এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন কি জরুরী - প্রথম পর্ব

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২৫৭ বার পঠিত
  • সেদিন সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ছিলাম প্রতিদিনের মতোই। সকালবেলায় চায়ের কাপে চুমুকের সাথে সাথে খবরের কাগজের বিভিন্ন খবর পড়া, দেশ বিদেশের হাল হকিকত জেনে নেওয়া প্রত্যেকের অভ্যাসের মধ্যেই পড়ে। হঠাৎ করেই মেয়ের প্রয়োজন পড়েছে একটা নির্দিষ্ট খবর দেখে নেওয়ার, তাই আমার কাছে এসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে থাকলো। সেদিনের কাগজে প্রায় তিরিশটি পাতা ছিল, ফলে অনেকক্ষন ধরে খুঁজলো এবং অনেক খোঁজার পরে সে তার অভীষ্ট খবরের দেখা পেল। 

    এটা নিতান্তই একটা রোজকার ঘটনা। আর শুধু খবরের কাগজ নয়, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এইরকম করে থাকি আমরা। আমার বাড়ীর জলের পাইপ লাইন গন্ডগোল করলে যদি আমরা মুদির দোকানে খোঁজ নিই মিস্ত্রির জন্য বা টিভির কোনো গন্ডগোল হলে যদি মিষ্টির দোকানে খোঁজ নিই মিস্ত্রির জন্য তাহলে যে ব্যাপার হবে, মেয়ের খবরের কাগজে খবর খোঁজার ব্যাপারেও সেই একই ব্যাপার হবে। খবরের কাগজে পাতা নির্দিষ্ট করা আছে এবং লেখা থাকে ওপরে যে, সেই পাতায় কোন ধরনের খবর পাওয়া যাবে। আমরা যদি খেলার পাতায় রাজনীতির খবর খুঁজতে যাই, তাহলে কোনোদিনই পাবো না। যাতে সহজে খুঁজে পাই সেইজন্যেই পত্রকাররা সেইরকম ব্যবস্থা করেছে।

    এটা কি ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে গেল? মোটেই না, প্রশাসনিক ব্যবস্থার এটা অতি ক্ষুদ্রতম উদাহরণ। সহজভাবে এই উদাহরণগুলোর কথা বলা হলেও যদি বলা হয়, বাড়ীর মিউটেশন করতে আমাকে স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল অফিসেই যেতে হবে অন্য কোথাও নয়, তাহলে আরও পরিষ্কার করে বলা হবে। এবার প্রশ্ন হলো, কেনো স্থানীয় ডাকঘরে গেলে হবে না? উত্তর হলো, ডাকঘর সেই কাজ করে না বা সেই কাজের জন্য ডাকঘর দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। তাহলে আবার প্রশ্ন হলো, কেনো দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। উত্তর হলো, ভারত সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার ডাকঘরকে সেই দ্বায়িত্ব দেয় নি। এবার প্রশ্ন হতে পারে, কেনো দেয়নি? তাহলে উত্তর হলো, এটা সম্পূর্ণরূপে প্রশাসনিক ব্যাপার।

    প্রাচীনকালে যখন দেশীয় রাজারা বা পরবর্তীতে মোঘল বা অন্যান্যরা এই দেশে রাজত্ব করতো তখন, তাদেরও প্রশাসনিক পরিকাঠামো ছিল। কিন্তু সেটা প্রথমতঃ খুব ছোট আকারে আর দ্বিতীয়তঃ সেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রিকৃত ছিল না। সে আমলের রাজা, নবাবদের একটা মন্ত্রীবর্গ থাকতো। অর্থ মন্ত্রী, সেনাপতি বা প্রধান সেনাপতি, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় কিছু মন্ত্রী থাকতো যারা রাজাকে বা নবাবকে পরামর্শ দিত। এতে মূল অসুবিধে হতো, যে সব রাজ্য বড় হতো তাদের প্রজাদের সুবিধা অসুবিধার সঠিক মূল্যায়ন হতো না এবং সেই মূল্যায়ন হতো না বলে সেই মত পরিকল্পনা হতো না। ফলে প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতি রাজা বা নবাবের কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যেত না। ফলস্বরূপ অনেকক্ষেত্রেই সেইসব অঞ্চলে প্রজাদের অসন্তোষ বাড়ত। বিদ্রোহ হতো সেই সব অঞ্চলে। রাজত্ব চালাতে গেলে রাজাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রয়োজন হতো। আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক প্রয়োজনীয়তা, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা এত বেশী এবং ব্যাপ্ত যে একজন রাজার বা নবাবের পক্ষে সেসব একা দেখভাল করা সম্ভব নয়। সেই কারণেই পারিষদবর্গ বা মন্ত্রীসভা এবং কার্যবন্টনের প্রয়োজন হয়। 

    জনসংখ্যা যত বাড়তে থাকে, জনজীবনের জটিলতা যত বাড়তে থাকে ততই প্রশাসনের কেন্দ্রিকতার কারণে সেসব সমস্যার সমাধান হতে অযথা দেরী হয়। নাগরিক জীবন ব্যতিব্যস্ত হতে থাকে। প্রয়োজন হয় বিকেন্দ্রীকরণের। অবশ্য প্রশাসনিক ব্যবস্থাটাও যে খুব উঁচুদরের ছিল সেইসময়, তাও নয়। সময়কালটা বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে। তখন ব্রিটিশরা এদেশে রাজত্ব করছে। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব শুরু হওয়ার পরে ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতবর্ষের শাসনভার ইংল্যান্ডের রানীর হাতে চলে যায়। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার সাথে ব্রিটিশ-ভারতের শাসন ব্যবস্থার প্রভূত পার্থক্যের কারণে প্রথমদিকে না হলেও পরবর্তীতে শাসন ব্যবস্থার বদলের প্রয়োজন অনুভব করে ব্রিটিশরা। সময়ের সাথে সাথে কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয় কিন্তু সেইগুলো অবশ্যই যথেষ্ট ছিল না। তাই প্রথম ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্দ্যেশ্যে পদক্ষেপ শুরু করে ব্রিটিশরা যার ফলস্বরূপ নতুন আইন পাশ হয় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এবং চালু হয় Government of India Act, 1919। এরপরেও সংশোধন হয়েছে, পরিবর্ধন হয়েছে সেই আইন। পুনরায় পাশ হয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এবং চালু হয়েছে Government of India Act, 1939। এরপরে ক্ষমতা হস্তান্তর ১৯৪৭ সালে এবং ১৯৫০ সালে সংবিধান চালু হওয়া। নতুন দেশের আইন ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলতে ব্রিটিশদের সময়ের ব্যবস্থাই চালু রাখা হয়। সেই একই দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা, কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক বা রাজ্য সরকার। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে প্রতিটি প্রদেশ বা রাজ্যেই কংগ্রেসের সরকার বহাল ছিল। ফলে কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুইটি স্তরেই একই দলের সরকার থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং ব্রিটিশদের সেই ব্যবস্থায় কোনো খামতি আছে কিনা তা খোঁজার কোনো প্রয়োজন হয়নি।

    এরপরে ব্রিটিশ আমলের প্রদেশগুলোকে ভেঙে রাজ্য তৈরী করা হয়, কিছু এলাকাকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাখা হয়, নাম দেওয়া হয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। "বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য" - প্রবাদের বাস্তবতা যতখানি ছিল ব্রিটিশ ভারতে, ধীরে ধীরে সেই বৈচিত্রের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ভাষার নামে, জাতির নামে রাজ্য গড়ে উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে। প্রথমে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং তারপরে রাজ্য গড়ে ওঠে একের পর এক। এছাড়াও অসমিয়ার জন্য আসাম, বাঙালীর জন্য পশ্চিমবঙ্গ, বিহারীদের জন্য বিহার (পরে আবার ঝাড়খণ্ড), গুজরাতিদের জন্য গুজরাত, মারাঠিদের জন্য মহারাষ্ট্র, তামিলদের জন্য তামিলনাড়ু ইত্যাদি ইত্যাদি। এরফলে ঐক্যের বিষয়টা দিন দিন কমতে থাকে। 
     
    প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়। জনগণের আর্জি, তাদের অসুবিধা, ন্যায়, সরকারী সুবিধা সবকিছুই আমলাতান্ত্রিক লালফিতের ফাঁসে পড়ে জনগণের নাভিশ্বাস উঠতে থাকে। দেশের অগ্রগতি থমকে যেতে থাকে। পাশাপাশি কেন্দ্র রাজ্যের ঐক্যও বৈরিতায় পরিণত হতে থাকে একটা সময়ের পরে। কেন্দ্রে কংগ্রেস দলের সরকার চললেও ধীরে ধীরে রাজ্যগুলোতে বিরোধী দলের সরকার আসতে শুরু করে বিগত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক থেকে। বিরোধী দল বলতে স্থানীয় রাজনৈতিক দল বা কংগ্রেস থেকে বেড়িয়ে এসে যে সব রাজনৈতিক দলগুলো তৈরী হয়েছিল তারা। বেশীরভাগটাই অবশ্য মূল কংগ্রেস দল ছেড়ে বেড়িয়ে আসা লোকেদের দল। সেই সময় থেকেই কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধের চারাগাছটার অঙ্কুরোদগম শুরু হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে সেই চারাগাছটাকে জল সার দিয়ে, রসদ দিয়ে তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে, এখন সে পূর্ণাঙ্গ বটবৃক্ষ। 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন