এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মাঠ

    Aniruddha Garai লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২৪৩ বার পঠিত
  • ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে হঠাৎ। মাথার উপর বিশাল বড় কালো আকাশ। তাতে কালচে মেঘেদের ভিড়। একটু চাঁদ দেখা যাচ্ছে। নক্ষত্রেরা লুকিয়ে পড়েছে সব কে জানে কোথায়। বৃষ্টিটা কখন দেখতে দেখতে ঝমঝম করে নামবে কেউ বলতে পারেনা। তার আগে কোনমতে বিশাল মাঠটা পেরোতে হবে। হাঁটার গতি বাড়ালাম। এত বড় মাঠটায় কোত্থেকে এলাম, কেন এলাম কিছুই মনে পড়ছেনা। গ্রামটার কী নাম, মাঠ পেরিয়ে কোথায় যাবো, কিচ্ছু না। চারিদিকের অন্ধকারটা ভীষন চাপ চাপ, ভীষণ ঘন। খুব দূরে হালকা কিছু জঙ্গল ঠাহর করা যায়। তার সামনে জমাট বাঁধা সাদা কুয়াশা। খুব ছোটতে মামারবাড়ি বেড়াতে এলে রাতের অন্ধকারে বড়দাদুর হাত ধরে যখন এরকম মাঠ পেরোতাম, দূরে এরকম কুয়াশা আর জঙ্গল দেখতে পেতাম। এই নিস্তব্ধতা আমার সেই ছোটবেলায় শোনা নিস্তব্ধতা। কি অসম্ভব রকমের চুপ। শিশির পড়লে সেই আওয়াজও শোনা যাবে। কখনও কখনও ঝিঁঝির ডাক শোনা যেত। কখনও দূরের কোনও গ্রাম থেকে ভেসে আসতো গানের আওয়াজ। জলসা হচ্ছে সেখানে, মাইক লাগিয়ে। দাদু অনায়াসে হেঁটে যেত, আর আমার হত ভয়। রাস্তা খুব একটা ঠাহর হত না অন্ধকারে, মনে হত গর্তে পড়ে যাব। দাদুর জামা টেনে বলতাম, "একটু আস্তে হাঁটো‌ না দাদু, ভয় করছে।" দাদু একটা অদ্ভুত জড়ানো গলায় উত্তর দিত, "ভয় কি দাদুভাই? এইতো বড়রাস্তায় উঠে পড়বো একটু পরে।" খানিকক্ষণ পর বড়রাস্তায় ছুটে যাওয়া মোটরভ্যানের আওয়াজ পেতাম। একটা ভট্ ভট্ ভট্ ভট্ আওয়াজ চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে ধীরে ধীরে মুছে দিতে দিতে এগিয়ে আসতো, তারপর আবার সেটা ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে যেত। আমিও ধড়ে প্রাণ ফিরে পেতুম।

    হাঁটতে হাঁটতে একবার দাঁড়িয়ে পড়ে দেখলাম চারিদিকে তাকিয়ে। যেদিকেই তাকাই খালি ধু ধু মাঠ। খুব দূরে সরু সরু কালো কালো তালগাছ দেখতে পাচ্ছি। তারও পেছনে কুয়াশা আর জঙ্গল। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, তার সাথে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মেঘ গলে গলে পড়ছে। আমি ছাড়া আর দুটি প্রাণী নেই এখানে। কি আশ্চর্য! যেন এখনই জন্ম হয়েছে আমার। এই মাঠের মধ্যে, এরকম চলমান অবস্থায়। এই আজকের, আজ রাত্রের আগের জীবনের কথা কিছু মনে নেই কেন? অথচ মনে আছে একদম শৈশবের কথা। একটা শহরের কথাও যেন মনে আছে। সেখানে আমি হয়তো থেকেওছি কিছুকাল, কিন্তু সমস্তই যেন গল্পকথা। হয়তো পড়েছি কখনও কোথাও, বা শুনেছি। এখন, এই বিশাল মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে আমার সমস্ত অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ জুড়ে পড়ে আছে এই মাঠ। আর সেই মাঠের মধ্যে আমি। সমস্ত অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ এসে ঠেকেছে এই মুহুর্তটায়। কোথায় যাবো বলে বেরিয়েছি? গোপালপুরে মাসীর বাড়ি? সেই গ্রাম কি এখানে? মাসীর সাথে যোগাযোগও নেই অনেকদিন। সেখানে যাবো, এরকম কথাও ছিল কি? হাত ঘড়িটা দেখার চেষ্টা করলাম, দেখতে গিয়ে বুঝলাম সব কাঁটা স্থির হয়ে গেছে। হাঁটতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক মনে পড়ে যাবে সব। কেন এসেছি, কী উদ্দেশ্য সব। বৃষ্টিও ঝমঝমিয়ে না পড়ে বরং কমে আসছে। দূরের জঙ্গলে গমগম করে উঠলো ঝিঁঝির ডাক, তা ভেসে এলো এখান অব্দি। দেরী না করে হাঁটা দিলাম হন হন করে। অনেকখানি পথ ফেলে এসেছি, এবং এখনও অনেকখানি পেরোতে হবে রাতের মধ্যেই। 
     


    একটা গলা ভেসে আসছে কোথাও থেকে। পরিচিত মনে হলো, কিন্তু কার তা মনে পড়লো না। গানের কথাগুলো চেনা। ছোটবেলায় শুনেছি কয়েকবার–
             
             "হরি হরি চুড়িয়াঁ, গোরে গোরে বাইয়াঁ
              বৈয়াঁ পকড় হর লীনী মোহ সে ন্যায়না মিলাইকে"
              
    আহা! এত রাত্রে কে গাইছে এমন করে? চলার গতি কমে এলো আপনা থেকেই। কে গাইছে এমন করে এত রাত্রে? সে কি উল্টোদিক থেকে আসছে? তবে তো তাকে দেখতে পাবো কিছুক্ষণের মধ্যেই। ছোটবেলায় শীতল রাত্রে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে দূর থেকে আসা জলসার আওয়াজে যেমন ঘুম আসতো, হঠাৎ সেরকম ঘুমোতে ইচ্ছে করলো। কত দূর থেকে ভেসে আসছে এই সুর, আমাকেও যেন নিয়ে যেতে চাইছে ভাসিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম, হ্যাঁ, কেউ গাইতে গাইতে এদিকে আসছে। তারপর অদ্ভুত এক ব্যাপার। যতই হাঁটি, খালি মনে হয় ওই গানের সুর আরো কাছে চলে এসেছে আমার, কিন্তু শেষমেশ আসেনা আর কিছুতেই। বৃষ্টি এইবার থেমে গেছে পুরোপুরি। রিনরিনে ঝিঁঝির ডাকে ভরে গেছে চারিপাশ। আর অদ্ভুত এক সুর আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাঠের উপর দিয়ে। শহরে কি কোনোকালে থেকেছি আমি? সেখানে মানুষ কেমন থাকে? সেখানে মানুষের দিন কাটে কীভাবে? সেখানে কি এরকম গান শোনা যায়? কে জানে, মনে নেই আমার। শহরেই কি থাকি এখনও, এইটা স্বপ্ন? জানিনা। ভীষণ বাস্তব বলেই তো মনে হচ্ছে সবকিছু। এই মাঠ, এই বৃষ্টি, ওই গান, এই আমি, এই সবকিছু।

    একটা বিশাল মাঠ। তেপান্তর। তার উপর অসীম কালো আকাশ। আকাশের বুকে মেঘ সরে গিয়ে নক্ষত্ররা বেরিয়ে আসছে একে একে। জ্যোৎস্নার আলোয় আস্তে আস্তে ধুয়ে যাচ্ছে সবকিছু। দূর থেকে ভেসে আসছে সেই গলা–
                   "ছাপ তিলক সব ছিনি রে মোহ সে ন্যায়না মিলাইকে"
    হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার বাঁশির মত এক সুর। আর আছি আমি। নাম গোত্র বংসপরিচয়হীন, ঠিকানাহীন, হন হন করে হাঁটছি। হেঁটেই যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ছুটছি। হাঁপিয়ে গেলে একটু দাঁড়াচ্ছি। হাতের চেটোয় কপালের বিন্দু ঘাম মুছে নিয়ে, দম নিয়ে আবার হাঁটছি বড় বড় পা ফেলে। যেন মাঠটা পেরোতে হবে বলেই এত তাড়া আমার।
     
     
    [২০২০ -তে ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করি লেখাটা। তারপর কিছু যোগ বিয়োগ করে ফের এখানে।]

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন