আজ পটেশ্বরী যখন ঝিমোচ্ছিল তখন আচমকা ওর মস্তিষ্কে ঢুকে গেল গল্পের অতি ক্ষুদ্র ছানারা...ঢুকেই তাদের দৌরাত্ম শুরু...একেকটা একেক দিকে লাফাচ্ছে। সামলাতে গিয়ে পটেশ্বরীর হাল, নাজেহাল। ওরা প্রত্যেকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আলাদা করে শোনার মত সময় ও ধৈর্য্য কোনটাই দেয় না পটেশ্বরী...রাগে অভিমানে ওরা মুখ ফুলিয়ে থিতিয়ে যায় ভেতরেই... তখন ওদেরই এক পুঁচকে ফস্কে গিয়ে লিখিয়ে নেয় কিছুটা...
সেটাই নিয়ে এলো পটেশ্বরী...
“অথ পটেশ্বরী কথা”
১
গল্পটা যখন শুরু হচ্ছে, পটেশ্বরীর ক্লাস নাইন...
সেভেন - এইটের সমস্ত খারাপ লাগা মিটিয়ে ভালো হবার প্রচেষ্টায় ও এখন একটু গল্প টল্প পড়ে...পড়ে কটা কবিতাও...আনন্দবাজার তখন ছাপত মন কেমনের কাহিনী...আর ওর কেবলই মনে পড়ে যেত সদ্য আলাপ হওয়া ছেলেটিকে...
যাক, এ এক বছরে সেও নির্ঘাত ভুলে গেছে ভেবে মন ভালো করত পটেশ্বরী...ঠাকুমা তখন মাদুরে বসে একাই ছক্কা পুট। ওর খুব কাছের মানুষ ঠাকুমা...পিঠ ঠেকিয়ে বসে, চাল উলটে দেয়...আর রাগে গজগজ করতে করতে ঠাকুমার মুখে বাঙাল ভাষার বুলি ফুরফুর করে ওড়ে...পটেশ্বরী আবার সাজিয়ে দেয় গুটিগুলো...
এমনটা রোজ রোজ হয়, ভেতর ঘরে চারটে মানুষ - তাও কেমন আলাদা হয়ে থাকে...
নাইনে ওঠার পর থেকেই পটেশ্বরী দেখে মা-কে একটা দুধ সাদা গাড়িতে করে প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হয়...বাবা যান সাথে, আসে সেজ মামাও...বেশ কিছুদিন মা আর বাড়ি আসে না...চিঠি লেখে হাসপাতালে বসে,
- তোর দিদির খুব জেদ। এবার সেকেন্ড হলো কেন?
বোন সে চিঠি দেয় পটেশ্বরীর হাতে অনেক অনেক বছর পর...মা তখন নেই, তবে চিঠিটা আছে। মায়ের হাতের স্পষ্ট লেখা - হাসপাতালের আয়া মাসি আজ খুব লেটে এসেছে...সব লিখে রাখে মা...
পটেশ্বরী সে চিঠি সামলে রাখে নিজস্ব ফাইলে...যেখানে হাত দিতে মানা আছে সকলের...
স্মৃতির পুটুলি যেন... খুললেই ঝুপ্পুস অন্ধকার...
২
সেদিনের অত বড় বাড়িটা আস্তে আস্তে দুই ভাগ হয়ে যায়। সাক্ষী থাকে উঠোন জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটা...কত অত্যাচার সহ্য করেছে ও পটেশ্বরীর।
পটেশ্বরী দেখে দুটো আলাদা ছাদ, ওর খুব ইচ্ছে হয় মাঝ বরাবর রাস্তা করে দেবে...
কিন্তু সব ইচ্ছে তো আর ফল দেয় না...তাই ও সব বাক্সবন্দী করে মন দেয় পড়াশুনায়।
এলেন বহু মাস্টারও...বছর এক পরপর তাদের বদল হয়। কারো সময়ের সাথে মেলে না, কারো শর্ত সপ্তাহে তিন দিন।
তাহলে কি হুল্লোড় করেই কেটে যাবে?
কিন্তু সে গুড়ে বালি। মামা তাঁর এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে আসে, বিএসসি ফাইনাল দিয়েছে..
সে মাস্টারও “পারব পারব” করে মাথা নাড়িয়ে চলে যেতেই পটেশ্বরীর মনে হয়, এবার থেকে আর যাই হোক বিজ্ঞানে সবাইকে টেক্কা দেওয়া যাবে। কিন্তু সে এক দীপাবলিতে নিজের হাতে রঙ মশলা ও তুবড়ি বানিয়ে উপহার দিয়ে যায় ছাত্রীটিকে...
সেদিন সে তুবড়ি জ্বললও অনেকক্ষণ, তবে উনি পড়ানো ছেড়ে দিলেন।
পটেশ্বরী চুপ থেকে আরো চুপ হয়ে যায়...নজর এখন লম্বা একটানা রাস্তাটায়...
৩
এরপর গল্পকে ঘুরতেও হলো সময়ের চালে...একটু পিছিয়ে পড়ল পটেশ্বরী। তখন ঘুড়ি ওড়ানোর দিন...বৃষ্টি হব হব-তে ফড়িংএর ছুটোছুটি... বড় সুন্দর সেই ছেলেবেলা, বড় তাড়াতাড়ি হারিয়েও যায়...
এর মাঝে দেখা দেন কিছু গানদিদির মতো মানুষ যারা অভয় দেন, হবে হবে – চালিয়ে যা... যদিও মন বসে না পটেশ্বরীর।
কিতকিত, এক্কা দোক্কার দিন কাটতে না কাটতেই ওদের পাড়ার সব টালির ছাদগুলো ক্রমশ পাকা হতে শুরু করে। আর মাঠগুলো কেমন ছোট হয়ে যায় অনেকটা। তখন ছাদে ছাদে কথা বলে শুধু। আর মানুষেরা একে অপরের মুখ দেখে অনেক অনেক দিন পর...
সবার বাড়ির দেওয়ালগুলো উঁচু হতে থাকে...এ বাড়ির নুন-হলুদ-ঝাঁঝ আগে জানালা দিয়েই পৌঁছে যেত ও বাড়িতে, এখন পাহাড় প্রতীম এক ইঁটবাক্স যেন...ইচ্ছে হলেও সরানো যায় না...
তখন থেকেই সম্পর্ক বুঝতে শুরু করে পটেশ্বরী... এক কঠিন জাদুবাক্স যা জুড়লে শুধুই মায়া বাড়ে।
পটেশ্বরীকে কাব্যিক করে তুলতে সে এক মাস্টারই যথেষ্ট...বাংলায় এমএ এক সাইকেল বাবু। মা-বাবার পরেই তাঁর হাতখানা মাথায় পড়তে পটেশ্বরী মানুষ হতে শুরু করে। এখন আর ফড়িং এর লেজে সুতো বেঁধে ওড়াওড়ি দেখে না । বরং খাঁচায় আটকানো টিয়া পাখিকে উড়িয়ে দিতেই আনন্দ।
৪
গ্রামারে ভুল ও অপটু ইংরেজিতে, তবু চিঠি লেখা চাই। চিঠির অসুখ বা অসুখের চিঠি দুটোতেই বেশ ভালোভাবে আক্রান্ত হয় পটেশ্বরী। কিন্তু সে চিঠির গন্তব্য নেই, তাই জমতে জমতে পাহাড় হতেই সে বুঝল বৃথাই সময় নষ্ট, অন্য কিছু হোক...
বাড়ির নারকেল গাছগুলোর মতন তখন বাড়তে লাগলো পটেশ্বরী। বয়স বাড়লে স্বভাবও বদলে যায় তাই ধীর স্থির ভাবগুলো তাঁর ক্রমে ক্রমে শেখা...এখন আর ঝপাং করে রাগ করতে পারেনা সে...বরং অন্যের রাগ থামাতে তাকে নিজেই ঝুঁকে যেতে হয় অনেক - অনেকটা।
ক্লাস তখন টেন। হাতে লাল মলাটের টেস্ট পেপার, গত পাঁচ বছরের একসাথে নিয়ে ছাদের ঘরে পড়াতে আসতেন মনোরথ স্যার। একেই তাঁর সারাদিনের ক্লান্তি। সব ছেলেপুলে পড়িয়ে সবার শেষে এ বাড়িতে। হুকুম হত অনেক। এ এক অন্য অভিভাবক যেন মাথার ওপর।
বাবা তখন ব্যস্ত ভীষণ – হাসপাতাল হাসপাতাল...
৫
মায়েরা কখন খায়, কখন ঘুমোয় কেউ জানেনা। তাদের আভ্যন্তরীন হার্ডডিস্কে লুকনো থাকে অনেক ছোট ছোট চিপস যা দিয়ে সহজেই তারা মেপে নিতে পারেন ছেলে মেয়েদের কম বেশি প্রয়োজনটা।
পটেশ্বরীর পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। পটেশ্বরীর মা ছিলেন সুপার উইমেন, যিনি ঘর ও বাইরে দুটো সমান ভাবে সামলাতেন। সেই চঞ্চল মানুষটাকে এভাবে ঝিমিয়ে পড়তে দেখে খারাপ লাগত পটেশ্বরীর। কিন্তু এই অসুখের নাকি প্রতিকার নেই। দেখতে দেখতে সময় যায়। সারা বাড়িতে তখন ওষুধ ওষুধ গন্ধ। কিছুতেই ভালো হচ্ছে না মায়ের শরীর... পটেশ্বরীর স্বপ্নগুলো আস্তে আস্তে গুটিয়ে যায় সব। এগারো ক্লাসে উঠতে না উঠতেই মায়ের অসুখ হয় চরমে।
পটেশ্বরী ঠাকুর মানত খুব...মানত জ্যোতীষবিদ্যাও...কিন্তু সেই সব কিছু মিথ্যে করে ফেব্রুয়ারীর এক শেষ দিনে ফুল সাজানো গাড়িতে মা চলে গেল। আর সেই দিন থেকেই এক ঝটকায় বয়স বেড়ে গেল পটেশ্বরীর। ঘুরে গেল ভাগ্যের চাকাও বিপরীতে...
“যা পেয়েছি কেন তা চাই না, যা চেয়েছি কেন তা পাই না”...
- ঝর্না বিশ্বাস
[ছবি- আর্ন্তজাল]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।