“এক উপন্যাসের সঙ্গে তো তেলেনাপোতা আবিস্কার গল্পের সাদৃশ্য দেখলাম। ... বহুদূরদেশবাসী দুই লেখক একই ফর্মে ভেবেছিলেন প্রায় একই কাহিনি।” লিখছেন বন্দিত লেখক অমর মিত্র, তার টাইম লাইনে। পাঠকের পড়া আর লেখকের পাঠ তো এক নয়। ফলে লেখক কোন বই পড়ে যখন তার সম্পর্কে দু-চার কথা লেখেন তা অন্য পর্যায়ে চলে যায়। আর তাই বাক্যদুটো পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। কৌতুহলী হয়েছিলাম, কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর উল্টোটাই দেখা যায়।
১৯৪২ সালে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় লেখা প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’ ১৯৪৬ সালে তার ছোটগল্পের সংকলন গ্রন্থ ‘কুড়িয়ে ছড়িয়ে’-তে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পুস্তক আকারে প্রকাশ পায়। অন্যদিকে ১৯৬২ সালে বই আকারে বের হয় ‘আউরা’ নভেলাটি। মজার ব্যাপার, ২০০১ সালে মেক্সিকোতে হইচই শুরু হয়, এবং ২০০৯ সালে পুয়ের্টো রিকো’তে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নভেলাটাকে, অশ্লীলতার কারণে! আশ্চর্যজনকভাবে দুটো লেখার গতিধারা একই রকম।
“প্রেমেন কখন লিখবে? সমস্তটা সকাল ইতর লোকজন দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে --- তারপর আছে সিনেমা ইত্যাদি বিষয় --- বিকেল এবং গভীর রাত অবধি আড্ডা।” লিখছেন জীবনানন্দ দাস তার ডায়রীতে। জীবনানন্দ কি জানতেন ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’ গল্পটার কথা? তিনি কি পড়েছিলেন? যদি পড়তেন, তাহলেও কি এ কথাটাকে কেটে দিতেন না? ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’ প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনেক মহালেখার এক লেখা --- এক মাইলস্টোন।
মধ্যম পুরুষে লেখার ঝকমারি যে কি এবং কতটা, যে লেখক বা লেখিকা লেখার চেষ্টা করেছেন, তিনিই জানবেন। কজন বাঙালী লেখক মধ্যম পুরুষে লিখেছেন? আমি তো প্রেমেন্দ্র মিত্রকে প্রথম পড়লাম। উনি কি লিখেছেন আর? কিম্বা কমলকুমার, কিম্বা...? জানি না। এমন লেখা বাংলায় থাকলে সহৃদয় পাঠক-পাঠিকা তার কিছু উদাহরন দেবেন। আমি পড়তে ইচ্ছুক। “‘সেকেন্ড পারসন ন্যারেটিভ’ সামলানো যে কেমন কঠিন, অথচ সামলে ওঠবার পর তার আবেদন কেমন হয়---”, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা অনুযায়ী, তার বড়ো প্রমাণ এই দুটি সৃষ্টি।
প্রেমেন্দ্র মিত্র তার গল্পে শহর কলকাতার কাছাকাছি একটি গ্রামকে সৃষ্টি করে দ্বৈত জগৎ সৃষ্টি করলেন। মধ্যম পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীতে তৈরী হল এক ধোঁয়াশা, একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবারের মুখোমুখি হওয়ার সাথে সাথে দরিদ্র পল্লীজীবনের চির অমলিন কথকতা রহস্যাবৃতের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে রহস্যেই ডুবে গেল। এবং এই ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে যে আলেখ্য আমার সামনে উঠে এল তা অদ্ভুত বাঙ্ময়। একটি প্রায় শূন্য গ্রামে এক দরিদ্রা মেয়ের মায়ের অপেক্ষা, জামাইয়ের জন্য, যে কথা দিয়ে আর ফেরে নি।
অন্যদিকে কার্লোস ফুয়েন্তেস এককাঠি উপরে উঠলেন। তিনি দ্বৈতসত্তার টানাপোড়েনের মধ্যে দ্বিখন্ডিত করলেন এক মানুষকে, সেই একই রকমের ন্যারেটিভে। একটি বিজ্ঞাপনের ভিত্তিতে কাজ পাওয়া এক লোক বন্দী হলেন এমন এক বাড়ীতে, যেখানে এক বৃদ্ধা আর অবিবাহিত এক রমণী থাকেন। এই দুজনকে ঘিরে তৈরী হয় রহস্যময় পটভূমি। মানুষটি আকৃষ্ট হল যে মেয়েটির প্রতি, সেই মেয়েটির সত্তায় মিশে আছে বৃদ্ধাটির সত্তা, যাদের দুজনকে মাঝে মাঝে আলাদা করাই কঠিন হয়ে পড়ে আলোআঁধারির ভয়াবহ রহস্যময়তায়, প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়া বাড়ীটাতে এই তিনটে মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এমন এক মায়াবিন্যাস, যার জাল থেকে বেরোনো প্রায় দুঃসাধ্য।
কার্লোস ফুয়েন্তেস তার নভেলায় আশেপাশের আবহকে করে তুললেন ছায়াময়, মায়াময়, ধোঁয়াশাময়, গা ছমছমে ভৌতিকময় এবং রহস্যময়। এই যে ‘ডাব্ল আইডেন্টিটি’র নির্মাণ, সেই দ্বিখন্ডিত সত্তাটি কার? এখানেই সাংঘাতিক রকমের জটিলতার সৃষ্টি করলেন লেখক। দোন্সেলেস্ শহরের মধ্যে থেকে ৮১৫ নম্বর বাড়িকে প্রথমে বিচ্ছিন্ন করলেন; এরপর বাড়ীর মধ্যে কোন্সুয়েলো ইয়োরেন্তের (বৃদ্ধা) সত্ত্বাকে আলাদা করলেন, এবং, অবশেষে দ্বিখন্ডিত করলেন মুল প্রোটাগোনিস্ট ক্যারেক্টার ফেলিপো মোন্তেরোকে (মানুষটি)। এই সমস্ত বিভক্ত সত্তাগুলোর টানাপোড়েনের কেন্দ্রে থাকে ‘আউরা’ নামক মেয়েটি। যে এত কাছে, তবুও অনেক দূরে। যে জীবিত, অথচ মৃতবৎ। যার নিঃশ্বাসের গরম হলকা ছেয়ে যায় মধ্যরাত্রে মোন্তেরোর বিশাল বুকে। পূর্ণিমার চাঁদকে ঢেকে দিয়ে রহস্যময় নির্জন ঘরে নেমে আসে মায়াজাগতিক পূর্ণতা, অথচ সেই পূর্ণতার আস্বাদ পায় কে? মায়াময়ীরূপী ছায়াময়ীকে ধরা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না। স্কাইলাইটের স্বচ্ছ কাঁচও নগ্ন নির্জন রাতের চরম ভয়াবহ রহস্যময়তাকে ভেদ করতে পারে না। শহরের বুকে নামে আদিম বিষন্নতা, নামে মোরান্তোর বুকেও, যেমন করে নেমে এসেছিল তেলেনাপোতা’র এক অনামা চরিত্রের বুকে, যামিনীর জন্য। যার সত্তা তার মায়ের সত্তার সাথে আটকে থাকে, যেতে পারে না কোথাও। আউরা আর যামিনী --- দুজনের অপেক্ষাই অনন্তকালের অপেক্ষা।
তবুও যামিনী আউরা নয়। যামিনী দিনের আলোর মত মিথ্যা, আউরা মধ্যরাতের মতো সত্যি; যামিনী নগ্ন নির্জনতার কায়া, আউরা গা ছমছমে ছায়া; যামিনী দৈনন্দিন জীবনের অসহায়তা, আউরা তীব্র কামনার হাহাকার; যামিনী পল্লীপ্রকৃতির মায়াবতী, আউরা শহুরে শূন্যতার মায়াবিনী; যামিনী কল্পনার জগতে অজ্ঞাতবাস করে, আউরা নিজেই বীভৎস কল্পনা; যামিনী অপ্রাপ্য, আউরা প্রাপ্যের জন্য উন্মাদিনী; যামিনী কঠোর বর্তমান, আউরা বেদনার্ত অতীত --- অথচ দুজনেই অস্তি-নাস্তির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে সম্পূর্ণ গল্পটাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
প্রেমেন্দ্র মিত্র কার্লোস ফুয়েন্তেস নয়, কার্লোস ফুয়েন্তেসও প্রেমেন্দ্র মিত্র নন। অথচ দুজনের এই কিম্ভুত ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে তাদের নিজস্ব মায়াময় জগতের মধ্যে এমন দ্বৈতসত্তার জগৎ সৃষ্টি করেছেন, যা মনের মধ্যে স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে বাধ্য। কাহিনীর টাইপ অদ্ভুতভাবে একই রেখেছেন দুজনে, পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকে, একে অন্যের কাজের প্রতি অজ্ঞাত থেকে। অতীতের আবেদনের বেদনা আর বিষন্নতা বর্তমানের আর্তনাদ হয়ে ফেরে দুটো লেখাতেই। আর এই বিষন্নতার গাঢ় বিন্দু আখ্যানশেষে রাত্রির মতোই রহস্যময়ী হয়ে কালো কালো হতাশার মধ্যে নিশ্চুপে ডুবে যায় টুপ্ করে...
======================
তেলেনাপোতা আবিস্কার – প্রেমেন্দ্র মিত্র
আউরা – কার্লোস ফুয়েন্তেস – অনুবাদঃ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
বই কৃতজ্ঞতাঃ প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সংগ্রহ
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ অমর মিত্র, গৌতম মিত্র
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।