এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিজয়ার লেখা

    Sanchayita Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ অক্টোবর ২০২০ | ১৩২১ বার পঠিত
  • আমার মা এয়োস্ত্রীর আচার নিয়ে খুব একটা অবসেসড্ ছিল না কোনোকালেও। তবুও বিষ্যুদবারে আলতা পরার একটা রেওয়াজ ছিল আমাদের বাড়িতে। রেওয়াজটা মায়ের তরফে সৃষ্ট নয়। রোজ বিকেলে মায়ের কাছে যে একপাল মেয়ের দল আসতো গল্প করতে, তারাই বৃহষ্পতিবার হলে আলতা নিয়ে বসে যেত। তখন আলতার বোতলটা হতো কাঁচের। উপরে একটা কাঠের ছিপি। একটা ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের বাটি থাকত। আর একটা কাঠিও থাকতো আলতা পরবার জন্য। যে কাগজের বাক্সটায় থাকতো বোতলটা, তার ওপরে শতাব্দী রায়ের একটা ঘোমটা টানা ছবি ছিল। মায়ের কাছ থেকে তুলো নিয়ে কাঠির মাথায় জড়িয়ে বেশ একটা তুলি তৈরী করে ফেলতো ওই দিদিরা। তারপর ছোট্ট ওই বাটিতে আলতা ঢেলে তুলিটা ডুবিয়ে দিতো তাতে। ধপধপে সাদা তুলো মুহূর্তে লাল হয়ে উঠতো। সেই টকটকে লাল আলতা পায়ে ছোঁয়ালেই কেমন দেবদেবীর পায়ের মতো হয়ে যেত ওদের পাগুলো। আর চোখেই পড়তো না ওদের এবড়োখেবড়ো নখ, ফাটা গোড়ালি, চওড়া পাঞ্জা। ওরা কেউ মোটা করে রং টানতো পায়ের সীমারেখা বরাবর। কেউ সরু করে টেনে পায়ের পাতার ওপর বিন্দু বিন্দু আলতা দিয়ে ফুল বানাতো। কেউ আবার তুলো সরিয়ে শুধু কাঠিটা আলতায় চুবিয়ে সরু সরু ঢেউ ঢেউ নকশা আঁকতো পায়ের সীমানা ধরে। ঢেউয়ের ফাঁকে ফাঁকে একটা দুটো বিন্দু, কুচো কুচো ফুল, একফালি চাঁদ, ছোট্ট ছোট্ট প্রদীপ আরও কত কি নকশা! পায়ের আঙুল আলতায় ঢেকে ফেলতো কেউ কেউ। মনে হতো আলতায় বুঝি পা চুবিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আলতা পরতে পরতে ওদের বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতো। পাড়া জুড়ে শাঁখে ফুঁ পড়ে যেত। পিসিমণিদের সজনে গাছের মাথায় পুঁচকে একটা চাঁদ উঠতো। টিভিতে 'খাসখবর' শেষ হয়ে 'জন্মভূমি'র টাইটেল ট্র্যাক শুরু হয়ে যেত। সেইসব মেয়ের দল তাদের অগোছালো ওড়না, এলো চুল, জমানো গল্পের সাজি জড়ো করে যে যার ঘরে ফিরে যেত। আমরা বইপত্র নিয়ে পড়তে বসতাম বাসাবাড়ির একমাত্র শোবার ঘরের বিছানাটায়।

    বাসাবাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে চলে আসার পর সেই আলতা পরার আড্ডাটা আর জমে নি। সেইসব মেয়ের দল চলে গেছে যে যার পথে। বহুদিন পর পর তাদের কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়। ছেঁড়া ছেঁড়া কথা হয়। পরস্পরকে নিমন্ত্রণ করি আমরা।
    -"এসো কিন্তু।"
    -"হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবো।"

    যাওয়া হয় না। ভুলে যাই। জীবন চলতে থাকে। বছর বছর লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজো, দুর্গাপুজোয় আলতাগুলো জমে ওঠে ঠাকুরঘরে। শুধু বিজয়া দশমীর বিকেলে খোলা হয় সেগুলোর কাগজের খোলস। প্রতিবারই অবাক হয়ে দেখি কাঁচের বোতলটা কবে যেন প্ল্যাস্টিকের হয়ে গেছে। আলতা ঢালার ছোট্ট বাটি আর কাঠিটা আর দেয় না কোম্পানী। ধূপকাঠির ওপর তুলো জড়িয়ে তুলি বানাই। তারপর সেটা আলতার বোতলে চুবিয়ে কলাপাতার ওপর লিখিঃ

    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'
    'শ্রী শ্রী মা দুর্গা সহায়'

    শাঁখে ফুঁ দেয় মা। প্রদীপ জ্বালে কাঠের সিংহাসনের সামনে। ছাতিমের গন্ধ মেখে পেলব সন্ধে নামে। কিচিরমিচির করে পাখির দল ঘরে ফেরে। ভাসান শেষে ঘরে ফেরে সিঁদুর মাখা মেয়ে-বৌদের দল। মোহর এক চোখ কৌতুহল নিয়ে জিগ্যেস করে, "ওটা কি লিখছো মাম্মাম?"
    - "দুর্গানাম। পরের বছর তুমিও লিখবে। আমি শিখিয়ে দেবো।"
    ঝলমল করে ওঠে ওর মুখ। টুকটুকে আলতার দিকে তাকিয়ে থাকে জুলজুলে চোখে।
    - "পরবি?"
    উৎসাহে মাথা নাড়ে মেয়ে। একটু তুলো আলতায় ভিজিয়ে ওর ছোট্ট ছোট্ট পায়ের সীমারেখা রাঙিয়ে দিই। খুদে খুদে আঙুলগুলো রঙিন করে দিই। পায়ের পাতাদুটোয় বড়ো বড়ো লাল ফোঁটা। ঠাকুরঘরের সাদা মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা আলতা পড়ে থাকে। ইচ্ছে করে মুছি না। মোহর তার টুকটুকে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে খুশীমনে। আলতো করে উঠে দাঁড়ায় দেবীর মতো পাজোড়া নিয়ে। তারপর ঘরে পরার চটিজোড়া হাতে নিয়ে আলগোছে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। পাছে জুতো পরলে অমন রং ঘেঁটে নষ্ট হয়ে যায়!

    ।।শুভ বিজয়া।।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন