছাত্রছাত্রীদের দেখতাম ক্লাস হয়ে গেলেই লাইব্রেরি যাচ্ছি ম‍্যাম, বলে দল কে দল তিনতলায় উঠে যেত। মনে ভাবি, ওরা হঠাৎ এত সুবোধ, সুমতি হল কেমন করে। পরে বুঝলাম, ও হরি, এই সুমতির পিছনে গল্প আছে। একতলায় ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা আলাদা কমনরুম আছে। এমনকি ক‍্যান্টিন রুমও আলাদা। তিনতলার কোণায় সবেধন চূড়ামণি ঐ ঘরটি হল 'কমন' কমনরুম, মানে ছেলেরা মেয়েরা একসাথে বসতে পারে।  ছাত্রছাত্রীদের কাছে এঘরের মর্যাদাই আলাদা। এই মিষ্টি ঘরটির আরও একটি মাহাত্ম্য ছিল। যখন ক্লাসের পালা শেষ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শুরু হত, সেই সময়ে অপর গুণটি প্রকাশ পেত। কাজের ওপরে বিরক্তি ধরে গেলে, চুপিসারে ওখানে উঠে এসে দরজাটি ভেজিয়ে দিলে কলেজে আর কেউ খুঁজে পাবেনা। লাইব্রেরি তখন বন্ধ, কাজেই ওই ঘরের কথা যারা খুঁজছে, তাদের মাথায় আসতনা। আর তখন তো মোবাইলের যুগ ছিলনা। কারোর মাথায় এলেও কাজ ফেলে তিনতলায় উঠে পুলিশিগিরি করা বাকিদের পোষাতনা। উঠলে যে পাওয়া যাবেই গ‍্যারান্টি তো নেই।যে ঘটনাটা বলার জন্য এত ভণিতা, সেটাও শুনেছি মীরাদির কাছে। আমাদের রসায়ন ল‍্যাবরেটরির সহায়ক ছিলেন নিমাই কুন্ডু। তিনি কলেজেই নাইট গার্ডের পাশের কোয়ার্টারে থাকতেন। দিব‍্য রইসি মেজাজের মানুষ। একবার পুরী বেড়াতে গিয়ে তাঁর বোলচাল দেখে সহযাত্রীরা তো মুগ্ধ। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ঠিকানাও চালাচালি হল। কলেজেও চিঠি এল অধ্যাপক নিমাই কুন্ডুর নামে। সে চিঠি পড়বি তো পড়, একেবারে তৎকালীন ডাকসাইটে অধ‍্যক্ষ বিশ্বনাথ ঘোষের হাতে। সে যাত্রা নিমাইদা  কি বলে নিস্তার পেল, তা অবিশ‍্যি আমি বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করিনি। এসব তো আমার কলেজে যোগ দেওয়ার আগের ঘটনা। যা হোক, আমার কলেজে যোগ দেওয়ার পরে অল্প কিছুদিন নিমাইদা ছিলেন। আড়ালে ওনাকে সবাই যে প্রফেসর কুন্ডু বলে ডাকতো সেকথা আমিও জানি। আসল ঘটনায় আসি। এহেন নিমাইদা পরীক্ষা চলাকালীন ঐ মিঠেকড়া ঘরে লো বেঞ্চে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনতলার সেই দরজার আকারে বড় বড় জানলা দিয়ে হাওয়া দিচ্ছিল। নিমাইদার চোখে তন্দ্রা জড়িয়ে এল। হঠাৎ একটা প্রবল অস্বস্তি। নিমাইদার ঘুমটা ভেঙে গেল। বুকের ওপরে অসহ্য ভার। নড়াচড়া করা যাচ্ছেনা। ঠিক যেন কেউ বুকের ওপরে চেপে বসে আছে। কতক্ষণ এমন কেটেছে কে জানে। বুকের ওপরে চাপ সরতে নিমাইদা নেমে এল। তারপরে ওঘরে ঘুমোনোও বন্ধ হয়ে গেল। এখন তো ওখানে অনেক আধুনিক আসবাব আর ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আছে। ক্লাস বা সেমিনার না হলে তালা দেওয়া থাকে। তাই চুপিচুপি ঘুমোনোর উপায় নেই। তায় ঘরে একধারে হাতলওলা চেয়ার। ঐ হাতলে রেখেই লেখা যায়, সামনে টেবিল লাগেনা। শুয়ে পড়ার মতো প্রশস্ত বেঞ্চিগুলোও নেই। এই একইরকম অভিজ্ঞতা পরে একতলায় তের নম্বর ঘরে প্রণবদারও হয়েছিল।

