এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • প্যাঁকাটি

    abhisek bose লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ জুলাই ২০২৪ | ১৪০ বার পঠিত
  • ওকে সেই ছোটবেলা থেকেই চিনি। পিঠে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে, ইষৎ সামনে ঝুঁকে, ড্যাবড্যাবে চোখ মেলে এদিক ওদিক দেখে, যেন পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতো। এইসব বেশি পুরনো কথা নয়। এই ন' দশ হাজার পাতা দিন ফিরে গেলেই পাওয়া যাবে। মাথায় এক সুতো চুল নেই। চেহারাটা বুড়োটে কিন্তু মুখটা শিশুর মতো। এই অসুখটা প্রোজিরি়য়া নাকি অটিস়ম, ওদের প্রতিবন্ধী বলে নাকি ভিন্নভাবে সক্ষম, সেটা বোঝার মতো বয়স ছিলনা। ও আসতো বাঁধরোড থেকে হেঁটে হেঁটে। আমাদের পাড়ায় ওর দিদি জামাইবাবুর বাড়ি। এই সামান্য আধা কিলোমিটার রাস্তা দিয়ে আসার সময় শ' খানেক লোকের সাথে ওর দেখা হতো। একটু কমবয়সীরা সামান্য মজা করতো ঠিকই কিন্তু কেউই ওকে বিরক্ত করতো না। আমরা যারা সদ্য হাফ প্যাডেল থেকে ফুল প্যাডেল সাইকেল চালাতে শিখেছিলাম, ওর সামনে সাইকেলটা থামিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতাম।

    ও নিজের আঙুলগুলো দিয়ে আলতো করে হাতের তালুটা ছুঁয়ে দুটো হাত বুকের কাছে নিয়ে এমনভাবে দোলাতো যেন একটা নবজাতককে কোলে নিয়ে দোলাচ্ছে। তারপর ওর দুর্বোধ্য ভাষা আর ইশারা মিশিয়ে বোঝাতো —ওটা আমার হবু সন্তান।
    ___________

    দীপ্তাভর পা গুলো ছিল প্যাঁকাটির মতো সরু ।  

    (দীপ্তাভর আসল নাম দীপ্তাভ নয়। এই নামটা আমি দিলাম।) 

    দীপ্তাভর চোখে থাকত আতস কাঁচ মাফিক মোটা চশমা । না পারতো ঠিক করে দৌড়তে , না পারতো জোরে ফুটবলে কিক্ করতে। তাও রোজ বিকেলে আমাদের ফুটবল ক্যাম্পে আসতো। আমাদের সাথেই দৌঁড়তো। হোঁচট খেতো, টলমল করতো, তাও দৌড়তো। একবার মিঠুন চক্রবর্তী বনাম মালদা একাদশ টুর্নামেন্টে যখন মিঠুন আর কিমবদন্তী সব প্রবীণ খেলোয়াড়দের সম্বর্ধনা জানানোর জন্য আমাদের পরিস্কার জার্সি আর বুট পড়ে মাঠে আসতে বলা হয়েছিলো। সেদিন ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের (DSA) মাঠে ঢোকার ঠিক আগে, একটা ছোট্ট গর্ত লাফ দিয়ে পেরোতে গিয়ে, দীপ্তাভ সাদা বুটে কাঁদা মেখে ঢুকেছিলো। মোদ্দা কথা ফুটবলার হওয়ার মতো কোনো উপাদান ওর মধ্যে ছিল না। তাও ও রোজ আমাদের সাথে পুষ্পেন স্যারের ক্যাম্পে ফুটবল প্র্যাকটিস করতো। ওর মা-বাবাও নিশ্চয়ই জানতো ,ও কোনোদিনও ফুটবলার হতে পারবে না, তবু রোজ ওকে মাঠে পাঠাতো।

    আমার খালি মনে হতো কেন যে ওর মা বাবা ওকে জার্সি, বুট, সিনগার্ড পড়ে মাঠে পাঠায়!? যেভাবে খেলার সময় ট্যাকল হতো, তাতে যেকোনো সময় ওর সরু পা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে পারতো।
      ________________

    আমাদের মধ্যে অনেকেই ফুটবলার হতে পেরেছে।  অনেকে হতে পারেনি। বেশিরভাগই একটা বয়সের পরে শক্ত পা নিয়েও ফুটবলার হতে চায়নি। দীপ্তাভ কিন্তু সবার সাথে দৌঁড়তো। দীপ্তাভর মতো ওর  মা-বাবার মনের জোর ছিল নিশ্চয়ই।
     __________

    ওকে এখনো দেখতে পায়। মাঝে মাঝেই রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। ইষৎ সামনে ঝুঁকে, ড্যাবড্যাবে চোখ মেলে এদিক ওদিক দেখে, পেছন থেকে ধাক্কা খাওয়ার মতো করে, রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করে। চেহারায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। মাফিনকে স্কুলে দিতে যাওয়ার সময় বাঁধের উল্টো দিক থেকে নেমে আসছিল। স্কুটিটা ওর সামনে দাঁড় করিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও আলতো করে আমার হাতের তালুতে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে, দুটো হাত বুকের কাছে নিয়ে বাচ্চা দোল খাওয়ানোর মতো দোলাতে শুরু করলো। তারপর মাফিনের দিকে চোখ পড়তেই ওর ড্যাবড্যাবে চোখটা আরো গোলগোল করে আমার দিকে তাকালো। মাফিনও অবাক হয়ে ওকে দেখছিল। আমি ওর বোঝার মতো করে ইশারায় বোঝালাম —'আমার মেয়ে।' 

    ওর শিশুর মতো মুখটা ঝলমল করে উঠল। তারপর দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বলে, খুশি মনে আবার হেলতে দুলতে সামনে এগোতে শুরু করল।

    (ফেসবুক পোস্ট / ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৩) 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন