এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • মন নিয়ে কথকতা

    Swastisobhan Chaudhuri লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | ৩২৩৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Swastisobhan Chaudhuri | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:২২374017
  • প্রসঙ্গ শুরু করার আগে একটা স্বীকারোক্তি খুব প্রয়োজন। আমি এই ধরনের অনেক প্রসঙ্গ শুরু করেছি। আলস্য ইত্যাদি কারণে অনেকগুলি শেষ করা হয়নি। অন্তত দুটি ক্ষেত্রে শেষ পর্যায়টি না লিখেই ছেড়ে রেখেছি। আর দুএকটায় শুরুটুকুই কেবল করেছি। আজ যে প্রসঙ্গের অবতারণা করছি তাও শেষ অবধি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলতে পারে। তবু নতুন ধরনের লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। এটাকে একটা disclaimer হিসেবে গণ্য করা হোক।

    #মন_নিয়ে_কথকতা

    প্রাক তথা প্রথম পর্ব

    মনটা একটু খিটকেল করে শুরুটা হল তো, সেই ভালো। মন্দের ভালো। ভালোর ভালো তো কিছু হয়না। (শিব্রাম উবাচ)

    আমি পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সম্ভবত, বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। কারণ আমার নিজের মনটাকেই তো ভালো বশে আনতে পারি না। কেউ কি পারে??

    আমাদের একটা চলতি নাম আছে, 'পাগলের ডাক্তার'। আমজনতার কাছে তো বটেই, বহু চিকিৎসক বন্ধুর কাছেও। আর 'শা.., পাগলের ডাক্তার, পাগল', এমন কথাও যে শুনতে হয়নি বা হয়না, তাও নয়। কিন্তু আমাদের অভিধানে এই 'পাগল' কথাটাই একটা নিষিদ্ধ শব্দ। যতক্ষণ না একজন মানুষকে তার সমস্ত রকম অস্বাভাবিক আচরণ স্বত্বেও একজন মানুষের স্বীকৃতি না দিতে পারছি, ততক্ষণ চিকিৎসার প্রাথমিক ধাপেই হোঁচট খেতে হবে। আমি এটুকু জানি, যে কি ওষুধ প্রয়োগ করলে এই মানুষটির অস্বাভাবিক আচরণের খানিক নিবৃত্তি ঘটবে, কিন্তু তার আগে তাকে একজন অসুস্থ 'মানুষ' হিসেবে চিহ্নিত করাটা বেশী জরুরী।

    যখন এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি, তখন পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টার মশাই, Malay দা প্রথমেই যেটা বলেছিলো সেটা একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ন কথা। এই বিষয়টা নানাদিকে ছড়িয়ে আছে, 'Abstract' ভীষণ, একে একটা সীমার মধ্যে বাঁধাটাই চিকিৎসক হিসেবে আমাদের কাজ, আমাদের চ্যালেঞ্জ। তাই বলে অসীমের খোঁজ নিতে হবে না তা নয়, বরং বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মনোজগতের বিষম আচরণের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সেগুলোর ছন্দেই 'সীমা' কে চিহ্নিত করতে হবে। যেন কবিগুরুর বাণী, "সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর"...

    যাক, অনেক আদ্যোপান্ত, ইতিবৃত্তান্তের চরকা কাটা হলো। আসলে কাজটা হলো মনকে নিয়ে। তা, মনটা আসলে কি? শরীরের কোথায় তার অবস্থান? সত্যি কি সে আছে, নাকি বায়বীয়? এসব নানা প্রশ্নের উত্তরে নানা "হু" "হা" জাতীয় উত্তর হয়। কিন্তু সেসব উত্তরে কাজ নেই। 'মন চল নিজ নিকেতনে'!

    নিকেতন হল মস্তিষ্ক, তার মধ্যেকার রাসায়নিক গতি প্রকৃতি, চিন্তা বা আবেগের উদয়, স্মৃতির কলা কৌশল, পারিপার্শ্বিকের অনুরণন, ভ্রান্তি বা বাস্তব, কত্ত কি!! এইসবের মধ্যে মনের ভাষ্য, কখনো কবিতায়, কখনো গদ্যে, কখনো সুরে, কখনো বা বেসুরে। কখনো বা সমাজের আস্ফালন, কখনো বা তার নিষ্ক্রিয়তা। এইসব নিয়েই মনের ছন্দ। বিজ্ঞানীরা অতিসচল যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অস্তিত্বের গতিপথ খোঁজেন, সে প্রক্রিয়া সত্য বটে, তবে মহাসত্য নয়!!

    না না, অত জটিল গল্প দিয়ে লাভ নেই, বরং গরুতে ফিরে আসি, তা সহজপাচ্য, সহজবোধ্যও বটে।

    যেমন, আমার কাছে একজন অনেকদিন আসেন, রোগী বলবো না, তাতে অসম্মান হয়। তিনি বেশ কিছুদিন পরে এসে যা জানালেন, তা হলো... ভালোই তো ছিলাম, ওষুধও খাচ্ছি, কিন্তু কিছুদিন আগে বড় জার্সি গরুটা মরে গেলো। আহা কি ভালো গরু ছিলো, দিনে দশ লিটার দুধ দিতো, তারপর থেকেই...। ওনার স্বামী ঘাড় নাড়লেন, মানে এটি ঘোর বাস্তব। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় এতটা মুহ্যমান হওয়া তত বাস্তব নয়। তাই, আবার দ্রুত আমার স্মরণ!!

    যাক সেকথা, আরেকজন বাবাকে নিয়ে এসে কথাপ্রসঙ্গে বললেন, বাড়িতে যখন গরু ছিলো বাবাই দেখতেন। বাবা অশক্ত হয়ে পরায় সেসব বাদ। আর এখন তো... এই বাবার এখন স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, কিছুই মনে থাকে না, এমনকী গরু পালনের কথাও কষ্ট করে....

    যাক, মনের গরুকে গাছে চড়ানো আমার উদ্দেশ্য নয়। যদি ভুলবশত চড়ে গিয়েও থাকে তবে নামাতে হবে....

    সেসব অনেক কথা, আরো বেশ কিছু কথা। সেগুলো নাহয় পরের দিন, পরের পর্যায় বা কিস্তিতে!!!...
  • pi | 57.29.***.*** | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৭:১১374022
  • পরের কিস্তি কই ?
  • dc | 132.164.***.*** | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৮:৪৯374023
  • মন নিয়ে কাছাকাছি তুমি আছো আমি আছি পাশাপাশি।
  • Swastisobhan Chaudhuri | 127.2.***.*** | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১১:৩১374027
  • #মন_নিয়ে_কথকতা

    দ্বিতীয় পর্ব

    "রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা".... কালজয়ী লাইন। কিন্তু 'অন্তর' মানে মন কোথায়? কোথাও যদি ঠিক করে না থাকে, তাহলে ব্যথা হবে কেমন করে? আর যদি ধরে নিই, মনের ঠাঁই মাথায়, তাহলে কি এটা আসলে 'মাথার ব্যথা'?

    না:, এগুলো বুঝি ঠিকঠাক ব্যাখ্যা হচ্ছে না!

    প্রেম করেছেন? প্রেমে ঝাড় খেয়েছেন? উত্তর সব 'হ্যাঁ' হলে আপনি এই 'অন্তরের ব্যথার' ব্যাপারটা জানেন। ভালো করে জানেন। এই ব্যথাটা ঠিক হাত কেটে গেলে, ছড়ে গেলে, 'গোটা অঙ্গে বোরোলিন' মেখে নেওয়ার মতো ব্যথা নয়। এটা একটা প্রাণ হু হু করা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, চোখ জলে ভরে আসা, সবকিছু অর্থহীন ভেবে পৃথিবী ছেড়ে পালানোর ইচ্ছের ঝড় তুলে আনা 'ব্যথা'...

    ঠিক ব্যথা নয়, একধরনের কষ্ট, মন ভালো না লাগা যন্ত্রণা, বিষাদ, যা স্থায়ী হলে ডেকে আনতে পারে এক দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যার (অসুখ শব্দটা ইচ্ছে করেই বাদ দিলাম।), সেটা হচ্ছে 'মানসিক অবসাদ'।

    পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্ততঃ ১০-১২ শতাংশ এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদের শিকার হন। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে কি হবে?? সাময়িক অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলোর সংখ্যা তো আরো অনেক বেশী!

    নিজের আত্মীয় প্রিয়জনকে নিয়ে শ্মশানে গেছেন বা গোর দিতে গেছেন কবরস্থানে, এমন মানুষের সংখ্যা, যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে কম নয়। আমি, এমনিতে অনেকবার গেছি, প্রথম বোধহয় একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময়, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মরদেহ নিয়ে।

    বছর দেড়েক আগে যখন নিজের মাকে নিয়ে গেলাম, দেহটি পরে আছে, বৈদ্যুতিক চুল্লীতে অন্য মৃতদেহ, আমার সমস্ত সত্তা তখন এই বিমূর্ত বেদনায় খানখান হচ্ছিলো, মায়ের পাশে বসে। একটা কিরকম দলা পাকানো ভাব!!

    আবার সেইদিন ইমার্জেন্সিতে একদল রাজনৈতিক মস্তান (স্বঘোষিত সমাজসেবী!!) মুখে কিঞ্চিৎ বিজাতীয়, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ, ঠিক যেনো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে এসেছে, আমাকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিতে দিতে এসেছিলো। আমার 'অমানবিক' গালে, গলায় ক্ষুরের মতো হাত বুলিয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিলো, 'লাশ' ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলো, তখনও একটা অদ্ভুত নিস্ফল রাগ, এইরকম একটা অসার যন্ত্রণার মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছিলো মনের গভীরে। এরকম 'বোধ'-এর স্বীকার আমরা প্রায়ই হই, প্রায় সকলেই, কোনো না কোনো সময়ে।

    তারপর, এই সঙ্কট কখনো সর্বব্যাপী হয়ে সমস্ত অস্তিত্বকে দখল করে ফেলতে পারে, সাময়িক ভাবে ধেয়ে আসতে পারে মৃত্যুচিন্তা, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা। তাৎক্ষণিক আবেগে এই ধরনের ঘটনা বড় একটা কম ঘটেনা। আবার দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ থেকেও তা আসে। সব মিলিয়ে 'আত্মহত্যা' প্রায়শই ওই 'অন্তরের ব্যথা' রই একটা তীব্রতম রূপ যা একজন মানুষকে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ থেকে আচমকাই সরিয়ে দিতে পারে।

    উফফ, কোথা থেকে কোথায় চলে আসলাম!! আসলে 'মন' তো, এভাবেই ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ব্যথা থেকে আনন্দে!! বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে!!

    তা হোক। কিন্তু কথা তো হচ্ছিলো 'ব্যথা' নিয়ে। আমাদের একটা শরীর আছে, ব্যথা, বিষ, যন্ত্রণা, তারও কিছু কম হয় না। হাতটা কেটে গেলো, পা টা গেলো মচকে, বদ হজম হলো, কিংবা প্রচন্ড জ্বর... শরীরের 'ব্যথা' তো নানাভাবে, নানারূপে আমাদের আক্রান্ত করে, করে চলেছে অহরহ। শিরশিরে ব্যথা, কনকনে বা দপদপানি ব্যথা, জ্বলে যাওয়া ব্যথা... অনেক রকম প্রকারভেদ। আসলে 'ব্যথা' হলো শরীরের কষ্টের প্রধানতম প্রকাশ, আর এইসব ব্যথার অনুভূতি গ্রাহ্য হওয়ার জন্য নানারকম স্নায়ু আছে যা মস্তিষ্ক অবধি নিয়ে যাবে, আবার অনুভূতি বহন করে আনবে ব্যথার জায়গায়।

    এইরে, কঠিন বিজ্ঞান বোঝাতে শুরু করলাম। ছ্যা ছ্যা ছ্যা!! নানা, ওসব কিছু নয়, কথা হচ্ছে, শরীরের ব্যথা নিয়ে। তা কম বা বেশী হতেই পারে! আবার, ব্যক্তি বিশেষেও কম, বেশী হয়!! একই জোরে চিমটি কাটলে পাঁচজন লোক একই রকম ব্যথা পায় নাকি?? পায় না। এখানেই ঠিক 'মনের' একটা ভূমিকা আছে! সেটা হচ্ছে বেদনার বোধ!! শরীর বা মন, সব যন্ত্রণার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি... কারো কম হয়, কারো বেশী। এইভাবেই শরীর মিশে যায় মনে, শারীরিক যন্ত্রণার প্রকাশবোধের ফারাক, আর মানসিক যন্ত্রণার উৎপত্তির ভাবভঙ্গী, এইসবের মধ্যেই মানুষ হয়ে ওঠে 'ব্যক্তি', তার নিজস্ব 'মানসিক পরিসর' নিয়ে। মন হয়ে ওঠে শরীরেরই অংশ, সেটা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান দিয়ে নয়, সামগ্রিক সত্তা দিয়ে, যতই মস্তিষ্ক-এর গভীরে অনেক রাসায়নিকের চলন থাকুক না কেনো!!

