এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • এ হাওয়া

    Aniruddha Garai লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ৫৪৬ বার পঠিত
  • এই সময়টা, এই শীতটা সবে যেতে শুরু করেছে, বিকেল পড়লে সোয়েটারের তলায় গরম করছে একটু– এই সময়টা একটা অদ্ভুত ফুরফুরে হাওয়া দেয়। কেমন বিষন্ন করে দেয়। সন্ধ্যায় ফেরার পথে মনে হয় কেউ যেন বলছে, "পাখি, সন্ধ্যে হল, এবার বাসায় ফেরার পালা।"

    আমি বলি, "মানুষের কি বাসায় ফেরা হয়? মানুষ তো শুধু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় এমন না– একটা সময় ফেলে আরেকটা সময়ে এসে পৌঁছয়। বাসা তো পড়ে রয়েছে সেখানে, যেটাকে অতীত বলে। সেখানে তো ফেরা যায়না। সময় চলে গেছে। সেদিন যারা ছোট ছিল, আজ সব বড় হয়ে গেছে। আমাদের যারা গল্প শোনাতেন– সেই বৃদ্ধেরা আজ কোথায়? সরস্বতী পুজোর পর এই সময়টা আমাদের পরীক্ষা থাকতো। এই ফুরফুরে হাওয়া থাকতে থাকতে সেই পরীক্ষা শেষও হত। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে সমস্ত গল্পের বই টেনে নামাতাম আগে। শুকতারা, আনন্দমেলা, টিনটিন, পথের পাঁচালী। অপুর সেই কাশীর স্কুলে ফুটবল খেলা আছে। অপুর কাছে বাঁশি আছে বলে তাকে আসতে বলা হয়েছে মাঠে। বিকেল হয়ে আসছে। অপু ঘরে এসেছে বাঁশি নিতে। কিন্তু যেতে আর পারছেনা। সেদিন কি এই ফুরফুরে হওয়া বইছিল? জানা নেই। নিশ্চিন্দিপুর শুধু দূর নয়, ক্রমশ পুরনোও হয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো বাড়ি ফিরবে অপূর্ব রায়, অপু ফিরবে কি? জানেনা। অপু জানেনা। আমরা কেউই জানিনা। তাই বাসায় ফেরা অত সহজ না বাবা। পরিযায়ী পাখির ঝাঁক সময় ফুরোলে দেশে ফেরে– কিন্তু আমাদের শুধু সেই দিয়ে হয়না। আমরা স্মৃতিতেও ফিরতে চাই। একবার, অন্তত একবার যদি ফেরা যায়। মোরামের রাস্তায় যদি একবার ছোটা যায় ধুলো ছিটিয়ে। সাইকেলটা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া যায়। লোডশেডিংয়ে জানালাটা খুলে দিয়ে চুপটি করে বসে থাকা জানালার পাশে– চারিদিক নিঝুম— টিমটিমে নক্ষত্রের পাশে টিমটিম করতে করতে উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন—  বিশাল আকাশ— মানুষ হারিয়ে যায়না এর মধ্যে? হারিয়ে যাবো, হারিয়ে যাবো, কেমন ছমছম করে ওঠে গা। এত নক্ষত্রের মধ্যে একটা ছোট্ট ছেলে যদি রাস্তা ভুলে যায়? পঁচিশ বছর বয়সে এইসব ভয়গুলো গুরুত্ব হারায়। এখন প্লেনও অনেক নীচ দিয়ে যায়– এই শহরেই এয়ারপোর্ট হয়েছে। এখন হারিয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবতে বসলে মনে পড়ে অনেকদূর চলে এসেছি। আমার মামারবাড়ির তুলসীমঞ্চ আর প্রদীপ পায়না। বুড়ো শিব উঠোনের একধারে সমাধি নিয়েছেন চুপচাপ। দাদুর অবর্তমানে তাঁর ঘর ক্রমশ ঝুলে ভরে যাচ্ছে। সেই ঘরে থাক থাক করে রাখা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট আর স্বরবিতানের সাথে আমার ক্লাস সিক্সের হাতঘড়ি আমার আত্মার একটুকরো ধরে রেখেছে এখনও। ব্যাংকের জনৈক বুড়ো কাস্টমার জানতে পারেন না, আমার ঠাকুরদা "আজকে ব্যাংকে যাবো" বলে একটা দিন যে বরাদ্দ করতেন ওই কাজে, তারপর বাড়ি এসে টাকা গুনতে বসতেন, তাঁকে দেখে সেইসব কথাই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। বলা যায়না, একদিন রাশ আওয়ারে হয়ত চলেই এলেন ঠাকুরদা, এসে বললেন— "সমু, বড় হয়ে গেছিস!"

    সন্ধেবেলা ঘরে ফেরার সময় উদীয়মান সূর্যের মত রিলায়েন্স ট্রেন্ডসের একটা বিশাল লোগো দেখা যায়। আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, এমন ভান করে অনেক উঁচুতে জ্বলজ্বল করে এলাকার লোকাল আম্বানির কোম্পানির নাম। দেখতে দেখতে একটা মোড় পড়ে। মোড়টা ঘুরলেই একটা পুকুর। পুকুরের পাশেই ঝোপের জঙ্গল, সেখানে অনেক পাখির বাস। সন্ধেবেলা তারাও ফেরে একে একে। তারপর একে একে জ্বলে ওঠে জোনাকি, গেয়ে ওঠে ঝিঁঝি। আমি ফরমাল ছেড়ে ঘরের কাপড় পরি। ফুরফুরে হাওয়া দেয়। যাওয়ার আগে একগাদা দুঃখ দিয়ে যাচ্ছে শীত। জনবসতি থেকে দূরে, বিশাল আকাশ আর ঝোপের বনের সাথে নিবিড় হয়ে ন্যাড়া ডালের উপর পাখিরা ঘুমোতে যায়।

    বাসায় ফেরা অত সহজ না পাখি। তোমাদের মত জীবন নয়গো আমাদের। সেই প্রাক- বৈদ্যুতিক যুগে, কোন এক নিস্তব্দ সন্ধ্যায়, দৈত্যাকার বৃক্ষদের পাতার ফাঁকে দৃশ্যমান তারার জমিন এবং ইতিউতি থেকে সাড়া দেওয়া শেয়ালের ডাককে সাক্ষী রেখে বুড়ো মহাদেবের কাছে আকুল হয়ে আমরা অমরত্ব প্রার্থনা করেছিলাম।‌ তাতে অনেক জ্বালা। বুড়ো মহাদেব তাই আমাদের স্মৃতি দিলেন।
    শোক দিলেন।
    ভাষা দিলেন।
     
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Falguni Mazumder | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:১৮516486
  • দারুন লেখা।
  • Aniruddha Garai | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:৫৪516488
  • ধন্যবাদ :)
  • Jayayi Roy | 2409:4060:e9f:a6be::554b:***:*** | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:৪৪516505
  • ভালো লেগেছে 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন