গল্প নাম্বার :- ২
স্বামীর খুনি লীলাবতী।
গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।
(সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব গল্প "স্বামীর খুনি লীলাবতী" নামক গল্পটি নীরব আলো শারদ সংখ্যা 2021 পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।)
রচনার শ্রেণী :- সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব শিক্ষামূলক ছোট গল্প।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
◆ বাইরে প্রচন্ড গরম প্রকৃতি যেন রুষ্ট। গাছের পাতা গুলো স্থির তীব্র অস্বস্তিকর পরিবেশ। ঠিক রাত আটটার সময় ঘরের মধ্যে এক পুরুষ কন্ঠের আর্তনাদ চিৎকার। তারপর তাকে বিছানায় ও ঘরের মেঝেতে রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
◆ এই দৃশ্য দেখে ঘরের মধ্যে থাকা আরেকজন পুরুষ ভয়ে আতঙ্কে পালানোর চেষ্টা করে। দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির সদর দরজার লোহার গেটের সামনে এসে দুই হাত দিয়ে গেটে সজোরে ধাক্কা দিতে শুরু করে।
◆ ভয়ে পিছনের দিকে তাকাতে তাকাতে চিৎকার করে বলে :- নরেশ দরজা খুলে দে, তোর বৌ মেরে ফেলবে। মদ পান করার সময় দশ হাজার টাকা দিয়ে ছিলাম, তোর বউয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক করার জন্য কিন্তু ….. আর সে ইচ্ছা নেই। বন্ধু, গেট খুলে দে ….আমাকে বাঁচাতে দে। তোকে আরো অনেক টাকা দেবে । দয়া করে বাঁচা আমাকে ……..।
◆ লীলাবতী মা কালির মতো বিবস্ত্র হয়ে, খড়গ না পেয়ে কিন্তু সবজি কাটার বটি হাতে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে গেটের সামনে আসে আর গায়ের জোরে ঝারা কোপ মারে। সেই মুহূর্তে গেট খুলে যায় কিন্তু সাথে সাথেই আরেক বার কোনো পুরুষ কন্ঠ তীব্র আর্ত চিৎকার করে উঠে।
◆ লীলাবতী ঊর্ধ্ব নয়ন নিম্ন দিকে নামাতে তার স্বামীর খণ্ডিত দেহ দর্শন করে জল বিহীন চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
◆ ধর্ষিতা উলঙ্গ শরীরে স্বামীর নামক নর পশুর খন্ডিত দেহের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে লাথি মারতে মারতে বলে :- বিয়ে করা বউকে মদের টাকার জন্য বিক্রি করার প্রতিশোধ নিয়েছি। বন্ধুদের মাধ্যমে আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
◆ লীলাবতী তার স্বামীর খন্ডিত দেহের উপর বসে পড়ে আর পাগলের মতো দুই হাত দিয়ে স্বামীর রক্ত মাখতে মাখতে বিভিন্ন বিলাপ করতে থাকে। নরেশের বন্ধু এই দৃশ্য দেখে ভয়ে শিউরে উঠে আর পালানোর চেষ্টা করে।
◆ লীলাবতীর পাশে রাখা বোঁটি ছুড়ে মারে আর নরেশের বন্ধুর পায়ে লেগে আঘাত হয়ে চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায়। মনের আনন্দে আত্মহারা হয়ে রক্তের হোলি খেলতে থাকে।
◆ কিছু সময় পর লীলাবতী এক হাতে স্বামীর কাঁটা মুন্ডু ও অন্য হাতে বলি দেওয়া বটি নিয়ে রাস্তা দিয়ে নটবর শিবের মতো প্রলয়কারী নৃত্য করতে করতে চলতে শুরু করে।
◆ রাস্তার দুই পাশে সমস্ত লোকজন ভয়ে ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর রূপ দেখে কেউ লীলাবতীর পথ অবরোধ করে না। অজানা আশঙ্কা নিয়ে ভয়ার্ত চোখে সকলেই এক বিরল দৃশ্য দেখতে থাকে । তারই মাঝে চাপা স্বরে ভিড়ের মধ্যে থেকে নানান মন্তব্য ভেসে আসে। পথের আঁকে বাঁকে--- "বেশ্যা, কুলটা, দুশ্চরিত্র বাজে মেয়ে ---- ঘরে স্বামী থাকতে অন্য পুরুষের ঘরে নিয়ে আসে।
◆ স্বামী হয়তো দেখে ফেলেছিল পরকীয়া প্রেমের লীলা, সেই কারণেই খুন করে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিলো………।
◆ অনেক মহিলারা কথাবার্তা বলতে বলতে লীলাবতীর বাবা-মাকে গালাগালি দিতে শুরু করে। মেয়েকে নিশ্চয় কোন শিক্ষাই দেয়নি, না হলে এমন কাজ কেউ করে করে। এ যেন কল্পনারও অতীত নিজের হাতে স্বামীর খুন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে লীলাবতীকে ধিক্কার জানায় ।
◆ বিশেষত মহিলারা ঝগড়া, কুকথা, অশান্তি বাধানোর ও গালিগালাজ করার বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী। নারীদের উপর শত অত্যাচারের ঘটনা কিন্তু নারীদের কারণে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।
◆ লীলাবতী রাস্তার শত শত মানুষের ভিড় ঠেলে ও সকলের কটুক্তি উপেক্ষা করে সোজা থানায় গিয়ে উপস্থিত হয়।
◆ থানায় নিরাপত্তা রক্ষী পুলিশ এই দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে দৌড়াতে দৌড়াতে থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে।
◆ লীলাবতী থানার অফিস ঘরে ঢুকে বড় লম্বা টেবিলের উপর কাঁটা মুন্ডু ও বটিটা রাখে। রক্তে টেবিল ভেসে গিয়ে মেঝেতে গড়াতে থাকে।
◆ তারপর কাঁদতে কাঁদতে দুই হাত উপরে তুলে পাশের দেওয়ালে সজোরে আঘাত করতে করতে নিজের হাতের শাঁখা পলা ভেঙে দিয়ে বলে - আমাকে গ্রেফতার করুন। আমি স্বামীকে খুন করে তার রক্তে হোলি উৎসব করেছি ও কাঁটা মুন্ডু দিয়ে ফুটবল খেলেছি।
◆ হঠাৎ এমন ভয়ানক পরিস্থিতির জন্য থানায় কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। সবাই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ভয়ে আতঙ্কিত, স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। একে-অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, এখন কী করণীয়?
◆ থানার ভারপ্রাপ্ত বয়স্ক অফিসার দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে লীলাবতীর কাছে এসে হাতজোড় করে বলেন, "মা, শান্ত হও। তোমার সব কথা শুনবো, অপরাধীর অবশ্যই সাজা পাবে।
◆ লীলাবতী তার শরীরের দিকে চোখ রাখতেই লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে স্তনদয় চেপে ধরে ঘরের এক কোণায় মেঝেতে বসে পড়ে ।
◆ ভারপ্রাপ্ত অফিসার মহানন্দা মহাশয় একজন মহিলা পুলিশের নির্দেশ দেন- "তাড়াতাড়ি ঐ মেয়েটিকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে রক্তাক্ত শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে স্নান করান। তারপর কাপড় পরিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসুন। কিন্তু সাবধান, ওনার সাথে উত্তেজিত ভাবে কথা বলবেন না।
◆ সেই মুহূর্তে নরেশের পাড়ার কয়েক জন প্রতিবেশী তাড়াহুড়ো করে থানায় আসে। "স্যার, আমাদের পাড়ায় লীলাবতী নামে বিবাহিত মহিলা অবৈধ সম্পর্ক ধরা পড়ে দুটো খুন করেছে। একজন গুরুতর জখম, হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে।
◆ অফিসারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী প্রতিবেশীদের সঙ্গে লীলাবতীর বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর লীলাবতীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
◆ পুলিশ কর্মকর্তা মহানন্দা মহাশয় পাশে বসিয়ে লীলাবতীকে বলেন - বলে মা; কেন খুন করলে স্বামী সহ তার বন্ধুদের ?
◆ লীলাবতী বয়স্ক অফিসের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় চুপচাপ থাকার পর নিস্পৃহ ভাবে বলতে শুরু করে।
◆ তিন বছর আগে উভয় পক্ষের অভিভাবকের দেখাশোনা করে আমাদের দুজনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানতে পারি, স্বামীর মদ আর জুয়া খেলা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ নেই।
তবুও বিধির বিধান মনে করে দুঃখ কষ্ট সহ্য করেই সব কিছু মেনে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
◆ সংসারের হাল ধরে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে কিন্তু স্বামীর অনেক অন্যায় অত্যাচার ও আবদার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। সংসার বাঁচানোর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি।
◆ আমার বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া সোনা-গয়না, টাকা-পয়সা সহ বাড়ির বাসন-কোসন একে একে সব কিছু মদ আর জুয়ার পিছনে চলে গেছে। তবুও সংসারের হাল ছাড়িনি কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের ছেলেকে ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে গেছে।
◆ একসময় সংসারে অনটন শুরু হয়। দুটি লবণ ভাত জোটানো মুশকিল হয়ে পড়ে । লজ্জা ঘৃনা ত্যাগ করে বাবার কাছে থেকে টাকা নিয়ে আসি আর সেলাই মেশিন কিনে নিয়ে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি।
◆ মাঝে মধ্যে স্বামীর মদের টাকার চাহিদা মেটাতে হতো। তার মধ্যে অনেক কষ্ট করে একটা মেশিন থেকে আরো তিনটে মেশিন কিনি। কিছু লোক দিয়ে কাজ করিয়ে বাড়তি রোজগারের চেষ্টা করি।
◆ আমার আয়-রোজগার দেখে স্বামী হিংসা শুরু করে। বন্ধুদের কথা মতো বাড়িতে মদ-জুয়ার আসর বসায়। সেই সাথে শুরু হয় আমার উপর নির্যাতন আর অত্যাচার ।
◆ কাল রাতে জুয়া খেলায় হারতে হারতে কয়েক হাজার টাকা হেরে যায়। তারপর শেষে আমাকে বাজী রাখে কিন্তু বন্ধুদের চক্রান্তে এবার গো হারা হেরে যায়।
◆ বন্ধুদের শর্ত অনুসারে ওর সামনেই স্বামীর দুই বন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। আমি ওদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়।
◆ ভেবেছিলাম রাতের মধ্যে মদের নেশা চলে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। আজ সারাদিন সেলাইয়ের কাজ করেছি। রাতে মেশিনে কাজ শেষ করার পর খাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরোতেই স্বামীর দুই বন্ধু মিলে জোর করে আমাকে বিছানায় নিয়ে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করে।
◆ ধর্ষণ চলাকালীন সময়ে উপায়ন্তর না দেখে হাতের কাছে বটি পেয়ে যাই আর চালিয়ে দেয়। সেই শয়তান চিৎকার করে মেঝেতে পড়ে যায়।
◆ স্বামীর আরেক বন্ধু পালানোর চেষ্টা করছিল। আমি আক্রমণাত্মক হয়ে ওর পিছন পিছন গেটের সামনে এসে জানতে পারি। আমাকে ধর্ষণ করার জন্য স্বামী নামক শয়তান দুই বন্ধুর কাছে থেকে বার হাজার টাকা নিয়েছে। স্বামী তার বন্ধুদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেটের বাইরে তালা লাগিয়ে অপেক্ষা করছিল।
◆ আমি দ্বিতীয় শয়তানটাকে খুন করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে কোপ বসিয়ে দেয় কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার স্বামী গেট খুলে বন্ধু কে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো। ধারালো বটির কোপে স্বামীর দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়।
◆ থানার অফিসার সবকিছু শোনার পর লীলাবতীকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করে জেলার জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। আর নরেশের দ্বিতীয় বন্ধুকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। ধর্ষণের মামলা এখন কোর্টের বিচারাধীন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
◆ রচনাকাল :- 5 সেপ্টেম্বর 2021 সালে। দত্তপুলিয়া যুব গোষ্ঠী ক্লাব, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
◆ সংশোধনের তারিখ :- ২ আগস্ট ২০২৩ সালে। আশ্রম খাটুরা-দোলন ঘাটা, মাঝদিয়া, নদীয়া।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
তৃতীয় নম্বর গল্প পড়ুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।