মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে, বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের প্রধানতঃ দুইটি স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছে। এক, মৃত্যুকে জয় করা অর্থাৎ অমরত্ব এবং দুই, অতীত আর ভবিষ্যতকে দর্শন করা অর্থাৎ বিজ্ঞানের ভাষায় টাইম ট্রাভেল করা। মৃত্যু মানব জীবনের একমাত্র সত্য হলেও মৃত্যুর পরের কল্পিত ঘটনাবলী মানুষ নিজেই তৈরী করেছে এবং স্বর্গ, নরক, পাপের প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি ইত্যাদির চক্রব্যূহে নিজেই ভীত হয়েছে। আবার বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, মানব জীবনের রসে সিঞ্চিত থাকার বাসনাও মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে বাড়িয়েছে। এইসব মিলিয়েই অনন্তকাল বেঁচে থাকার বাসনা মানুষের মনের মণিকোঠায় মহীরুহ হয়েছে। পাশাপাশি নিজের এবং পৃথিবীর অতীত ও ভবিষ্যতকে দেখতে পাওয়ার আশায় সময়ের সাথে সাথে লোভী হয়ে উঠেছে মানুষ। একবার যদি নিজের ছোটবেলা, পূর্বপুরুষদের অবস্থা দেখতে পাওয়া যেত অতীতে গিয়ে বা ভবিষ্যতে গিয়ে নিজের বৃদ্ধাবস্থা বা মৃত্যুর পরের অবস্থাটা দেখে নেওয়া যেত!
নিজের ভবিষ্যত রোগভোগের ফিরিস্তিটা একবার যদি জানা যেত তাহলেই নিজেকে সুরক্ষিত করে নেওয়া যেত, ঘুরিয়ে বললে সেই অমরত্বের কথা। আদপে টাইম ট্রাভেল অমরত্বের ইচ্ছের একটি অংশ মাত্র, আলাদা কোনো আকাঙ্ক্ষা নয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে গবেষণার পালেও হওয়া লেগেছে আর মানুষের আশার ফানুসটাও আকাশছোঁয়া হয়েছে দিনে দিনে। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমরা নিশ্চয়ই অমর হয়ে যাবো!!!
কবিগুরুর কথায়, "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু"। বিজ্ঞানের গবেষণাগারে দিন, রাত, বছরের পর বছর পরিশ্রম করে চলেছি আমরা অমরত্বের খোঁজে। কিন্তু অমরত্ব হাজির জাপানের সমুদ্রে, ভূমধ্যসাগরে। ভূমধ্যসাগর ও জাপানের সমুদ্রে দেখা যায় টারিটোপসিস ডোরনি নামের জেলিফিশ বা ব্যাকওয়ার্ড-এজিং জেলিফিশ। বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য জেলিফিশের এই ক্ষুদ্র প্রজাতিকে 'অমর জেলিফিশ' নামেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। জাপানের কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা খোঁজ করেছেন এই জেলিফিসের অমরত্বের রহস্য। তারা বলেন, কখনই বার্ধক্য আসেনা ব্যাকওয়ার্ড এজিং জেলিফিশের। বয়সের ভারে এদের মৃত্যু হয়না। বয়সকে লুকিয়ে ফের যৌবনে ফিরে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে এই প্রাণীটির। বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এক দল গবেষক। তারা এই জেলিফিশদের জীবনচক্রের ওপর নজর রেখে দেখেছেন, কখনও এসব জেলিফিশের দেহের কোনো অংশে আঘাত লাগলে বা অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গেসঙ্গে এরা ‘পলিপ দশা’ তে চলে যায়। পলিপের আকারে দেহের চারপাশে মিউকাস মেমব্রেন তৈরি করে তারা।