    না:, বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আসলে সক্কলে উন্মুখ হয়ে থাকেন আরো কিছু গল্পগাছার জন্য, এতসব 'ধান ভানতে শিবের গীতের' জন্য পুরোটা নয়।

    সেসব গল্পগাছা তো আসবেই, কথকতার সূত্র ধরেই।

    সূত্রবিহীনভাবে ভাবে এটুকু বলি, প্রথমদিকে বাড়িতে চেম্বার করতাম। একদিন একজনকে ধরে নিয়ে এসেছিল বেঁধেছেদে। চেম্বারে ঢোকানো যায়নি, অগত্যা বেরোতে হলো রাস্তায়। উনি আমার পায়ে পরে গেলেন। তারপরই এক রাম চিমটি পায়ে। ব্যথায় লাফিয়ে উঠে পা সরিয়ে নিতে গিয়ে দেখি তিনি একটি চটি আঁকড়ে ধরে আছেন। পা, চটি থেকে বের করে নিয়ে সরে আসতেই, তিনি সেটিকে হাউই এর মত করে উড়িয়ে দিলেন, সেই চটি পরে ল্যান্ড করলো পাশের গন্ধ-নর্দমায়। শারীরিক (নাকি মানসিক!) নিগ্রহের এই রকম অনেক গপ্পো আছে। আসবে ধীরে সুস্থে।

    আর হ্যাঁ, আগের দিন জার্সি গরুর দুঃখে ম্রিয়মান একজন মহিলার কথা বলেছিলাম। উনি আসলে আমাকে অনেকদিন ধরে দেখান, সাত আট বছর বা বেশীও হতে পারেন। এখন অল্প ওষুধে দিব্যি ভালো আছেন। প্রথমে, হাসপাতালের ওয়ার্ড এ যখন দেখতে যাই, ওনাকে দেখতে, উনি পাথরকুচি, ভাঙা কাঁচ ইত্যাদি নির্বিবাদে চিবোচ্ছিলেন! মুখ কেটেকুটে রক্তারক্তি, ভ্রুক্ষেপই নেই!!

    ওই যে বলছিলাম 'ব্যথা' পুরোপুরি শারীরিক নয়, মানসিকও নয়। সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কিছু, ব্যক্তিনির্ভর, সবসময় গ্রাহ্য করার মতো নয়, আবার অগ্রাহ্যও করা যায় না।

    আবার অন্য দিন, আরো কথা নিয়ে।

    যারা প্রথম পর্ব পড়েননি, তাদের জন্য লিংক থাকলো, চাইলে দেখে নিতে পারেন।
    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1807161889294603&id=100000024289406
  • Swastisobhan Chaudhuri | 127.2.***.*** | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১১:৩১374026
  • #মন_নিয়ে_কথকতা

    দ্বিতীয় পর্ব

    "রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা".... কালজয়ী লাইন। কিন্তু 'অন্তর' মানে মন কোথায়? কোথাও যদি ঠিক করে না থাকে, তাহলে ব্যথা হবে কেমন করে? আর যদি ধরে নিই, মনের ঠাঁই মাথায়, তাহলে কি এটা আসলে 'মাথার ব্যথা'?

    না:, এগুলো বুঝি ঠিকঠাক ব্যাখ্যা হচ্ছে না!

    প্রেম করেছেন? প্রেমে ঝাড় খেয়েছেন? উত্তর সব 'হ্যাঁ' হলে আপনি এই 'অন্তরের ব্যথার' ব্যাপারটা জানেন। ভালো করে জানেন। এই ব্যথাটা ঠিক হাত কেটে গেলে, ছড়ে গেলে, 'গোটা অঙ্গে বোরোলিন' মেখে নেওয়ার মতো ব্যথা নয়। এটা একটা প্রাণ হু হু করা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, চোখ জলে ভরে আসা, সবকিছু অর্থহীন ভেবে পৃথিবী ছেড়ে পালানোর ইচ্ছের ঝড় তুলে আনা 'ব্যথা'...

    ঠিক ব্যথা নয়, একধরনের কষ্ট, মন ভালো না লাগা যন্ত্রণা, বিষাদ, যা স্থায়ী হলে ডেকে আনতে পারে এক দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যার (অসুখ শব্দটা ইচ্ছে করেই বাদ দিলাম।), সেটা হচ্ছে 'মানসিক অবসাদ'।

    পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্ততঃ ১০-১২ শতাংশ এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদের শিকার হন। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে কি হবে?? সাময়িক অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলোর সংখ্যা তো আরো অনেক বেশী!

    নিজের আত্মীয় প্রিয়জনকে নিয়ে শ্মশানে গেছেন বা গোর দিতে গেছেন কবরস্থানে, এমন মানুষের সংখ্যা, যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে কম নয়। আমি, এমনিতে অনেকবার গেছি, প্রথম বোধহয় একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময়, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মরদেহ নিয়ে।

    বছর দেড়েক আগে যখন নিজের মাকে নিয়ে গেলাম, দেহটি পরে আছে, বৈদ্যুতিক চুল্লীতে অন্য মৃতদেহ, আমার সমস্ত সত্তা তখন এই বিমূর্ত বেদনায় খানখান হচ্ছিলো, মায়ের পাশে বসে। একটা কিরকম দলা পাকানো ভাব!!

    আবার সেইদিন ইমার্জেন্সিতে একদল রাজনৈতিক মস্তান (স্বঘোষিত সমাজসেবী!!) মুখে কিঞ্চিৎ বিজাতীয়, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ, ঠিক যেনো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে এসেছে, আমাকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিতে দিতে এসেছিলো। আমার 'অমানবিক' গালে, গলায় ক্ষুরের মতো হাত বুলিয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিলো, 'লাশ' ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলো, তখনও একটা অদ্ভুত নিস্ফল রাগ, এইরকম একটা অসার যন্ত্রণার মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছিলো মনের গভীরে। এরকম 'বোধ'-এর স্বীকার আমরা প্রায়ই হই, প্রায় সকলেই, কোনো না কোনো সময়ে।

    তারপর, এই সঙ্কট কখনো সর্বব্যাপী হয়ে সমস্ত অস্তিত্বকে দখল করে ফেলতে পারে, সাময়িক ভাবে ধেয়ে আসতে পারে মৃত্যুচিন্তা, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা। তাৎক্ষণিক আবেগে এই ধরনের ঘটনা বড় একটা কম ঘটেনা। আবার দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ থেকেও তা আসে। সব মিলিয়ে 'আত্মহত্যা' প্রায়শই ওই 'অন্তরের ব্যথা' রই একটা তীব্রতম রূপ যা একজন মানুষকে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ থেকে আচমকাই সরিয়ে দিতে পারে।

    উফফ, কোথা থেকে কোথায় চলে আসলাম!! আসলে 'মন' তো, এভাবেই ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ব্যথা থেকে আনন্দে!! বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে!!

    তা হোক। কিন্তু কথা তো হচ্ছিলো 'ব্যথা' নিয়ে। আমাদের একটা শরীর আছে, ব্যথা, বিষ, যন্ত্রণা, তারও কিছু কম হয় না। হাতটা কেটে গেলো, পা টা গেলো মচকে, বদ হজম হলো, কিংবা প্রচন্ড জ্বর... শরীরের 'ব্যথা' তো নানাভাবে, নানারূপে আমাদের আক্রান্ত করে, করে চলেছে অহরহ। শিরশিরে ব্যথা, কনকনে বা দপদপানি ব্যথা, জ্বলে যাওয়া ব্যথা... অনেক রকম প্রকারভেদ। আসলে 'ব্যথা' হলো শরীরের কষ্টের প্রধানতম প্রকাশ, আর এইসব ব্যথার অনুভূতি গ্রাহ্য হওয়ার জন্য নানারকম স্নায়ু আছে যা মস্তিষ্ক অবধি নিয়ে যাবে, আবার অনুভূতি বহন করে আনবে ব্যথার জায়গায়।

    এইরে, কঠিন বিজ্ঞান বোঝাতে শুরু করলাম। ছ্যা ছ্যা ছ্যা!! নানা, ওসব কিছু নয়, কথা হচ্ছে, শরীরের ব্যথা নিয়ে। তা কম বা বেশী হতেই পারে! আবার, ব্যক্তি বিশেষেও কম, বেশী হয়!! একই জোরে চিমটি কাটলে পাঁচজন লোক একই রকম ব্যথা পায় নাকি?? পায় না। এখানেই ঠিক 'মনের' একটা ভূমিকা আছে! সেটা হচ্ছে বেদনার বোধ!! শরীর বা মন, সব যন্ত্রণার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি... কারো কম হয়, কারো বেশী। এইভাবেই শরীর মিশে যায় মনে, শারীরিক যন্ত্রণার প্রকাশবোধের ফারাক, আর মানসিক যন্ত্রণার উৎপত্তির ভাবভঙ্গী, এইসবের মধ্যেই মানুষ হয়ে ওঠে 'ব্যক্তি', তার নিজস্ব 'মানসিক পরিসর' নিয়ে। মন হয়ে ওঠে শরীরেরই অংশ, সেটা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান দিয়ে নয়, সামগ্রিক সত্তা দিয়ে, যতই মস্তিষ্ক-এর গভীরে অনেক রাসায়নিকের চলন থাকুক না কেনো!!

    না:, বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আসলে সক্কলে উন্মুখ হয়ে থাকেন আরো কিছু গল্পগাছার জন্য, এতসব 'ধান ভানতে শিবের গীতের' জন্য পুরোটা নয়।

    সেসব গল্পগাছা তো আসবেই, কথকতার সূত্র ধরেই।

    সূত্রবিহীনভাবে ভাবে এটুকু বলি, প্রথমদিকে বাড়িতে চেম্বার করতাম। একদিন একজনকে ধরে নিয়ে এসেছিল বেঁধেছেদে। চেম্বারে ঢোকানো যায়নি, অগত্যা বেরোতে হলো রাস্তায়। উনি আমার পায়ে পরে গেলেন। তারপরই এক রাম চিমটি পায়ে। ব্যথায় লাফিয়ে উঠে পা সরিয়ে নিতে গিয়ে দেখি তিনি একটি চটি আঁকড়ে ধরে আছেন। পা, চটি থেকে বের করে নিয়ে সরে আসতেই, তিনি সেটিকে হাউই এর মত করে উড়িয়ে দিলেন, সেই চটি পরে ল্যান্ড করলো পাশের গন্ধ-নর্দমায়। শারীরিক (নাকি মানসিক!) নিগ্রহের এই রকম অনেক গপ্পো আছে। আসবে ধীরে সুস্থে।

    আর হ্যাঁ, আগের দিন জার্সি গরুর দুঃখে ম্রিয়মান একজন মহিলার কথা বলেছিলাম। উনি আসলে আমাকে অনেকদিন ধরে দেখান, সাত আট বছর বা বেশীও হতে পারেন। এখন অল্প ওষুধে দিব্যি ভালো আছেন। প্রথমে, হাসপাতালের ওয়ার্ড এ যখন দেখতে যাই, ওনাকে দেখতে, উনি পাথরকুচি, ভাঙা কাঁচ ইত্যাদি নির্বিবাদে চিবোচ্ছিলেন! মুখ কেটেকুটে রক্তারক্তি, ভ্রুক্ষেপই নেই!!

    ওই যে বলছিলাম 'ব্যথা' পুরোপুরি শারীরিক নয়, মানসিকও নয়। সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কিছু, ব্যক্তিনির্ভর, সবসময় গ্রাহ্য করার মতো নয়, আবার অগ্রাহ্যও করা যায় না।

    আবার অন্য দিন, আরো কথা নিয়ে।

    যারা প্রথম পর্ব পড়েননি, তাদের জন্য লিংক থাকলো, চাইলে দেখে নিতে পারেন।
    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1807161889294603&id=100000024289406
  • Swastisobhan Chaudhuri | 127.2.***.*** | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১১:৩১374025
  • #মন_নিয়ে_কথকতা

    দ্বিতীয় পর্ব

    "রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা".... কালজয়ী লাইন। কিন্তু 'অন্তর' মানে মন কোথায়? কোথাও যদি ঠিক করে না থাকে, তাহলে ব্যথা হবে কেমন করে? আর যদি ধরে নিই, মনের ঠাঁই মাথায়, তাহলে কি এটা আসলে 'মাথার ব্যথা'?

    না:, এগুলো বুঝি ঠিকঠাক ব্যাখ্যা হচ্ছে না!

    প্রেম করেছেন? প্রেমে ঝাড় খেয়েছেন? উত্তর সব 'হ্যাঁ' হলে আপনি এই 'অন্তরের ব্যথার' ব্যাপারটা জানেন। ভালো করে জানেন। এই ব্যথাটা ঠিক হাত কেটে গেলে, ছড়ে গেলে, 'গোটা অঙ্গে বোরোলিন' মেখে নেওয়ার মতো ব্যথা নয়। এটা একটা প্রাণ হু হু করা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, চোখ জলে ভরে আসা, সবকিছু অর্থহীন ভেবে পৃথিবী ছেড়ে পালানোর ইচ্ছের ঝড় তুলে আনা 'ব্যথা'...

    ঠিক ব্যথা নয়, একধরনের কষ্ট, মন ভালো না লাগা যন্ত্রণা, বিষাদ, যা স্থায়ী হলে ডেকে আনতে পারে এক দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যার (অসুখ শব্দটা ইচ্ছে করেই বাদ দিলাম।), সেটা হচ্ছে 'মানসিক অবসাদ'।

    পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্ততঃ ১০-১২ শতাংশ এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদের শিকার হন। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে কি হবে?? সাময়িক অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলোর সংখ্যা তো আরো অনেক বেশী!

    নিজের আত্মীয় প্রিয়জনকে নিয়ে শ্মশানে গেছেন বা গোর দিতে গেছেন কবরস্থানে, এমন মানুষের সংখ্যা, যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে কম নয়। আমি, এমনিতে অনেকবার গেছি, প্রথম বোধহয় একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময়, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মরদেহ নিয়ে।

    বছর দেড়েক আগে যখন নিজের মাকে নিয়ে গেলাম, দেহটি পরে আছে, বৈদ্যুতিক চুল্লীতে অন্য মৃতদেহ, আমার সমস্ত সত্তা তখন এই বিমূর্ত বেদনায় খানখান হচ্ছিলো, মায়ের পাশে বসে। একটা কিরকম দলা পাকানো ভাব!!

    আবার সেইদিন ইমার্জেন্সিতে একদল রাজনৈতিক মস্তান (স্বঘোষিত সমাজসেবী!!) মুখে কিঞ্চিৎ বিজাতীয়, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ, ঠিক যেনো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে এসেছে, আমাকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিতে দিতে এসেছিলো। আমার 'অমানবিক' গালে, গলায় ক্ষুরের মতো হাত বুলিয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিলো, 'লাশ' ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলো, তখনও একটা অদ্ভুত নিস্ফল রাগ, এইরকম একটা অসার যন্ত্রণার মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছিলো মনের গভীরে। এরকম 'বোধ'-এর স্বীকার আমরা প্রায়ই হই, প্রায় সকলেই, কোনো না কোনো সময়ে।

    তারপর, এই সঙ্কট কখনো সর্বব্যাপী হয়ে সমস্ত অস্তিত্বকে দখল করে ফেলতে পারে, সাময়িক ভাবে ধেয়ে আসতে পারে মৃত্যুচিন্তা, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা। তাৎক্ষণিক আবেগে এই ধরনের ঘটনা বড় একটা কম ঘটেনা। আবার দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ থেকেও তা আসে। সব মিলিয়ে 'আত্মহত্যা' প্রায়শই ওই 'অন্তরের ব্যথা' রই একটা তীব্রতম রূপ যা একজন মানুষকে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ থেকে আচমকাই সরিয়ে দিতে পারে।

    উফফ, কোথা থেকে কোথায় চলে আসলাম!! আসলে 'মন' তো, এভাবেই ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ব্যথা থেকে আনন্দে!! বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে!!

    তা হোক। কিন্তু কথা তো হচ্ছিলো 'ব্যথা' নিয়ে। আমাদের একটা শরীর আছে, ব্যথা, বিষ, যন্ত্রণা, তারও কিছু কম হয় না। হাতটা কেটে গেলো, পা টা গেলো মচকে, বদ হজম হলো, কিংবা প্রচন্ড জ্বর... শরীরের 'ব্যথা' তো নানাভাবে, নানারূপে আমাদের আক্রান্ত করে, করে চলেছে অহরহ। শিরশিরে ব্যথা, কনকনে বা দপদপানি ব্যথা, জ্বলে যাওয়া ব্যথা... অনেক রকম প্রকারভেদ। আসলে 'ব্যথা' হলো শরীরের কষ্টের প্রধানতম প্রকাশ, আর এইসব ব্যথার অনুভূতি গ্রাহ্য হওয়ার জন্য নানারকম স্নায়ু আছে যা মস্তিষ্ক অবধি নিয়ে যাবে, আবার অনুভূতি বহন করে আনবে ব্যথার জায়গায়।

    এইরে, কঠিন বিজ্ঞান বোঝাতে শুরু করলাম। ছ্যা ছ্যা ছ্যা!! নানা, ওসব কিছু নয়, কথা হচ্ছে, শরীরের ব্যথা নিয়ে। তা কম বা বেশী হতেই পারে! আবার, ব্যক্তি বিশেষেও কম, বেশী হয়!! একই জোরে চিমটি কাটলে পাঁচজন লোক একই রকম ব্যথা পায় নাকি?? পায় না। এখানেই ঠিক 'মনের' একটা ভূমিকা আছে! সেটা হচ্ছে বেদনার বোধ!! শরীর বা মন, সব যন্ত্রণার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি... কারো কম হয়, কারো বেশী। এইভাবেই শরীর মিশে যায় মনে, শারীরিক যন্ত্রণার প্রকাশবোধের ফারাক, আর মানসিক যন্ত্রণার উৎপত্তির ভাবভঙ্গী, এইসবের মধ্যেই মানুষ হয়ে ওঠে 'ব্যক্তি', তার নিজস্ব 'মানসিক পরিসর' নিয়ে। মন হয়ে ওঠে শরীরেরই অংশ, সেটা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান দিয়ে নয়, সামগ্রিক সত্তা দিয়ে, যতই মস্তিষ্ক-এর গভীরে অনেক রাসায়নিকের চলন থাকুক না কেনো!!

    না:, বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আসলে সক্কলে উন্মুখ হয়ে থাকেন আরো কিছু গল্পগাছার জন্য, এতসব 'ধান ভানতে শিবের গীতের' জন্য পুরোটা নয়।

    সেসব গল্পগাছা তো আসবেই, কথকতার সূত্র ধরেই।

    সূত্রবিহীনভাবে ভাবে এটুকু বলি, প্রথমদিকে বাড়িতে চেম্বার করতাম। একদিন একজনকে ধরে নিয়ে এসেছিল বেঁধেছেদে। চেম্বারে ঢোকানো যায়নি, অগত্যা বেরোতে হলো রাস্তায়। উনি আমার পায়ে পরে গেলেন। তারপরই এক রাম চিমটি পায়ে। ব্যথায় লাফিয়ে উঠে পা সরিয়ে নিতে গিয়ে দেখি তিনি একটি চটি আঁকড়ে ধরে আছেন। পা, চটি থেকে বের করে নিয়ে সরে আসতেই, তিনি সেটিকে হাউই এর মত করে উড়িয়ে দিলেন, সেই চটি পরে ল্যান্ড করলো পাশের গন্ধ-নর্দমায়। শারীরিক (নাকি মানসিক!) নিগ্রহের এই রকম অনেক গপ্পো আছে। আসবে ধীরে সুস্থে।

    আর হ্যাঁ, আগের দিন জার্সি গরুর দুঃখে ম্রিয়মান একজন মহিলার কথা বলেছিলাম। উনি আসলে আমাকে অনেকদিন ধরে দেখান, সাত আট বছর বা বেশীও হতে পারেন। এখন অল্প ওষুধে দিব্যি ভালো আছেন। প্রথমে, হাসপাতালের ওয়ার্ড এ যখন দেখতে যাই, ওনাকে দেখতে, উনি পাথরকুচি, ভাঙা কাঁচ ইত্যাদি নির্বিবাদে চিবোচ্ছিলেন! মুখ কেটেকুটে রক্তারক্তি, ভ্রুক্ষেপই নেই!!

    ওই যে বলছিলাম 'ব্যথা' পুরোপুরি শারীরিক নয়, মানসিকও নয়। সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কিছু, ব্যক্তিনির্ভর, সবসময় গ্রাহ্য করার মতো নয়, আবার অগ্রাহ্যও করা যায় না।

    আবার অন্য দিন, আরো কথা নিয়ে।

    যারা প্রথম পর্ব পড়েননি, তাদের জন্য লিংক থাকলো, চাইলে দেখে নিতে পারেন।
    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1807161889294603&id=100000024289406
  • Swastisobhan Chaudhuri | 127.2.***.*** | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১১:৩১374024
  • #মন_নিয়ে_কথকতা

    দ্বিতীয় পর্ব

    "রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা".... কালজয়ী লাইন। কিন্তু 'অন্তর' মানে মন কোথায়? কোথাও যদি ঠিক করে না থাকে, তাহলে ব্যথা হবে কেমন করে? আর যদি ধরে নিই, মনের ঠাঁই মাথায়, তাহলে কি এটা আসলে 'মাথার ব্যথা'?

    না:, এগুলো বুঝি ঠিকঠাক ব্যাখ্যা হচ্ছে না!

    প্রেম করেছেন? প্রেমে ঝাড় খেয়েছেন? উত্তর সব 'হ্যাঁ' হলে আপনি এই 'অন্তরের ব্যথার' ব্যাপারটা জানেন। ভালো করে জানেন। এই ব্যথাটা ঠিক হাত কেটে গেলে, ছড়ে গেলে, 'গোটা অঙ্গে বোরোলিন' মেখে নেওয়ার মতো ব্যথা নয়। এটা একটা প্রাণ হু হু করা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, চোখ জলে ভরে আসা, সবকিছু অর্থহীন ভেবে পৃথিবী ছেড়ে পালানোর ইচ্ছের ঝড় তুলে আনা 'ব্যথা'...

    ঠিক ব্যথা নয়, একধরনের কষ্ট, মন ভালো না লাগা যন্ত্রণা, বিষাদ, যা স্থায়ী হলে ডেকে আনতে পারে এক দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যার (অসুখ শব্দটা ইচ্ছে করেই বাদ দিলাম।), সেটা হচ্ছে 'মানসিক অবসাদ'।

    পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্ততঃ ১০-১২ শতাংশ এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদের শিকার হন। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে কি হবে?? সাময়িক অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলোর সংখ্যা তো আরো অনেক বেশী!

    নিজের আত্মীয় প্রিয়জনকে নিয়ে শ্মশানে গেছেন বা গোর দিতে গেছেন কবরস্থানে, এমন মানুষের সংখ্যা, যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে কম নয়। আমি, এমনিতে অনেকবার গেছি, প্রথম বোধহয় একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময়, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মরদেহ নিয়ে।

    বছর দেড়েক আগে যখন নিজের মাকে নিয়ে গেলাম, দেহটি পরে আছে, বৈদ্যুতিক চুল্লীতে অন্য মৃতদেহ, আমার সমস্ত সত্তা তখন এই বিমূর্ত বেদনায় খানখান হচ্ছিলো, মায়ের পাশে বসে। একটা কিরকম দলা পাকানো ভাব!!

    আবার সেইদিন ইমার্জেন্সিতে একদল রাজনৈতিক মস্তান (স্বঘোষিত সমাজসেবী!!) মুখে কিঞ্চিৎ বিজাতীয়, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ, ঠিক যেনো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে এসেছে, আমাকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিতে দিতে এসেছিলো। আমার 'অমানবিক' গালে, গলায় ক্ষুরের মতো হাত বুলিয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিলো, 'লাশ' ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলো, তখনও একটা অদ্ভুত নিস্ফল রাগ, এইরকম একটা অসার যন্ত্রণার মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছিলো মনের গভীরে। এরকম 'বোধ'-এর স্বীকার আমরা প্রায়ই হই, প্রায় সকলেই, কোনো না কোনো সময়ে।

    তারপর, এই সঙ্কট কখনো সর্বব্যাপী হয়ে সমস্ত অস্তিত্বকে দখল করে ফেলতে পারে, সাময়িক ভাবে ধেয়ে আসতে পারে মৃত্যুচিন্তা, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা। তাৎক্ষণিক আবেগে এই ধরনের ঘটনা বড় একটা কম ঘটেনা। আবার দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ থেকেও তা আসে। সব মিলিয়ে 'আত্মহত্যা' প্রায়শই ওই 'অন্তরের ব্যথা' রই একটা তীব্রতম রূপ যা একজন মানুষকে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ থেকে আচমকাই সরিয়ে দিতে পারে।

    উফফ, কোথা থেকে কোথায় চলে আসলাম!! আসলে 'মন' তো, এভাবেই ঘুরে ফিরে বেড়ায়। ব্যথা থেকে আনন্দে!! বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে!!

    তা হোক। কিন্তু কথা তো হচ্ছিলো 'ব্যথা' নিয়ে। আমাদের একটা শরীর আছে, ব্যথা, বিষ, যন্ত্রণা, তারও কিছু কম হয় না। হাতটা কেটে গেলো, পা টা গেলো মচকে, বদ হজম হলো, কিংবা প্রচন্ড জ্বর... শরীরের 'ব্যথা' তো নানাভাবে, নানারূপে আমাদের আক্রান্ত করে, করে চলেছে অহরহ। শিরশিরে ব্যথা, কনকনে বা দপদপানি ব্যথা, জ্বলে যাওয়া ব্যথা... অনেক রকম প্রকারভেদ। আসলে 'ব্যথা' হলো শরীরের কষ্টের প্রধানতম প্রকাশ, আর এইসব ব্যথার অনুভূতি গ্রাহ্য হওয়ার জন্য নানারকম স্নায়ু আছে যা মস্তিষ্ক অবধি নিয়ে যাবে, আবার অনুভূতি বহন করে আনবে ব্যথার জায়গায়।

    এইরে, কঠিন বিজ্ঞান বোঝাতে শুরু করলাম। ছ্যা ছ্যা ছ্যা!! নানা, ওসব কিছু নয়, কথা হচ্ছে, শরীরের ব্যথা নিয়ে। তা কম বা বেশী হতেই পারে! আবার, ব্যক্তি বিশেষেও কম, বেশী হয়!! একই জোরে চিমটি কাটলে পাঁচজন লোক একই রকম ব্যথা পায় নাকি?? পায় না। এখানেই ঠিক 'মনের' একটা ভূমিকা আছে! সেটা হচ্ছে বেদনার বোধ!! শরীর বা মন, সব যন্ত্রণার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি... কারো কম হয়, কারো বেশী। এইভাবেই শরীর মিশে যায় মনে, শারীরিক যন্ত্রণার প্রকাশবোধের ফারাক, আর মানসিক যন্ত্রণার উৎপত্তির ভাবভঙ্গী, এইসবের মধ্যেই মানুষ হয়ে ওঠে 'ব্যক্তি', তার নিজস্ব 'মানসিক পরিসর' নিয়ে। মন হয়ে ওঠে শরীরেরই অংশ, সেটা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান দিয়ে নয়, সামগ্রিক সত্তা দিয়ে, যতই মস্তিষ্ক-এর গভীরে অনেক রাসায়নিকের চলন থাকুক না কেনো!!

    না:, বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আসলে সক্কলে উন্মুখ হয়ে থাকেন আরো কিছু গল্পগাছার জন্য, এতসব 'ধান ভানতে শিবের গীতের' জন্য পুরোটা নয়।

    সেসব গল্পগাছা তো আসবেই, কথকতার সূত্র ধরেই।

    সূত্রবিহীনভাবে ভাবে এটুকু বলি, প্রথমদিকে বাড়িতে চেম্বার করতাম। একদিন একজনকে ধরে নিয়ে এসেছিল বেঁধেছেদে। চেম্বারে ঢোকানো যায়নি, অগত্যা বেরোতে হলো রাস্তায়। উনি আমার পায়ে পরে গেলেন। তারপরই এক রাম চিমটি পায়ে। ব্যথায় লাফিয়ে উঠে পা সরিয়ে নিতে গিয়ে দেখি তিনি একটি চটি আঁকড়ে ধরে আছেন। পা, চটি থেকে বের করে নিয়ে সরে আসতেই, তিনি সেটিকে হাউই এর মত করে উড়িয়ে দিলেন, সেই চটি পরে ল্যান্ড করলো পাশের গন্ধ-নর্দমায়। শারীরিক (নাকি মানসিক!) নিগ্রহের এই রকম অনেক গপ্পো আছে। আসবে ধীরে সুস্থে।

    আর হ্যাঁ, আগের দিন জার্সি গরুর দুঃখে ম্রিয়মান একজন মহিলার কথা বলেছিলাম। উনি আসলে আমাকে অনেকদিন ধরে দেখান, সাত আট বছর বা বেশীও হতে পারেন। এখন অল্প ওষুধে দিব্যি ভালো আছেন। প্রথমে, হাসপাতালের ওয়ার্ড এ যখন দেখতে যাই, ওনাকে দেখতে, উনি পাথরকুচি, ভাঙা কাঁচ ইত্যাদি নির্বিবাদে চিবোচ্ছিলেন! মুখ কেটেকুটে রক্তারক্তি, ভ্রুক্ষেপই নেই!!

    ওই যে বলছিলাম 'ব্যথা' পুরোপুরি শারীরিক নয়, মানসিকও নয়। সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কিছু, ব্যক্তিনির্ভর, সবসময় গ্রাহ্য করার মতো নয়, আবার অগ্রাহ্যও করা যায় না।

    আবার অন্য দিন, আরো কথা নিয়ে।

    যারা প্রথম পর্ব পড়েননি, তাদের জন্য লিংক থাকলো, চাইলে দেখে নিতে পারেন।
    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1807161889294603&id=100000024289406
  • Swastisobhan Chaudhuri | 57.***.*** | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:২৪374029
  • #মন_নিয়ে_কথকতা

    তৃতীয় পর্ব
    --------------

    গাড়ীটা এসে দাঁড়ালো আউটডোরের সামনে। মারুতি ভ্যান। সঙ্গে আরো ৫-৭ জন বাইকে। সব মিলিয়ে হুড়মুড় করে প্রায় জনা দশেকের এক জনতা ঢুকে পড়লো ওপিডি র ভিতরে। মুখে স্পষ্টতই আশঙ্কার ছাপ।

    ব্যাপারটা কি?? যা জানা গেলো, ভদ্রলোক বেশ কয়েকদিন অনর্গল কথা বলে চলেছেন, বড় বড় কথা, ঘুম নেই, দেদার পয়সা বিলোচ্ছেন, সাংঘাতিক মুডে আছেন।

    বললাম, তাহলে নামিয়ে আনুন, দেখি। ওদের বক্তব্য হলো, ভুলিয়ে ভালিয়ে এনেছি, কিন্তু এখন হাসপাতাল, তাও মানসিক হাসপাতাল দেখে নামতে চাইছেন না। বললাম, এতজন আছেন, জোর করে নামিয়ে আনুন। দু-চারজন গিয়ে নানারকম নরম স্বরে বোঝাতে লাগলো, কিন্তু জোর-টোর বিশেষ কাউকে করতে দেখলাম না। বুঝলাম একশন-এ নামতে হবে, বেশ জটিল একশন!!

    তখন আমি তুফানগঞ্জে মানে তুফানগঞ্জ মানসিক হাসপাতালে। সরকারী চাকরীতে প্রথম পোস্টিং। মানসিক হাসপাতাল হলেও আউটডোরই চালু ছিলো তখন। ২০০০ এর জানুয়ারী তে চালু হয়, আমি যোগ দিই ঐ বছরেরই ডিসেম্বরে। এখনো আউটডোরই আছে, তবে শুনেছি বড় ইনডোর (১০০ শয্যার) এর বাড়ী তৈরী হচ্ছে। মাঝে একবার অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ২০ শয্যার ইনডোর চালু করা হয়েছিল, কিন্তু কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায়! সে কথা পরে!!

    এইবারে একশনে নামার আগে আমাদের একমাত্র গ্রূপ ডি দুধকুমারদার সাথে একটু আলোচনা করে নিলাম। ফার্মাসিস্ট তাপসদাকে ইঞ্জেকশন তৈরীর কথা বলে গাড়ির কাছে এগোলাম। অন্য কিছু রোগীর বাড়ির লোকজনকেও ডেকে নিলাম, তবে ওই রোগীর বাড়ির লোকজন তখন প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে।গাড়ীতে উঁকি মেরে দেখলাম এক মাঝবয়সী, মোটাসোটা, প্রভাবশালী ভদ্রলোক লম্বা সিটের ঠিক মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে বিরক্ত মুখে বসে আছে। নামার কথা বলায় সোজ্জা 'না' বলে দিল। তখন নাম কি, বাড়ী কোথায় এসব হাবিজাবি কথা বলতে বলতে একপায়ে গাড়ীর স্লাইডিং দরজাটা চেপে ধরে, হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলাম। একটু দরজার দিকে এগিয়ে আসতেই জাপটে ধরে আরেকটু টান, ব্যাস দেহটা একটু বাইরে আসতেই, দুধকুমারদা ও অন্য আরো কয়েকজন মুহূর্তে চ্যাংদোলা করে ওপিডির বাইরের ঘরের খাটে এনে ফেলা গেলো। সিস্টার মালাদি সিরিঞ্জ হাতে রেডিই ছিলো। হতচকিত ভদ্রলোক কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝপাঝপ দু দুটো ইঞ্জেকশন একদম ওনার কোমরে ফুঁড়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে আসা লোকজন তখন একটু সাহস ফিরে পেয়েছে। রোগীকে বাকি সামলানোর কাজটা ওরাই করলো।

    ওষুধপত্র লেখা হল। চোদ্দ দিন ওষুধ খেয়ে তিনি যখন আবার এলেন দেখাতে, একেবারে অন্য মানুষ, উত্তেজনার আর ছিটেফোঁটাও নেই।

    ভাবছেন অনেকে, কি এমন হয়েছিল ওনার?? খুব সোজা ভাষায়, ওনার ভীষণ 'ফূর্তি' হয়েছিলো, একেবারে বাঁধনছাড়া ফূর্তি, ইংরেজীতে বলা যায় EUPHORIA (ELATION ও বলা যেতে পারে!) আর এই ফূর্তিতে সামান্য বাঁধা পেলেই তৈরী হচ্ছিলো মারাত্মক উত্তেজনা, অসংলগ্ন আচরণ।

    হ্যাঁ, এটা একধরনের মানসিক সমস্যা। এক্ষেত্রে বিষাদের ঠিক বিপরীত আচরণ করে থাকে মানুষ। মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছাস, বাঁধনহীন অসংলগ্ন আচরণ, অত্যন্ত দ্রুত কথা বলা, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়া, যা কখনোই মানুষটির আগের ব্যক্তিত্বের সাথে খাপ খায় না।

    কিন্তু, এইসব মানুষেরা ভীষণ বিষণ্ণতাতেও আক্রান্ত হতে পারেন কখনো। এদের মানসিক অবস্থা অসম্ভব আনন্দ থেকে ভয়ঙ্কর মন খারাপের দুটি চূড়ান্ত অবস্থাতেই যেতে পারে। একে "বাই-পোলার ডিসঅর্ডার" বলা হয়ে থাকে। ভাগ, উপভাগ ইত্যাদি প্রসঙ্গে যাওয়ার কোনো উৎসাহ নেই। চিকিৎসা আছে, মূলতঃ ওষুধের চিকিৎসায় মনটাকে মাঝামাঝি পরিসরের মধ্যে রাখা সম্ভব, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী, অনেক ক্ষেত্রে জীবনভর।

    আমি এই প্রথম সরাসরি একটি গুরুতর মানসিক সমস্যার মধ্যে ঢুকলাম, তাও আবার এক্কেবারে শুরুতে। আগের দুটোতে ঢুকিনি। আসলে বিষাদের আলোচনা করেছিলাম আগে, আনন্দও যে অতি মারাত্মক হতে পারে তার ইঙ্গিত দেওয়াটাও দরকার ছিলো। না না, তাই বলে আনন্দ করবেন না, ফূর্তি করবেন না এমন নয়, অবশ্যই করবেন। কারণ....

    কোনো মানসিক সমস্যাকে অসুখের পর্যায়ভুক্ত করতে দুটি প্ৰধাণ জিনিষের কথা মাথায় রাখতে হয়, ১) এই আচরণ নিয়মিত ভাবে সামাজিক সমস্যার কারণ হচ্ছে কিনা, আর ২) কাজের জায়গায় প্রাত্যহিক অসুবিধা তৈরী করছে কিনা!! ইংরেজি শব্দটি বেশ সুন্দর, socio-occupational impairment. তা নিয়মিত ভাবে না হলে ভাবতে বসে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

    আর হ্যাঁ, এই আচরণের বা সমস্যার সাথে যদি কোনো নেশার জিনিষের সরাসরি সম্পর্ক থাকে, তা হলে পরিপ্রেক্ষিতটা অনেকটাই পাল্টে যায়।

    এগুলো হলো সব আবেগজনিত সমস্যা, এরসঙ্গে উৎকন্ঠার সমস্যা এখনো আলোচনা শুরু হয়নি, আর সর্বোপরি আছে চিন্তার সমস্যা। এগুলোর মধ্যে সুক্ষ যোগাযোগ আছে।

    তার উপরে বাচ্চাদের সমস্যা, বৃদ্ধদের সমস্যা, বুদ্ধির সমস্যা, স্মৃতিশক্তির সমস্যা, নেশার সমস্যা, আরো কত্ত কি!!! ওরে বাবারে, এই সিরিজ নিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে রে, আমার চুল উঠে যাবে রে....

    না: খ্যামা দেন কত্তারা, দিদিমনিরা!! নেখা থেকে নয় গো!! আপাতত পববো থেকে!!!

    সবশেষে বলি, তুফানগঞ্জ মানসিক হাসপাতালের ইনডোরে প্রথম যে রোগী চিকিৎসাধীন হয়ে এসেছিলো, তার আক্রমণে দুধকুমারদার হাত ভেঙ্গেছিলো, দুটো তিনটে পাঁজর ভেঙ্গেছিলো, সর্বোপরি ফুসফুসের একটি অংশে চোট লেগে, নিউমোথোরাকস (pneumothorax) হয়েছিল। সিস্টারও বেশ জখম হয়। আমি তখন তুফানগঞ্জ ছেড়ে চলে এসেছি। খবর পেয়েছিলাম।

    এরপর ইনডোরে ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়।

    কিন্তু এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে মানসিক অসুস্থতা থাকলেই মানুষ খুব হিংস্র হবেন, তারা খুব বিপজজনক, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে পরিকাঠামোর সমস্যা ছিলো বলেই মনে হয়। খুব অল্প সংখ্যার মানুষই এইধরনের আচরণ করতে পারেন, তাদের সামলাতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগটাই এমন নয়, বরং সাধারণ অন্য মানুষের মতোই। সহৃদয় ভাবে, এদের অধিকাংশ, হ্যাঁ শতকরা ৯৫ শতাংশেরও বেশী মানুষের চিকিৎসাই বাড়িতে করা যায়, এবং অতি অনায়াসে। বাকিদেরও সাময়িক সময়ের জন্য হাসপাতাল বাসের প্রয়োজন হতে পারে। শুধু সমস্যাটা শুরু হওয়ার পরে প্রথমেই চিহ্নিত ও চিকিৎসা শুরু হওয়া জরুরী।

    দ্বিতীয় পর্ব পড়তে হলে নীচের লিংক ব্যবহার করুন। দ্বিতীয় পর্বে আবার প্রথম পর্বের লিংক আছে।

    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1812417802102345&id=100000024289406
  • Swastisobhan Chaudhuri | 57.***.*** | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:২৪374028
  • #মন_নিয়ে_কথকতা

    তৃতীয় পর্ব
    --------------

    গাড়ীটা এসে দাঁড়ালো আউটডোরের সামনে। মারুতি ভ্যান। সঙ্গে আরো ৫-৭ জন বাইকে। সব মিলিয়ে হুড়মুড় করে প্রায় জনা দশেকের এক জনতা ঢুকে পড়লো ওপিডি র ভিতরে। মুখে স্পষ্টতই আশঙ্কার ছাপ।

    ব্যাপারটা কি?? যা জানা গেলো, ভদ্রলোক বেশ কয়েকদিন অনর্গল কথা বলে চলেছেন, বড় বড় কথা, ঘুম নেই, দেদার পয়সা বিলোচ্ছেন, সাংঘাতিক মুডে আছেন।

    বললাম, তাহলে নামিয়ে আনুন, দেখি। ওদের বক্তব্য হলো, ভুলিয়ে ভালিয়ে এনেছি, কিন্তু এখন হাসপাতাল, তাও মানসিক হাসপাতাল দেখে নামতে চাইছেন না। বললাম, এতজন আছেন, জোর করে নামিয়ে আনুন। দু-চারজন গিয়ে নানারকম নরম স্বরে বোঝাতে লাগলো, কিন্তু জোর-টোর বিশেষ কাউকে করতে দেখলাম না। বুঝলাম একশন-এ নামতে হবে, বেশ জটিল একশন!!

    তখন আমি তুফানগঞ্জে মানে তুফানগঞ্জ মানসিক হাসপাতালে। সরকারী চাকরীতে প্রথম পোস্টিং। মানসিক হাসপাতাল হলেও আউটডোরই চালু ছিলো তখন। ২০০০ এর জানুয়ারী তে চালু হয়, আমি যোগ দিই ঐ বছরেরই ডিসেম্বরে। এখনো আউটডোরই আছে, তবে শুনেছি বড় ইনডোর (১০০ শয্যার) এর বাড়ী তৈরী হচ্ছে। মাঝে একবার অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ২০ শয্যার ইনডোর চালু করা হয়েছিল, কিন্তু কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায়! সে কথা পরে!!

    এইবারে একশনে নামার আগে আমাদের একমাত্র গ্রূপ ডি দুধকুমারদার সাথে একটু আলোচনা করে নিলাম। ফার্মাসিস্ট তাপসদাকে ইঞ্জেকশন তৈরীর কথা বলে গাড়ির কাছে এগোলাম। অন্য কিছু রোগীর বাড়ির লোকজনকেও ডেকে নিলাম, তবে ওই রোগীর বাড়ির লোকজন তখন প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে।গাড়ীতে উঁকি মেরে দেখলাম এক মাঝবয়সী, মোটাসোটা, প্রভাবশালী ভদ্রলোক লম্বা সিটের ঠিক মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে বিরক্ত মুখে বসে আছে। নামার কথা বলায় সোজ্জা 'না' বলে দিল। তখন নাম কি, বাড়ী কোথায় এসব হাবিজাবি কথা বলতে বলতে একপায়ে গাড়ীর স্লাইডিং দরজাটা চেপে ধরে, হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলাম। একটু দরজার দিকে এগিয়ে আসতেই জাপটে ধরে আরেকটু টান, ব্যাস দেহটা একটু বাইরে আসতেই, দুধকুমারদা ও অন্য আরো কয়েকজন মুহূর্তে চ্যাংদোলা করে ওপিডির বাইরের ঘরের খাটে এনে ফেলা গেলো। সিস্টার মালাদি সিরিঞ্জ হাতে রেডিই ছিলো। হতচকিত ভদ্রলোক কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝপাঝপ দু দুটো ইঞ্জেকশন একদম ওনার কোমরে ফুঁড়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে আসা লোকজন তখন একটু সাহস ফিরে পেয়েছে। রোগীকে বাকি সামলানোর কাজটা ওরাই করলো।

    ওষুধপত্র লেখা হল। চোদ্দ দিন ওষুধ খেয়ে তিনি যখন আবার এলেন দেখাতে, একেবারে অন্য মানুষ, উত্তেজনার আর ছিটেফোঁটাও নেই।

    ভাবছেন অনেকে, কি এমন হয়েছিল ওনার?? খুব সোজা ভাষায়, ওনার ভীষণ 'ফূর্তি' হয়েছিলো, একেবারে বাঁধনছাড়া ফূর্তি, ইংরেজীতে বলা যায় EUPHORIA (ELATION ও বলা যেতে পারে!) আর এই ফূর্তিতে সামান্য বাঁধা পেলেই তৈরী হচ্ছিলো মারাত্মক উত্তেজনা, অসংলগ্ন আচরণ।

    হ্যাঁ, এটা একধরনের মানসিক সমস্যা। এক্ষেত্রে বিষাদের ঠিক বিপরীত আচরণ করে থাকে মানুষ। মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছাস, বাঁধনহীন অসংলগ্ন আচরণ, অত্যন্ত দ্রুত কথা বলা, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়া, যা কখনোই মানুষটির আগের ব্যক্তিত্বের সাথে খাপ খায় না।

    কিন্তু, এইসব মানুষেরা ভীষণ বিষণ্ণতাতেও আক্রান্ত হতে পারেন কখনো। এদের মানসিক অবস্থা অসম্ভব আনন্দ থেকে ভয়ঙ্কর মন খারাপের দুটি চূড়ান্ত অবস্থাতেই যেতে পারে। একে "বাই-পোলার ডিসঅর্ডার" বলা হয়ে থাকে। ভাগ, উপভাগ ইত্যাদি প্রসঙ্গে যাওয়ার কোনো উৎসাহ নেই। চিকিৎসা আছে, মূলতঃ ওষুধের চিকিৎসায় মনটাকে মাঝামাঝি পরিসরের মধ্যে রাখা সম্ভব, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী, অনেক ক্ষেত্রে জীবনভর।

    আমি এই প্রথম সরাসরি একটি গুরুতর মানসিক সমস্যার মধ্যে ঢুকলাম, তাও আবার এক্কেবারে শুরুতে। আগের দুটোতে ঢুকিনি। আসলে বিষাদের আলোচনা করেছিলাম আগে, আনন্দও যে অতি মারাত্মক হতে পারে তার ইঙ্গিত দেওয়াটাও দরকার ছিলো। না না, তাই বলে আনন্দ করবেন না, ফূর্তি করবেন না এমন নয়, অবশ্যই করবেন। কারণ....

    কোনো মানসিক সমস্যাকে অসুখের পর্যায়ভুক্ত করতে দুটি প্ৰধাণ জিনিষের কথা মাথায় রাখতে হয়, ১) এই আচরণ নিয়মিত ভাবে সামাজিক সমস্যার কারণ হচ্ছে কিনা, আর ২) কাজের জায়গায় প্রাত্যহিক অসুবিধা তৈরী করছে কিনা!! ইংরেজি শব্দটি বেশ সুন্দর, socio-occupational impairment. তা নিয়মিত ভাবে না হলে ভাবতে বসে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

    আর হ্যাঁ, এই আচরণের বা সমস্যার সাথে যদি কোনো নেশার জিনিষের সরাসরি সম্পর্ক থাকে, তা হলে পরিপ্রেক্ষিতটা অনেকটাই পাল্টে যায়।

    এগুলো হলো সব আবেগজনিত সমস্যা, এরসঙ্গে উৎকন্ঠার সমস্যা এখনো আলোচনা শুরু হয়নি, আর সর্বোপরি আছে চিন্তার সমস্যা। এগুলোর মধ্যে সুক্ষ যোগাযোগ আছে।

    তার উপরে বাচ্চাদের সমস্যা, বৃদ্ধদের সমস্যা, বুদ্ধির সমস্যা, স্মৃতিশক্তির সমস্যা, নেশার সমস্যা, আরো কত্ত কি!!! ওরে বাবারে, এই সিরিজ নিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে রে, আমার চুল উঠে যাবে রে....

    না: খ্যামা দেন কত্তারা, দিদিমনিরা!! নেখা থেকে নয় গো!! আপাতত পববো থেকে!!!

    সবশেষে বলি, তুফানগঞ্জ মানসিক হাসপাতালের ইনডোরে প্রথম যে রোগী চিকিৎসাধীন হয়ে এসেছিলো, তার আক্রমণে দুধকুমারদার হাত ভেঙ্গেছিলো, দুটো তিনটে পাঁজর ভেঙ্গেছিলো, সর্বোপরি ফুসফুসের একটি অংশে চোট লেগে, নিউমোথোরাকস (pneumothorax) হয়েছিল। সিস্টারও বেশ জখম হয়। আমি তখন তুফানগঞ্জ ছেড়ে চলে এসেছি। খবর পেয়েছিলাম।

    এরপর ইনডোরে ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়।

    কিন্তু এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে মানসিক অসুস্থতা থাকলেই মানুষ খুব হিংস্র হবেন, তারা খুব বিপজজনক, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে পরিকাঠামোর সমস্যা ছিলো বলেই মনে হয়। খুব অল্প সংখ্যার মানুষই এইধরনের আচরণ করতে পারেন, তাদের সামলাতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগটাই এমন নয়, বরং সাধারণ অন্য মানুষের মতোই। সহৃদয় ভাবে, এদের অধিকাংশ, হ্যাঁ শতকরা ৯৫ শতাংশেরও বেশী মানুষের চিকিৎসাই বাড়িতে করা যায়, এবং অতি অনায়াসে। বাকিদেরও সাময়িক সময়ের জন্য হাসপাতাল বাসের প্রয়োজন হতে পারে। শুধু সমস্যাটা শুরু হওয়ার পরে প্রথমেই চিহ্নিত ও চিকিৎসা শুরু হওয়া জরুরী।

    দ্বিতীয় পর্ব পড়তে হলে নীচের লিংক ব্যবহার করুন। দ্বিতীয় পর্বে আবার প্রথম পর্বের লিংক আছে।

    https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1812417802102345&id=100000024289406
  • স্বস্তিশোভন চৌধুরী | 127.2.***.*** | ০৩ মার্চ ২০১৮ ০০:১৬374018
  • #মন_নিয়ে_কথকতা

    (চতুর্থ পর্ব)

    আমাদের শহরে কাল ছিলো 'দোল'। আর আজ হলো 'হোলি'। এরকম অনেক জায়গাতেই হয়। প্রথমদিনে আবীর দিয়ে 'ভূত' বানানো বা 'ডিজাইনার' খেলা, আধুনিক নিয়মে।(মূলতঃ মহিলারাই, তবে আজকাল পুরুষরাও, এগুলো একধরনের 'ফ্যাশন স্টেটমেন্ট', মূলতঃ ছবি তোলবার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়!)

    আর আজকের উৎসব, একেবারে 'হা রে রে রে' প্রকৃতির। তেল, জল, খুনী রঙ, আরো কত্ত কি দিয়ে এক ভয়ানক, 'অতিরঞ্জিত' খেলা। এ খেলায় সবাই মাতেন না, যারা মাতেন তারা বাদে, খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষজন রাস্তায় নামেন না, ফাঁকা রাস্তায় কোথাও কোথাও ধুন্ধুমার, যানবাহন কম, নেই বললেই চলে, দোকানপাট, অফিস কাছারি বেশিরভাগটাই বন্ধ।

    কাল বেশ কয়েকটা 'বড়া' খাওয়া হয়েছিলো, তার ভিতরে বাঁধাকপি না অন্য কোনো বিশেষ শাকপাতার পুর দেওয়া ছিলো, তাই নিয়ে অত মাথা ব্যথা নেই!তবে বেশ কিছুক্ষণ বাদে, মাথায় বেশ একটা 'টলমলে' ভাব হয়েছিলো, কারো কারোর কিঞ্চিৎ ভুল বকার ঝোঁক, বা হাসির ফুলঝুরি, কিছু নিমীলিত নেত্র!! এইসব নিয়েই এক বন্ধুর বাড়িতে বন্ধুদের সম্মিলিত ভোজ, কিঞ্চিৎ রঙ খেলা, বাচ্চাদের হইহই, জমজমাটি আড্ডা, সব মিলিয়ে দিনটা জমেছিলো বেশ। ঘরে ফেরার পরেও যার রেশ থেকে যায় সবদিক থেকেই।

    লিখছি তো বাবা মন নিয়ে, তা এমন দোলের বা হোলির বিষয় নিয়ে কচরমচর শুরু করলাম কেন??? তার কারণ, ওই যে বললাম, মাথার ভেতর 'টলমল'...কিসব বড়ার কিসব এফেক্ট।

    এরকমই হয়, নেশা করলে। নেশার কি আর শেষ আছে!! দোলের আগের দিন কিছু কিছু দোকানে লম্বা লম্বা লাইন পরে, বোতলজাত তরল বগলস্থ করে, বা ব্যাগজাত করে ঘরে ফেরার জন্য, হোলিকে আরো রঙীন করে তোলার জন্য। এদের কেউ নিয়মিত পায়ী, বিশেষ দিনে মাত্রাটা চড়ে, আর কেউ কেউ অনিয়মিত, উৎসবের মেজাজে মনটা ফুরফুরে করার জন্য কিছু বিশেষ দিনে কিছু কিছু। এদের মাঝামাঝি আরো বহু মানুষ আছেন, মাত্রার ফারাকের হিসেবে।
    সামাজিক ভাবে স্বীকৃত এই নেশাটি সারা পৃথিবী জুড়েই চালু এবং আমাদের নানা সমস্যা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। এই "এলকোহলপ্রেমী" দের নিয়ে নানা রকম সামাজিক সমস্যা যেমন প্রায়শই হয়, মানসিক ও শারীরিক সমস্যা কিছু কম হয় না।

    এতো গেলো জলের রাস্তা, এছাড়া আরেক রকম 'বায়বীয়' নেশা বেশ চালু, আমাদের দেশে অবৈধ, কোনো কোনো বাবা বৈধ করার জন্য জরুরী দরবার করছেন, পৃথিবীতে কিছু দেশ বা কিছু দেশের কিছু প্রদেশে বৈধ। এটি গাঁজা, ভোলেবাবার পেরসাদ হিসেবে এদেশে, মারিজুয়ানা হিসেবে বিদেশে পরিচিত। অনেক চালু নাম আছে, অনেক রকম 'চেহারায়' আছে। এই নেশা নিয়মিত বেশী পরিমানে করার বিপদ আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়।

    এছাড়া আছে, আফিম বা আফিমের থেকে তৈরী হওয়া নানারকম মাত্রার জিনিষ, যেমন হেরোইন। এগুলোও নেশা যারা করে তাদের মধ্যে ভালই প্রচলিত, আর 'স্বাস্থ্য সমস্যা' হিসেবে সবচেয়ে মারাত্মক। opoid গ্রূপের সিনথেটিক ওষুধ, মুখে খাওয়ার মতো ওষুধ (ট্যাবলেট বা সিরাপ আকারে) বা ইনজেকশন, এইসব কিছুরও বহুল প্রচলন আছে।

    এছাড়া কড়া নেশার মধ্যে আছে কোকেন, অত্যন্ত দামী, এদেশে খুব বড়লোকদের 'রেভ পার্টি' ইত্যাদিতে কিছু প্রচলন থাকলেও, সাধারণ ভাবে প্রচলিত নয়। বিদেশে কড়া নেশাখোরদের মধ্যে ভালোই জনপ্রিয়।

    আছে ঘুমের ওষুধ। কিছু ব্যান্ড আপনি বা আপনারা জানেন, নেশার সামগ্রী হিসেবে নয়, ঘুমের ওষুধ হিসেবেই। কিন্তু যদি মাত্রাটা ক্রমশ বাড়তে থাকে, দিনের বেলাতেও ব্যবহারের ইচ্ছে হয়, ওষুধ খাওয়ার পরে বেশ মজা লাগে, কোনোদিন ওষুধ না থাকলে চূড়ান্ত অস্থিরতা হয়, তাহলে কিছুটা হলেও আপনি এই ঘুমের ওষুধের নেশার চক্করে একটু হলেও পরে গেছেন।

    আজকাল কমবয়সীদের একটা নেশা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, শোঁকার নেশা। মূলতঃ 'ডেনড্রাইট' জাতীয় পেট্রোকেমিক্যাল থেকে উদ্ভূত থিকথিকে আঠার মতো জিনিষ, প্লাস্টিক প্যাকেটে ঢেলে উগ্র গন্ধটা শোঁকা হয়, এতে মাথাটা নাকি হালকা লাগে, উড়ুউড়ু ভাব হয়। এনজেপি স্টেশনে, প্লাটফর্মে থাকা শিশুদের একসাথে রাত্তির বেলায় এই নেশা করতে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আবার অন্ততঃ একজন বা দুজনের আমি চিকিৎসা করেছি, যারা বড় হয়েও এই নেশা ছাড়তে পারেনি, অন্য নেশায়, মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের ছোট্ট শহরে কমবয়সীদেরও এই নেশার চিকিৎসা করতে হয়েছে।

    এর বাইরে আছে, ভাঙ, সিদ্ধি যা মূলতঃ গরিব মানুষের নেশা। গাঁজাও প্রায় তাই। আছে তামাকের নানারকম ব্যবহার, পান(জর্দা সহ), সিগারেট, বিড়ি, খৈনি, নস্যি, গুটখা... কত রকম নাম। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক সমস্যার পরিমাণও কম নয়। আছে, 'প্যাসিভ স্মোকিং' এর সমস্যা। এর বিরুদ্ধে প্রচারও উচ্চগ্রামে চলে, তাতে হয়তো নিয়ন্ত্রণ কিছুটা বেড়েছে। উন্নত দেশেও তাই। সিগারেট কোম্পানিগুলি, যেমন ITC অন্য ব্যবসায় লগ্নী বাড়াচ্ছে, কেউ কেউ আবার এশিয়া বা আফ্রিকার আরো অনুন্নত দেশে ব্যবসা ছড়াচ্ছে।

    এছাড়াও কিছু "অফ বিট" নেশা আছে। যারমধ্যে এমফেটামিন গোত্রীয় স্টিমুলেন্ট আছে, মজার ব্যাপার এটা কমবয়সীদের ক্ষেত্রে কিছু মানসিক সমস্যায় জরুরী ওষুধ, কিন্তু বেশী বয়সীদের ক্ষেত্রে নেশার জিনিষ। আমাদের দেশে সরকারী বিধিনিষেধের চক্করে ওষুধটি পাওয়া বা নির্দিষ্ট ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করাও রীতিমত ঝকমারি বিষয়।

    সবশেষে চা বা কফি, কিছু গুণ থাকলেও মূল রাসায়নিক "ক্যাফেইন" বেশি মাত্রায় উত্তেজক ধরনের নেশার জিনিষ।

    এ গুলো হল নেশার বস্তুর বিবরণ। কিন্তু কোনটা কিভাবে অসুবিধা তৈরী করে, কেন এইসব নেশায় আসক্ত হয়ে পরে মানুষ, এইসব অনেক প্রশ্ন আছে। থাকতেই হবে, শুকনো শুকনো নেশার বিবরণে কি আর চিড়ে ভেঁজে!!

    সবথেকে গুরুত্বপূর্ন বিষয়টি হল, মানুষ কেনো নেশা করে, কিভাবে ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে?! আসলে যে কোনো নেশারই একটা নিজস্ব prize value আছে, মানে 'পুরস্কার মূল্য'। কি সেই পুরস্কার?? মনের মধ্যে, মাথার মধ্যে একটা হালকা টলমলে ভাব, একটু ফুর্তির ভাব, কথা বলতে ভালো লাগা, এককথায় একটা Expansive Mood, মানে আবেগের একধরনের মসৃণ বিস্ফোরণের মতো, সবকিছু ভাল লাগতে লাগা, কিছু এলোমেলো করেও, কথা বা শরীরের জড়তা সত্বেও, একটা বেশ উত্তুঙ্গ অবস্থা।

    সব নেশাতে একই ধরনের ব্যাপার হয়না, কিন্তু প্রত্যেকটিতেই এমন কিছু হয়, যে নেশা করছে, সে এটাকে ভালোবেসে ফেলে। এই অবস্থাটা ফিরে ফিরে আসুক তাই চায়।

    আজকাল এটার একটা সুন্দর নাম হয়েছে, "addictive behaviour", মানে "নেশাপ্রবন ব্যবহার", যারা নেশা নিয়মিত করে তাদের এই ধরনের আচরণের প্রাবল্য দেখা যায়।

    তবে addiction শুধু কিছু খেলাম, তার থেকে হলো, এরকম নাও হতে পারে। অন্য কিছুরও হতে পারে, যেমন আমরা প্রায়শই শুনে থাকি, বইয়ের নেশা, খেলার নেশা, মাছ ধরার নেশা... এগুলো ঠিক ক্ষতিকর addictive behaviour নয়। কিন্তু ক্ষতিকরও কিছু আছে।

    এরমধ্যে নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা গেছে, "INTERNET ADDICTION" কে, কারণ এই সংক্রান্ত সমস্যা, কমবয়সী মানুষদের মধ্যে সারা পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে, মানসিক, শারীরিক, সামাজিক সমস্যা তৈরী করছে।

    সমাধানের রাস্তাগুলো সহজ নয়, আলোচনার অন্যান্য পর্বে, সাধ্যমত আনতে চেষ্টা করবো।

    একটা বিষয় আলাদাভাবে উল্লেখ করছি, বিদেশে মদ্যপান বা ধূমপান, ছেলেদের মধ্যে বেশী হলেও, মেয়েদের মধ্যে নেহাৎ কম নয়। কিন্তু আমাদের দেশে একদম নিম্ন আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় আর ঠিক এর উল্টো, অত্যন্ত উচ্চ আর্থসামাজিক পরিকাঠামোতে মেয়েদের এইরকম ঝোঁক চালু ছিল, মধ্যবিত্তদের মধ্যে ততটা নয়, পান-জর্দার চলটাই বেশী ছিলো। আজকাল নগরায়নের দ্রুততায় মেয়েরাও পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। এই নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। শুধু একটাই বক্তব্য, মূলতঃ চিকিৎসক হিসেবে, প্রসবের প্রস্তুতি থেকে প্রসবের পরে যখন শিশু বুকের দুধ খায় সেই পর্যন্ত, এই গুলির ব্যবহার পরিত্যাজ্য। অন্যথায় কিছু অসুবিধার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

    ভারী ভারী, গম্ভীর কথা তো অনেক হলো। আজ সন্ধ্যায়, হোলির দিনে, পাড়ার মুদিখানার দোকানে একটু গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি একটি অল্পবয়সী ছেলে ফাঁকা রাস্তায় কিঞ্চিৎ ব্যাঁকাট্যারা ভাবে সাইকেল চালাতে চালাতে আসছে, আর বলছে, এই ঠিক করে চলো, ঠিকসে..। বলতে বলতেই, দোকানের সামনের ল্যাম্পপোস্ট-এর গায়ে কোনোরকমে সাইকেলটা ছুঁড়ে দিয়ে, ধপাস করে মাটিতে, ঘাসজমিতে শুয়ে পড়লো, কিছুক্ষন নিথর, তারপর বুকে হাঁটার চেষ্টা করলো, কোনোরকমে উঠলো, সাইকেল ভালো করে স্ট্যান্ড করালো, আড়মোড়া ভেঙে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো, স্বগতোক্তির ঢং এ বললো, আপনারা দেখলেন একটা ছেলে পরে গেলো, ক্রমক্ষীয়মান স্বরে। এবারে টলমল করে আরেকজন দাঁড়িয়ে-থাকা ছেলের দিকে এগোলো, কাছে গিয়ে কিছু বললো বিড়বিড় করে, বা বললো না!! স্যাট করে আবার পিছিয়ে এসে পোস্টের গা ঘেঁষে ব্যালান্স করলো। এরই মধ্যে একটি টোটো বেরিয়ে গেল, যাতে স্বামী স্ত্রী উচ্চগ্রামে ঝগড়া করছে, প্রবল অশ্লীল শব্দের ব্যবহারসহ, বাচ্চার সামনে।... ছেলেটি আবার টলমল করে সাইকেল এর কাছে!! বুঝলাম ওর সেরেবেলাম (cerebellum) [মস্তিষ্কের পেছনের অংশ, যা শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখে!] নেশার চক্রান্তে সাময়িক অকেজো, তবে বাড়ী সম্ভবতঃ কাছেই, পৌঁছে যাবে ঠিক। পরিবেশটা ভালো লাগলো না,বাড়ী ফিরে আসলাম।

    বেশ bore করাচ্ছি আপনাদের, বোধহয়। তবু যারা ক্ষমা ঘেন্না করে পড়বেন, তাদের জন্য বলি, আগামী পর্বে, মেয়েদের নিজস্ব কিছু সমস্যার প্রসঙ্গ উত্থাপনের ইচ্ছে রইল। দেখা যাক।

    সবাইকে হোলির শুভেচ্ছা।
  • রিভু | 114.19.***.*** | ০৩ মার্চ ২০১৮ ০৭:৪৬374019
  • পড়ছি।
  • Swastisobhan Chaudhuri | 127.2.***.*** | ২০ মার্চ ২০১৮ ১৯:৪৩374020
  • (পঞ্চম পর্ব)

    বেশ কিছুদিন কোনো পর্ব লেখা হয়নি। আমার সর্বজনগ্রাহ্য 'ল্যাদ' তো ছিলই, পাশাপাশি কিছু ঘটনাবলী ছিল মনকে আলোড়িত করার মতো। কোথাও মূর্তি ভাঙ্গাভাঙ্গি, আবার কোথাও দূরতর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সহকর্মিনী চিকিৎসক কৃষ্ণার উপর অকথ্য, অসভ্য আক্রমণ কর্মরত অবস্থাতেই। বড় অসহায় লাগছিলো। এই বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থায়, মনের কথা আর কি লিখবো, বুঝতে পারছিলাম না।

    আজ তো লিখতেই হবে। আজ নারী দিবস। অন্য দিনের সাথে তফাৎ কিছু নেই, শুধু বছরের এই তারিখটাকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে 'নারী'দের জন্য। অনেকে এইসব আদেখলাপনা পছন্দ করেন না, তাদের সব ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী আছে এই নিয়ে।

    মোট মানুষের মোটামুটি অর্ধাংশের জন্য কেনো একটি বিশেষ আলাদা দিন?? ঐতিহাসিক ভাবে, শ্রমজীবী নারীদের নির্দিষ্ট সময় কাজ ও বর্ধিত মজুরীর দাবিতে ঐদিন একটি বড়োসড়ো আন্দোলন হয়েছিলো (আমি যতটুকু জানি, সেটা ভুলও হতে পারে)। আচ্ছা, এইখানে কোনো বৈষম্যের গন্ধ পাচ্ছেন? তা আছে বইকি!! পুরুষ শ্রমিকদের 'আটঘন্টা' কাজের দাবী স্বীকৃত হয়ে যাওয়ার পরেও নারীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি, আবার মজুরীও অনেকটাই কম, ইচ্ছেমতো। আজও এই বৈষম্য কেটেছে সবজায়গায়, এমনটা জোর গলায় বলা যায় না।

    তা, আমি কেনো 'নারী দিবস' নিয়ে এতসব বলছি?? আসলে আমার মা বছর দেড়েক আগে চলে গেছেন, বউ আছে, দিদি আছে। ছোট পারিবারিক বৃত্তের মধ্যে এরা আমাকে ঘিরে থাকা মানুষ এবং 'নারী'। এর বাইরেও বৃহত্তর পারিবারিক গন্ডীতে, বন্ধু বা চেনা-জানার মধ্যে আছেন আরো অনেক মানুষজন যারা আদতে 'নারী', এদেরকে অস্বীকার করে তো আমার জীবন হতে পারে না। এরা এবং সারা পৃথিবীজুড়ে আরো অন্য নারীরা প্রায় চিরকাল যে সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয় প্রতিনিয়ত, যে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার বা পারিপার্শ্বিক অসহনশীলতার শিকার হয় প্রত্যহ, অহরহ, তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা আমারও। তাকে স্বীকার না করলে আমি নিজেই একজন পিছিয়ে পড়া মানুষ!!

    আচ্ছা, এতক্ষণ অবধি যারা আমার এই 'ভ্যানভ্যান' পড়ছেন, তারা ভাবছেন, এসবের মধ্যে আবার মন কই??? মন আছে... আজ পৃথিবীতে যত মানুষ বেঁচে আছেন, চলে ফিরে বেড়াচ্ছেন, করে কমমে খাচ্ছেন, তাদের সকলেরই এই পৃথিবীতে আসা কোনো নারীর দশ মাসের গর্ভ ধারণের সূত্রে। পুরুষের কিন্তু এই ক্ষমতা নেই, কোনো যন্ত্রেরও নেই। এই অবস্থার, বা এর পূর্ব ও পরবর্তী অবস্থার মানসিক উদ্বেগ ও যন্ত্রণা নিয়েই এই লেখা।

    কথা না বাড়িয়ে প্রথম গল্পে আসি। একদিন চেম্বারে একজন ভদ্রমহিলা এলেন। একলাই। সাধারনতঃ আমি সঙ্গে কোনো পরিবারের লোক, নিদেনপক্ষে অতিপরিচিত কেউ না থাকলে চিকিৎসা শুরু করিনা। কিন্তু এক্ষেত্রে করেছিলাম।

    ইনি প্রবাসী। শিশু সন্তানকে নিয়ে শহরে নিজের বাড়িতে এসেছিলেন কয়েকমাসের জন্য। তখন গভীরতম বিষাদে আক্রান্ত ছিলেন। স্বামী সঙ্গে আসেননি, তিনি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করেন। ভদ্রমহিলার বাড়ীতে বাবা বৃদ্ধ, একা, মা মারা গেছেন আগেই। বাবাকে উনি এই বিষাদের খবর দিতে চান না, তবে দূর ভাষে স্বামীর সাথে কথা বলেই এসেছেন বলে জানালেন। নিজে একটি স্কুলে চাকরী করতেন, কিন্তু বছর আড়াই আগে গর্ভধারণের কিছুদিন পর চাকরী ছেড়ে দিতে হয়। বেসরকারী স্কুলে "child care leave" বা "maternal leave" এর অতো সুবিধা নেই। যাই হোক, এই কর্মহীন অবস্থাতেই ওনার বিষাদের সূত্রপাত। তারপরে বাচ্চা জন্মানোর পরে এই বোধ আরো বাড়তে থাকে। এরমধ্যে স্বামীর উপেক্ষা, সময় না দেওয়া, এইসব যন্ত্রণাকে আরো বাড়ায়। স্বামী কর্তব্য সব করলেও নিজের কাজ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন, কোম্পানীর প্রয়োজনে, এমনকী গর্ভাবস্থার সময়েও বিদেশে অন্ততঃ দুবার বেশ কিছুদিনের লম্বা কাজে থেকেও এসেছিলেন।

    এই নি:সঙ্গতার সূত্র ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আলাপ হয় একজনের সাথে। অন্তরঙ্গতা বাড়ে। নির্ভরশীলতা বাড়ে। কিন্তু, কিছুদিন আগে, সেই 'অন্তরঙ্গ' বন্ধুর বিয়ে ঠিক হয়। বিয়েটা হওয়ার কথা, আবার ওনারই এক আত্মীয়ার সঙ্গে। এই খবরে, উনি একেবারেই ভেঙে পড়েন। এই অবস্থাতেই আমার কাছে আসেন।

    প্ৰথম যে দুদিন আসলেন, চোখের জল বাঁধ উপচিয়ে পড়ছিলো। কথা বললাম, ওষুধ দিলাম। তৃতীয় বার থেকে দেখলাম অনেকটা সামলে নিয়েছেন। চতুর্থ বার দেখলাম, সবকিছু সামলে নিয়ে নতুন কাজকর্ম করার উৎসাহ তৈরী হয়েছে। এরইমধ্যে ফিরে যাওয়ার সময় এসে গেলো, ততদিনে স্বামীর প্রতি পুরোনো মমত্ববোধ ফিরে এসেছে।(ওদের বিয়ে ভালোবাসা করেই!)

