মাটি ভাগ হয়, দেশ ভাগ হয়, মানুষ, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন, পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জন্ম জন্মান্তর ধরে গড়ে ওঠা গ্রাম, ঝিল, পুকুর, বনবাদাড়, ঘরবাড়ি বিদীর্ণ করে দেয় দিল্লির শাসকের কাঁচি। দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী আসিফ সামিনার পরিবার এপার-ওপার হয়ে যায়, তাদের সদ্য প্রস্ফুটিত প্রেমের মাঝে রাষ্ট্র খুঁটি পুঁতে দেয়। প্রবল ঝুঁকি নিয়ে তারা খণ্ডিত হয়ে যাওয়া নাজির বিলের কাছে দেখা করে, সুখী দাম্পত্যের স্বপ্ন দেখে, তারপর একদিন সীমান্তরক্ষীর গুলিতে দুই উজ্জ্বল তরুণ তরুণী পাচারকারীর লাশ হয়ে যায় .... সম্পাদক বিমল চক্রর্তীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, কারণ ত্রিপুরার দেশভাগের গল্প একসাথে গ্রন্থিত হয়েছে এরকমটা অন্তত এই প্রতিবেদকের আগে কখনো নজরে আসেনি। সেদিক থেকে এই সংকলনটি অনন্য ... ... ...
দেবেশ রায়, এডোয়ার্ড সয়িদ-এর কালচার অ্যান্ড ইমপিরিয়ালিজম বই থেকে তুলে এনেছেন ইতিহাসের এক নৈর্ব্যক্তিক সত্য – “সাম্রাজ্য বস্তুত এক প্রলম্বিত নৈতিক কর্তব্য।” সেই কর্তব্য পালনের জন্যেই অধীনস্থ, নীচ, পশ্চাৎপদ জাতিগুলিকে শাসন করতে হবে। আর এই ‘নৈতিক কর্তব্য’ সাধন করতে গিয়েই ব্রিটিশ শাসকেরা উপমহাদেশের ক্ষমতালোভী কতিপয় রাজনৈতিক নেতার যোগসাজশে ঘটিয়ে তুলতে পারল এমন এক অভাবিতপূর্ব ঘটনা – দেশভাগ। ভারত-চেতনার হত্যা ঘটাতে তারা ঠেলে দিল আমাদের গৃহযুদ্ধে, দাঙ্গায়। রক্তপাত, অবিশ্বাস, ঘৃণার লাভাস্রোতে ছাই হয়ে গেল সাধারণ কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন আর ভবিষ্যৎ। এমন চিরস্থায়ী সেই অভিঘাত যে, সাত দশক পার হয়েও সেদিনের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে আমাদের লেখায়, চেতনায়। ... ...
কেন্দ্র রাজ্যের পুনর্বিন্যাসের দাবিতে রাজ্যে গড়ে উঠল আন্দোলন। জ্যোতি বসু প্রমোদ দাশগুপ্ত অশোক মিত্র তাকে অন্য ভাষা দিলেন। জ্যোতি বসু বললেন, খানিকটা যেন মুজিবের স্বরেই, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে টাকা ছাপানোর মেশিন আছে। ওদের যখন ইচ্ছে টাকা ছাপিয়ে নেয়। রাজ্য সরকারকে ভাগ দেয় না। আর রাজ্য সরকারের হাতে টাকা ছাপানোর মেশিনও নেই।' স্বর আরেকটু উঁচু পর্দায় যেতে পারত। গেলে দেশের মঙ্গল হতো। গেল না। কারণ সর্বভারতীয় হতে চাওয়ার দায়। অমল সরকার লিখেছেন: কংগ্রেস, বিজেপি যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, রাজ্যগুলিকে শোষণ করেছে। রাজ্যগুলিকে একদিকে রাজস্বের ভাগ কমিয়ে দিয়ে বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার সীমা স্থির করে দেওয়ার পাশাপাশি নানা শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যে হাজার হাজার কোটি টাকা ( এখন লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা; গত সাত বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ বেড়েছে ৪৯ লাখ কোটি থেকে বেড়ে এক কোটি দুই লাখ কোটি টাকা) ঋণ নিচ্ছে তা নিয়ে জবাবদিহির বালাই নেই। ... ...
