#পাহাড়যাপন
আতরের দোকান করে যারা, তাদের কাছে দোকানের বাইরের পৃথিবীটা বাসি বলেই মনে হয়। পুষ্পের সৌরভ পেলেও যেন মনে হয় জোলো, ভালো মিষ্টির সুবাসও মনে ধরে না। সব কিছুই বড় অপরিশোধিত। আতরের দোকানটা যেন আরেক জগত, গন্ধের হাট বসেছে সেখানে। কোনওটা পারস্যের ফুলের আতর, কোনটা হিমালয়ের আয়ুর্বেদিক শিকড়ের গন্ধ। প্রতিটি ফুল নিজের ইতিহাস জানায়, বলতে চায় নিজের গল্প।কয়েকজন কারিগর বছরের পর বছরের ধরে এক্সপেরিমেন্ট করে যায় নতুন সুগন্ধের আশায়। দক্ষ হাতে গন্ধ তৈরি করে ওস্তাদ তারা। কিন্তু যে গন্ধ শেষমেশ তৈরি করা যায় না, সেই আতরের কারিগররা হীনমন্যতায় ভোগে। ব্যর্থতা স্বীকার করতে চায় না। মাথার চুল খামচে ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায় কিন্তু...পারে না।
পুরনো দেরাজের ভিতরেও একরকম গন্ধ থাকে। গন্ধটা খুব পরিচিত হলেও কিন্তু ঠাহর করা যায় না। কখনও বা মনে হয় গন্ধটা প্রাচীন আসবাবের, আবার কখনও মনে হয় নতুন বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ।বেশ কয়েক বছর পর যখন দেরাজ খোলে, গন্ধটা ছড়িয়ে থাকে বইয়ে, ছোটবেলার ডায়রিতে, জমানো স্টিকারের কৌটোয়, রঙিন পেনসিলে। একটুক্ষণ বসে থাকলে আস্তে আস্তে অন্যান্য প্রতিযোগিরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে চেনানোর জন্য। লক্ষীপুজোর গন্ধ, সন্ধ্যেবেলায় হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসার গন্ধ, মাদুরে বসে খেতে বসার সময় হারিকেনের সলতের গন্ধ, মরাঘাসের ওপর ভিজে ফুলের অপেক্ষার গন্ধ, আরো কত...
রঙের ও নিজস্ব এক একটা গন্ধ থাকে, যেমন থাকে ইতিহাসের। স্মৃতির গন্ধ অবশ্য লুকিয়ে থাকে নুড়ি নুড়ি গল্পের পিছনে,আড়াল দিয়ে হাসে। কিন্তু বর্তমানের কোনো গন্ধ থাকে না, কারণ বর্তমানের কোনো গল্প থাকে না। গল্প বুনে ওঠে অতীতের তারে। তাই গল্পের গন্ধ তৈরি করা যায় না।
উপরের লাইনগুলো বেশ কয়েক বছর আগে অফিসের টিম মিটিংয়ে বসে লিখেছিলাম। টিম লীড ভ্যাজর ভ্যাজর করে যাচ্ছিল, আমি গম্ভীর মুখে ল্যাপটপে ডেটা দেখার ভান করে নোটপ্যাডে টাইপ করছিলাম। বছরদুয়েক পর ট্রেনে করে ব্যাঙ্গালোরে ফিরছি, আকস্মিকভাবে আলাপ হয়ে গেল সামনের সিটে থাকা এক মাঝবয়সী দম্পতির সঙ্গে। কথায় কথায় জানলাম ভদ্রলোক পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক ও কবি, নাম উজ্জ্বল সিংহ। নিজেও 'ঘোড়সওয়ার' বলে একটা পত্রিকা বের করেন। আমি তখন উজ্জ্বলদাকে চিনতাম না, কবিতা টবিতা নিয়েও আমার ধারণা নেই। দু' একবার ন্যাকাবোকা অন্তমিল দিয়ে কয়েক লাইন লিখতে গিয়েছি, তারপর বকুনি শুনে আর ও পথ মাড়াইনি। ছন্দ বোঝা নাকি আমার কম্ম নয়! যাই হোক, আমিও টুকিটাকি লেখার চেষ্টা করি সেটা যেন কোত্থেকে জেনে ফেললেন, বললেন শুনি কী লিখেছো? এসি কামরা না হলে নির্ঘাত জানলা থেকে ঝাঁপ-টাপ দিতাম। কুকুলকানের সন্ধানে তো আর শোনানো যায় না, বাধ্য হয়েই এই কয়েকটা লাইন পড়লাম। উজ্জ্বলদা এক মুহুর্তও না ভেবে বললেন, "এ তো কবিতা। পাঠিয়ে দিও। আমি ঘোড়সওয়ারে ছাপব।" কথার কথা নয়, লেখাটা সত্যি উনি বইমেলা সংখ্যায় ছেপে দিলেন। ভাবতেও লজ্জা করে।
আজ এত বছর পর এই লেখাটার কথা মনে পড়ে গেল একটাই কারণে। আমারও নিজেকে আজ সেই আতরের দোকানদারির মতোই মনে হচ্ছে। সে মনেপ্রাণে চেষ্টা করে যাচ্ছে জীবনের একটা ছবি গড়ে তোলার-- সে ছবিতে শুধুই পাহাড়, মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর, সবুজের আচ্ছাদন আর বনের পাখি। নগরজীবনের ব্যস্ততা নেই, দায়িত্ব নেই, উচ্চাশা নেই, আছে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি। অঢেল সময়। কিন্তু বাস্তবে সেই ছবি গড়া তার পক্ষে অসম্ভব। আর সম্ভব নয় বলেই আমার অবস্থাও আজ আতরের ব্যর্থ কারিগরদের মতো। হয়তো একদিন হলেও হতে পারে, কিন্তু এই মুহুর্তে নয়। আমার পাহাড়যাপন পর্ব এখানেই শেষ।
গত তিন মাসে আমি পাহাড়কে যেভাবে দেখলাম, সেভাবে আগে দেখিনি। দেখা সম্ভবও ছিল না। হাড় কাঁপানো শীত আর তুষারপাত যেমন দেখা হল, বসন্তের আগমনেরও সাক্ষী হয়ে রইলাম। দেখলাম, ঋতুর সঙ্গে সবুজের রঙ কীভাবে বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে পাহাড়িয়া জীবনের রোজনামচা। বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান গাওয়া যেমন হল, নতুন বন্ধুদের আনন্দ অনুষ্ঠানের ডাকও পেলাম। গাছগুলো পাতা মেলল, চুড়ার বরফ গলে গেল আস্তে আস্তে। খরস্রোতা পাহাড়ি নদী এখন আরো ক্ষিপ্ত। বাগানের আপেলেও লাল রঙ ধরছে। কালো বলের মতো দেখতে একটা কুকুর ধীরে ধীরে পরিণত আর তাগড়াই হয়ে উঠছে, যার নাম সাইচু। দেখলাম, প্রত্যন্ত এক গ্রামেও দুই মেয়ে টিকটক স্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, বিশাল ছেত্রীর গানের কলি আঁকড়ে তারা ভিডিও করছে রোজ। সুজুকা বলে একরত্তি পুঁচকে মেয়েটা, যার আসল নাম গরিমা, তাকে খুব মিস করব। মিস করব গ্রামের অন্য বাচ্চাদেরও। গীতা, অনু, ঋশু, পরিধি। পরিধির কচি গলায় 'সচিন ভাইয়া' যা শুনে মাথাখারাপ হওয়ার জোগাড় হত, সেটাও মিস করব। অনুর কাঁদো কাঁদো মুখে বলা 'পালক তো নাহি হ্যায় আজ' কথাটা মনে করে হাসব হয়তো। প্রকৃতির কথা আর কী বলি, আকাশের নীল রং আর সবুজের কথা ভাবলেই কান্না পাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি আর টুকরোটাকরা মুহুর্তের কথা মনে পড়ছে, যার মূল্য আগে বুঝতে পারিনি। সত্যি, গল্প তো বুনে ওঠে অতীতে। বর্তমানের কোনও গল্প হয় না।
রঙের গন্ধ আর পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে আজ আমরা চলে যাব। কিন্তু ফিরে যা আসব, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ততদিনের জন্য, বিদায়। সবাই ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। আর থাকুক সবুজে।
ছবিটা খুব সুন্দর। লেখাও। আচ্ছা আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? জীবনের ছবি গড়ে তুলতে না পারলে কী ক্ষতি আছে? ঐ যে কয়েকটা নিমেষ পেলেন যেখানে নগরজীবনের ব্যস্ততা-দায়িত্ব এসব নেই, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি আছে। সেগুলো তো কোথাও না কোথাও জমা হয়েই রইলো? পুরো ছবি না হোক, ছোটোছোটো অণু ছবি। আপনার নিজেরই তো হয়ে রইলো? আপনার আরেকটা লেখায় দেখেছিলাম একটু আক্ষেপ, জীবনে 'সেইভাবে' কিছু করা হলোনা। আবার ঐ একই প্রশ্ন, না করা হলে কী ক্ষতি আছে? কিছু করতেই হবে সব্বাইকে? কেউ যদি সারাজীবনে কিছুই না করে তাহলেই বা কী? এই প্রশ্ন আপনাকে বিশেষ ভাবে নয়। বেশির ভাগ মানুষকেই এই কথা বলতে শুনেছি। যতবারই শুনেছি আমার এই একই কথা মনে হয়। তাই বললাম।
জীবনে সেইভাবে কিছু করা হল না, সেই নিয়ে আমার বিশেষ আক্ষেপ নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতার প্রত্যাশা অবশ্যই আছে। কী করা নিয়ে কথাটা হচ্ছে সেটা সম্ভবত আনাড়ি হাতে বোঝানো সম্ভব নয়, সেটা আমারই ভুল। ধরুন, জীবনে বাড়ি গাড়ি হল না, চাকরি বাকরি হল না, টাকা পয়সা হল না। এতে আমার আক্ষেপ হবে না এক বারের জন্যও। কিন্তু ধরুন আমাজনের জঙ্গল বা হিমালয় দেখা হল না, নতুন দেশের অভিজ্ঞতা হল না, এক জায়গায় জীবন কেটে গেল। কত কিছু জানা হল না, উপলব্ধি হল না কত অনুভবের। তাহলে আক্ষেও হবেই। এটা মানুষ হিসেবে আমাদের ডিফাইন করে। আমার পরিচিত অনেকে সারা জীবনে একটা বইও পড়েনি, তাতে কিছু ক্ষতি হয়েছে? হয়নি। না পড়লেও বা কি! কিন্তু যারা পড়েছে তাদের কাছে একটা দিগন্ত খুলে গেছে। মহাবিশ্বকে অ্যাপ্রিশিয়েট করার জন্যই এই অপার্থিব অভিজ্ঞতা আরো বেশি করে পেতে চাওয়ার লোভ। এইটুকু জীবন। চলে তো সকলকেই যেতে হবে। তাও সেই তাড়নাটুকু থাক না হয়! এই করেই কেটে যাবে।
আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। আপনি আগেও লিখেছিলেন যে টাকা জমাননা, জমান অভিজ্ঞতা। সেটা আমি খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করি। এখন যে ব্যাখ্যা দিলেন সেও বুঝতে পারলাম। ভালো থাকুন, আরো লিখুন।