এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আলতুফালতু 

    Sanchayita Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ নভেম্বর ২০২০ | ১০৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • বহুদিন অবধি বাবা আমাদের দুই ভাইবোনের চুল কেটে দিত। আমাদের বাসাবাড়ির ভেতরের উঠোনে ইঁট পেতে তার উপর বসতাম। গায়ে পুরোনো গামছা জড়ানো থাকত। বাবা নিজের দাঁড়ি কাটার কাঁচি আর আয়না নিয়ে আসত। তারপর সামান্য জলে চুল আধভেজা করে দিয়ে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে চুল কেটে দিত। মাথাটা হেমন্তের ফসলশূণ্য ক্ষেতের মতো হয়ে যেত! এটাতে কষ্ট হতো না বড়ো একটা। কষ্ট হতো ন্যাড়া করে দিতো যখন গরমের শুরুতে, তখন। দাঁড়ি কামানোর ক্ষুর দিয়ে নির্দয়ভাবে বাবা ন্যাড়া করে দিত। রুক্ষ চুলের গোছা ছড়িয়ে থাকতো পুরো উঠোন জুড়ে। মরুভূমির মতো মাথা আর এক সমুদ্র চোখের জল নিয়ে বসে থাকতাম ইঁটের ওপর। বাবা হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে লাইফবয় সাবান ঘষে স্নান করিয়ে দিত। কুচো কুচো চুলগুলো সাবানের ফেনায় ভেসে চলে যেত। গা মুছতে মুছতে ভাবতাম, পরের দিন স্কুলে গেলে আবার সবাই কোরাসে "ন্যাড়া ন্যাড়া ন্যাড়া/বেঞ্চির ওপর দাঁড়া" গাইবে! আবার কারণে অকারণে বড়োরা মাথায় হাত বুলিয়ে যাবে!

    সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত বাবা গরমকালে ন্যাড়া আর পুজোর আগে বয়কাট চুল কেটে দিত আমাকে। ভাইয়ের চুল ছিল খাঁড়া খাঁড়া। তাই ওর জন্য বরাদ্দ ছিল বাটিছাঁট। মাঝে মাঝে অবশ্য সেলুনদর্শণ আমাদের ভাগ্যে ঘটেছে। টাউন স্কুলের পেছনে একটা চেয়ার, একটা আয়না, একটা চাঁদোয়াওয়ালা একটা সেলুন ছিল। তার আয়নাটা ঝুলতো যে দেওয়ালে, সেটা মসজিদের পাঁচিল। চেয়ারটা পাতা ছিল যেখানে, সেটা হাউড্রেনের ওপর জমানো স্ল্যাব। যাই হোক, সেখানে ড্রেনের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে চুল কাটানোর সুযোগ ঘটেছে বেশ কয়েকবার। তারপর, মনে হয় মায়ের আপত্তিতেই, আমরা জয়হিন্দ সেলুনে যেতাম। বড়ো রাস্তার ওপর ছোট্ট সেই সেলুনে যেতে আমার খুব ভালো লাগত। কারণ আয়নাঘেরা তিনটে দেওয়াল ছিল সেখানে। কাঠের চেয়ারের ওপর কাঠের পাটাতনে বসে চুল কাটানোর সময় দেখতাম, বাম-ডান-সামনে আয়নাতে আরো তিনটে আমিও একইসঙ্গে চুল ছাঁটাচ্ছে। এতগুলো আমি-র একই পরিণতি দেখে মনে বলভরসা পেতাম আর কী! অবশ্য প্রতিবারই সেলুন থেকে ফেরার পর বাবা নিজের কাঁচি আর চিরুণী এনে ন্যানোমিলিমিটার এবড়োখেবড়ো চুলগুলোকে ছেটে সমান করে দিত। আসলে, আমার বাবা হেব্বি পারফেকশনিস্ট ছিল।

    পিঙ্কুমামাদের বাড়ির নীচে একটা বিউটি পার্লার ছিল। সৌন্দর্যসচেতন মহিলারা সেখানে চুল কাটাতে যেতেন। ভুরু প্লাক, ফেসিয়াল আর চুলে লকস কাটতো যেসব মহিলারা, অন্যরা অবশ্য তাদেরকে খুব বিশ্বাসযোগ্য ভালো মহিলা বলে মনে করত না তখন। সেটা অবশ্য অন্য গল্প। পার্লারের সামনে কাঁচের ডিসপ্লেতে নানা বিউটি প্রোডাক্ট সাজানো থাকত। কাঁচের দরজায় সুন্দরী মডেলের লাস্যময়ী ছবি। সন্ধেবেলায় তার হোর্ডিঙে আলো দিয়ে নাম জ্বলতো 'শ্রীয়া বিউটি পার্লার'। আমার মনে হতো, শ্রীয়া নিশ্চয়ই ওই ছবির মডেলের নাম! এই পার্লারে চুল কেটেই সে অমন সুন্দরী হয়ে গেছে! কতদিনের সাধ ছিল আমার ওখানে চুল কাটানোর। বহু ঝুলোঝুলির পর একবার মা নিয়ে গিয়েছিল ওখানে। ততদিনে বয়কাট থেকে আমি চাইনিজকাটে উন্নীত হয়েছি। বিশেষ কোথাও যাওয়ার সময় তখন দুটো শিং বেঁধে মা আমাকে নিয়ে যায়। আর স্কুলে যাওয়ার সময় মোটা হেয়ার ব্যান্ড। যাই হোক, শ্রীয়া বিউটি পার্লার থেকেও আমি চাইনিজ কাট চুল কেটে ঘরে ফিরলাম। বাবা অফিস থেকে ফিরে নিজের কাঁচি দিয়ে আবার আমার চুল কাটতে বসল। মা'কে ধমক দিয়ে এবং আমার চুলে নিজের চিরুণী প্রয়োগ করে হাতেকলমে বুঝিয়ে দিলো, বেশী পয়সা খরচ করে কত বেশী পরিমাণ এবড়োখেবড়ো চুল কাটা হয়েছে। আমরা বেশ বুঝলাম, আমাদের বিউটি পার্লার অভিযান এখানেই শেষ। জয়হিন্দ সেলুনই আমাদের ভবিষ্যৎ।

    মোহরের আঠারো মাস বয়সে যখন প্রথম চুল কাটাতে নাপিত এলো বাড়িতে, আমার সেদিন ভারি মন খারাপ হয়েছিল। ওর অমন আঙুর থোকার মতো একমাথা রেশম রেশম চুল সাফ করে দিলো যখন, কি অসম্ভব কষ্ট যে হয়েছিল আমার! নাপিত চলে যাওয়ার পর ওকে স্নান করাতে গিয়ে দেখি ঘাড়ের কাছাকাছি এক দু'কুচি চুল লক্ষ্য করেনি নাপিত। আমার অবশ্য খুব আনন্দ হয়েছিল এই অযাচিত ভুলে। ও ঘুমোলে আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম ওর প্রথম চুলের ওই অংশটুকু। তারপর একসময় ওর নতুন চুল গজালো। সেই চুলের কুচি কোথায় মিলিয়ে গেল নতুন চুলের ভিড়ে।

    লকডাউনের আগে আমি আর মোহর হাবিবসে চুল কাটাতে যেতাম। সেটা আমাদের একধরনের আনন্দ ছিল। কারণ চুল কাটিয়ে আমরা আইসক্রিম বা ভুট্টা কিংবা ফ্রায়েড চিকেন খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। এখন তো সেসবের বালাই নেই। এবার গরমকালে আর পুজোর সময় আমিই ওর চুল কেটে দিয়েছি। ইন ফ্যাক্ট নিজের চুলও নিজেই কেটে নিয়েছি। আমার সেসব আনতাবড়ি ছাঁট দেখে শিবাজী হাসে। আমার মা রেগে যায়। আমার শাশুড়ি মা বকাবকি শুরু করে। আমি অবশ্য নির্বিকার থাকি সেসবে। আমি শীতের রোদে পিঠ দিয়ে মোহরকে চেয়ারে বসাই। ক্যান্ডি বা চিপসের লোভ দেখিয়ে ওকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে বাধ্য করি। তারপর আমার ছোট্ট কাঁচি আর মামমামের চিরুণী নিয়ে আলুথালু করে চুল ছেঁটে দিই ওর। দুই জুলপি কখনো সমান হয় না।বামদিকের চুল ডানদিকের চেয়ে বেশী ছোট হয়ে যায়। ক্ষুরের অভাবে ঘাড়ের দিকের চুলের কোনো বাউন্ডারী লাইনের বাপ-মা থাকে না। মোহর মাঝে মাঝে ভীত স্বরে জিগ্যেস করে, "আমার সব চুল কেটে দেবে না তো, মামমাম?" আমি খচখচ করে কাঁচি চালাতে চালাতে ওকে আশ্বস্ত করি, "না না বাবা। একদম নয়"। রঙ্গন গাছে একটা বুলবুলি পাখি এসে বসে। কামিনীর ডালের ফাঁক দিয়ে ঝিলমিলে রোদ আঁকিবুঁকি কাটে মেটে উঠোনে। আমগাছের গুঁড়ি বেয়ে ওঠা চুঁইপাতায় সকালের শিশির চিকচিক করে। হলদে কালো একটা প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় হাসনুহাসার ঝোপে। মোহর গুটুরগুটুর করে গল্প করে মিঠে স্বরে। আমাদের আশেপাশে কখন যেন চুপিচুপি বাবা এসে দাঁড়ায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • r2h | 192.139.***.*** | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:২৭516263
  • ভালো ভালো লেখা মিস হয়ে যায়, অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ে।

    ভালো লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন