ভালো রেখো সাইকেল : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ২৬ জুন ২০২১ | ২৬০২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
সাইকেল আর বই, এই তাঁর জগৎ। রাজাবাজারের বাড়িতে বইয়ের ভিড়ে বাকি সব কিছুই অদৃশ্য বলা চলে। সে বাড়িতে প্রথম যে দিন গেলাম, বিচিত্র অভিজ্ঞতা। রূপদার গলা শুনতে পাচ্ছি, মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি না। অনেক পরে নজর করি, দুটি বইয়ের তাকের ফাঁকে এক চিলতে জায়গায় গা এলিয়ে রূপদা। কথায় কথায় বললেন, দেশের বাড়ি থেকে সে দিনই সকালে ফিরেছেন। জানতাম, দেশের বাড়ি ভগবানপুর। অনুমান করতে পারছিলাম, রূপদা কীভাবে গিয়ে থাকতে পারেন। তবু, খানিক মজা করার জন্যই বললাম, এই গরমের মধ্যেও কি নন-এসি বাসে…। বাক্যটি শেষ করার ফুরসত পেলাম না। রূপদা যেন রীতিমতো অপমানিত বোধ করলেন। পাল্টা প্রশ্ন, ‘কেন, বাস কেন? সাইকেল থাকতে বাস কেন?’ মার্জনা চেয়ে বললাম, সব ঠিক আছে। কিন্তু বম্বে রোডে ঝড়ের গতিতে চলা গাড়ির মধ্যে সাইকেলে চলাফেরা ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে না! রূপদা কথাটা কানেই তুললেন না।
আকবর বাবরের মা : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ০৩ জুলাই ২০২১ | ২৪৩৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
পরিযায়ী শ্রমিক কথাটা তখন শুনিনি। কোনও খবর লিখিনি। শ্রমিক, শ্রমিক নেতা, শ্রমমন্ত্রী, কারও মুখে শুনিনি শব্দ দু’টি। খবরের কাগজ, টেলিভিশনের খবরে এ নিয়ে কোনও খবর, আলোচনা নজরে আসেনি। মইনুল, আমিনুল এবং ওদের আরও অনেকের সঙ্গে আমাদের তখন রোজকার আড্ডার সম্পর্ক। ওদের মুখেই জানতে পারি, মুর্শিদাবাদের গ্রামে জোয়ান ছেলেদের অনেকেই গ্রামছাড়া। কেউ কাজের সন্ধানে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। কেউ পুলিশের ভয়ে এলাকাছাড়া। সে জেলার খবর শিরোনামে আসে গঙ্গা-পদ্মা-জলঙ্গির ভাঙন আর সিপিএম-কংগ্রেস মারামারি-খুনখারাপির সুবাদে। ছাপা হয়, খোলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচার, মানুষ পাচার, নানা সামগ্রী চোরাচালানের খবর। আর ছাপা হয় আইএসআই চর ধরার রোমহর্ষক কাহিনি।
ডেলি প্যাসেঞ্জারি মানে/ দিন আনি দিন খাই : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ১০ জুলাই ২০২১ | ২৮৮১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৮
ট্রেনের কামরা তখনও অন্ধকার৷ দর দর করে ঘামছেন কয়েকশো মানুষ৷ কিন্তু পিন ড্রপ সায়লেন্স৷ খিস্তি-খেউড়, ঠেলাঠেলি সব থেমে গিয়েছে৷ কামরা ভর্তি জনতা মন দিয়ে রেডিও-র স্থানীয় সংবাদ শুনছেন৷ সংবাদ পাঠক এ বার খবর পড়া থামিয়ে বলছেন, ‘এই কমপার্টমেন্টে, আপনাদের মধ্যে সরকারি কর্মচারী ক’জন? বড়জোর পাঁচ-দশ জন৷ বাকিরা! বাকিদের কী হবে? তাদের কী দোষ? তারাও কি সব সত্ মায়ের সন্তান?’ আরও বললেন, ‘তবে খেয়াল রাখবেন, সরকারি কর্মচারীর মাইনে বাড়লে দু’পয়সা আপনার পকেটেও আসবে৷ ওরা কিনলে তবে তো আপনি বেচবেন? এখন তো এ-কূল ও-কূল দু’কূল যাওয়ার জোগাড়৷ উনি (জ্যোতি বসু) বলে দিয়েছেন, দিতে পারব না৷ কেন্দ্র না দিলে দিতে পারব না৷
এত টাকা দিয়ে আমি কী করব! : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | আলোচনা : সমাজ | ১৭ জুলাই ২০২১ | ২৪৩০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
সেই সকালে, বাবুদা যে দিন দু’টাকা চেয়ে আমাকে বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছিলেন, আমার হাতে সে দিন অনেক টাকা৷ কিন্তু আমার নয়, স্কুলে এনসিসি-র অনুষ্ঠানের জন্য সহপাঠীদের চাঁদার টাকা৷ রবিবার সকালে এনসিসি স্যারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা৷ সাত-পাঁচ না ভেবে, একটু যেন দয়াপরবশ হয়ে স্কুলে ঢোকার মুখে, চার ধারে কেউ কিছু বুঝতে না-পারে, এমন ভাবে বাবুদার হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে হাঁটা দিলাম৷
আমি মরলে শ্মশানে যাইয়ো গদাধর : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২০৯৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
এক দিন কথায় কথায় শ্যামলদা বললেন, ‘চল যাই, গদাধর কর্মকারের সঙ্গে দেখা করে আসি৷’ মদ আছে, মাতলামো নেই, চরিত্রটা বেশ মনে ধরেছিল শ্যামলদার৷ পর দিন সাতসকালে গদাদার দোকানে হাজির হলাম শ্যামলদার ইচ্ছার কথা জানাতে৷ দেখি, চায়ের কাপে পাতি লেবু নিংড়ে রস বের করে এক চুমুকে রস মুখে পুড়ে পাড়া কাঁপিয়ে বললেন, ‘বোম বোলে’৷ শ্যামলদা তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চাওয়ার হেতু শুনে বললেন, ‘কিন্তু আমি তো মদ ছেড়ে দিয়েছি৷’ বললাম, সে কী! কবে ছাড়লেন! বললেন, ‘দিনক্ষণ কি মনে থাকে৷ স্বপ্নে বাবা (মানে ত্রিনাথ ঠাকুর) কইল, অনেক খাইসস, আর না৷ এ বার ছাড়৷ ব্যাস, ছাইড়া দিলাম৷ নতুন নেশা লেবুর রস। রোজ সকালে একটা।’ বললাম, ‘আপনি যে বলেছিলেন, ডাক্তার বলেছেন, মদ ছাড়লেই বিপদ৷’ সহাস্যে বললেন, ‘ডাক্তার কি বাবার থিকাও বড় পণ্ডিত?’
আমাকে কেন ছড়ি ধরতে হল, বল বল বল : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ৩১ জুলাই ২০২১ | ২২১৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
দেশভাগের পর দখলি জমিতে কলোনি স্থাপনের সময়ই স্কুলের জন্য চারটি জায়গা চিহ্নিত করা ছিল৷ নিজেদের ঘর-বাড়ি তৈরির পাশাপাশি এর-ওর কাছ থেকে পাওয়া দানের টাকায় চলে স্কুল তৈরির কাজ৷ ‘বহিরাগত’ শিবপ্রসাদ নাগ কলোনি আর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের সেই লড়াইয়ের কথা মনে রাখতেন৷ পয়সার অভাবে কারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, মানতে পারতেন না৷ তবু ম্যানেজিং কমিটির সদস্যেরা, তাঁরা আবার কলোনিরই মানুষ, রোজগার বাড়াতে নিয়ম করলেন, মাইনে এবং পরীক্ষার ফি বকেয়া যাদের, তাদের মার্কশিট দেওয়া হবে না৷ চাপের মুখে হেড স্যার সে নিয়ম মানলেন৷ ফলে বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন দেখা গেল সব ক্লাসেই অর্ধেকের বেশিরভাগ ছাত্র অনুপস্থিত৷
আলাপহীন সম্পর্ক : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ১৪ আগস্ট ২০২১ | ১৩৯৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
মাইকে ঘোষণা হয়, অবরোধ উঠে গিয়েছে৷ পরবর্তী ডাউন ট্রেন ইছাপুর স্টেশন ছাড়ছে৷ ওই পথটুকু ঘড়ি ধরে আসলে, সোদপুরে সেই ট্রেনের পৌঁছতে আরও মিনিট কুড়ি৷ সময় যত গড়ায়, চোখের সামনে ভাসতে থাকে ট্রেনের চেনা ছবিটা — মালপত্রে উপচে পড়া ট্রাক, লরির মত - ট্রেনের ইঞ্জিন, ড্রাইভার-গার্ডের কামরার বাইরে, দরজার পাদানিতে, ভিড়ের গায়ে ভিড় লেপ্টে৷ মাঝে মধ্যে কানে আসে, সেই ট্রেন থেকেই আগে কোথাও রেলের পোস্টে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছেন কোনও যাত্রী৷ ট্রেনের ছাদও বাদ যায় না। সেখান থেকে মাঝেমধ্যেই ওভারহেড তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে টপাটপ মানুষ মরে। এই আছি, এই নেই - কী বিচিত্র জীবন।
কেমন আছো, কেমন আছিস, কেমন আছেন : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ২১ আগস্ট ২০২১ | ২৩৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
কী খবর, কেমন আছিস, মাসিমার কী খবর, মেসোমশাই ভালো আছেন, ইত্যাদি কথাগুলি সবার কাছেই কেমন বহুকাল না শোনা ঠেকল।
অথচ, এই তো সেদিনের কথা, পাড়ায় কারও বিয়ে হলে নতুন বউ কিংবা বরকে দেখতে প্রতিবেশীরা রাস্তায় এসে দাঁড়াতেন। পাড়ার কেউ গত হলেও দেখা যেত একই দৃশ্য। শেষ যাত্রা চাক্ষুষ করতে গোটা পাড়া যে যার বাড়ির গেটে এসে দাঁড়াত। মাঝরাত কিংবা ভোররাতে দেহ শ্মশানের যাবে শুনে অনেকে একে তাঁকে অনুরোধ করতেন, ‘যাওয়ার সময় আমারে একটু ডেকে দিও।’ কেউ কেউ জানালার ধারে বসে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন শেষ যাত্রার সাক্ষী থাকবেন বলে। তার আগে চলত মৃতের স্মৃতিচারণা।
সব কিছু যে কবে বদলে গেল তারও কি খবর রেখেছি আমরা?
সেদিনই রাতে বৌদির ফুলশয্যা : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ২৮ আগস্ট ২০২১ | ২৪৫৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
দুর্যোগ কেটে গেলে পাড়ার আড্ডায়, চায়ের দোকানে কারও কারও কথায় অভিমান ঝরে পড়ত, ‘সে দিন আমি এত করে যেতে চাইলাম, তোমরা রাজি হলে না৷' কেউ বলতেন, ‘রাতবিরেতে দরকার হলে আমায় ডেকো৷ রাতে আমি তো জেগেই থাকি। এক দিন না হয় হাসপাতালে বা শ্মশানে রাত জাগব।' তেমন একজনকে এক দিন বললাম, ‘কাকু, আপনাকে তো ফার্স্ট ট্রেনে অফিস ছুটতে হয়৷ আপনি কী করে হাসপাতালে রাত কাটাবেন!’ দার্শনিকসুলভ জবাব এল, ‘জীবনটা অফিস আর বাড়িতেই থমকে আছে বুঝলি৷ মাঝেমধ্যে রুটিন বদল করা ভালো৷ একটু হাসপাতাল-টাসপাতাল গেলে মন্দ কী?’
রক্তের সম্পর্ক : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৬২২ বার পঠিত
এনআরএসে তখন যন্ত্রণাকাতর যাত্রীদের আর্তনাদ, পরিজনের কান্না৷ রেডিও, টিভিতে খবর পেয়ে বাড়ি না ফেরা যাত্রীর পরিজনের ভিড় থিক থিক করেছে৷ আহতদের রক্ত দরকার৷ হাসপাতালে রক্ত নেই৷ অদূরে মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বেশ কয়েক জনকে৷ দেওয়ালে দেওয়ালে তখনও সিপিএমের ছাত্র-যুবদের লেখা সবটা মুছে যায়নি, ‘রক্ত দিয়ে গড়ব মোরা সাধের বক্রেশ্বর৷’ বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রাজ্য সরকারের উদ্যোগে গড়ার অঙ্গীকার৷ কাগজে খবর হয়েছিল, বক্রেশ্বরের জন্য দেওয়া বিপুল রক্ত মজুতের ব্যবস্থা না থাকায় নর্দমায় ফেলে দেওয়া হয়েছে৷ অথচ হাসপাতাল সেদিন রক্তশূন্য৷
এনআরএসের এমার্জেন্সির ভিড়ে হঠাৎ সেই তরুণের সঙ্গে দেখা, বিকালে যাকে রেলকর্তার ঘরে দেখেছি৷ তার সঙ্গে নানা বয়সের আরও জনা দশ-পনেরো লোক৷ ছেলেটি গলা চড়িয়ে হাঁক পাড়ছে, ‘ডাক্তারবাবু কার রক্ত দরকার? কার দরকার, কার দরকার? আমরা রক্ত দেব৷’
‘এ বাবু উসকে লিয়ে দো রুপিয়া, মেরে লিয়ে এক রুপিয়া!’ : অমল সরকার
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : সমাজ | ২৩ অক্টোবর ২০২১ | ১৪২৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
মল্লিকবাজার মোড়ে প্রথমে অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থায়, পরে বাচ্চা কোলে ভিক্ষা করত যে মেয়েটি, মেয়ো রোডের ছেলেটিরই বয়সি সে। কিশোরীর ওই পরিণতি কে করল? কেনই বা সে ওই বয়সে বাড়ি ছাড়া? জানা হয়নি। ফুটপাথে প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে শিশুর সারল্যে কিশোরী মায়ের সন্তানের সঙ্গে খেলা, মাতৃস্নেহে শিশুর যত্নআত্তি করার দৃশ্য যানজটে আটকে থাকা গাড়ির আরোহী, পথচলতি মানুষের চোখ টানত। প্রেস স্টিকার সাঁটা গাড়ির আরোহীর মনে প্রশ্ন তোলপাড় করে দিয়ে যেত, এই কিশোরী মা মৌলালির সেই নাবালিকা নয়তো?