    তিনতলার ঐ কোণের ঘরের ঠিক নিচে দোতলায় উনিশ নম্বর ঘর আছে। ঘটনাটা আমি হিমদার মুখে শুনেছি। হিমদা মানে হিমলাল শর্মা ছিলেন কলেজের নাইট গার্ড, নেপালের মানুষ। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি এই কলেজে আছেন এবং কলেজটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। কোভিড অতিমারীর মধ্যে তিনি কলেজ থেকে অবসর নিলেন। কোনো এক শনিবার দুপুরে কলেজ ছুটির পরে, অধ‍্যক্ষ কালাচাঁদবাবু কাজে ব‍্যস্ত ছিলেন। আর তাঁর গাড়ির চালক গোপাল থাপা উনিশ নম্বর ঘর ফাঁকা থাকায় সেখানে লো বেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দুসারি হাই বেঞ্চের মাঝখানে তিনি সুরক্ষিতই ছিলেন, পড়ে যাবার অবস্থা ছিলনা। কিন্তু হঠাৎ কী হয়ে গেল, গোপাল থাপাদা দেখলেন তিনি মাটিতে পড়ে আছেন। একরকম ঘটনা ঘটেছিল আর একবার ঠিক লাইব্রেরির নিচে একতলায়, তেরো নম্বর ঘরে। তখন ঐ ভবন তৈরি হচ্ছে। দুজন রাজমিস্ত্রি কাজের ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ তারা পড়ে গেল। জেগে উঠে সম্বিত ফেরার পর দুজনেই বলেছিল যে মনে হল কে যেন সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আরও একটা ঘটনা হিমদা বলেছিলেন, সেকথা ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। ঐ ভবন যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন এক রাজমিস্ত্রি ওপরে ঢালাই ছাদে  বসে সিমেন্টের মশলা মাখছিল। ছাদের যেদিকে কলেজের মাঠ, মানে ভিতরের প্রান্তেই ছিল সে। হঠাৎ কী হল তার চেতনায় নেই। কলেজের বাইরের দিকে সরস্বতীর খালের ওপারে দোকানদারেরা চীৎকার করে ওঠাতে কলেজের লোকেরা দৌড়ে গেল। গিয়ে দেখে কলেজের পিছনে খালের পাড়ে সে পড়ে আছে। সংকীর্ণ নদীর ওপারে বাজার। সেখানে দোকানদারেরা দেখেছে একজন পড়ে যাচ্ছে। হিমদা তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। কিন্তু অত ওপর থেকে পড়েও বিশেষ কিছু আঘাত তার লাগেনি। সামান্য ফার্স্ট এড করেই ডাক্তারেরা তাকে ছেড়ে দেন। হয়তো সে ওপাশে গিয়েছিল, হয়তো মাথা ঘুরে গিয়েছিল, হয়তো এমন নরম ঝোপ জঙ্গলের ওপর পড়ল যে কিছু হলনা - এসব ঘটনার যুক্তিগ্রাহ্য কার্যকারণ খুঁজতে গেলে অনেক কষ্ট কল্পনা করতে হয়। তবে এসব ঘটনা ঘটেছে কলেজে আমি যোগ দেওয়ার আগে। পুরোনো মানুষজনের কাছে শুনেছি গভীর রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বি ব্লকের একতলার বারান্দায় নাকি নারী কন্ঠের কান্না শোনা যেত। একটু আগে যে নিমাইদার কথা বললাম সেই নিমাইদাতো কলেজেই থাকতেন। তিনিও ঐ কান্না নাকি শুনেছিলেন।


    ষষ্ঠ পর্বঃ জীবন খেয়া

    এই সব শুনতে শুনতে এমন একটা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যে সময় পেলেই শ‍্যামলদাকে জপাতাম - ও শ‍্যামলদা কলেজের পুরোনো দিনের গল্প বলুন, কলেজের ভূতের গল্প বলুন, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। শ‍্যামলদা তাঁর সহজ মশ্করার ভঙ্গিতে বলতেন, আরে তুমি হলে তালব‍্য শ এ শারদা, মানে দুর্গা। তোমার চালচিত্রে শিবের অনুচরেরা রয়েছেন। শুধু চীৎকারকের চাকরি করলে হবে? ( উনি লেকচারারের বাংলা করেছিলেন চীৎকারক) শান্ত হয়ে অপেক্ষা কর। কলেজকে জড়িয়ে থাকো। ঠিক একদিন অনুভব করবে। হয়তো ওনার কথাই সত্যি হয়েছে।

    একথা ঠিক যে ভরদুপুরে ভূতের মারা ঢেলা বা ঠেলা আমি খাইনি, তবে প্রজ্ঞাদির চাঁটি খেয়েছি প্রচুর। প্রজ্ঞাদিকে দেখতাম বয়সে অনেক বড় সহকর্মীদের দাদা তুই বলে কথা বলতেন। বাড়িতে দশ বছরের বড় জ‍্যেঠতুত দাদাদের আমিও তুই করে বলতাম। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যে এমন হতে পারে, সেটা প্রজ্ঞাদি করে দেখালেন। কলেজে এসে ইস্তক দেখছি ওনার হাঁটুতে ব‍্যথা। অথচ কোনো কিছু পছন্দসই না হলেই তিনি যে কাউকে চাঁটা মারার জন্য দৌড়োচ্ছেন। স্টাফরুমে প্রথমে ভাববাচ‍্যে নানা কথা বলে বলে ওনাকে ক্ষ‍্যাপানো হত। কে না জানে খারাপ জিনিসটা মানুষ আগে শিখে নেয়। বড়দের দেখে দেখে যেদিন বড়রা নেই, সেদিন আমরা মানে ছোটরাই শুরু করে দিতাম। অঙ্কের প্রশান্তদার মেয়ে হবার পরে, যেই না তার নাম রাখা হয়েছে প্রজ্ঞা, তখন আর আমাদের পায় কে? প্রশান্তদা বুক ফুলিয়ে প্রজ্ঞাদির সামনে ঘুরত, প্রজ্ঞা আমার কি করবে, আমি প্রজ্ঞার বাবা। আমরাও সঙ্গে পিসির দল পোঁ ধরতাম। কিছুক্ষণ সহ‍্য করে, চাঁটি মারার জন্য প্রজ্ঞাদি উঠে দাঁড়ালেই স্টাফরুমের প্রশস্ত টেবিলটার চারিপাশে চোর - পুলিশ খেলা শুরু হয়ে যেত। আবার এমন আবদার, অল্প একটু দৌড়োদৌড়ির পরেই সকলকে মাথা আর কান বাড়িয়ে দিতে হবে, যাতে প্রজ্ঞাদির কান মুলে চাঁটি মারতে সুবিধে হয়। কারণ ওনার হাঁটুতে ব‍্যথা। বেশিক্ষণ উনি লড়তে পারবেন না। কানমলা, চাঁটি আর মিট্টি মিট্টি গালি খেয়ে যে যার ক্লাসে চলে যাবে।

    একবার প্রজ্ঞাদি আমি আর কমার্সের মুকুলদা কলেজ স্পোর্টসের শেষ দিনে গো অ্যাজ ইউ লাইকে নেমে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে সকালে কলেজে এসে মাথায় ভূত চাপল আমার। বাকি দুজনকে বলতে তারা এক কথায় রাজি। গল্পটা এমন ফাঁদা হয়েছিল, যেন প্রজ্ঞাদি আমার খান্ডারনি মা। আমি আর মুকুলদা লুকিয়ে বিয়ে করে পালাতে গিয়ে মায়ের হাতে ধরা পড়ে গেছি। আমার চুল তো চিরকালই ছোট। সেকেন্ডের মধ্যে ঐ চুলের গার্ডার খুলে আমি ছুটকু ছুটকু দুটো বিনুনি বেঁধে নিলাম। আর মুকুলদা পট করে কোনো এক ছাত্রের মাথা থেকে ক‍্যাপ তুলে নিয়ে, সেটা উল্টো করে পরে নিল, যেন পাড়ার হিরো। কলেজের মাঠে তখন ছেলেমেয়েরা আদিম মানুষ, সব্জিওয়ালি, রামসীতা, সাংবাদিক, একটি গাছ একটি প্রাণ  এসব সেজে সবে ঘুরতে শুরু করেছে।  প্রজ্ঞাদি গিয়ে বিচারকদের বেঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সব দেখছে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রজ্ঞাদির গাড়ি করে মাঠে এক পাক দিয়ে আমরা দুজন প্রজ্ঞাদিরই সামনে নামলাম। আর ব‍্যাস সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল অভিনয়। প্রজ্ঞাদি তো হারেরেরে করে আমাকে শাপমুন‍্যি করছে, আর হাতের সুখ করে আমাকে চাঁটি আর কানমলা দিয়ে যাচ্ছে। আমি আর মুকুলদা মাঠে নামার আগে কিছু আনতাবড়ি ডায়লগ রেডি করেছিলাম, আর প্রজ্ঞাদি বলেছিল, আমাকে কিছু ঠিক করতে হবেনা, শুরু হলে দেখবি কী করি। ফার্স্ট প্রাইজ জিতব। আমরা তাতেই বিশ্বাস করেছি। কিন্তু তিনি যে মুখের চাইতে হাত দিয়ে বেশি ডায়লগ বলবেন, সেটা তো বুঝিনি। প্রতিযোগী থেকে দর্শক, ছাত্রছাত্রী থেকে কলেজ কর্মী সবাই তখন আমাদের তিনজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। যেই না আমি বলেছি, দেখো মা আমার এখন আঠেরো বছর হয়ে গেছে, আমাকে আর তুমি আটকে রাখতে পারোনা, অমনি প্রজ্ঞাদির হাতের বেগও বেড়ে গেছে। মহা মুস্কিল, আমাকে সংলাপই বলতে দিচ্ছেনা। শেষে মুকুলদা বেগতিক দেখে ঠিক করে রাখা সংলাপ বাদ দিয়ে, তেড়ে উঠে বলে উঠল, এভাবে আপনি ওর গায়ে হাত তুলতে পারেন না। ব‍্যাস। গোল হয়ে থাকা ভিড়টা উল্লাসে ফেটে পড়ে, সঙ্গে চটর পটর হাততালি। এদিকে ততক্ষণে আমার গাল আর কানদুটো প্রহারের চোটে লাল টকটকে হয়ে গেছে। আজ এত বছর পরে লিখতে গিয়েও কানদুটো একটু একটু টনটন করছে। আর সেই দিন গুলো হারিয়ে ফেলেছি বুঝে গলার ভিতরটা দলা পাকিয়ে একটা চিনচিনে ব‍্যথা করছে। তবে একথা বলতে বাধা নেই, কলেজে যত ভূত আছে, তার মধ্যে সেই ভূতটা সবচেয়ে খারাপ, যেটা সেদিন আমার মাথায় চেপেছিল। আর সব ভূত ভালো। চাঁটি, কানমলা দূরের কথা, আর কোনো ভূত আমার কেশাগ্র কোনোদিন স্পর্শ করেনি। আর এই ভূতটা সবচেয়ে ভালো, যেটা আমার মাথায় বসে এখন এই লেখাটা লিখিয়ে চলেছে। এই ভূত বা অতীত অবগাহন আমার প্রাণের আরাম আর আত্মার শান্তি এনে দিচ্ছে।

    আমার নামটা সাতঘাট পেরিয়ে যেমন 'নানু' তে  এসে থিতু হল, তেমন স্টাফরুমে বল্লরীদিরও একটা শর্ট নাম ছিল - 'লরি'। একদিন কোনো ছাত্রকে বল্লরীদি বকাবকি করেছিল। স্টাফরুমে কিকরে যেন সব খবর চলে যেত। বল্লরীদি ক্লাস সেরে আসার পরে লরি রেগে গেছে, কি হয়েছে, এসব নিয়ে খুব হৈচৈ হচ্ছিল, যাতে ওর রাগ পড়ে যায়। হঠাৎ অধ‍্যক্ষ কালাচাঁদবাবু কোনো কাজে স্টাফরুমে এসে, কিছু শুনে জিজ্ঞেস করলেন, লরি কে? আর যায় কোথা, সবাই চমকে চুপ। ওনার একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিল, অর্ধেকের কম কথা শুনে পুরো বিষয়টা নিমেষে বুঝে ফেলতেন। কয়েক মুহূর্ত পরে নিজেই বললেন, ও বল্লরী। বলে হা হা করে হাসলেন। কলেজে যখন আমি যোগ দিই, তখনও আমার এম ফিল শেষ হয়নি। লাস্ট সেমেস্টার বাকি ছিল। কলেজ ছুটি হলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের এম ফিলের ক্লাসে যেতাম, কারণ ওটা ছিল ইভনিং কোর্স। শেষ পরীক্ষার ফল ভালোই হয়েছিল। কারণ শরীরে ক্লান্ত হলেও, সারাদিন কলেজ যে অফুরান এনার্জির যোগান দিতো, তাতে মনের ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। ফল বেরোনোর পরে বড়োরা সকলে প্রিন্সিপালকে ধরে বসলেন, শারদা কলেজ থেকে গিয়ে ক্লাস করে ফার্স্ট হয়েছে, আপনি খাওয়ান। এর আগে মুকুলদা ছিল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর বল্লরীদি ছিল বিশ্বভারতীর প্রথম স্থানাধিকারী। স্টাফরুমের সকলেই ওদের দুজনকে নিয়ে গর্ব করতেন। সেই তালিকায় আমার নামও উঠল। পরে আরও প্রথম স্থানাধিকারীরা এই কলেজে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু যখনকার কথা বলছি, তখন আমি ছিলাম কনিষ্ঠতমা। খাওয়ানোর প্রস্তাব শুনে কালাচাঁদবাবু বিস্মিত হয়ে আমার দিকে নির্দেশ করে বললেন, ও খাওয়াবে না? বড়োরা তখন ভ্রূ কুঁচকে বললেন, পুঁচকে মেয়ে, কটা টাকা মাইনে পায়? সবে সংসার পেতেছে! আপনি খাওয়ান।

    বছর গড়ায় নাকি জল। সেদিনের পুঁচকে মেয়ের চুলে আজ রুপোলি রেখা। জীবনে সুখ দুঃখের নৌকো পাশাপাশি চলে। অবসরের পরে রঘুদা পূর্ণাঙ্গ ভগবদ্গীতা বাংলা ছড়ায় অনুবাদ করেছিলেন। সংশোধন করেছিলেন শ‍্যামলদা। মারা যাওয়ার আগে মুদ্রিত বইটির এক কপি তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বইটি দেখি। একা বসে থাকলে সিনেমার মতো চোখের সামনে ছবি চলে। কখনো দেখি আমি পিজি হাসপাতালের বেডে। রাত দুটোয় আধো অচেতনে প্রজ্ঞাদির মুখ। কখনো আমি গোলপার্কের এক নার্সিং হোমের বিছানায়। চোখ খুলে দেখলাম মুকুলদা আর বল্লরীদি দেওয়ালে পিঠ দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, নিশ্চুপ। কালাচাঁদবাবুর বেড়ানোর আর ছবি তোলার শখ ছিল। নিজের তোলা একটি পদ্মফুলের ছবি আমাকে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, বাড়িতে এসে দিয়ে গিয়েছিলেন কোনো দুর্ঘটনার পর মন ভালো করার জন্য। ছবিটি দেখি। টাটকা স্মৃতিও আসে। আমার বাবার বাইপাস অপারেশন চলছে, মেডিকা হসপিটালে দাঁড়িয়ে আছেন বর্তমান অধ‍্যক্ষ সুব্রতবাবু এবং তাপসদা। কখনো দেখি আমার কর্তামশাইকে নারায়না হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, এমার্জেন্সি। তাড়াহুড়োয় কলেজের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে শুধু একটি মেসেজ। হাওয়ার গতিতে বাইক চালিয়ে কলেজ থেকে এসে হাজির হয়েছে সন্দীপ। এত স্মৃতির ভারা বেঁধে আমি নিজেই এখন হেঁটে চলে বেড়ানো এক কলেজের ভূত।

    সবে তিনবছর হল, কলেজে যোগ দিয়েছে মধুরিমা। সেদিন বলে, দিদি সকালে যখন লাইব্রেরি খুলি, নৈঃশব্দ্যটা কেমন যেন গমগম করে, যেন অনেকে আছে। শুনে নির্বিকার থাকি। মুখের হাসিটিও টাল খায়না আমার। শুধু বলি প্রথম প্রথম অসুবিধা হয় বটে, পরে সব সয়ে যায়। যাই হয়ে যাক না কেন কলেজের ট্র‍্যাডিশন বজায় থাকে।


    সমাপ্ত
    ---------

     


    https://kinjalbose.wordpress.com/2017/01/20/semaphore-tower/।এই লিঙ্ক-এ টাওয়ারের ছবি আর গুরুত্ব দেওয়া আছে।


    https://amitabhagupta.wordpress.com/2013/07/15/optical-telegraph-in-india-the-forgotten-saga/


    https://rangandatta.wordpress.com/2013/07/17/semaphore-towers-a-pre-telegram-communication-system/


    https://rangandatta.wordpress.com/2021/01/20/great-trigonometrical-survey-gts-towers/



    আন্দুল রাজবাড়ির ইতিহাসঃ https://pritamnaskar.blogspot.com/2021/03/history-of-andul-rajbari-howrah.html?m=1


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • π | ০২ আগস্ট ২০২১ ০৩:৪১496290
  • এই রাতবিরেতে পড়ে ... :ড


    কিন্তু অনকের অধ্যাপক সিরিয়াসলি ভূতে বিশ্বাসী? 


    লেখাটা ভারি ঝরঝরে কিন্তু পর্বে পর্বে এলে, আর লাইন গ্যাপ কম থাকলে পড়তে আরেকটু সুবিধা হত। 

  • বিপ্লব রহমান | ০৩ আগস্ট ২০২১ ০৬:৩৬496350
  • কলেজ বাড়ির রহস্য শেষ পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেল! এই সাত সকালেও গল্পগুলো পড়তে পড়তে গায় কাঁটা দিয়ে উঠলো! 


    রীতিমত পাকা হাতের লেখা। 


    তবে আরেকটু রয়েসয়ে লিখলে পারতেন। প্রতি পর্ব আলাদা আলাদা করে ধারাবাহিক আকারে লিখলে আরও ভাল হতো। 


    অনলাইনে এত দীর্ঘ লেখা পড়তে পড়তে প্রায় হাঁফ ধরে যায়। 


    আরো লিখুন। শুভ 

  • জয় | 82.***.*** | ০৩ আগস্ট ২০২১ ১১:৪১496358
  • আমার হাসপাতাল (কাজ) যাওয়া দেরী কর দিলেন শারদাদেবী! কি ঝরঝরে লেখা- পড়তে গিয়ে থামা যায় না! আমার কাজের জায়গা যদি এমন হ'ত- চাঁটি বকুনি কিংবা তেনাদের নিশ্বাস প্রশ্বাস সবই কি কাঙ্খিত! 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন