বহুদিন অবধি বাবা আমাদের দুই ভাইবোনের চুল কেটে দিত। আমাদের বাসাবাড়ির ভেতরের উঠোনে ইঁট পেতে তার উপর বসতাম। গায়ে পুরোনো গামছা জড়ানো থাকত। বাবা নিজের দাঁড়ি কাটার কাঁচি আর আয়না নিয়ে আসত। তারপর সামান্য জলে চুল আধভেজা করে দিয়ে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে চুল কেটে দিত। মাথাটা হেমন্তের ফসলশূণ্য ক্ষেতের মতো হয়ে যেত! এটাতে কষ্ট হতো না বড়ো একটা। কষ্ট হতো ন্যাড়া করে দিতো যখন গরমের শুরুতে, তখন। দাঁড়ি কামানোর ক্ষুর দিয়ে নির্দয়ভাবে বাবা ন্যাড়া করে দিত। রুক্ষ চুলের গোছা ছড়িয়ে থাকতো পুরো উঠোন জুড়ে। মরুভূমির মতো মাথা আর এক সমুদ্র চোখের জল নিয়ে বসে থাকতাম ইঁটের ওপর। বাবা হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে লাইফবয় সাবান ঘষে স্নান করিয়ে দিত। ... ...
তারা জানে না, স্থায়ীভাবে শিশুটির জন্য কোনো অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা তারা করতে পারবে কি না। তারা এতটুকুই জানে, তাদের চালচুলোহীন বেকারত্বময় জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবে এক সম্পদ যোগ হয়েছে। যে সম্পদের কোনো মূল্য নেই অন্য কারো কাছে। কোনো দাদু-দিদা-ঠাকমা-ঠাকুরদা-পিসি-কাকা-মামা-মাসি নেই তাকে দাবী করার… যত্ন করার… ভালবাসার। তাই তাকে আগলে রাখার দায়িত্বের চেয়ে বড়ো দায়িত্ব এই মুহূর্তে আর তাদের জীবনে নেই… কখনোই ছিল না। …সন্ধ্যা গাঢ় হচ্ছে। কাদের বাড়ির শাঁখে ফুঁ পড়লো। কোথাও থেকে বুঝি উলুধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে। কাঁসরঘন্টা বেজে উঠলো কোথাও। এই মুহূর্তটা… ঠিক এই মুহূর্তটা দু'টো অপাংক্তেয় মানুষের কাছে কিভাবে ভাস্বর হয়ে উঠলো, সেটা গোটা পৃথিবীর কেউ জানলো না… কেউ না। ... ...
আমার মা এয়োস্ত্রীর আচার নিয়ে খুব একটা অবসেসড্ ছিল না কোনোকালেও। তবুও বিষ্যুদবারে আলতা পরার একটা রেওয়াজ ছিল আমাদের বাড়িতে। রেওয়াজটা মায়ের তরফে সৃষ্ট নয়। রোজ বিকেলে মায়ের কাছে যে একপাল মেয়ের দল আসতো গল্প করতে, তারাই বৃহষ্পতিবার হলে আলতা নিয়ে বসে যেত। তখন আলতার বোতলটা হতো কাঁচের। উপরে একটা কাঠের ছিপি। একটা ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের বাটি থাকত। আর একটা কাঠিও থাকতো আলতা পরবার জন্য। যে কাগজের বাক্সটায় থাকতো বোতলটা, তার ওপরে শতাব্দী রায়ের একটা ঘোমটা টানা ছবি ছিল। মায়ের কাছ থেকে তুলো নিয়ে কাঠির মাথায় জড়িয়ে বেশ একটা তুলি তৈরী করে ফেলতো ওই দিদিরা। ... ...
পুজো শেষ হলেই দুপুরগুলো বদলে যায়। কেমন ওম ওম হয়ে যায় রোদ্দুরটা… চোখে আরাম লাগে। আমার শ্বশুরবাড়িটা মোটামুটি বাগানবাড়ি। একটু ছায়া ছায়া ভাব সারা বাড়িটার গায়ে প্রায় সবসময় লেগে থাকে। পুজোর পরই এ বাড়িতে শীত টুকি দেয়। পামগাছ আর বেগমবাহারের ঝাড় পেরিয়ে নানা রঙের পাতাবাহার আর রঙ্গন লাল সুরকি বিছোনো পথটার দুইদিকে সান্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ... ...
মোহরের অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে সম্ভবত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ বা মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। মনে নেই সঠিক। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড হয়ে গেলাম হঠাৎ। তার অ্যাডমিন ডিক্লেয়ার করলেন যে, তিনি মোহরদের ক্লাস টিচার। অমুক দিন থেকে ক্লাস নেবেন। মেসেজটা একবারে পড়ে বুঝি নি। কয়েকবার পড়তে হয়েছিল। হ্যাঁ, হতে পারে আমি ইংরেজীতে কাঁচা, কিন্তু প্রায় punctuation marks বিবর্জিত সে লেখা উদ্ধার করাও খুব সহজসাধ্য হয়নি আমার জন্য। এখনো ওনার নিজের লেখা পোস্টগুলো আমি ভেঙে ভেঙে, সম্ভাব্য স্থানগুলোতে সম্ভাব্য punctuation marks বসিয়ে পড়ে বুঝবার চেষ্টা করি। ... ...
মার্কন্ডেয় কাটজু বাঙালীদের অপমান করে বেশ ভালো ফুটেজ পাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। লোকটা রসিকতার ছলে আরামসে এবেলা ওবেলা গা জ্বালানি পোস্ট দিচ্ছে। কিছু মুষ্টিমেয় লোকজন প্রতিবাদ করছে, পেজ রিপোর্ট করছে। কিন্তু বাঙালী জনমানসে যতটা আলোড়ন ওঠা উচিত, তার সিকিভাগও দেখলাম না। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষরাই নাকি ভাষা আন্দোলন করেছিলেন?ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে কত কত মানুষ! ভাবা যায়! ... ...
মোহরের অনলাইন ক্লাস হচ্ছে সোম-বুধ-শুক্র। সকাল আটটা থেকে বারোটা অবধি লম্বা ক্লাস রুটিন। আমি আর মোহর মিউট করে ক্লাসে ঘাপটি মেরে বসে থাকি প্রায়ই। সরাসরি আমাদেরকে কিছু জিগ্যেস করলে উত্তর দিই আর কি। বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের দিয়ে 'গুড মর্ণিং' উইশ করে কান ঝালাপালা করে দেয় টিচারের। সেসব শুনে মোহর ফিকফিক করে হাসতে হাসতে আমাকে বলে, "গুড মর্ণিং, মাম্মাম"। আমি ওর কাঁধে ঠোনা মেরে বলি," গুড মর্ণিং, গিণুবাবা"। ... ...