একটা টাটকা শোক থেকে আরেকটা টাটকা শোকে চলে যাচ্ছি। প্রথমটার থেকে দ্বিতীয়টায় গেলে পরের গুলো লঘু হয়ে যাচ্ছে। আসলে ধীর গতিতে দেখলে আমাদের এই শোক উবাচ অনেকটাই সময় ধারার মতো ইতিহাস মেনে চলছে, যুগ বদলালেও আমরা একেবারে যুগপৎ বদলে যাইনি। রামের কাছে একটা মৃত্যু ভোর ভোর এসে পৌঁছায় তো সেটা শ্যামের কাছে সেটা প্রাক দুপুরে। তারপর দুজনের শোকবহর চলে প্রকৃতি মেনে। আমি আপনি সেখানে হাত ঢোকাতে পারিনা। বড়জোর পারলেও আম্ফান ইয়াসে ভেসে যাওয়া শুকনো ত্রাণ বিনিময়ের মতো, হাত বুলিয়ে ছেলে ভুলোনো। কিন্তু রাম শ্যাম? রাম শ্যাম রহিম করিমের আবহাওয়ার খবর ভেসে যায় পাড়া থেকে বেপাড়া হয়ে পরিচিত গ্রহান্তরে। তারপর শোক পাথর ভেঙে ভেঙে নিক্তি মাপে স্বজন-পড়শি। খুচরো কথার মতো পড়ে থাকে কে চলে গেলো ছেড়ে, এরপর শোকের নিক্তিতে পরিবারের কে বেশী এগিয়ে। সন্তান সন্ততিরা এই খুচরো সান্ত্বনাপাড়ার মুখ্য বাসিন্দা হয়, ক্রমে জীবিত থাকলে স্ত্রী অথবা স্বামী। এরপরে আর এই পাড়া আর দীর্ঘ হয় না। নতিদীর্ঘ পাড়ার আলোচনা স্তিমিত হয়। বছর ভোর গুনতে গুনতে এই শোকও ক্লান্ত দুপুরের একা চিল হয়ে যায়। তারপর ওই সান্ত্বনা তালিকার প্রথম কয়েক জনের মনে পড়ে, ঠিক ওই একা চিল টাকে। খাঁখা চিলেকোঠায় সে চলে আসে আলটপকা রাত দুপুরে।
কিন্তু এই শোক যাতায়াত ঠিক কতটা টাটকা হয়, তা একমাত্র মেপে রাখতে পারে মগজ। একটা মৃত্যু থেকে পরের মৃত্যুতে এসে শ্বাস নেওয়া এই স্বকর্ণ অভিঘাতে তাই মগজই হয়ে ওঠে একমাত্র কুলদেবতা, যে কিনা সমস্ত মাপা আছেদ্যা নিয়ে এক লহমায় পরিবার কর্তাকে অগ্নি পরীক্ষায় ফেলে। এই সামান্য সময়তেই তো কেপে ওঠে রাম শ্যাম রহিম করিমেরা। তারা সময় প্রত্যাশাও করেনি কোনো দিন এইসময়ের কাছে, তবুও এতো মুহুর্মুহু ফোন আসে কেন ফোনে? কেন আর এক পলকেও মনে পড়েনা উপরওয়ালার নাম? আর আমরা অপর দিকে খেলে যাই ওদের নিয়ে, ছেলে খেলা..
অন্য দিকে এই শোকবহরের মহানিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ককেই আমার পরাক্রমী লাগে একমাত্র। যাকে নিয়ে লিখব বলেই তো গোটা লেখার অছিলা। রাম রহিমের মতো আমিও এর সঙ্গ করলাম একটা মাস। তাই এই কথা গুলো লিখছি বলেই আমার কাছে কেউ আবার প্রশ্ন তুলতে পারেন শোক উত্তাপের। আমি তাকে এড়িয়ে যাবই না, বরং তাকেও বুঝিয়ে দিতে পারি আমার নিঃশোক উপলব্ধি। এই নিঃশোক কথা-লেখাকে যে সায় দিচ্ছে তারও নাম সেই মগজই। আমাদের হাজার স্মৃতিকে যে ধরে রেখে ছিলো, তাকেই তো মৃত্যু ঝাপটা সামলিয়ে নিতে হয়েছে..
রাম রহিম শ্যাম করিমের সান্ত্বনা পাড়ায় আমার নাম ছিলো না। থাকার কথাও নয়। তবুও মৃত্যু এলো, রোদেলা এক দিনের পর পরবর্তী দিন রোদ হয় যেমন, গত দিনের ইতিহাস মুছিয়ে আরেকটা চকচকে স্রোত। কিন্তু ইতিহাস মুছে যায় পুরোপুরি? স্রোত খাজের ছায়ায় তাই ডুবে থাকে স্মৃতি। আমার বেড়ে ওঠার স্মৃতি অপটু ডুবুরির মতো মুখ তুলতো সেই দিন গুলোয়। আমি একটুও ওদের ভাসিয়ে রাখতে চাইতাম না। মাঝ পুকুরে অনেকটা জল খেয়ে নিলে শিক্ষানবিশ আমার সাঁতারবেলায় যেমন কষ্ট হতো, খানিকটা তেমনই হয়েছে। আর বাদবাকি টা নিজেও জানিনা। তবে আমাদের সেই সমবেত শোকের দিন গুলো ছেড়েও এখনও কথায় কথায় অনেক স্মৃতি উঠে আসছে। যে স্মৃতিতে দম চাপা কষ্ট হলেও আজলা করে নিতেই হবে। না হলে, আমার যে আলোময় সহোদরদের খুন করেছি, তাদের ফিরে পাবো?
বহুদিন আগে স্কুলের এক বিএড পড়তে আসা শিক্ষিকা যা বলেছিলেন সেটা সারাংশ করলে হয়; আমাদের পূর্ব পুরুষের চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড়ো সত্যি, তবে তাঁদের চলে যাওয়ার পর আরেকটা যেটা সত্যি পড়ে থাকে সেটা আমাদের থেকে যাওয়াটা। রোম থেকে রোমে, মূল থেকে মূলে আসলে তো থেকে যায় আমাদের শিকড়েরা। তাই সেই সকাল গুলোতে মেঘলা রোদে তলিয়ে বসলেই আমার সেই ম্যাম এর প্রথম দিনের ক্লাস করানোর কথাই বারবার ফিরে আসতো মগজে। ম্যামের কথা গুলো ভেসে ওঠার পর তাই আমি আরো সচেতন হয়েছি। যে অতল থেকে এখন স্মৃতিরা ভেসে আসে তাদের শোক কাটিয়েই জায়গা করে দিচ্ছি। এই জায়গায় একটা ঘেটো কলোনীর মতই যেন বেঁচে থাকতে পারে রাম রহিমের পিঠে হাত বোলানোর থেকে উঠে আসা স্মৃতি, পরিজনের কান্নার স্মৃতি, আমার ছেলেবেলা। আবার হাঁটতে হাঁটতে এখন "রক্তের" কাঁধ ছুলে যে মায়া স্মৃতি গড়ে উঠছে সেসবও.. সব।
এহেন সময়তেই তাই আমার মগজের স্মৃতি খোড়া আর নির্মাণের একটা সময় রেখা পাতলাম, যেখানে ডুব সাঁতার কেটে রাম রহিম শ্যাম করিমের শোক চিল আমার খাঁখা চিলেকোঠাতে দু দণ্ড বসতে পারে।
বেশ লাগল লেখাটা।
স্নৃতিদের ঘেটো কলোনির মত বেঁচে থাকা, এই শব্দবন্ধ মনে থেকে যাবে হয়তো।
চমৎকার লাগলো লেখাটা! শোকের ভিতর থেকে তার জটিল বিন্যাসকে ভাষায় তুলে ধরা! অপূর্ব!