এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শহর এ দিল্লী

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৮৮ বার পঠিত
  • দিল্লীর বৈশিষ্ট্য হলো যে সে কোন একটা নির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক শহুরে বসতি নয়। তবে সে কী? অনেক দিন ধরে, অনেক রাজবংশের আমলে তৈরি নানা শহরের যোগফল হলো শহর এ দিল্লী বা দিল্লী মহানগরী। দিল্লীর ইতিহাসকে হাজার তিনেক বছর পেছনে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। লোককথা সূত্রে এ হলো পাণ্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছিল এই ইন্দ্রপথ সহ আরো চার পথ বা জায়গায় যারা পানিপথ, সোনপথ, তিলপথ আর বাগপথ বলে পরিচিত। দিল্লীর পুরোনো কেল্লার আসপাশে ইন্দ্রপথ বলে একটা গ্রামের অস্তিত্বের জন্য অনেকে এই লোককথার কল্পনার ইতিহাসকে সত্যি বলেও মানে। একসময় নানা যুগের সাত শহর নিয়ে গড়া দিল্লীর ধারণা সবাই মানতো। এখন কম বেশি চোদ্দটা শহরের আর তিনটে শহরায়ন কেন্দ্রের কথা সত্যির কাছাকাছি বলে মনে করা হচ্ছে।আসলে সাত শহর মনে করা হয়েছিল বাস্তবে বা লিখিত সূত্রে পাওয়া সাত সাতটি মধ্যযুগীয় কেল্লার উপস্থিতির জন্য যা শেষ কথা বলে ইতিহাসকাররা এখন আর মানেন না। 
     পৃথ্বীরাজরস নামের কাব্যতে তোমার রাজবংশের রাজা অনঙ্গপালকে প্রথম দিল্লীর প্রতিষ্ঠাতা বলা হচ্ছে। উনি সূরযকুণ্ড থেকে লাল কোটে রাজধানী স্থানান্তরিত করলেন। সেখানে নতুন কেল্লায় উনি ১০৫০ সাল নাগাদ, চন্দ্র বংশীয় এক রাজা সম্ভবত চন্দ্রগুপ্ত দুইয়ের জয়স্তম্ভ এনে বসিয়েছিলেন। তোমারদের হটিয়ে সেই কেল্লা অজমেরের চৌহানরা দখল করলেন দ্বাদশ শতকে। শেষ চৌহান রাজা পৃথ্বীরাজ তিন বা রাই পিথোরাকে হারিয়ে দেন মহম্মদ ঘোরি তরাইনের যুদ্ধে ১১৯১-৯২ তে। রাই পিথোরার কেল্লা ঘোরি বংশের হাতে গেল তারপর থেকে মোটামুটি লিখিত সূত্র পাওয়া যাচ্ছে দিল্লী বা তার ইতিহাসের। যার থেকে সন তারিখ মিলিয়ে সাত সাতটা মধ্যযুগীয় কেল্লাকে ঘিরে একটা সাত শহরের ইতিহাসের ছক তৈরি হয়েছিল। আগেই জানা গেল সেটা এখন পূর্ণাঙ্গ বলে মানা হচ্ছে না কারণ নিছক কেল্লা ভিত্তিক বা গ্যারিসন টাউন ভিত্তিক নয় দিল্লীর নগরায়নের দীর্ঘ আর জটিল ইতিহাস।তবু সেই ছকটা উল্লেখ করা যায়ঃ

    সাত শহর নিয়ে তৈরি দিল্লী

    প্রথম
    - কেল্লা রাই পিথোরা বা লাল কোট এখনকার মেহেরউলিতে অবস্থিত।
    - প্রথমে তোমার, পরে চৌহান রাজবংশ।
    - ১০৫২ খ্রিষ্টাব্দ।

    দ্বিতীয়
    - দিল্লীর হৌজ খাস এলাকার কাছে শহর ঘেঁষা শাহপুর জাট গ্রামে অবস্থিত সিরি কেল্লা।
    - আলাউদ্দিন খিলজি মঙ্গোল আক্রমণের মুখে দিল্লীর সুরক্ষা জোরদার করতে এই কেল্লা বানিয়েছিলেন।
    - ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দ।

    তৃতীয়
    - দক্ষিণ পূর্ব দিল্লীতে অবস্থিত প্রাচীন এক শহর ঘেঁষা গ্রাম ছিল তুঘলকাবাদ যা এখন দিল্লী নগর পালিকার অন্তৰ্ভূক্ত।
    - এখানে কেল্লা নির্মাণ করেন তুঘলক বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক।
    - ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দ।

    চতুর্থ
    - এখনকার দক্ষিণ দিল্লীতে অবস্থিত জাহানপানহা  (পৃথিবীর আশ্রয়স্থল) কেল্লা।
    - এটাও মঙ্গোল আক্রমণ থেকে দিল্লীর সুরক্ষা মজবুত করার জন্য বানিয়েছিলেন সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক।
    - ১৩৩৪ খ্রিষ্টাব্দ।

    পঞ্চম
    - যমুনার ধারে বাহাদুর শাহ জাফর মার্গের কাছে অবস্থিত ফিরোজাবাদ বা ফিরোজ শাহ কোটলা।
    - বানিয়েছিলেন সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক। এখনো চালু জামি মসজিদ আর পুরোনো ধাপকাটা কুয়ো ছাড়াও এখানে অশোকের আমলের একটা স্তম্ভও পুনঃব্যবহৃত হয়েছিল যার ব্রাহ্মী লিপি পাঁচশো বছর পর জেমস প্রিন্সেপ পাঠোদ্ধার করেন ১৮৩৭এ।
    - ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দ

    ষষ্ঠ
    - দিল্লীর প্রগতি ময়দানের কাছে দিল্লী-মথুরা রোডে অবস্থিত দিনপানহা (ধার্মিকের আশ্রয়স্থল), শের শাহবাদ বা পুরনো কেল্লা।
    - লোকশ্রুতি হলো এখানেই নাকি ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী ছিল। বাদশাহ হুমায়ুন নতুন মোঘল রাজধানী দিনপন্হা বানিয়েছিলেন ১৩৩০এ, শের শাহ সেটা আক্রমণ করে ভাঙ্গচুর করার পর সেখানেই নতুন করে বানালেন শুরু করেন শের শাহবাদ কিন্তু শেষ করার আগেই তিনি মারা গেলে সুরি বংশের পতন হয়। ১৫৫৫ এ আবার হুমায়ুন ফিরে এলেন পারস্য থেকে।মোঘলরা পুনরায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করলো। শের শাহের অসমাপ্ত কাজ শেষ করলেন হুমায়ুন। কিন্তু স্থাপত্যের শৈলী অভিন্ন হওয়ায় কোনটা মোঘলরা আর কোনটা আফগানরা বানিয়েছে তা আলাদা করা যায়না। এরপর থেকে ক্রমশ এটা পরিচিত হয়ে যাচ্ছে পুরোনো কেল্লা বলে।এখানে নানা পর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে খ্রিষ্ট পূর্ব ১০০০ এর আগে প্রাক মৌর্য থেকে মোঘল যুগ অবধি বসতির চিহ্ন  পাওয়া গেছে। কিন্তু এই তথ্য থেকে থেকে মহাকাব্যের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরীস্থল বলে এর ঐতিহাসিকতা সুপ্রমাণিত নয়।
    - ১৩৩০/১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দ

    সপ্তম
    - শাহজাহানাবাদ বা লাল কেল্লা
    - মধ্য এশিয়ায় বালক ,  বাদাকশানে ১৬৪৬-৪৭ এ শাহাজাদা ঔরঙ্গজেবের নেতৃত্বে বিজয়ী অভিযান চালাতে গিয়ে মোঘল ফৌজকে মার খেয়ে ফিরে আসতে হয়। তারপর শাজাহানের অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়ালো দিল্লী মহানগরের মধ্যস্থলে এখনকার পুরোনো দিল্লীতে দেওয়াল ঘেরা নতুন শহর শাহজাহানাবাদ নির্মাণ নিয়ে মেতে থাকা। মোঘল চারবাগ কায়দায় এ শহর তৈরি হয়েছিল যা স্থাপত্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বাগানগুলোর আয়তাকার বা বর্গাকার প্যাটার্নে পরিস্ফুট। এই শহর বানানোর প্রাথমিক খরচ ষাট লাখ টাকা। যেখানে আগ্রার কেল্লা স্থাপত্য আর মসজিদের খরচ ৫৩ লাখ আর তাজমহল সহ মুমতাজাবাদ নির্মাণের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ ৫০ লাখ।
    - ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে ১৬৪৮এ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও কিছু কাঠামো, চারপাশের দেওয়াল আর জামা মসজিদ বানাতে আরো আট বছরের বেশিই লেগেছিল।

    দিল্লীর নানা কেল্লা শহর বানানোর প্যাটার্ন লক্ষ্য করলে দেখা যায় উত্তরের (কিছুবা বা পূবের) খোলা জায়গা, যেখান দিয়ে পাহাড়ি ঠাণ্ডা হাওয়া আসে, ভিড় ছেড়ে ক্রমশ সেদিকেই নতুন শহর বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে অর্থাৎ একটা উত্তরমুখী বেড়ে চলার প্রবণতা দেখা যায়।একমাত্র তুঘল কাবাদ নির্মাণে এই প্যাটার্ন অনুসৃত না হলেও সে সময়েও ভিড়ভাট্টা ছেড়ে নদীর তীরে ফাঁকা সুবিধাজনক জায়গায় শহর বানানো হয়েছিল।

    সূত্র :
    ১) Delhi through the ages, Essays in Urban History, Culture and Society edited by R E Frykenberg
    ২) People Taxation and Trade in Mughal India, Shireen Moosvi
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রীমল্লার বলছি | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:৩৮734104
  • তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। যদি আরও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যেত, ভালো লাগত। 
  • upal mukhopadhyay | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:৪৪734111
  • @পাপাঙ্গুল আপনার ব্লগ খুব ভালো  লাগলো তবে  আমার  উদ্দেশ্য আলাদা ।আমি  একটা নভেল  লিখছি মহাবিদ্রোহ  নিয়ে ।সে প্রসঙ্গে  পরপর  ব্লগ  করতে  থাকবো  থাকবো  বা  লেখাটার কিছু  অংশ দেবো ।
  • পাপাঙ্গুল | 49.206.***.*** | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:৪৪734113
  • উপলবাবু , অবশ্যই yes
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন