সম্প্রতি এমে সেজায়ারের ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম পড়লাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইওরোপ দুর্বল হয়ে গেছিল, তার জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুরনো ধাঁচের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা। কথিত তৃতীয় বিশ্বে দেখা দিচ্ছিল উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন।
সেজায়ার ঠিক এই বাস্তবতাতেই লিখেছিলেন তাঁর ডিসকোর্স।
এই বইয়ে সেজায়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। উপনিবেশ কেবল প্রতিষ্ঠান আর আইনকানুন দিয়ে টিকে ছিল না, টিকে ছিল না কেবল কারাগার আর অত্যাচারীদের ক্ষমতাবলে। এসব তো আছেই। কিন্তু ইওরোপীয় উপনিবেশবাদের একটা সাংস্কৃতিক দিক ছিল। যার মূলকথা ছিল ‘নেটিভদেরকে’ যদি শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাদেরকে মূলধারায় ‘আত্মীকরণ’ করতে হবে। সেজায়ারের ভাষায়, আ ফ্রেঞ্চম্যান উইদ ব্ল্যাক স্কিন। এই কাজে এগিয়ে এসেছিলেন ধর্মগুরু আর বিজ্ঞানপ্রেমিরা, এগিয়ে এসেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তির চাবুক হাতে নিয়ে।
এই বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশ স্থাপনকারীদের কেউ আফ্রিকার ইতিহাসকে পরিকল্পিতভাবে বিকৃত করেছেন, কেউ দাবি করেছেন কোনো ইতিহাসই নেই আফ্রিকার। কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে উপনিবেশবাদকে জায়েজ করেছেন। আবার কেউ মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে “আফ্রিকানরা চিরশিশু” এই বর্ণবাদী চিন্তাকে রীতিমতো ‘বৈজ্ঞানিক’ চেহারা দিয়েছেন।
কালো আফ্রিকানদের জন্য এর ফল হয়েছে মারাত্মক। তাদের অনেকেই নিজেকে উপনিবেশের মাঝে হারিয়ে ফেলেছে। উপনিবেশ স্থাপনকারীদের লেখা মিথ্যা ইতিহাসে বিশ্বাস এনেছে, নিজের আত্মপরিচয় ভুলে, মেতে উঠেছে ইওরোপীয় হওয়ার এক অবাস্তব প্রতিযোগিতায়।
সেজায়ার ওঁ তাঁর প্রজন্মের আমূল পরিবর্তনকামীদের আশা ছিল, বিউপনিবেশীকরণ আফ্রিকার মানুষদেরকে মুক্তি দেবে। সেই আশায় তাঁরা বিকশিত করেছিলেন নেগ্রিচুড-এর ধারণা। এটা প্রাক-উপনিবেশিক কোনো ‘সোনালি অতীতে’ ফেরার প্রকল্প ছিল না, ছিল উপনিবেশের পরিয়ে দেয়া চশমাটা খুলে নিজের অতীতকে পুনরাবিষ্কার করা, তার সাথে বর্তমানের সবচে অগ্রসর চিন্তা ও চর্চার মেলবন্ধন ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত সুন্দরতর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা।
সেজায়ারদের সেই স্বপ্ন এখনো পূরণ হয় নি।
*
ডিসকোর্স পড়তে পড়তে আমি আমার কথা ভাবছিলাম। আমাদের কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম আরেক উপনিবেশিক শিকার দক্ষিণ এশিয়ার কথা।
আজকে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা যেসব জাতিরাষ্ট্র দেখি, এসবের সীমানা নির্ধারণ করেছিল উপনিবেশিক শাসকরা। সেইসাথে নির্ধারণ করে দিয়েছে নানান পরিচয়ের সীমানাও। উত্তরউপনিবেশে আমরা যেসব দেশীয় শাসকদেরকে দেখতে পাই, তাঁরা জুলুম করতে শুধু উপনিবেশিক আমলের প্রতিষ্ঠান আর আইনকানুনই ব্যবহার করেন না, সেইসাথে ব্যবহার করেন উপনিবেশের তৈরি করা পরিচয়ের সীমানাগুলোকেও।
তাই উপনিবেশ দক্ষিণ এশিয়াতেও মুক্তি আনে নি, নানান পরিচয়ের নামে, নতুন নতুন যুদ্ধের ময়দান তৈরি করেছে মাত্র।
*
বাংলাদেশে পরিচয়ের রাজনীতির মোটামুটি দুই ধারায় চলে। একটা ধর্মীয় পরিচয়। অন্যটা জাতিগত পরিচয়।
ধর্মীয় পরিচয়বাদীদের নজরে বাংলাদেশ মূলত মুসলমানদের দেশ। কারণ ‘সংখ্যাগুরুই’ মুসলমান। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এরা এই দেশে ‘সংখ্যালঘু’।
জাতিগত পরিচয়বাদীদের চোখে বাংলাদেশ প্রধানত বাঙালিদের দেশ। কারণ বাঙালিরাই ‘মূলধারা’। এই দেশের সমতল আর পাহাড়ের অন্যান্য জাতির মানুষেরা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বা ‘উপজাতি’ আর উর্দুভাষী ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’।
*
বাংলাদেশে এই দুই ধারার পরিচয়বাদই উপনিবেশের উত্তরাধিকার।
*
উপনিবেশের এই দুই ধারার উত্তরাধিকারীরা মাঝে মাঝেই নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে লিপ্ত হন। আমরা আগে মুসলমান পরে বাঙালি নাকি আগে বাঙালি পরে মুসলমান এই সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন বিতর্ক বেশ উত্তাপ ছড়ায়। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও গরম থাকে সামাজিক মাধ্যম।
এই বিতর্কের প্রথম সমস্যা হল, এতে বাঙালিও না মুসলমানও না, দেশের এমন মানুষদেরকে অদৃশ্য করে দেয়া হয়। দ্বিতীয় সমস্যা হল, এতে শাসকদের উপকার হয়। সমাজ এহেন বিতর্কে লিপ্ত থাকলে সব ধর্ম আর জাতির মানুষদের নাগরিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নগুলো হাওয়া করে দেয়া যায়।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই তাই হচ্ছে।
*
২০২১ সাল ছিল বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি। একটা দেশের জন্য অর্ধশতাব্দী কম সময় নয়। অথচ এখনো আমরা অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছি। ন্যুনতম নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিও এখানে বিকশিত হয় নি। ক্ষমতার পালাবদলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটুকুও বারবার ব্যাহত হয়েছে। সামরিক ও বেসামরিক উভয় চেহারায়ই এসেছে স্বৈরশাসন। উত্তরউপনিবেশের মুক্তি উপনিবেশের দায়ের সম্প্রসারণ থেকে গেছে, সত্যিকার অর্থে মানুষের মুক্তি আসে নি।
*
পরিচয় প্রশ্নের সুরাহা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা না, কিন্তু অন্য বহু সমস্যা সমাধানে পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করতে সুবিধা হবে।
সেই বিবেচনায় আমি কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করছি।
আমার প্রথম প্রস্তাব – বাংলাদেশ এক জাতির দেশ নয়, বহুজাতির দেশ। বাঙালি, সান্তাল, গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, উর্দুভাষী। সব জাতির মানুষকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
আমার দ্বিতীয় প্রস্তাব – বাংলাদেশ এক ধর্মের দেশ নয়, বহুধর্মের দেশ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে নিয়েই বাংলাদেশ। সব ধর্মের মানুষকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
আমার তৃতীয় প্রস্তাব – বাংলাদেশের সব মানুষের নাগরিক পরিচয় হবে বাংলাদেশি। এদেশের সব ধর্ম আর জাতির মানুষকেই নিয়েই গড়ে তোলা হবে একটি বাংলাদেশি পরিচয়। এই নাগরিক পরিচয়কে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশি পরিচয়টিই প্রাধান্য পাবে।
বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোগতভাবে পুরোপুরি উপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান। এর সংবিধানও উপনিবেশের ছায়া থেকে বেরোতে পারেনি। তাই আমাদের একটি নতুন রাষ্ট্র বানাতে হবে। সেই নতুন রাষ্ট্রের জন্য নতুন সংবিধান লাগবে। যার আলোকে তৈরি হবে আমাদের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র। সেই প্রজাতন্ত্রে পরিচয় মানুষকে সীমিত করবে না। উপনিবেশের দীর্ঘ ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে মুক্ত মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার নাগরিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করবে।
ইরফানুর রহমান রাফিন একজন অনুবাদক ও লেখক। এবছর দিব্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে প্রাক-ইতিহাস ও ইতিহাস বিষয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী বই ‘সময়রেখা’। লেখকের সাথে যোগাযোগ: irrafin2020@gmail.com।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।