একের বিপরীতে অন্য কাউকে দাঁড় করানো যে আমাদের শেষ পর্যন্ত ঠেলে দেয় ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইয়ের ঢাকা শহরে, ইলিয়াসের মতো সর্বদ্রষ্টা লেখক তা জানতেন। তিনি কেবল করেছেন সেই কাজটিই, যা করতে পারেন সৎ এবং মহৎ সাহিত্যিকেরাঃ ভাষাহীনকে ভাষা দেওয়া। কালাম মাঝি হোক, কি শরাফত মণ্ডল; কম্যুনিস্ট পার্টির ছোকরারা হোক কিংবা মুসলিম লীগের চ্যালারা; ইলিয়াস ব্যাক্তির ওপর কোনো সত্য আরোপ করেননি। তিনি কেবল সমষ্টির মাঝে ব্যক্তির আকাঙ্খার সাথে সমাজের বৈষম্যের পার্থক্যটাই এঁকে গেছেন। লেখার টেবিলকে ইলিয়াস পল্টনের ময়দান করে তোলেননি। ফলে, উদ্দিষ্ট এই উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের এন্টি-থিসিস; এমন কথা যে ইদানিং শুনতে পাই, সাহিত্যের পাঠক হিসেবে তখন আহত না হয়ে আর উপায় থাকে না। ... ...
৭৫ বছরে কিছু পাল্টায়নি, কারণ আমাদের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো অনড় হয়ে আছে ঘৃণার পাহাড়। পাল্টাতে হলে সেটাকে সরাতে হবে। দাঙ্গার আগুন আর রক্ত সত্য, সত্য মানুষের নিষ্ঠুরতা। কিন্তু তাকে পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো 'তবু', যেগুলোর কাছে যাওয়া খুব কঠিন কাজ। কিন্তু এমন মানুষ তো বিরল নন, যারা দাঙ্গায় সর্বস্ব খুইয়েছেন, কিন্তু তবু সাম্প্রদায়িকতাকে মনে স্থান দেননি। এখনই মনে পড়ছে সদ্য প্রয়াতা সীমা দাসের কথা যাঁর আত্মজৈবনিক "দ্যাশ থেকে দেশে" বইটি প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল। মিহির সেনগুপ্তের সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, অমর মিত্রের দেশভাগ-বেদনার উত্তরাধিকার পড়লেই বোঝা যায় উভয় পক্ষেরই দাঙ্গা-উত্তর মানসিকতা কী হওয়া উচিত। এই আগুন ও রক্ত আর ঐ 'তবু'র মধ্যে নিরন্তর দোল খায় যে পেন্ডুলাম তার নাম মানুষের মন। যখন সে থামে, দেখা যায় তা নিশ্চিত হেলে আছে 'তবু'-র দিকেই। ... ...
হায়দারের উপন্যাসের পাঠক-মাত্রেই জানেন, অজস্র চরিত্র ও দ্রুতগামী ঘটনাক্রমের সাথে তাল রাখতে গেলে পাঠককে সদা সতর্ক থাকতে হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, তাদের সামাজিক অবস্থা, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরগুলির মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া – এমন অনায়াস বয়ানে বুনে চলেন, যেন এক মহানদী – যাতে এসে মিশছে শাখানদীরা, বেরিয়ে যাচ্ছে উপনদীরা, আবার ঘুরে এসে হয়ত মিশছে মূল নদীতে। এই বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক স্তরের চরিত্রগুলো এত নিখুঁত বিস্তারিত – তাদের প্রায় রক্ত-মাংসের মানুষের মতই অনুভব করা যায়। এই উপন্যাসে রসবোধ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। এক প্যারাগ্রাফ পড়ে হেসে ফেলতে না ফেলতেই, পরের প্যারাগ্রাফ প্রায় বিধ্বস্ত করে দেয়। অথচ কোথাও একটুও তাল কাটে না, একটুও আরোপিত মনে হয় না। ... ...
সূর্য দীঘল বাড়ি। যে আয়তাকার বাড়ির দুই সমান্তরাল দীর্ঘ বাহু পূব থেকে পশ্চিমে টানা। এই ধরণের বাড়িতে থাকে স্থায়ী অমঙ্গলের ছায়া। এখানে কেউ বেশিদিন টিকতে পারে না, নইলে নির্বংশ হয়। এইখানটায় এসে আমি থমকে যাই। জীবনে একটাই বাড়ি বানিয়েছিলাম – আরে সেটাও তো ছিল এক সূর্য দীঘল বাড়ি! সে বাড়িতে কতদিন ছিলাম? মাত্র দশ বছর। আমার পেছনের আরেক সূর্য দীঘল বাড়িতে দুই ছেলে মারা যাওয়ায় বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। কেনে আমার পরিচিত এক উদীয়মান কবি। একবছরের মধ্যে মারা যায় রক্তবমি হয়ে। তবে কী - ! ... ...
বাষট্টি অধ্যায়-বিশিষ্ট ৩৩৬ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির পট উত্তোলিত হয় বীরাঙ্গনা দাসীর প্রসঙ্গায়নে। বীরাঙ্গনা নামটি আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় মাইকেল সৃষ্ট বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুন্তলা, তারা, রুক্মিণী, কেকয়ী, সূর্পনখা, দ্রৌপদী, ভানুমতি, দুঃশলা, জাহ্নবী, উর্বশী, জনাকে। এই বীরাঙ্গনা ওপার থেকে এপারে এসেছে, পুত্র বা কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল; কিন্তু কলকাতা, বসিরহাট, অনায়াস যাতায়াত করেছে। তার নিরন্তর পথিক বৃত্তি, সবাইকে হাস্যমুখ করানাের চেষ্টা বিস্মিত করে। কিন্তু সাদা থান, সেমিজ, বগলে পুঁটলি নিয়ে প্রৌঢ়া কপােতাক্ষ স্বপ্নে বিভাের, মধুসূদনের রচনা, মধুজীবনী সে লােকজনকে শুনিয়ে বেড়ায়, মধুজীবন ও রচনা পাঠে বালক বৃদ্ধ সকলকে উৎসাহ জোগায়। তার এই নিরন্তর মাইকেলচর্চা নিজের ও অন্যের দুঃখ ভােলায়। ইনি নাকি মাইকেলের দৌহিত্রী, সবার কাছে মাইকেল দিদিমা। আর অসম্পৃক্ত পাঠকের কাছে বীরাঙ্গনা মাইকেল প্রসঙ্গের চারণ কবি, ফরাসী এবাদুরদের মতােই। পুত্র কোর্টের মুহুরি, মেয়ের শ্বশুর বাড়ি দিল্লিতে। পথপরিক্রমা জীবনেরই, বুড়ি বীরাঙ্গনাকে মাইকেল উদ্বুদ্ধ করে, কপােতাক্ষ তাকে দেয় স্নেহ ও বিষাদ। তবে বিরলে ছাড়া এ অনুভব জাগে না। নিরন্তর তার চোখ ছলছল করে - "কেমনে ফিরিব—হায়রে কে কবে মােরে, ফিরিব কেমনে শূন্য লঙ্কাধামে আর।' বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ-দুটোই শূন্য হয়ে গেছে তার মতে। দিদিমা অভিরামের বেলগাছিয়ার বাড়িতে প্রায়ই এসে ওঠে, যেন আপনজন। হাবুলের পাকিস্তান মানি না জেহাদ বুড়ি মানে না। চারপাশের লোককে সময়ে অসময়ে সে মধুজীবন, মধু রচনা শোনায়। ... ...
বিত্তহীন একটি পরিবারের সবচেয়ে বড় বিত্ত হল আবেগ। কাঁধ-উঁচো থালাখান, ছিক্ষেত্তরের বাটিখান, তেঁতুলের আচারের ঠিলেডা বা পুরনো একটু ঘি --সবকিছু বস্তায় ভরে নিয়ে গেলেও, ওদের মন-মগজে স্মৃতি জট পাকিয়ে রয়। কী যেন ফেলে যাচ্ছে! পুরুষ-পুরুষের পায়ের ছাপ পড়ে আছে যে বাড়ির আনাচেকানাচে, তার ধুলোটুকুও যেন আগল হয়ে সামনে দাঁড়ায়।....গল্প এগোয়। এগোয় কুঁড়োরামের পরিবার। ... ...
বইটি পড়তে পড়তে আচ্ছন্ন লাগে, প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত হই। একেবারে তরতরে সাহিত্যিক বাচনে গল্পচ্ছলে যেন লেখা হয়েছে বিবরণগুলি। ফলত ইতিহাস হয়ে উঠেছে জীবন্ত, সজীব, নড়ে চড়ে বেড়ানো। আমাদের পড়া যাবতীয় পুরনো সাহিত্যকর্ম, নানা গল্প উপন্যাসে যে বিন্দু বিন্দু পার্টিশন-যাপন, তার যাবতীয় ফাঁক-ফোকর পূর্ণ করার দায় নিয়ে এসেছে এই বই। এই বই আসলে চেয়েছে নিজের শর্তে কথা বলতে, নিজের মত করে চলতে চেয়েছে গদ্যের ভেতর দিয়ে। কোন নস্টালজিয়াকে প্রশ্রয় দেয়নি, একপেশে গল্পও বলতে চায়নি - যেখানে কোনও একটি ধর্মের মানুষই উৎপীড়িত...। এখানে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ এই তিন গোষ্ঠীর মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখের গল্প থেকে যায়। এই গল্পগুলো জুড়ে জুড়ে একটা ছিন্নভিন্ন সময় ও ছিন্ন জনজাতির কথা চলে আসে। একরকম শারীরিক বেদনাবোধ জাগে, ভেতরে ভেতরে ক্ষত বিক্ষত লাগে - কেননা আমার পরিবারও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উচ্ছিন্ন পরিবার। ... ...
"আমাদের দেশভাগ এক জটিল, বহুস্তরীয় ইতিহাস। বিভিন্ন ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথায় তার বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে। কোনও একটি লেখা তো তার সব কোণ ধরতে পারে না। তার উপর উদ্বাস্তু শব্দটা তো আর কোন সমসত্ত্ব গোষ্ঠীকে বোঝায় না। বিভিন্ন জাত-ধর্ম-লিঙ্গ-দেশ-কালের স্থিতির ভিত্তিতে একেক জনের দেশভাগের স্মৃতি একেক রকমের। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন লেখা জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় এক রক্তমাখা ইতিহাস। সেখানে হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, সাফল্য আর ব্যর্থতার কাহিনি। যে দেশভাগ মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণ বাঙালি পুরুষের কাছে ধন-মান-প্রাণ নিয়ে পলায়ন, এবং পরবর্তীকালে এক ধরণের স্মৃতিমেদুরতার জন্মদাতা, সেই একই দেশভাগ অন্য অনেক মেয়েদের ব্যক্তিগত যাতনার উৎসমুখ।" জ্যোতির্ময়ী দেবীর "এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা" আর গোপালচন্দ্র মৌলিকের "দেশভাগ ও ননীপিসিমার কথা" - পড়লেন স্বাতী রায়। ... ...
"উদ্বাস্তু কলোনি পত্তন ঘিরে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট, ডান-বাম রাজনৈতিক বিরোধ, দলাদলি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত কোঁদল, নেতাদের দাপট- দুর্নীতি- ধান্দাবাজি ছিল। কিন্তু সেটাই সমাজে নির্ধারক ছিল না। জমিদারের গুন্ডা-পুলিশের সঙ্গে যুঝে রাতপাহারার ফাঁকে জলজংলা, পতিত জমি দখল করে নয়া বসত পত্তন ও ভিটেমাটির বিলি-বন্দোবস্তের কালে নানা মতের পূর্বপুরুষদের যূথবদ্ধ অস্তিত্বের লড়াই এখন পুরাকথার সামিল।" উদ্বাস্তু কলোনির কথা : একটি স্মৃতিকথা সংকলন - বইটি নিয়ে লিখলেন বিশ্বজিৎ রায়। ... ...