এর পর ক্ষতিগ্রস্থ অংশ সেরে উঠলেই পলিপ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে তারা। তখন বিজ্ঞানীরা এটা দেখে অবাক হন যে, পলিপ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা জেলিফিশগুলোর দেহের প্রায় সব কোষই নতুন ও সজীব। আর এভাবেই নিজেদের বয়স কমিয়ে যৌবনে চলে আসে তারা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এসব জেলিফিশ তিন দিন পলিপ অবস্থায় থেকে শরীরের সব কোষ রূপান্তর করে ফেলে। তবে এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বার্ধক্যে উপণিত হলে জেলিফিশেরা বার্ধক্যের উল্টো দিকে ধাবিত হয়ে অমর হয়ে থাকলেও যে কোনো দুঘর্টনায় যেমন, বড় মাছ এদের খেয়ে ফেললে বা হঠাৎ বড় কোনো রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই এরা মারা যায়। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যু এদের হয় না।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জেলিফিস এমন একটি প্রাণী, যেটি বারবার ছোট অবস্থায় ফিরে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু কোন জাদুবলে তারা এই ক্ষমতা অর্জন করেছে, তা উদ্ধার করা যায়নি। যদিও স্প্যানিশ গবেষকরা অমর জেলিফিশ টুরিটোপসিস ডোহরনি-র জিনোম বুঝতে সক্ষম হয়েছেন বলে জনা গিয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন জিনোমিক কী-গুলিকে সংজ্ঞায়িত করছেন, যা এর মৃত্যু এড়াতে এবং আয়ু বাড়াতে সক্ষম। ওভিয়েডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর কার্লোস লোপেজ-ওটিনের নেতৃত্বে গবেষক দল তাদের দীর্ঘায়ুর রহস্য উদ্ঘাটন করা এবং মানুষের বার্ধক্যের নতুন সূত্র খুঁজে পাওয়ার আশায় অনন্য জেলিফিশের জেনেটিক ক্রম ম্যাপ করছে। গবেষণাটি প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সাযেন্সে প্রকাশিত হয়েছে।
স্প্যানিশ গবেষকরা টুরিটোপসিস ডোহরিনের বোন টুরিটোপসিস রুব্রার সঙ্গে একসঙ্গে ক্রমবর্ধমান জিন শনাক্ত করছেন এবং উভয়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য খতিয়ে দেখছেন। টুরিটোপসিস রুব্রা হল একটি ঘনিষ্ঠ জেনেটিক কাজিন যার যৌন প্রজননের পরে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ক্ষমতা থাকে না, সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাঁরা আরও উদ্ঘাটন করেছে যে টুরিটোপসিস ডোহরিনের জিনোমে ভিন্নতা রয়েছে। তার মধ্যে টেলোমেরস নামক ক্রোমোজোমের প্রান্ত বজায় রাখতে সক্ষম। টেলোমেরের দৈর্ঘ্য মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ছোট হতে শুরু করে। পুনরুজ্জীবন এবং অমরত্বের একক চাবিকাঠি থাকা জেলিফিশের সফল পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছেন গবেষকরা।
টুরিটোপসিস ডোহরিনের জীবনচক্র সাধারণত দুই অংশে বিভক্ত। এটি অযৌন পর্যায়ে সমুদ্রের তলদেশে বসবাস করে। সেখানে যখন খাদ্যের অভাব থাকে জীবিত থাকার লড়াই চালায় ওই জেলিফিশ। আর যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে জেলিফিশ যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত থাকে, প্রজনন করে। অনেক জেলিফিশ এই সময় লার্ভা পর্যায়ে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, আবার অনেকে যৌন পরিপক্কতায় পৌঁছনোর পর সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং বার্ধক্য ফিরিয়ে আনে।
এছাড়াও এই পৃথিবীতে আরও তিন ধরনের প্রাণী আছে যারাও অমরত্বের দাবী রাখে।
১. এভার-গ্রোয়িং লবস্টারস: লোহিত সাগরের এই বাসিন্দারা আদৌ জৈবিক ভাবে অমর কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে দ্বিমত রয়েছে। তবে, নানা ভাবে পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, গলদা চিংড়ির বিশেষ এই প্রজাতির মৃত্যুর এক এবং একমাত্র কারণ কিন্তু অসুখ। রোগভোগ ছাড়া অন্য কোনও কারণে এরা মরে না। বার্ধক্য এদের শরীরে থাবাও বসাতে পারে না। যে কারণে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এরা প্রজনন করতে সক্ষম। সম্প্রতি নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে ধরা-পড়া একটি লবস্টারের বয়স হিসেব করে দেখা গিয়েছে ১৪০ বছর। কিন্তু, গড়ে এই প্রজাতির পুরুষ গলদাচিংড়ি ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। সেখানে স্ত্রী চিংড়িদের গড় আয়ু ৫৪ বছর।
২. স্টার্ডি টার্টলস: কচ্ছপের দৌড়ের সেই গল্পটির মতোই এরা চলনে শ্লথ কিন্তু গড়নে স্টেডি। এমনিতেই কচ্ছপের আয়ু কয়েক'শো বছর। আর বিশেষ প্রজাতির বলিষ্ঠ এই কচ্ছপটি অমর বলেই দাবি করে থাকেন প্রাণীবিদরা। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শরীরের বয়স হলেও এদের অরগ্যানের কিন্তু বয়স বাড়ে না। ফলে, অসুখ না-করলে, বা শিকারির ফাঁদে ধরা না দিলে স্টার্ডি টার্টলসও অমর।
৩. রিজেনারেটিং ফ্ল্যাটওয়ার্মস: এরা প্ল্যানারিয়ান ওয়ার্ম নামেও পরিচিত। আক্ষরিক অর্থেই এই কীটেরা অমর। একবার জন্মালে মৃত্যু নেই। তার কারণ, এদের মধ্যে পুনর্জন্মের অদ্ভূত ক্ষমতা রয়েছে। এই কীটের শরীরের কোনও অংশ কেটে দু-টুকরো হয়ে গেলে দুটো পৃথক ফ্ল্যাটওয়ার্ম তৈরি হয়ে যায়। এ ভাবেই টুকরো টুকরো হয়ে একটা থেকে অসংখ্য ফ্ল্যাটওয়ার্মের জন্ম হয় বলেই এদের রিজেনারেটিং ফ্ল্যাটওয়ার্ম বলা হয়ে থাকে।
এটা ভাবতেও কষ্ট হয় যে, মাছ, পোকা, এমনকি কৃমি জাতীয় প্রাণী অমরত্বের স্বাদ পেয়েছে, আর আমরা প্রাণীকূল শ্রেষ্ঠ মানুষ কিন্তু এখনও অমরত্বের খোঁজই পেলাম না, স্বাদ তো দূরের কথা। একবার ভাবুন তো, চল্লিশ বছর বয়সে মনে হলো আর একবার দশ বছর বয়স হয়ে যাক এই শরীরটার। যেমনি ভাবা, অমনি কাজ। এইবার বয়স দশ কিন্তু পড়াশুনা নেই, দৌড়ঝাঁপ আছে, ক্রিকেট - ফুটবল - ডাংগুলি সব খেলা আছে। ছেলেপুলের বয়স কুড়ি আর তাদের বাবার বয়স দশ। আবার ধীরে ধীরে বয়স চল্লিশ হলে আবার দশে ফিরে আসা যাবে। সুকুমার রায় কিন্তু অনেককাল আগেই কল্পনা করেছিলেন, হ য ব র ল - এর বুড়োর মুখ দিয়ে আমাদের শুনিয়েছিলেন, ‘তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়েস ঘুরিয়ে দিই৷ তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না- ঊনত্রিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে৷ এমনি করে যখন দশ পর্যন্ত নামে তখন আবার বয়েস বাড়তে দেওয়া হয়৷ আমার বয়েস তো কত উঠল নামল আবার উঠল, এখন আমার বয়েস হয়েছে তেরো৷’
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।