বোম্বে সিনেমার রাগী যুবক অমিতাভ বচ্চন এবং জনসংস্কৃতিতে তাঁর প্রভাব নিয়ে বাঙালি পন্ডিতরা পেপারে পেপারে প্রচুর অশ্রুজল ঝরিয়েছেন। অমিতাভ নায়ক হিসেবে এতই লম্বা যে পর্দায় আঁটেননা, গলা এতই ব্যারিটোন যে সাউন্ড সিস্টেম তাকে ধরতে পারেনা। তিনি নিপীড়িতজনের অশ্রুজলকে ধারণ করে তাকে ক্রোধের অঙ্গারে পরিণত করেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে হতাশ জনমানসের কম্পাস হয়েছেন। পর্দার অমিতাভ আসলে ভারতের আপামর জনতার আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক। এই নিয়ে গুচ্ছের লেখা হয়েছে। সব শেয়ালের এক রা এর মতো, তার মোদ্দা কথা হল, সত্তর-আশিতে গোটা ভারতের জনসংস্কৃতির মূর্ত রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বোম্বের সিনেমা।
এবার, আমি যদি বলি, এই পুরো ন্যারেটিভটা, অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে মূলত ঢপবাজি, তাহলে পন্ডিতরা বলবেন, হতেই পারেনা। তার সঙ্গে যদি যোগ করি, অমিতাভ-টমিতাভ না, বাংলার জনসংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী, ধরুন, বীণা দাশগুপ্ত বা জ্যোৎস্না দত্ত, তাহলে তো বাক্য বন্ধ হয়ে যাবে। এরা আবার কারা? সংক্ষেপে তাই বলে দেওয়া যাক, এঁরা হলেন বাংলার দুই যাত্রাসাম্রাজ্ঞী( ইচ্ছে করেই দুজন মহিলার নাম নিয়েছি), জনসংকৃতি নিয়ে পন্ডিতি আলোচনায় যাঁদের দেখতে পাবেননা। মারা গেলে দুলাইনের খবর হয়, আর মাঝেমধ্যে কোথাও কদাচিৎ একটা প্রতিবেদন। যাঁরা গ্রাম বাংলায় বড় হয়েছেন, তাঁরা জানেন, এই দুটো নামের কী মাহাত্ম্য। যাত্রার কী মহিমা। আমি আশির দশকে থাকতাম সিঙ্গুরে। ক্লাবমাঠে যাত্রার উপদ্রবে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যেত। রোজই লেগে আছে। প্রতিটা যাত্রায় কয়েক হাজার জনসমাগম কোনো ব্যাপার না। আর নট্য কোম্পানি এলে? ভৈরব গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের পালা? ওরে বাবা। উন্মাদনার চোটে টেকা অস্থির। কোনো সিনেমা নিয়ে এই উন্মাদনা কখনও চোখে পড়েনি।
এগুলো অবশ্য অঙ্কের হিসেব না। ৭০ বা ৮০ তে যাত্রা কত লোকে দেখতেন জানিনা। ওসব নিয়ে কেউ লেখে টেখেনা। তবে যাত্রার রমরমা যখন তুলনায় কমে এসেছে, তখন গত দশকেও সালে যাত্রা ছিল বছরে ২১ মিলিয়ন ডলার ব্যবসার শিল্প। বিবিসি লিখেছে। বাংলায় যাত্রার ৩০০ টা কোম্পানি আছে, যাতে কুড়ি হাজার লোক কাজ করেন। এই নতুন শতকে, এত ইন্টারনেট, ওটিটি, সিরিয়াল, সিনেমার ঢক্কানিনাদের পরেও, সংখ্যাটা সিনেমার চেয়ে বেশি। ফলে ৭০ বা ৮০ তে কী ছিল, সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গত সংখ্যাগুলোও এক সায়েবের লেখা, বাঙালি পন্ডিতরা এসব নিয়ে ভাবেননা, তাঁরা পপ-কালচার ও শাহরুকখান নিয়ে লেখেন টেখেন। বস্তুত উৎপল দত্ত আর কিছুটা ঋত্বিক ঘটক ছাড়া, জনসংস্কৃতির এই বিপুল ব্যাপারটা নিয়ে বাঙালি ভদ্রলোক যে চিন্তিত, এরকম কোনো লক্ষণ দেখা যায়না।
সমস্যা হচ্ছে, এতে জনসংস্কৃতি নিয়ে একটা উদ্ভট অবাস্তব বকচ্ছপ ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে। যাঁরা জনসংস্কৃতি, পড়ুন পপ-কালচার নিয়ে লেখেন-টেখেন, তাঁরা কেউ যাত্রা দেখেননি। ওটা ইয়ার্কির বিষয় মনে করেন। তাঁরা পড়েছেন মূলত ফিল্ম স্টাডিজ কিংবা সাহিত্য, সেখানে যাত্রা পড়ায়না। এবং কৈশোরে নিষিদ্ধ আকর্ষণ হিসেবে, বয়সের উপর নির্ভর করে, হয় দেখেছেন অমিতাভ বচ্চন নয়তো শাহরুক খানকে। না দেখলেও, "সিঁদুর দিওনা মুছে" হল খিল্লির জিনিস আর "দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে" হল জনসংস্কৃতি, জেনেছেন। এবং তারপরে গুচ্ছের পেপার পড়েছেন, যেখানে বলিউডকে জনসংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কল্কে পেতে হলে তাঁদেরও সেটাই লিখতে হবে। ফলে পপ-কালচার নামক ন্যারেটিভ যা তৈরি হয়েছে, তাকে কনফার্মেশন বায়াস থেকে শুরু করে হেজিমনি, যেকোনো ইংরিজি নামে ডাকতে পারেন, বংলায় শিক্ষার অভাবও বলতে পারেন, কিন্তু মোদ্দা ব্যাপারটা হল, জিনিসটা শিকড়বর্জিত, বাস্তবতারহিত। জনসংস্কৃতি বলে যাকে চালানো হচ্ছে, তাতে জনতার অবদান নেই বললেই হয়। বাঁধা গত আছে, মূলত বিদেশী এবং বোম্বের ন্যারেটিভের প্রতি ভক্তিভাব আছে। কিন্তু জনতা নেই। ফলে অমিতাভ বচ্চন আছেন, কিন্তু ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় নেই।
এর ফলে হিন্দির একরকম করে আধিপত্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ অজ্ঞানতার কারণে, সঙ্গে আরেকটা জিনিস হয়েছে, সেটা হল জনসংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা। পন্ডিততের ধারণা, লোকে কিছু জানেনা, মানুষের কাছে 'বাণী' নিয়ে পৌঁছত হবে। যাত্রা সম্পর্কে ন্যূনতম খোঁজখবর রাখলে জানা যেত, বাংলার মানুষদের যতটা মূর্খ ভাবা হয়, তা আদৌ তাঁরা নন। হিটলার, স্তালিন, থেকে শুরু করে বুশের ইরাক আক্রমণ, প্রতিটা নিয়েই পালা হয়েছে, হয়ে থাকে, ওটাই চল, এবং সেগুলো বিপুল হিট। লোকে হামলে পড়ে দেখেছে (আমি ২০০০ পর্যন্ত জানি) । আপনাদের প্রিয় তথ্যচিত্র যদি লোকে না দেখে, সমস্যাটা তথ্যচিত্রের। পাবলিকের না। এবং এর থেকে আরেকটা জিনিস আসে, 'পপুলার' জিনিসকে নিচু চোখে দেখা, কিন্তু সে অন্য বিষয়। আজকের বক্তৃতার বিষয় হল শাহরুক খানকে নিয়ে কম মাথা ঘামিয়ে জ্যোৎস্না দত্তকে চিনুন। বাংলাকে চিনতে পারবেন। এই প্রসঙ্গে উৎপল দত্তের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ আছে, পড়ুন। 'পপ-কালচার' কী জিনিস জানতে পারবেন। খুব বেশি আশা করিনা, কিন্তু এই একুশে ফেব্রুয়ারিতে আশাবাদী হয়ে শেষ করতে হয়। নইলে পাপ হবে।
পুঃ একটা জিনিস লিখতে ভুলে গেছি। বাঙালি পন্ডিত কিন্তু একটা জনসংস্কৃতি জানেন। একটাই জানেন। সেটা হল বাউল। বিদেশে বিখ্যত হবার কারণেই হোঁক, গাঁজা খাবার সুবিধের জন্যই হোক, ওটা বেশ, যাকে বলে 'হেপ' হয়েছে। কিন্তু সেটাও ঐতিহ্যটা বাদ দিয়ে। বাউলের সুরে ধ্রুপদী সঙ্গীতের সরাসরি প্রভাব আছে, সে নিয়ে কাউকে বলতে শুনিনা। কিন্তু সেটা আজকের বিষয় না। আজকের বিষয় হয়, মনে রাখবেন, বাউলই একমাত্র জনসংস্কৃতি না। আর গ্রামেগঞ্জে যাত্রার তুলনায় ওর প্রভাব নস্যি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।