
গ্রামের নাম পুলনা। চিরতরে হারিয়ে গেছে এই গ্রাম। না, নামটা আছে, গ্রামটাও আছে। কিন্তু বদলে গেছে আমার স্মৃতিতে ধরে রাখা এক চিলতে গ্রামের সেই পরিচিত দৃশ্য, যেখানে সূর্যের আলো মাথায় হাত দিয়ে ঘুম ভাঙাত। চা-ওয়ালা রমনকিশোর ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এর ট্রেকারদের চা দিতে ভুলে গিয়ে মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকত আচমকা জেগে ওঠা রামধনুর দিকে। হেমকুণ্ড সাহিবগামী তীর্থযাত্রীরা চলে যেত এই গ্রামের পাশ দিয়েই কিন্তু ফিরেও চাইত না গ্রামের মোড়ল রামধনীর দিকে। গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান যদি নিয়ম করে নদীর ধারে গিয়ে রঙিন পাথর কুড়োয় তাহলে কে আর পাত্তা দেয়?
গোবিন্দঘাটের হইচই থেকে দূরে পাহাড়ের কোলে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকত পুলনা। নাম না জানা পাখিরা নিয়ম করে তাদের নিজস্ব 'সারেগামাপা' প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত সাতসকালে, সাক্ষী থাকত আকাশ, সাক্ষী থাকত বনের গাছপালা। প্রতিদিন পাতার বস্তা নিয়ে গ্রাম থেকে ঘাঙরিয়া যেত আমার বন্ধু শীতল, সেখানে তাঁবুওয়ালা আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন সেই পাতা কিনে আগুন জ্বালত। পুলনা গ্রামের মুখে সহিসরা ঘোড়া বেঁধে রাখত, তারা অলস ভঙ্গিতে ঘাস চিবিয়ে যেত সর্বক্ষণ। এই ঘোড়া করেও অনেকে হেমকুণ্ড সাহিবে যাবে, তখনও সেখানকার রাস্তায় ব্ল্যাক আইস আর কুচো বরফের বিপদ ওঁত পেতে আছে।
মাত্র তো তিন চার মাস, তারপর তো বরফের আচ্ছাদনের নীচে ঢেকে যাবে সমস্ত ভুন্ডার ভ্যালি, শান্ত হয়ে ঝুপড়িতে সেঁধিয়ে যাবে লোকজন। শুধু লক্ষণগঙ্গা আর অলকনন্দার সঙ্গম থেকে জলের উচ্ছ্বাসের শব্দ ভেসে আসবে। কিন্তু বর্ষার এই সময়টা এখানে বসন্তের সামিল। ট্রেকাররা আসে, কিছু আয়ও হয়। পাখিদের গলার স্বরে চাশনি, আকাশের গায়ে সিঁদুর মাখা রোদ, জলের শব্দে মিশে যাওয়া সেতারের সুর-- সেই অপেক্ষায় সারা বছর বসে থাকে রমনকিশোর বা রামধনীরা।
আঁকাবাঁকা পথ, সোনারঙা আকাশ আর কচিকলাপাতা রঙের সবুজ বন নিয়ে বেঁচেছিল পুলনা।
এলোমেলো, অলস জীবন।
সেই পুলনা আর নেই। ২০১৩ সালে উত্তরাখন্ডে 'ক্লাউড বার্স্ট' -এর সময় পুরো গাঁ ভেসে গিয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেও কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। যে ক'জন থাকত, অনেকে প্রাণ হারিয়েছে, বাকিরা শরণার্থী শিবিরে মাথা গুঁজেছিল। আবহবিদরা বার বার করে সাবধান করেছিলেন আসন্ন বিপদের কথা ভেবে পরিবেশ সচেতনটার দিকে মনযোগী হতে, এখনও করছে, ও সব কে শোনে? বছর দুয়েক পর পুলনা পঞ্চায়েত গড়ে আবার ঘরবাড়ি দাঁড় করানো হল; সরকারের পক্ষ থেকে কিছু লোকজনকে বসিয়ে দেওয়া হল টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারে। পাকা বাড়ি, টুরিস্ট সেন্টার, বিদ্যুৎ --- খালি সেই মানুষজনগুলো ফিরল না। তারা যে আদৌ এখানে থাকত, সেটা প্রমাণ করার জন্যে অনেকেই কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সরকারের কাছে। পরবর্তী কয়েক বছরে একের পর এক হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রোজেক্ট বসেছে এই অঞ্চলে, জঙ্গল কাটা পড়ছে দ্রুত। ফুলো কী ঘাটি যাওয়ার পথে যে গ্লেশিয়ার পড়ে সেটা প্রায় ভ্যানিস হওয়ার মুখে। পাখিদের গান কমে গেছে, আকাশের রঙ ঝাপসা, মেঘেরা এক্কাদোক্কা খেলতে আসে না। পুলনা গ্রামের মতো হারিয়ে যাচ্ছে সব কিছু...
আজ প্রায় দশ বছর আমার এক বন্ধুর মারফত ফেসবুকে জানলাম রমনকিশোর আজকাল উত্তরকাশির কাছে জোশিয়ারা ব্যারেজ হাইড্রো প্রজেক্টে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। এ কয়েক বছরে একদম বুড়িয়ে গেছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে, দৃষ্টি শূন্য। পুলনার কথা শুনলে উত্তর দেয় না, বিড়ি টেনে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে নির্বিকারে। এরকম শত শত রমনকিশোর সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে হয়তো...
পুলনার কোনো ছবি নেই আমার কাছে। সে যাত্রায় পকেটে ১৯৭৭ টাকা ছিল, স্মার্টফোনের যুগ তখনও আসেনি। ঘাঙরিয়ার একটা ছবি দিলাম।

এ জায়গা তো মারাত্মক!!
এটা পড়ে আসলে কিছু বলার থাকে না। এই যে ভীষণ মন খারাপ লাগছে এইটাও তো কাল অফিস খুলে বসলেই আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে। গ্রামটা যেমন মিলিয়ে গেছে।
এটা পড়ে আসলে কিছু বলার থাকে না। এই যে ভীষণ মন খারাপ লাগছে এইটাও তো কাল অফিস খুলে বসলেই আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে। গ্রামটা যেমন মিলিয়ে গেছে।
পরিবেশ বদল নিয়ে আমরা সকলেই উদাসীন। এই নিয়ে সাহিত্য রচনাও খুব কম। আমাজন ফায়ার আর গ্লোবাল ওয়াইল্ড ফায়ার ক্রাইসিস নিয়ে একটা বই লিখেছি। থ্রিলারের মোড়কে পুরো ব্যাপারটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিশেষ রেস্পন্স দেখিনি। অথচ আমাজন বা পুরুলিয়ার ঘটনায় ফেসবুকে পোস্টের বন্যা বয়ে যায়। হুজুগ ছাড়া সত্যিকারের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে না এলে এইরকমই চলবে।
kk | 97.9.***.*** | ১০ জুন ২০২১ ২০:৪৫494821সুদীপ, আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগছে। আপনার বইটার নাম কী? ঘাঙরিয়ার ছবি খুব সুন্দর লাগলো।
কেকে বাবু, আপনার আসল নাম দেখতে পাচ্ছি না। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমাজনের বইটার নাম অনলগর্ভা। একপর্ণিকা প্রকাশনী। আরো কয়েকটা বই আছে। একটা ছবি দিলাম।

kk | 97.9.***.*** | ১০ জুন ২০২১ ২৩:৪৪494825বাঃ, থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ!!