সন্ধ্যায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে প্রধান বিচারপতিকে তাই দ্রুত চলে যেতে হয়। যে দেশে ভুরি ভুরি মামলা জমে রয়েছে, যে দেশে সামান্য একটা চুরির বিচার পেতেও দিন মাস বছর পেরিয়ে যায় সে দেশে আরজি কর থোড়িই কোনও গুরুত্বপূর্ণ মামলা? বরং সন্ধ্যার অনুষ্ঠানটি অনেক বেশি জরুরী। কবি সেই কবেই বলে গেছেন "বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে" তা কী আর সাধে, তিনি যে ত্রিকালদর্শী।
চলছিল মামলা হাইকোর্টে কাল হলো তার সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে। এ অনেকটা অতি লোভে তাঁতি নষ্টের মতো কেস। সকলেই ভাবলো সুপ্রিম কোর্ট যখন সুয়োমুটো কেস করেছে নিশ্চিত এর একটা বিহীত হবে। আসলে রাষ্ট্রের অধীনে যে আইন ব্যবস্থা তাকে তো রাষ্ট্রের নির্দেশেই চলতে হবে, তাতে কী এসে গেলো জরুরী অনুষ্ঠানে যেতে গিয়ে যদি শুনানিই না হয়, কী এসে গেলো গত দু'দিনে তিন বার শুনানির সময় দিন পেছিয়ে যায় তো? অনুষ্ঠান জরুরী বিচার নয়। কারণ যত মহামান্য বিচারপতির দিন ঘনিয়ে আসছে রিটায়ার্মেন্টের তত তার ব্যক্তিগত কাজ বাড়ছে। অতএব আগামীকাল শুনানি হবে, কারণ তিন মাস বিচার পড়ে থাকা আবার কোনও বড় বিষয় নাকি, মামলা একটু না পচলে তার গুরুত্ব বাড়ে না।
এখনও পর্যন্ত এই মামলার এক এবং এক মাত্র স্ট্যাটাস আসামী একজন এবং আগামীকাল থেকে প্রতিটি কাজের দিন শিয়ালদহ কোর্টে এই মামলার শুনানি চলবে। এই যে এত মুখবন্ধ খাম সুপ্রিমো কোর্টে জমা পড়ল, বিচারপতিত্রয় সেই খামের রিপোর্ট পড়ে উদ্বিগ্ন হলেন, সন্দীপ ঘোষের মোবাইল থেকে ডেটা উদ্ধার হল, প্রমাণ লোপাটের তত্ত্ব বোঝা গেল জলের মতো পরিষ্কার, তার কী হল? তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠলো, কীসের জন্য সন্দীপ বাহিনী এত সব করলো, উত্তর নেই, কীসের কারণে টালা থানার ওসি সন্দীপকে সাহায্য করলেন? উত্তর নেই, আসামী কিন্তু সেই একজন। জুতোর শুকতলা খয়ে যায় ভারতীয় আইনে বিচার পেতে, মাসের পর মাস বছরের পর বছর শুধু তারিখ। সেই যে সানি দেওল দামিনী সিনেমায় বলেছিলেন, "তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ তারিখ পে তারিখ, রহে যাতি হ্যায় সির্ফ তারিখ'। হল জুড়ে সিটি পড়েছিল, সানি দামিনীর বিচার ছিনিয়ে এনেছিলেন, আমাদের রক্ত গরম হয়েছিল, হল ভরেছিল, সিনেমা ব্যবসা করেছিল, কিন্তু নিট ফল? আ বিগ জিরো।
আন্দোলনের শুরুতেই বলেছিলাম মিনিমাম চার বছরের আগে এই মামলার শুনানি হবে না। খুব মির্যাকল কিছু ঘটলে তবে বছর দুই লাগতে পারে। কারণ? জননেতা নেই, তিনি তার পকেট গরম করতে ব্যস্ত, গত ১৫ বছরে ভারতীয় রাজনীতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কারণ গত ১৫ বছরে ধীরে ধীরে বিরোধী শূন্য করে ফেলা হয়েছে ভারতীয় রাজনীতিতে, এখন বিরোধী মানেই সে গোপনে আসলে সহযোগী। যতই আমরা সেটিংস হতে দেব না বলে রাস্তা কাঁপিয়ে মিছিল করি সেটিংস তো হবেই। হবেই মানে হবেই। কারণ আমরা এখনও অন্তঃসার শূন্য। এখনও আমরা আন্দোলন বলতে বুঝি মোমবাতি আর শান্তিপূর্ণ ধর্না, তাতে না তো বিচার ব্যবস্থার কিছু এসে যায়, না তো সরকারের আর না তো রাষ্ট্রের। আমাদের যত রাগ যত ক্ষোভ আসলে কালীপুজোর ড্যাম পরে যাওয়া পটকা বাজির মতো, দীর্ঘদিন ফেলে রাখার ফলে জ্বলে ওঠার সময় দমাস করে আওয়াজের বদলে ফুসস আওয়াজ করে খানিকটা ধুঁয়ো ছাড়ে। এখনও গোটা আন্দোলনে আমরা একবারও প্রতিবাদ বলতে পদত্যাগের দাবি জানাতে পারি না, কারণ নানান পলিটিক্যাল সমস্যা। আসলে ঘর বাঁচিয়ে চাকরি বাঁচিয়ে স্বার্থ বাঁচিয়ে তবে আন্দোলন। আসলে পলিটিক্যাল কারেক্ট থাকতে হবে আমাদের। আমি ভাই অতশত বুঝি না, পুঁথিগত বিদ্যে সামান্যই। রাজনীতি বুঝি না, তাই সরে আসতে বাধ্য হয়েছি, কারণ অন্ধ সমর্থন আমার দ্বারা হয় না।
তাহলে? তাহলে আর কিছুই না, আমরা আসলে ওই ড্যাম পড়ে যাওয়া ফুলঝুরি অথবা বুড়িমার চকোলেট বোমা, ধোঁয়া আছে, আওয়াজ নেই, আগুন আছে কিন্তু সামান্যই। আমরা বছর ভর নানা কর্মসূচি নেব, ওমুক আলো জ্বালো, তমুক আলো জ্বালো, বাড়িতে অরন্ধন, এখানে ওখানে প্রদীপ বা মোমবাতি গোঁজা, প্রতীকী অনশন, কিন্তু তার লাভ কী? শুনেছি লাভের গুড় পিঁপড়েতে খায়। এও তাই, আমরা জেগেছি নিঃসন্দেহে, কিন্তু বড় প্রশ্ন কতটা জেগেছি? আচ্ছা গত ৮ আগস্ট থেকে ছেড়ে দিলাম, গত এক মাসে কতগুলো ধর্ষণ খুন এই রাজ্যে হয়েছে কোনও হিসেব আছে তার? এত বড় আন্দোলন যখন এখনও অপরাধীর মনে, অপরাধীদের মনে সরকারের মনে ভয় জাগাতে পারেনি, কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে পারেনি তখন এই আন্দোলনের এতদিনের কর্মসূচির পরিণাম কী? পরিণাম হল- রেফারেল ব্যবস্থা চালু হল, তাও বেড পেল না বা ভর্তি হল না রোগী, ৫৯ জনকে সাসপেন্ড করা হল তদন্ত করে, কিন্তু রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রধান বললেন আরে না না আমাকে জানানো হয়নি, অতএব এই সাসপেনশন অবৈধ এবং কোর্টও সেই রাজ্য প্রধানের সমর্থনে মাথা দোলালেন, দোষীরা ছাড়া পেলেন নতুন সংগঠন তৈরি করলেন। তিনুরা এলো, আন্দোলন নিয়ে লিখলেই আপনার চোদ্দগুষ্ঠী তুলে খিস্তি করলেন।
আজ এই তিন মাস পরে একটা কথা জানতে বড় ইচ্ছে হয়, এই যে স্বাস্থ্য পরিষেবার এই হাল, রোজই কিছু না কিছু শোনা যায় তারপরও আমার আপনার ঘর সেফ ভেবে নিচ্ছি কী করে? রোগীর কিছু হলে ডাক্তার কেলিয়ে সমাধান পাচ্ছি কি? অচলাবস্থা কাটাতে সমস্ত কিছু আজও আমরা অচল করে দিতে পারি না। আমাদের দম নেই, এদিকে নেতাজির জন্মদিন এলে আমরা হেদিয়ে মরি, আমাগো একখান নেতাজি আসে, আমাগো একখান ক্ষুদিরাম আসে, আমাগো একখান কানাইলাল আসে, আমাগো একখান ওমুক আসে। আরে শালা ওরা ছিল ওরা ওগো কাজ কইরা গেসে, তোরা কী ডা করলি? সরকারি না পেয়ে লোন নিয়ে বাড়ির লোককে প্রাইভেটে ভর্তি করালি, সরকারি স্কুলে শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো নয় অতএব খেয়ে না খেয়ে মোটা টাকা দিয়ে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করালি, চাকরি নাই, ঘুষ দিয়ে ব্যাকডোর দিয়েই সই চাকরি পেলি, অর্থাৎ আমার প্রবলেম সলভ, ভার মে যায়ে দুনিয়া। সমস্ত কিছু অচল করে দিতে আমাদের আসলে ফাটে।
মনে পড়ে দিল্লিতে যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, ইউপি, পাঞ্জাব, হরিয়াণার সহপাঠীরা আমার মত কয়েকজন বাঙালি পড়ুয়াকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করত। আমরা ডরপোক আছি, আমরা খালি রাজনীতি করি, আমাদের বাংলা মানেই জ্যোতি বসু আর মমতা দিদি। কথায় কথায় শুনতে হত আরে বাঙ্গালি শালে তেরি বস কা কুছ নেহি, খালি পলিটিক্সিই কার সাকতে হো, যাও বাঙ্গাল লৌট যাও, মমতা বনো, জ্যোতি বসু বানো, ইয়ে সব তুমহারা বস কা নেহি। বেশিরভাগ হিন্দিভাষী মানুষের কাছে আজও বাঙালি মানেই বাংলাদেশী এবং ডরপোক বাঙালি। ফলে চলুন আমরা যাই, মোমবাতি জ্বালি, নানা কর্মসূচির তদারকি করি আর বাসে ট্রামে ট্রেনে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে, ফেসবুকে বলি এই রাজ্যের কিছু হবে না। আমাদের কিছু না হলে রাজ্যেরও কিছু হওয়ার নাই জেনে রাখো বাঙালি।
রাজনীতি আমার দ্বারা হবে না, অফিস পলিটিক্সই ঠিক মতো বুঝি না তায় রাজ্য দেশের রাজনীতি। আমি যা বুঝি তা হলে আমার ঘরে কেউ ঢুকলে আমার পরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে আমার ঘরে একটা ভয়ঙ্কর শ্বাপদ ঢুকে গেলে যতক্ষণ না আমি সেটাকে মেরে তাড়াব ততক্ষণ থামব না।
বিচার তুমি দেবে না/ নিস্তার পাবে না" শুধু স্লোগানে নয় কাজেও হোক। নইলে আওয়াজই হবে সেই আওয়াজে কারও ঘুম ভাঙবে না। ওই যে ভগত সিং বলেছিলেন, "যো লোগ উঁচা শুনতে হ্যায়, উনহে ধামাকে কি জরুরত হ্যায়"। শেষমেশ আমরা না ওই ডরপোক আর ন্যাকা বাঙালিই না হয়ে থেকে যাই।
-ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত