এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভোটরঙ্গ দুটো আলাদা সময় : দুটো ছবি

    Debanjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ জুন ২০২৪ | ৩৪০ বার পঠিত
  • পর্ব ১
    এখন দেশে ভোটরঙ্গ নিয়ে মানুষের আশা আকাঙ্খা উচ্ছাস উল্লাস আশংকা সবই চরমে। আমার নিজের এই ভোটযুদ্ধের ব্যাপারে নিজের জীবনের দুটো অভিজ্ঞতার কথা আজকে বলবো। প্রথমেই বলে রাখি এদুটো কিন্তু লোকসভা বা বিধানসভা নয় পাতি এলাকার মিউনিসিপ্যালিটির ভোটের কিন্তু আজকে এখানে এই ঘটনা উল্লেখ করলাম ভোটরঙ্গের একটা ছবি তুলে ধরতে।

    প্রথম ঘটনা ২০০৫ সালের। আমাদের নতুন ফ্লাট কিনে নতুন পাড়াতে ওঠবার পরে ওটাই ছিল আমার প্রথম ভোট। তা সকাল সকাল ৮ টার মধ্যেই বুথে গিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার ঠিক আগে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তাকে চিনতাম এই জন্য যে পাড়াতে তিনি খুব সম্ভবত: ছোট একটা মুদিখানার দোকান তখন চালাতেন; সেই সময়ে মনে হয়েছিল তার বয়েস এই চল্লিশের কোঠা সবে ছাড়িয়েছে। গালে কাঁচাপাকা দাড়ি, গায়ে আটপৌরে একটা প্যান্টশার্ট, মুখ থেকে বিড়ির গন্ধ আসছে, হাতে একটা পুরোনো বাজারের ব্যাগ; খুব সম্ভব: ভোটটা দিয়ে তিনি বেরিয়ে যাবেন রোজকার বাজার করতে। ভোট এর লাইন দিয়ে দাঁড়ানো আর পাঁচটা মানুষের সঙ্গে তাকে আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই। তবুও এতগুলো লোকের মধ্যে তাকে আলাদা করে মনে রাখবার একটাই কারণ তার বাক্যবাণ। লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অবস্থাতেই তিনি উগরে দিচ্ছেন তার যত রাগ ক্ষোভ দুঃখ, এবং পুরো ঝালটাই তিনি ঝাড়ছেন সেসময়কার শাসক দলের বিরুদ্ধে। ভোটের লাইন এ তার আগে পিছে কেউ শুনছে কিনা বিশেষত শাসক দলের কেউ যদি শুনে ফেলে সেই নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই তিনি শুধু উগরে দিচ্ছেন তার যেন দুনিয়ার যত রাগ সব শাসক দলের উপরে পারলে শাসক দলের ক্যান্ডিডেটের জামানত তিনি একই জব্দ করে দেবেন। সেই সময়টা এখনকার মতোই মে বা জুন মাস ছিল যতদূর মনে পড়ছে। তা ভ্যাপসা গরমের মধ্যে ভদ্রলোকের এসব শাসক দলের এগেনস্টে করা এসব টুকরো টুকরো চোখা চোখা কমেন্টস খারাপ লাগছিলো না শুনতে; সেসময়ে স্মার্ট ফোনের বাজারে আগমন হয়নি কাজেই গরমে লাইন দিয়ে দাঁড়াবার সময়ে কিছুক্ষনের জন্য হলেও এইরকম একটা ডিস্ট্রাক্শন ভালোই লাগছিলো। তখন আমি কলেজে পড়ি, খবরের কাগজে পড়ে ছিলাম যে দেশের মেট্রো শহর গুলো যেমন মুম্বাই বা দিল্লিতে ব্যস্ত মানুষ ভোট দিতে খুবই কম যায় এখন মনে হচ্ছিলো এই ভদ্রলোকের রানিং কমেন্ট্রি ওসব জায়গার বুথগুলোতে শোনাতে পারলে হয়তো ভোটিংপার্সেন্টেজের রেট একটু বাড়লেও বাড়তে পারে! তা এইরকম করতে করতেই ভোট দেবার ঘরে আমাদের পালা এসে পড়লো, একসঙ্গে ৪-৫ জনের ডাক পড়ছিলো ভোট দেবার সময়। আমার সামনের ভদ্রলোকের যখন পালা এলো তখন তিনি তার ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড দেখাবার পরেই প্রিসাইডিং অফিসার মুখ তুলে বললেন, "আপনার তো ভোট পড়ে গেছে।" অদ্ভুত ব্যাপার, যে ভদ্রলোক এতক্ষন এতকিছু বলছিলেন তার মুখটা হয়ে দাঁড়ালো বিশ্বকাপ ফাইনালে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ৭০ হাজার দর্শকের "সচিন সচিন" চিৎকারের মধ্যে একটাও বল না খেলে তেন্ডুলকর রান আউট হয়ে গেলে যেরকম হতো ঠিক সেরকম! "আমার ভোট!" বলে অস্ফুটে একটা কথা বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন আস্তে আস্তে ভোটের ঘর থেকে। এতক্ষন শাসক দলের নাম করে এতগুলো চোখা চোখা বাক্যবাণ চালানো মানুষটা মনে হলো শাসকদলের আসল জায়গাতে আসল শক্তি প্রদর্শনে একেবারেই মুহ্যমান!

    পরের ঘটনা ২০১৫ সালের। মাঝখানে ১০ ১০ টি বছর কেটে গেছে, জীবনকে দেখার চোখটাও বদলে গেছে অনেকটাই। সেবারে মনে পড়ছে মে মাসের মাঝামাঝি সময় ছিল সেটা। ভোট পড়েছিল একটা রবিবারের দিনে। সেই সপ্তাহে নেপালে একটা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেটা মনে আছে। কলকাতাতেও আফটারশক হচ্ছিলো তার পর কয়েকদিন ধরেই। সেদিন সকাল থেকেই আমার ইচ্ছে করছিলোনা ভোট দিতে যেতে। ওই যে বললামনা আমার জীবনবোধ আস্তে আস্তে জীবনের মার্ খেতে খেতে অনেকটাই পাল্টে যাচ্ছিলো সেই সময়টাতে। কি হবে ভোট দিয়ে, আমার জীবনের কি কোনো উন্নতি আদৌ হতে পারে ভোট দিয়ে! আন্তোনিও গ্রামসি ভোটাধিকার আর সাধারণ মানুষের ক্ষমতা নিয়ে যাই বলুন সারা সপ্তাহ ধরেই মনে হচ্ছিলো যাকেই ভোট দিয়ে দি আমার জীবন কি বদলাবে একটুকুও! রবিবারের অনেক আগেই ঠিক করে ফেললাম যাই হোক এবারে আর ভোট দেবোনা। রবিবার ছুটির দিন ভোট দিয়ে আর সময় নষ্ট করবোনা একেবারেই। কিন্তু বিধি বাম! আমার মনে যাই থাকুক না কেন সর্বশক্তিমানের বোধয় ইচ্ছে ছিল অন্যরকম! রবিবার সকাল নটার সময়েই আমাদের পাড়াতে আরেকটা আফটারশক হলো। "ভূমিকম্প ভূমিকম্প!" বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের পুরো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের সবকটা ফ্ল্যাট থেকে আমরা সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাম। এভাবে ৫ ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবার পরে হঠাৎ করে ফ্ল্যাটের আমাদের সমবয়সী কোনো একজন বললো, "নাহ বসে বসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি হবে যাই গিয়ে ভোট দিয়েই আসি"। ব্যাস এসব ক্ষেত্রে যা হয় একজন বললে ভেড়ার পালের মতো আরো অনেকে পিছনে এগিয়ে যায়, এখানেও ঠিক তাই হলো। কিচ্ছুক্ষন পরেই দেখলাম ফ্ল্যাটের আরো অনেকের সঙ্গে আমিও ভোটিং বুথের জন্য পাড়ার যে স্কুল সেদিকে যেতে শুরু করে দিয়েছি। পাঠক যদি ভেবে নেন সর্বশক্তিমানের ইচ্ছে এইখানেই পূর্ণ হয়ে গেলো তাহলে খুব ভুল করবেন। আমাকে সেদিন উনি জীবনের যে গল্পটা দেখাতে চাইতেন সেটা তখনই শুরু হচ্ছিলো! ভোটের লাইন এ দাঁড়াবার পর দেখি ভিড় প্রায় একেবারেই নেই বললেই চলে। ভূমিকম্পের আফটারশকের ভয়েই হোক বা জীবনের ধারাপাতের উপরে ঘেন্না ধরে যাওয়াই হোক সকাল দশটা প্রায় বেজে গেলেও ভোটের লাইন তখন প্রায় ফাঁকা! ফ্ল্যাট থেকে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম ভোটের লাইন এ। কাকতালীয় কি না জানিনা কিন্তু দেখি সেই ১০ বছর আগের ভদ্রলোক এবারেও ঠিক আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে। গত বারের থেকে তার চেহারাতে ফারাক বিশেষ নেই তবে এবারে যেন মনে হলো তার জীবনের উপরে ক্ষোভ আগের থেকে অনেকটাই কম কেননা এবারে শাসকদলকে নিয়ে চোখা টুকরো তির্যক মন্তব্যের পরিমান দেখলাম অনেকটাই কম। যেহেতু লাইন বেশ ছোট ছিল তাই ১৫ মিনিটের মধ্যেই ভোটের ঘরে আমাদের পালা চলে এলো। ভোটার কার্ড দেখিয়ে, আঙুলে কালী লাগাতে যাবো ঠিক সেই সময়ে আমার পিছনের সেই ভদ্রলোকের ভোটার কার্ড দেখাবার পালা এলো ঠিক সেসময়ই শুনলাম প্রিসাইডিং অফিসারের মুখে ঠিক ১০ বছর আগের সেই দৈববাণী আরেকবার " আপনার ভোট তো হয়ে গেছে"! আঙুলে কালী লাগিয়ে ভোটিং মেশিনের ঘরে ঢোকবার মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম সেই আগের মতো অন্ধকার মুখ করে ভদ্রলোক বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে একটু একটু করে!

    অনেক বছর ধরেই ভোট দিচ্ছি কিন্তু আমার ভোটার জীবনের এইদুটো ঘটনা আমাকে সর্বশক্তিমান যা দেখিয়েছেন সারা জীবন মনে থাকবে। সত্যি ভোটের লাইন টাতে কত লোক যে থাকে জীবনের কত বিচত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অসিতবরণ বিশ্বাস | 2401:4900:7453:2e4f:f941:3fa7:da81:***:*** | ০৩ জুন ২০২৪ ২০:৫৫532671
  • বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিলেন ? ভোট হয়ে গেছে !
    আমার মানতে একটু অসুবিধা হলেও একটা জিনিস দিব্যি বুঝতে পারলাম: 
    গত দশ বছরে সত্যিকারের পরিবর্তন হয়েছে  !
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন