এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জন্মদিনের গল্প

    Sanchayita Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ নভেম্বর ২০২০ | ৮৮১ বার পঠিত
  • যে বছর আমার জন্ম হয়েছিল, শুনেছি, সে বছরটা বন্যার বছর ছিল। বন্যার জল বাড়তেই আমার দাদুর পরিত্যক্ত ভিটে থেকে বাবা-মাকে নিয়ে নিজের চাকুরীস্থলে চলে গিয়েছিল ছোটমামা।ছোটমামা তখন চাকুরীরত ও ব্যাচেলর। দুটো চালচুলোহীন শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে, যাদের কাজই হলো সর্বত্র চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে বেড়ানো, তাদেরকে নিজের কাছে রাখার পিছনে মামার নিজস্ব লাভজনক সমীকরণ ছিল। কিন্তু সেটা অন্য গল্প। যাইহোক, মামা স্থানীয় হাসপাতালে মায়ের মেটারনিটি কার্ড করে দিয়েছিল বলে মা আয়রনের বড়িটুকু ফ্রীতে পেত হাসপাতাল থেকে। গোটা প্রেগন্যান্সী পিরিয়ডে মায়ের 'ওষুধ খাওয়া' বলতে ওটুকুই।

    পুজোর পর যখন বন্যার জল সরতে শুরু করলো, মামা অম্লানবদনে আদেশ করলো, "এবার তোরা গ্রামের বাড়ি ফিরে যা। কেউ তো দেখার নেই ভিটেটা"। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো মামার দিকে, "কিন্তু এখানে তো হাসপাতালে কার্ড করা হয়ে গেছে। আর দিনপনেরো পরই তো ডেট দিয়েছে!" বাবা অবশ্য কিছু বললো না। বেকার ছেলেমেয়েদের কোনো এমারজেন্সিই গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধু পরেরদিন সাত ঘন্টা ট্রেনে বাসে সময় কাটিয়ে মাকে নিয়ে দাদুর ভিটেতে ফিরে গেল।

    বন্যার জল সরে যাওয়ার পর পলিপড়া উঠোন! আসন্নপ্রসবার জন্য ডেথট্র্যাপ। বাবা কোত্থেকে খানিক কাঠের তক্তা এনে ঢোকার মুখ থেকে উত্তরের ঘর পর্যন্ত পেতে দিলো। মা তার ওপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে হেঁটে ঘরে গিয়ে উঠলো। ঘরে তো এলো, কিন্তু খাবে কি? মায়ের প্রতিবেশী এক কাকিমা প্রস্তাব দিলো তাদের বাড়িতে কয়েকদিন খাওয়াদাওয়ার জন্য। অবশ্যই কন্ডিশন অ্যাপ্লাইজ! সেটা অবশ্য অন্য গল্প। যাই হোক, দিন এগোতে লাগলো। বাবা পরিত্যক্ত ভিটেকে বাসযোগ্য করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।

    যেদিন আমার জন্ম হয়েছিল, সেদিন মায়ের খুব ইলিশ খাওয়ার শখ হয়েছিল। বাবা কোত্থেকে ইলিশ জোগাড় করেছিল জানি না। কিন্তু কাঁচালঙ্কা কালো জিরে দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল আর গরম ভাত খাওয়ার সৌভাগ্যে মা যখন অভিভূত, ঠিক সেসময়ই মায়ের ব্যথা উঠলো। হাসপাতালে যাওয়ার আর্থিক সম্বল নেই। তাই গ্রামের একমাত্র ধাত্রী আর একমাত্র হাতুড়েকে বাবা ডেকে আনলো। ষোলো ঘন্টা টানা ব্যথা সহ্য করে অসংখ্য নাড়ী প্যাঁচানো আন্ডারওয়েট এক শিশুকে ভূমিষ্ট করানো বড়ো মুখের কথা নয়!তাও আবার বাড়িতে! এরপর যদি প্ল্যাসেন্টার কিছু অংশ মায়ের শরীরে থেকে থাকে আর সাতদিনের বাচ্চাকে প্রতিবেশীদের কাছে ফেলে মাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, সে আর অবাক হওয়ার কি বিষয়! কিন্তু সেটা অন্য গল্প। এই গল্প যার কাছে শোনা, তার স্মৃতি অনুযায়ী, আমার পৃথিবীতে আসার গোটা সময়টাই বাবা উঠোনের এককোণে দাঁড়িয়ে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছিলো আর নিঃশব্দে চোখ মুছছিল মাথা নীচু করে।

    শেষ দুপুরে আমার জন্মের পর প্রতিবেশী, ধাই, হাতুড়ে সবাই ফিরে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে। উত্তরের ঘর থেকে এখনও বন্যার গন্ধ যায়নি। মেঝে জোড়া কাঠের পাতের ওপর দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা। উঁচু তক্তপোশে একদম মাঝখানে ন্যাকড়ায় মোড়া এক শিশু ঘুমোচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলছে। অন্য সদ্যোজাতদের চেয়ে লম্বায় এই শিশু বেশ খানিকটা বড়। কিন্তু তার মায়ের তো ডিম-দুধ-আদর জোটেনি গোটা প্রেগন্যান্সিতে, তাই বাচ্চারও হাড়ের ওপর ঝুলঝুল করছে চামড়া।... ঝিঁঝির ডাকে কান পাতা দায়। ঘরে হ্যারিকেনের নরম আলো। শিশুটির একপাশে ক্লান্ত মা, আরেকপাশে হতভম্ব বাবা। তারা এতো ছোট বাচ্চা আগে কখনো ধরেনি। জানে না লালনপালনের নিয়ম। তারা জানে না, স্থায়ীভাবে শিশুটির জন্য কোনো অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা তারা করতে পারবে কি না। তারা এতটুকুই জানে, তাদের চালচুলোহীন বেকারত্বময় জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবে এক সম্পদ যোগ হয়েছে। যে সম্পদের কোনো মূল্য নেই অন্য কারো কাছে। কোনো দাদু-দিদা-ঠাকমা-ঠাকুরদা-পিসি-কাকা-মামা-মাসি নেই তাকে দাবী করার… যত্ন করার… ভালবাসার। তাই তাকে আগলে রাখার দায়িত্বের চেয়ে বড়ো দায়িত্ব এই মুহূর্তে আর তাদের জীবনে নেই… কখনোই ছিল না। …সন্ধ্যা গাঢ় হচ্ছে। কাদের বাড়ির শাঁখে ফুঁ পড়লো। কোথাও থেকে বুঝি উলুধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে। কাঁসরঘন্টা বেজে উঠলো কোথাও। এই মুহূর্তটা… ঠিক এই মুহূর্তটা দু'টো অপাংক্তেয় মানুষের কাছে কিভাবে ভাস্বর হয়ে উঠলো, সেটা গোটা পৃথিবীর কেউ জানলো না… কেউ না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন