বাবা বললেন, ‘খাবি কি?’
কথাটা উঠেছিল হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢোকার সময়ে। বহুদিন আগের কথা। সেটা উনিশশো তিয়াত্তর সাল।
পরিস্থিতি ভাবলে মনে পড়ে যায় মনীশ ঘটকের কবিতা - ‘এর চেয়ে মর্মান্তিক গুরুদণ্ড ভার, সেদিন অতীত ছিল ধ্যান ধারণার’। কবির কল্পনার সেই 'দু-চোখ ডাগর' মেয়ে, 'কুড়ানি' যার নাম, তার দেওয়া শাস্তি ছিল - 'তরে করুম না বিয়া'! কিন্তু এই দন্ডে দন্ডিত আমি যাই কোথায়?
ছোটবেলা থেকেই জানি যে বড় হয়ে আর্টিস্ট হব, ছবি আঁকবো। স্কুল পাশ করে কলকাতায় আর্ট কলেজ-এ পড়তে যাব এতে কোনো প্রশ্নের সুযোগ নেই. কখনো ভাবি নি বাবা তাতে বাদ সাধবেন; ভাবি নি শিল্পী হয়ে 'খাব কি?'! বরং মনে গভীর ইচ্ছে ছিল যে আর্ট কলেজ শেষ করে প্যারিস-এর কোনো ষ্টুডিও-তে পাশ্চাত্য শিল্পকলার নানা প্রকরণ আরো ভালো করে রপ্ত করব।
বাবার মত শিক্ষিত ও উদারমনের মানুষের কাছ থেকে এই ভয়ানক আদেশ? তখনকার দিনে - আমি উনিশশো ষাটের দশকের কথা বলছি - যখন বর্ধমানের মত কৃষিপ্রধান শহরে চাকরি সুবাদে বাস করেও তিনি চারপাশের সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা ও জাতি-ধর্মের বাইরে ছিলেন। নিজের অসাধারণ ধীশক্তি ও শিক্ষকতার গুণে, সুবক্তা ও সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে তো বটেই অন্যান্য বেশির ভাগ মানুষের কাছেই নিজেকে শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন। রাজবাড়ির প্রান্তে বনাবাসের চত্বরে যখন সন্ধেবেলার টেনিস খেলার আসর জমতো, বাবার ক্রীড়াকুশলতা দেখে আমরা তো বটেই, বাইরের বহু লোকে অবাক হয়ে যেত। নিজের তিন ছেলেমেয়েকে তিনি তাই সেভাবেই মানুষ করেছিলেন। অনেক সময়েই আমরা মনে মনে জানতাম যে আমরা ভাইবোনেরা 'একটু আলাদা'। স্কুলে বন্ধুরা যখন জিজ্ঞেস করত, 'তোদের দেশ কোথায়' - তখনও বেশির ভাগ শহরের পরিবারগুলোর আর্থিক ভিত ছিল গ্রামে, যেটাকে তারা জানত নিজেদের 'দেশ' বলে - তখন আমরা বলতাম 'কেন, ভারতবর্ষ? এটাই তো আমার ও তোমার, সকলের দেশ!'। পাশের বাড়ির উকিল কাকু ছিলেন জহর আলি, যাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলো ও লেখাপড়া করে পিঠোপিঠি ভাই-বোনের মতো আমরা বড় হয়েছি। বাবা সব কিছুকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন আমাদের, অন্ধভাবে না বিশ্বাস করে বুদ্ধির মাধ্যমে জানার চর্চা চলত বাড়িতে। ফলে ছোটোবেলা থেকে আমরাও জানি যে বই- এবং বই-এর অক্ষর গুলো-ই ধ্রুব সত্য, এর ওপরে কোনো অলীক ও কল্পিত ঠাকুর-দেবতা নেই। দাদার সহযোগী হিসেবে, তার সঙ্গে মাঞ্জা ধরে ধরে ঘুড়ি ওড়াতে শিখেছিলাম ভালোই। আর ওই ঘুড়ি ওড়ানোর জন্যেই এক বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে অন্য ছাদে যাওয়ার গা-শিরশিরানি মজাও নিতে শিখেছিলাম। যখন আমি মেয়ে হয়েও প্রথম শহরের রাস্তায় সাইকেল চালাতে শিখি, একটা হায় হায় রব উঠেছিল বৈকি। 'দে ধাক্কা মেরে ফেলে দে পাকা ছুঁড়িকে' - এরকম একটা ভাব। কিন্তু বাবার ব্যক্তিত্বের সামনে অন্য কারুর কোনো আপত্তি ধোপে টেঁকে নি। এই জোরেই হয়ত, আমিও কি শুনেছি কারুর কথা? বাবার আদরের মেয়ে আমি, অপরিসীম স্বাধীনতা আত্মগত করে বেড়ে উঠেছি। কে কি বলছে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের ভাবনাচিন্তা মতো নিজের পথ খুঁজে চলতেই ব্যস্ত। এভাবে ভাবতাম যে আমার নিজের জীবনের নিয়মগুলো আমি নিজেই তৈরী করে নেব, নিজের বিচার ও বুদ্ধি মতো।
তাই সেই বাবার এইমত একশো-আশি ডিগ্রী মোড় ঘোরায় জোর একটা ধাক্কা লেগেছিল বই কি! অসহ্য! বাবার এই আদেশ মর্মান্তিক তো ঠেকলোই, দিল বুকে বেদম জ্বালা ধরিয়ে। এই ছবি আঁকা শেখার একটা ইতিহাস আছে. যেটা এখানে ছোটো করে বলে নিই। আমি যখন স্কুল-এর প্রথম শ্রেণীতে পড়ি, বুনিয়াদী অঙ্ক বইয়ের নামতা মুখস্থ করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, তখন বাবার কয়েকজন শিক্ষানুরাগী বন্ধুবান্ধবের উৎসাহে বর্ধমানে ‘উদয়চাঁদ গ্রন্থাগার’ স্থাপিত হল। তখন থেকেই অন্যান্যদের সঙ্গে আমিও তার সদস্য। পাশেই ছোট্ট খেলার পার্ক, লাইব্রেরি, ব্যায়াম করার আখড়া, আর একটা নিটোল স্টুডিও, যার নাম ‘শিশুকলাকেন্দ্র’। এই শিশুকলাকেন্দ্রের স্টুডিও-তেই, প্রতি রবিবারে সকল ন’টা বাজতেই কাঁধের ঝোলায় রং-তুলি, খাতা আর অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে, দু-নম্বর পাকমারা গলি থেকে বি সি রোড ধরে হেঁটে গেছি স্কুলজীবনের বাকি কটা বছর। তখনকার দিনে রাস্তা এত ভিড়ে ভর্তি ছিল না. হেঁটে হেঁটে দিব্বি পৌঁছে যেতাম সময়মতো। মাঝে মাঝে রিকশা-ওয়ালারা এসে টিং টিং ঘন্টি বাজিয়ে বলত, 'কি খুকি কোথায় যাবে?' আমি মাথা নেড়ে নিজের পথে হাঁটা দিতাম, কারণ বাবার দেওয়া রিকশা ভাড়াগুলো তো জমাতে হবে নিজের ইচ্ছেমত আরো রং-তুলি কেনার জন্যে!
কি করে জানি না হয়ে উঠেছিলাম মাস্টারমশাই শিবু কুন্ডু-র প্রিয় ছাত্রী। তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অনেকটাই উজাড় করে দিয়েছিলেন আমায় ও আরো দুজন ছাত্রী - মালা ও অরুনা-কে। বলাই বাহুল্য যে সেই কলাকেন্দ্র উঠে গেছিল বছর পাঁচেক বাদে। আমাদের তখন ঠাঁই হলো শিক্ষক মহাশয় শিবুবাবুর বাড়ির বারান্দায়, যেখানে অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সারি বেঁধে ছবি আঁকতে বসতাম আমিও। স্কুল শেষ করে কলেজ-এ যাওয়া পর্যন্ত ওই এগারো বছর ধরে তিনি-ই আমার চোখ-কে দেখতে শিখিয়েছেন। এখন বুঝি আমিও ছিলাম পাভলভ-এর সেই কুকুরটার মতো; রবিবার সকালে ছবি আঁকার ক্লাস-এ যেতে না পারলে রীতিমত উইথড্রয়াল সিম্পটম দেখা দিত। সেই ষাট দশকের শেষদিকে, তার পরেও সত্তরের গোড়ার দিকে, বর্ধমানের মতো চাষপ্রধান আধা-শহরে কয়েকটা পুঁচকে মেয়ে, অরুনা, মালা আর আমি, নিজেদের উদ্যোগে 'ছবির প্রদর্শনী' করতাম। শিবুবাবুর প্রশ্রয়ে বেশ কয়েকবার কলকাতার একাডেমী অফ ফাইন আর্টস-এও ছবি দিলাম। একাডেমী অফ ফাইন আর্টস-এর মধ্য-গ্রীস্মের প্রদর্শনী-তে যোগ দিয়ে নিজেদের অর্বাচীনতা নিজেদের কাছেই প্রমাণ করতাম। এসব কাজকর্মে কি যে আনন্দ পেতাম তা বলে এখন বোঝানো মুশকিল। তখনকার দিনের ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে শিবুবাবুও একজন মনে রাখার মতো মানুষ ছিলেন। বারান্দার পাশে,তাঁর শোবার ঘরের দেওয়ালে, ঝুলতো বৌদির, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর বিরাট ক্যানভাস-এ তেলে আঁকা ন্যুড চিত্র। নিজের ও নিজের মা ছাড়া অন্য কারুর অনাবৃত শরীর আমার সেই প্রথম খোলাখুলি দেখা। বলা চলে যে শিবুবাবু আমাদের তিন জনকে সেই রক্ষণশীল বদ্ধ সমাজে নিজের বা অন্যের শরীর নিয়ে আড়ালে আবডালে হা হা হি হি করে হাসি-ঠাট্টার খুকিপনা থেকে উদ্ধার করলেন। উনি-ই আমাদের মনগুলোকে টেনে বের করে বর্ধমানের বাইরের জগতে পৌঁছে দিলেন। তাঁর কাছেই শিখলাম কোলাজ কি বস্তু, জল-রং এর সাধারণ ছবিকে জল-ধোয়া গুয়াশের অনির্বচনীয় কল্পনার স্তরে কিভাবে নিয়ে যাওয়া যায়। তাঁর বাড়িতে আরো ছিল পাঁজা করা পাশ্চাত্য শিল্পের নানা বই, যেগুলো আমরা গিলে খেতাম। তাঁর কাছেই জানলাম ভ্যান গঘ কিরকম ভাবে তাঁর কানটা কেটে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর পছন্দের নারীটির কাছে, তাঁর প্রেমের উপহার হিসেবে। এরকম একটা ভালোবাসাও যে সম্ভব হতে পারে, এটা তো ছিল কল্পনার বাইরে! এই সব বই, তার ছবি আর সুদূর দেশের গন্ধমাখা কাহিনীগুলো ডানা মেলে মনটাকে উড়িয়ে নিয়ে যেত অসম্ভবের দেশে।
মনে রাখা ভালো যে সেই সময়ে মধ্যবিত্ত বাঙালীর জীবনে ছবির স্থান ছিল নগন্য। দেওয়ালে সাধারণত ঝুলতো মেয়েদের সুচিশিল্পের নমুনা, কিংবা মৃত পূর্বপুরুষদের ছবি। আমার রক্ষণশীল ঠাকুরদাদার কোলকাতার বাড়িতে লাল আলতায় পায়ের ছাপ ফটো ফ্রেমে বাঁধানো, খুব অবাক-ই লাগত সেসব অজানা মানুষদের পদচিহ্ন দেখে। এমনিতেও সেসব কালে গ্রামীণ মধ্যবিত্তদের বাড়ি-ঘর-দোর গোছানোর তেমন একটা চল ছিল না। সত্যেন দত্তের অনুবাদের সেই কবিতার নির্দেশ, দুটি পয়সা জুটলে 'ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী' জানা থাকলেও, ওসব ফুল-টুল নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না কারুর। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ছবি-টবি ছিল বাহুল্য মাত্র, অপ্রয়োজনীয়, সামান্য জিনিস। নীরদ সি চৌধুরী-র 'বাঙালি জীবনে রমনী'-র মতই - কাজে লাগবে, খাবে কম, আয় দেবে বেশি, কিন্তু বেশি বকে ঝামেলা আর বাড়াবে না! সেই রকম ভয়ানক বাস্তব ও রুক্ষ একটা জগতে যেখানে 'পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি',একটা সাদামাটা মফস্সলের ততোধিক সাদামাটা ছোট মেয়ে একটা 'ভিশুয়াল প্রাণী'-তে পরিণত হয়ে উঠছিল ওই শিবুবাবু আর তাঁর বারান্দার সকালগুলোর জন্যে।
সেকালে সাধারণ মানুষদের চোখের কাজের মধ্যে ছবি আঁকা বা দেখা, কোনটাই তেমন পড়ত না। সিনেমা ছিল বটে, তবে খুব অল্প লোকেই নিয়মিত সিনেমা দেখত। তখন সিনেমা বলতে সাদাকালো ছবি - মনে নেই কবে প্রথম তা দেখেছিলাম। কিন্তু আমার চোখের সামনে আরেকটা পৃথিবীর জানালা খুলে গেল শিগগিরি। প্রধানত বাবার উদ্যোগে, আরো অধ্যাপক বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায়, চালু হলো বর্ধমান শহরের প্রথম 'সিনে ক্লাব'। সিনেমার সঙ্গে বেশির ভাগ আলাপ হলো সেখানেই: বেশ ঘরঘর করে আওয়াজ হত রীল-গুলো ঘুরবার সময়ে, মাঝে মাঝে কেটেও যেত। বেশির ভাগ-ই বিদেশের সিনেমা - তখনকার দিনের কমিউনিস্ট ব্লক-এর দেশগুলোর থেকে সস্তায় পাওয়া ছবি। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে দিয়েই পরিচয় হলো অন্য এক দৃশ্যমান জগতের সঙ্গে।
ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে যে গান শেখাও চলছিল সে কথা তো বলাই হলো না। বর্দ্ধমান শহরের মধ্যে মানসীদি, মানসী চৌধুরী, ছিলেন এক অসাধারণ সুন্দরী, আদ্যন্ত একটি নরম মনের মানুষ, আর স্বর্গীয় এক কন্ঠের অধিকারিণী। মানসীদির কোলের কাছে বসে, হারমোনিয়াম-এর রীড টিপে টিপে কাটত সন্ধেগুলো। যত না গান গাওয়া, তার চেয়ে বেশি গানের গল্প। আমি তো ভিশুয়াল, আগেও বলেছি। আমার এখনো ধন্দ লাগে রাগ গুলোর শারীরিক মূর্তি নিয়ে। ছোটোবেলায় এই প্রশ্নটি আমাকে যার-পর-নাই ভুগিয়েছে! কি করে একটা রাগকে মনের মধ্যে দেখতে পাব, কিভাবে তাকে আঁকব - শুধু সুরে নয়, ছবিতেও - এটা এক রকম যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। তবে গানের কান যদি মানসীদি দিয়ে থাকেন, সুরের কান কিন্তু পেয়েছিলাম মায়ের থেকে। মা তো আই. পি. টি. এ. বাড়ির মেয়ে, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দলে কোরাস গান হারমোনাইজ করে গাওয়াতে তৈরী উদাত্ত গলা, তাই ছোটবেলা থেকেই মায়ের গান শুনে বড় হয়েছি। তাঁর ব্রাহ্ম পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী মা চাকরি করতেন, একটা মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, তাঁর সুমধুর কন্ঠের গান শুনি। মা কাজ করতে করতে, হাঁটা-চলা করতে করতে, চান করতে করতে - প্রায় সর্বক্ষণ গাইতেন। শুধু সলিল বাবুর গান-ই নয়, মা গাইতেন জর্জ বিশ্বাস, অর্থাৎ দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া রবি ঠাকুরের গানগুলো-ও। এছাড়াও মাথার ওপরে, আকাশের সূর্যের মতো আলো বিচ্ছুরণ করে থাকতেন সুচিত্রা মিত্র তাঁর দরাজ গলার সংগীত নিয়ে। বাবার এক বন্ধু একবার এনে দিলেন একটা HMV কোম্পানি-র রেকর্ড প্লেয়ার। তাতে নানা স্পিড-এর রেকর্ড বাজত সারাদিন, অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর অবারিত ও অনবরত যাওয়া-আসা, গানে-গানে গল্পে-গল্পে হইচই-এ আমাদের সাদামাটা বাড়িটা যেন সব সময়ে আনন্দমুখর হয়ে থাকত।
তখনকার সমাজে বাকি সব বাড়িতে গান গাওয়া হত না তা নয়, বেশির ভাগ মেয়েই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখত যাতে বিয়ের আগে 'দেখতে এলে' পাত্রপক্ষকে দু-চারটে গান শোনানো যায়। তবে মানসীদির মতো গান-কেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেওয়া মেয়েদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এনারা আবার সাধারণত অবিবাহিত হতেন। অর্থাৎ, অত কান্ড করে গান শেখার পরে গানের আর তেমন বিশেষ কোনো মূল্য থাকত না। রেডিও-তে কীর্তন বা পল্লীগীতি ছাড়া সাধারণত বাজত আধুনিক গান, মেয়েমহলে শ্যামল মিত্র ছিলেন খুব জনপ্রিয়। বাংলা সিনেমার গান তখন বাজত দুপুরবেলায়, রেডিও-র অনুরোধের আসর প্রোগ্রামে। বুধবার রাতের দিকে লুকিয়ে বিনাকা গীতমালা শুনত আমার দাদা, আমরাও তাতে কান পাততুম, তবে বাবার কাছে ধরা পড়লে বেশির ভাগ কানমলা খেত দাদাই। কানমলা, কারণ দেওয়ালে ঝোলানো দাড়ি-ওয়ালা ওই মার্কসবাবু হিন্দি গান-টান শুনতেন বলে মোটেও জানা নেই!
যাই হোক, কলেজ-এ তো যেতে হবে, আর সেটা কলকাতাতেই, প্রশ্নাতীতভাবে। সেই একটি ব্যাপারে আমার সঙ্গে বাবাও একমত। কিন্তু পড়বো কি? বাবার বিষয় ছিল ইকনমিক্স। মাকে তো তিনি ষোলো বছরের ছোটো মেয়ে-টিকে বিয়ে করেছিলেন, তাই মাকেও পড়িয়েছিলেন ওই এক-ই বিষয়। মা আসলে নিজের ইচ্ছেয় কি পড়তে চেয়েছিলেন তা নিয়ে আমি কোনো দিন ভাবি-ই নি। নিজেও ছবি আঁকা আর গান গাওয়া ছাড়া তো জীবন নিয়ে তেমন কোনো গভীর চিন্তা করি নি - তাহলে কি পড়বো?
কেন, ভূগোল? ছোট এক মফসসল শহরে বড় হয়ে যে পৃথিবী-টাকে জানার এক অদম্য বাসনা সংগোপনে বহুদিন ধরে মনের মধ্যে পুষেছি, তার একটু কাছাকাছি যাওয়া যায় একমাত্র এই বিষয় নিয়ে পড়লেই! কলকাতায় ভূগোল পড়তে আসার গল্প অন্য আরেক দিন সময়মতো হবে. তবে বাবার পথে চলে আমি নিজেও তো এক দিদিমণি, তাই ঢেঁকির যেমন স্বর্গে গিয়েও ধান ভানা, সেই আপন স্বভাবমতো শেষ করার আগে কিছু ব্যাখ্যা ও কিছু প্রশ্ন রেখে যাই না হয়।
বড় হবার পরেও অনেক সময়ে মনের মধ্যে এই প্রশ্ন পীড়া দিয়েছে, আমার মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা, বাবা কেন আমায় স্বাধীনভাবে নিজের জীবনের ধারা বেছে নিতে বাধা দিলেন? তাহলে কি ওই সব ছিল তাঁর একটা ছলনা মাত্র? না কি তাঁর অর্থনৈতিক মন শিল্পী জীবনের দাম বিচার করে, অজানা কোন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায়, তাঁকে তাঁর অতি আদরের মেয়ের ইচ্ছেয় হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করল?
আর এক অর্থনীতিবিদ এর বই পড়ে এই প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এই সম্প্রতি পেলাম। এই সাহেব বলছেন যে আমাদের দেশে, অর্থাৎ ভারতে, মেয়েদের মধ্যে 'হাউসহোল্ড ক্যাপিটাল' বা ‘ডোমেস্টিক ক্যাপিটাল’ তৈরির দিকে জোর দেওয়া হয়। ডোমেস্টিক ক্যাপিটাল-এর মানে যেসব পুঁজি বেশি থাকলে মেয়েরা ভাল করে সংসার করতে পারবে, যাতে ওই 'সংসার সুন্দর হয় রমনীর গুণে' কথাটি সার্থক হবে। বিয়ের বাজারে ডোমেস্টিক ক্যাপিটাল-এর দাম বেশি, কিন্তু তা দিয়ে রোজগার তেমন একটা করা যায় না - ওই দুয়েকজন সেলাই দিদিমনি বা গানের দিদিমনি বাদে। এর উল্টো দিকে হলো মার্কেটেবল ক্যাপিটাল অর্থাৎ যেসব পুঁজি থাকলে অর্থনৈতিক দিক থেকে মেয়েদের মূল্য বাড়বে, যেসব গুণাবলী চাকরির বাজারে মূল্যবান। আমার ইকনমিস্ট বাবা তাহলে কি এই ভাবনা থেকেই আমায় ঠেলে কলেজে পড়তে পাঠালেন, যাতে আমার অর্থনৈতিক পুঁজি বাড়ে? তিনি কি বুঝেছিলেন যে ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে গেলে, নিজের মতো নিজের ভাবনায় চলতে গেলে, তাঁর মেয়ের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একান্ত জরুরি? কিন্তু এটাও তো বড় দুশ্চিন্তার কথা যে ছবি আঁকা ও গান করার মতো ব্যাপারগুলো তাহলে তাঁর কাছে ছিল একান্তই সাংসারিক মূলধন, অনর্থনৈতিক বোঝা যা আমার কস্মিনকালে কোনো কাজে লাগবে না!
কি ভয়ংকর কথা! বাবার বিষয় পড়ব না বলে জেদ করে আমি ইকনমিক্স পড়ি নি. ভাগ্যিস! অর্থনীতিবিদেরা সব কিছুকেই টাকার অঙ্কে বিচার করেন, তাই গান-বাজনা-ছবি আঁকার মতো সুক্ষ্ম দক্ষতাগুলোকেও তাঁরা 'পুঁজি' হিসেবে বর্ণনা করেন। কি মুশকিল, এ তো সত্যি-ই ভারী দুখের কথা! পুঁজি বাড়াচ্ছি ভেবে তো জীবনে কিছুই করলাম না, গান গাওয়া কি ছবি আঁকা তো নয়-ই। তবে এটুকু জানি যে বাবার কথা কিছুটা মেনে, আর কিছুটা না মেনে, কলকাতার কলেজ-এ ভূগোল পড়তে গেলাম। সাদা-কালোয় ম্যাপ এঁকে এঁকে ছবি ও সুর হারিয়ে গেল জীবন থেকে। ওই মার্কেটেবল পুঁজির জোরে সারা জীবন কলুর বলদের মতো চাকরির ঘানি টেনে গেলাম: বাবার আজ্ঞামত নিজের ও অন্যের পেট ভরালাম। কিন্তু না গেয়ে গেয়ে আজ এখন আমার গলা থেকে গান ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছে; চোখের জ্যোতি কমে কমে, রঙের ভুবন মিলিয়ে যাচ্ছে। সারাজীবনের দেবতা ছাপার অক্ষরগুলোকে আর ভালো দেখতে পাইনা যখন, তখন জীবনের প্রান্তে এসে মাঝে মাঝে এসব প্রশ্ন মাথায় জাগে বৈকি।
তবে একথা ঠিক যে বাবার অযৌক্তিক আচরণের প্রতিবাদে ড্রাগের নেশায় ঢুকে পড়িনি। যেটুকু রাস্তা নিজে ভেঙ্গে বের করেছি, সেই পথে অল্প মূলধনটুকু নিয়েই বাকি পথ হেঁটেছি।
এভাবেই আমরা বড় হয়েছি, কিছু হাসি, কিছু কান্না, কিছু আশা আর কিছু নিরাশার মধ্যে। অন্য এক সময় ছিল সেটা। সে যুগে মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার এর অত্যাচার ও সুবিধা কোনটাই ছিল না. জীবন চলত ধীর গতিতে, বদল আসতো ঢিলে ঢালা ভাবে, তার নিজের ইচ্ছে মতো। সেই দেশ ও কাল এখন অতীত হয়ে গেছে। 'পাস্ট ইস আ ফরেন কান্ট্রি' - সত্যিই সে ছিল একটা অন্য দেশ ও সময়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।