    প্রবাসে আমার counterpart কোনো চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিয়ে, আপাতত ওষুধ খেয়ে যেতে বলেই আমার কাজ ফুরিয়েছিলো। কিন্তু, আলোড়িত হয়েছিলাম, বর্তমান দ্রুত সময়ের, গর্ভাবস্থার সুগভীর চাপের হিসেব কষে।

    আরেকটা ঘটনার কথা বলি। এক্ষেত্রে বউটিকে তার স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরাই নিয়ে এসেছিলো প্ৰথমে। রীতিমতো অসংলগ্ন আচরণ, প্রবল উত্তেজনা ছিলো তখন তার মধ্যে। যাই হোক, ওষুধ পত্র দিয়ে সেসব কমানো গেলো। একটু দেরীতেই দেরীতেই আসতো, তবে ওষুধটা খেতো ঠিকঠাক তখন।

    হঠাৎ একদিন এসে জানালো, মাসিক তিন-চার মাস বন্ধ। আমরা যেসব ওষুধ ব্যবহার করি তাতে এরকম অনেক সময় হয়, তবু ওকে যে ওষুধ দিয়েছিলাম, তাতে এই সম্ভাবনা কম। রুটিন অনুযায়ী 'ইউরিন টেস্ট' করালাম, পজিটিভ এলো। বোঝালাম যে, ওর ওষুধ চলাকালীন বাচ্চা এসেছে, তাই গর্ভস্থ ভ্রূণ-এর উপর কিছু খারাপ প্রভাব পড়লেও পড়তে পারে। এই অবস্থায় যদি বাচ্চা না রাখতে চায়, তাহলে, আবার বাচ্চা রাখতে চাইলে, তাহলেও, যেন একবার কোনো স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ-এর সঙ্গে যেন কথা বলে। ওদের আগে একটি বাচ্চা ছিলো, তাই এইসব বললাম। নইলে প্রথম বাচ্চা হলে, কখনোই 'না রাখার' কথা বলতাম না। ওরা বাচ্চা রাখতে চাইলো, আমি ওষুধ কমিয়ে দিলাম। তাতে আবার মানসিক অসুবিধা বাড়ায়, আবার ডোজ বাড়াতে হয়েছিলো।

    এইখানে একটা জরুরী 'ডাক্তারি' কথা বলে নিই। 'মাতৃত্ব' চলাকালীন যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তাদের মূলতঃ চারটে ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়। A, B, C, আর D। এরমধ্যে 'A' এর মধ্যে যেগুলো, সেগুলো প্রেগন্যান্সির সময় নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায়, আর 'D' অংশের ওষুধগুলো কখনোই ব্যবহার করা যায়না। আর 'B' এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা চলে প্রয়োজন হলে, বিপদের সম্ভাবনা কম। কিন্তু, 'C' হলে একমাত্র জরুরী ও বিশেষ প্রয়োজনেই ব্যবহার করা যেতে পারে, ভ্রূণের বিপদের সম্ভাব্যতা বেশী। আমাদের ব্যবহৃত মানে মনের অসুবিধায় যেসব ওষুধ ব্যবহার হয়, তারমধ্যে 'C' ক্যাটেগরি ভুক্ত ওষুধের সংখ্যা বেশি। 'B' আর 'D' এর সংখ্যা যৎসামান্য। আর কি কান্ড, 'A' তে একটিও নেই!

    যাই হোক, দ্বিতীয় বাচ্চাটাও ভালোভাবেই হয়ে গেলো। কিন্তু আবারো মেয়ে। চিকিৎসা চলতে থাকলো। ওষুধ কমানো হলেও, বাচ্চাকে মাতৃ দুগধ না খাওয়ানোর পরামর্শই দিতে হয়েছিলো, নিয়মমাফিক। কারণ এই ধরনের বেশিরভাগ ওষুধই, দুধে নি:সৃত হয়ে থাকে। এইসময়ে 'লাইগেশন' অপারেশন করে নিতে বলেছিলাম। করেনি। ব্যাস, কিছুদিন বাদে আবার সেই পুরোনো সিকুয়েল... মাসিক বন্ধ... 'ইউরিন টেস্ট'... পজিটিভ... এবারেও বাচ্চা রাখার সিদ্ধান্ত... আমার সতর্ক বাণী... সব বিফলে গিয়ে আবারও কন্যা সন্তান!!!

    আমি ভীষণ রেগে গিয়ে আর চিকিৎসা করতে চাইনি, কিন্তু ওরা এবারে চলে এলো হাসপাতালে। চিকিৎসা করতেই হবে। বাধ্যতামূলকভাবেই। না, ভবিতব্য বদলালো না। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় পুনরায় মাতৃত্ব এবং পুত্র সন্তান পেয়ে বাবা-মা এর গদগদ অবস্থা।

    এক্ষেত্রে কোনো শিশুরই কোনো জন্মগত ত্রুটি হয়নি, কিন্তু হতে পারতো। হয়তো ওষুধগুলো ততটা মারাত্মক নয়, যেহেতু যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়নি আজ অবধি, 'নিরাপদ' বলে দেওয়ার মত পরিসর তৈরী হয়নি। কিন্তু, এটাই আমাদের সমাজ, মানসিক অসুস্থতা স্বত্বেও, ওষুধ খেয়েও, পুত্র সন্তানের তাগিদে চার চারটি সন্তান উৎপাদন করতে হবে একজন নারীকে, এবং সে নিজেও এই চাপের বিরুদ্ধে কিছু বলবে না, বরং আনন্দের সাথে এই চাপ গ্রহণ করবে (আমি আলাদা করে মেয়েটির সাথে কথা বলেছিলাম, সন্তানধারনে ওর কোনো আপত্তি কোনো সময়েই ছিলো না!), সমাজের শিক্ষাটাও এমনি। অথচ এই প্রান্তিক পরিবারটির উপার্জন চারটি সন্তান প্রতিপালনের পক্ষে একেবারেই অনুকূল নয়। এবং এর মধ্যে, তিনটিই কন্যা সন্তান।

    অনেকটা বড় হয়ে গেলেও শেষ যে মেয়েটির কথা লিখবো, সেই মিষ্টি মেয়েটির মানসিক অসুস্থতা ধরা পড়ে ১৩-১৪ বছর বয়সে। খুবই গরিব ঘরের মেয়ে, চিকিৎসায় সেরেও ওঠে বেশ তাড়াতাড়ি, ওষুধ কমাতে কমাতে একসময় খুব কম ডোজের ওষুধই চলছিল।

    তারপর অনেকদিন খোঁজ নেই। হঠাৎ একদিন উদয়, এবারে 'কপাল ফাঁটা' অবস্থায়, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই। আবার আগের সমস্যা শুরু হয়েছে। চিকিৎসা শুরু করলাম, সাড়াও দিতে থাকলো, কিন্তু আচমকা গর্ভাবস্থা! প্রথম সন্তান, এতো কম বয়স, এবারের চিকিৎসায় একেবারে প্রাথমিক অবস্থা, না পারবো চট করে ওষুধ পত্তর কমাতে... প্রচন্ড রাগ প্রায় আক্রোশের আকারে ঝরে পড়লো, ওর স্বামীর ওপর। সে আবার একেবারেই বোকাসোকা ধরণের ছেলে। আমার রাগ দেখে গুটিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। পাঠানো হল স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞর কাছে। চিকিৎসা চলল, কিন্তু সাত মাসে 'মিসক্যারেজ'। আবার, এই একটা ঝটকায় মানসিক সমস্যা সাময়িক ভাবে বাড়লো, তবে আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে আসলো।

    মেয়েটি এখনো চিকিৎসা করায়, খুব অল্প ওষুধ খায়, এমনকি এলাকার বা গ্রামের কারো কোনো গন্ডগোল দেখলে হাসপাতালে আমার কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু ওর আর কোনো সন্তান হয়নি এখনো!!

    যাক, এই লেখায় আপনাদের অনেক A B C D শেখালাম, ডাক্তারির সমস্যা নিয়ে বললাম বেশী, সাহিত্য উপাদান একেবারেই কম। আসলে, একটা বিশেষ দিনকে স্মরণ করে একটা বিশেষ ধরনের সমস্যার বিশেষ একটা দিক তুলে ধরার চেষ্টা!! চাট্টিখানি কথা নাকি!!!

    আসলে কিন্তু বোঝাতে চাইলাম, মন আর শরীরকে আলাদা করা, বড় সহজ নয়। তার চেষ্টা করারও কোনো দরকার নেই, 'শারীরিক' আর 'মানসিক' আসলে মিলেজুলে থাকা বিষয়, পরিবেশ ও সমাজের সঙ্গেও। জানি না কতটা বোঝাতে পারলাম!!

    সবশেষে বলি, আমার আরেকজন রোগিনী আছে, এরও একটা মিসক্যারেজ... না তা ঠিক নয়!! জন্মানোর মাত্র কয়েকদিন বাদে বাচ্চাটা মারা যায়। এর সমস্যাটাও একটু জটিল। মুস্কিল হলো, 'D' ক্যাটেগরির একটি ওষুধে চমৎকার থাকে, কিন্তু তার থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ওষুধ-এ শিফট করার চেষ্টা করলেই বিগড়ে যায়। আবারো চেষ্টা করছি।

    শেষটুকু লিখলাম, এটা বোঝাতে যে মানসিক সমস্যা নিয়ে আমাদের নিজেদেরও কত মানসিক সঙ্কটে থাকতে হয়!! একটু বুঝুন, আপনারা, আর হ্যাঁ, নারীদের বুঝুন, তাদের সমস্যাগুলো একটু আন্তরিকভাবে বুঝুন। পূর্ণ কর্মক্ষমতার সময়ে প্রতি মাসে পাঁচদিন কি যন্ত্রণা, কি অসহায় রক্তক্ষরণ নিয়ে বাঁচতে হয়, সেটা বুঝুন। এটুকু বোঝার জন্য 'নারীবাদী'দের মতো চিন্তা-ভাবনা করতে হবে না, শুধু পারস্পরিক সহানুভূতিশীল হলেই হবে।

    নারীদের, বিশেষত কন্যাসন্তানদের নির্যাতনের এবং তৎপরবর্তী মানসিক সমস্যারও অনেক ইতিহাস আছে। আজ থাক, অন্য কোনোদিন, অন্য কোনো পর্বে। বা অন্য কোনো লেখায়।

    দেখলেন তো, আবারো সেই একদিন দেরী। কাল পার হয়ে গেছে 'নারী দিবস'। বুঝতেই পারিনি!!!
  • | 52.107.***.*** | ২০ মার্চ ২০১৮ ২০:০২374021
  • ৮ই মার্চ নারীদিবস। আজ বা গতকাল নয়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন